বাংলা সনে বাঙালির অর্থবছর

গোলাম কিবরিয়া পিনুগোলাম কিবরিয়া পিনু
Published : 15 April 2014, 12:04 PM
Updated : 15 April 2014, 12:04 PM

আমি বেশ আশ্চর্য হই এবং লজ্জা বোধ করি যখন দেখি বাসায় যে গৃহকর্মী গ্রাম থেকে এসে কাজ করে, সে বাংলা তারিখ ও মাসের নির্ভুল উচ্চারণ ও হিসেব বলতে পারছে। দিনপঞ্জি দেখে সে বাংলা তারিখ ও মাসের হিসেব রাখে না, সে এটা মনে রাখে আন্তরিক ও নির্ভুলভাবে। কারণ বাংলা সন তার হৃদয়জাত সংস্কৃতিরই অংশ।

কিন্তু আমরা অনেকে যারা নিজেদের বাঙালি বলে ভাবি, বাঙালি সংস্কৃতির ধারক-বাহক-উত্তরাধিকারী হিসেবে গর্ববোধ করি– তারা কি বাংলা সন ও তারিখকে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে রাখি? রাখি না।

দেশের বেশিরভাগ মানুষ গ্রামে বসবাস করেন। তাঁদের নিত্যদিনের জীবনপ্রবাহের সঙ্গে বাংলা সন ও তারিখ জীবন্ত। বিশেষত কৃষিজীবীরা বাংলা সন ও তারিখ নিজেদের ভেবে সারাবছর ব্যবহার করে থাকেন।

অন্যদিকে, সরকার, রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিক সংগঠন, গণমাধ্যম, কবি-লেখক-শিল্পী, সাংস্কৃতিক কর্মীদের কাছে বাংলা সন ও তারিখ অনেকাংশে মৃত এবং বছরের অন্যান্য সময় বিচ্ছিন্ন ও অবহেলিত। অথচ বাংলা সন ও তারিখ থেকে উৎসারিত বলেই বাংলা নববর্ষকে আমরা গ্রহণ করেছি আনন্দ ও উৎসবের আমেজে– ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক পরিসরে।

দিন দিন বাংলা নববর্ষ আয়োজনের বিস্তৃতি ঘটছে। বাঙালির আপন উৎসব হিসেবে এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। এই উৎসব এখন বাঙালির সর্বজনীন উৎসবের গৌরব নিয়ে দেদীপ্যমান। এর সাংস্কৃতিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য গণমানুষের সমর্থনে আগের চেয়ে বেড়েছে।

এখন নগরে-শহরে-বন্দরে-পাড়ায়-মহল্লায় বিভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে বাংলা নববর্ষ বাঙালির প্রাণের উৎসব হিসেবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যদিও উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিতজনের মতো, গরীব কৃষক, মজুর ও অন্যান্য শ্রেণির অনেকে বাংলা নববর্ষ উৎসবের আমেজে বরণ করতে পারেন না।

সরকারের নির্দেশ আছে– সরকারি পর্যায়ে বাংলা সন ও তারিখ ব্যবহার করতে হবে। সত্যের খাতিরে বলতে হয়, স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের আমলে বাংলা ভাষা ব্যবহার বিষয়ে একটি আইন জোরালো ভূমিকা পালন করেছিল, যার ফলে সরকারি পর্যায়ে বাংলা ভাষা ব্যবহার অনেকটা গতিশীল হয়েছিল, সেই সঙ্গে বাংলা সন-তারিখও। আর এখন বাংলা সংস্কৃতির ধারক-বাহক বলে কথিত সরকারের আমলে বাংলা ভাষা ব্যবহার অনেক ক্ষেত্রে অবহেলিত হচ্ছে, অবহেলিত হচ্ছে বাংলা সন-তারিখও।

আগে সরকার-নিয়ন্ত্রিত বিটিভিতে বিভিন্ন ঘোষণায় বাংলা সন ও তারিখ উচ্চারিত হত; এখন তা হয় না। বিটিভির অনুষ্ঠানের প্রান্তিক শুরু হত বাংলা মাস ও তারিখ অনুযায়ী; সেটাও এখন বাতিল। নতুন কুঁড়িসহ বিভিন্ন প্রতিযেগিতার ঘোষণা দেওয়া হত বাংলা মাস-তারিখ অনুযায়ী। সরকারের গণমাধ্যম থেকে আস্তে আস্তে বাংলা সন ও তারিখ সবার অলক্ষ্যে অবহেলিত ও বিতাড়িত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি চ্যানেলগুলোর অবস্থা আরও করুণ।

সরকারি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল কি বাংলা সন-তারিখ ব্যবহার করে? করে না। বিচ্ছিন্নভাবে রাজনৈতিক দলগুলো কখনও কখনও ব্যবহার করে বটে, তবে তা চোখে পড়ার মতো নয়। সরকারি পর্যায়ে কিছু অনুষ্ঠানের ব্যানারে বাংলা সন ও তারিখ অল্পবিস্তর ব্যবহার করতে দেখা যায়।

কেবল ভিত্তিপ্রস্তরে বাংলা সন ও তারিখ ব্যবহার হতে বেশি দেখা যায়। রাজনৈতিক দলগুলো যদি তাদের পোস্টার, লিফলেট ও সভায় বাংলা সন ও তারিখ নিয়মিত ব্যবহার করত, তাহলে এর প্রচলন আরও চোখে পড়ত।

যে সব সাংস্কৃতিক সংগঠন পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ পালন করে থাকে, তারাও এমনকি তাদের নিয়মিত কর্মকাণ্ডে বাংলা সন ও তারিখ ব্যবহার করে না। এ ক্ষেত্রে 'ছায়ানট' একবারে ব্যতিক্রম। তাদের সকল কর্মকাণ্ডে বাংলা সন ও তারিখের ব্যবহার লক্ষ্য ব্যবহার করা যায়। বিভিন্ন ধর্মীয় সভা, ওরশ, সার্কাস, যাত্রা ইত্যাদির পোস্টারে বাংলা সন ও তারিখ গুরুত্বসহকারে ব্যবহার করা হয়ে থাকে– সেটা অবশ্যই সাধারণ মানুষের কথা মনে করে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সন ও তারিখকে অন্তরে ও কর্মকাণ্ডে গুরুত্ব দিতেন বলেই তাঁর জন্মদিন পালিত হয় পঁচিশে বৈশাখে আর মৃত্যুদিন বাইশে শ্রাবণে। অন্যদিকে, আমাদের স্বাধীনতা দিবস হয় ছাব্বিশে মার্চ, বিজয় দিবস ষোলই ডিসেম্বর, এমনকি বাংলা ভাষা আন্দোলনের শহীদ দিবস হয় একুশে ফেব্রুয়ারি! আমাদের অচেতন ও মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মানুষের ভূমিকার কারণে দিবসগুলোকে আমরা খ্রিস্টীয় তারিখে চিহিৃত করে ফেলেছি।

বাংলা নববর্ষে আমরা খুব কমই বর্ষপঞ্জি ও ডায়েরি বের করি। সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো খ্রিস্টীয় সন ও তারিখে গুরুত্ব দেয় বলে, তাদের বর্ষপঞ্জি ও ডায়েরি বাংলা নববর্ষে বের হয় না।

বাংলা সন ও তারিখ যুগ যুগ ধরে এদেশের বেশিরভাগ মানুষের জীবনপ্রবাহের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে আছে। সেই সন ও তারিখকে বাঙালির জীবনের অনেক ক্ষেত্রে গৌরবের সঙ্গে যুক্ত করতে পারিনি আমরা, যদিও বাঙালি হিসেবে আমরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছি– তারও বিয়াল্লিশ বছর পার হতে চলল।

রাষ্ট্রব্যবস্থায় স্বাধীনভাবে নিজেদের জীবনের বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্য সংহত করার সুযোগ পাওয়ার পরও, আমরা অনেক ক্ষেত্রে সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারিনি। সে কারণে বেশিরভাগ বাঙালির কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে থাকার কথা থাকলেও, বাংলা সন ও তারিখ আজও সরকারি উদ্যোগে রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত নয়। বাংলা সন-তারিখ অনুযায়ী বাংলাদেশে এখনও বাজেট প্রণয়ন, অর্থবছর, শিক্ষাবর্ষ, অনুষ্ঠান-সভা-দিবস ইত্যাদি নির্ধারিত হয় না।

বাংলা সন ও তারিখ যদি উল্লিখিত পর্যায়ে আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে পারি তাহলে বাংলা নববর্ষ উদযাপন আরও কাছের মনে হবে, বাঙালির ভিত্তিমূল আরও শক্তিশালী হবে, বাঙালির সংস্কৃতি আরও সম্মুখবর্তী হবে। সেই বিবেচনাবোধ থেকে আমাদের প্রচলিত অর্থবছর পরিবর্তন করে পহেলা বৈশাখ থেকে ৩০ চৈত্র (১৫ এপ্রিল থেকে ১৪ এপ্রিল) পর্যন্ত নির্ধারণ করলে ভালো হত।

এখন রয়েছে পহেলা জুলাই থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত, যা পরিবর্তনযোগ্য। পাকিস্তান ছাড়া আমাদের অতিপরিচিত আর কোনো দেশেই উল্লিখিত সময়ে অর্থবছর হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। যেমন, ভারত ও শ্রীলঙ্কায় অর্থবছর হল পহেলা এপ্রিল থেকে ৩১ মার্চ, মালদ্বীপ ও ভূটানে পহেলা জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর, নেপালে ২১ মার্চ থেকে ২০ মার্চ, যুক্তরাষ্ট্রে পহেলা অক্টোবর থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও জাপানে পহেলা এপ্রিল থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত। আমেরিকা অর্থবছর পরিবর্তন করেছে তাদের প্রাকৃতিক ও অন্যান্য বিষয়ে বিবেচনা করে; অন্যান্য দেশেও তাই।

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী দ্বারা নির্ধারিত অর্থবছরের সময়সীমা আমরা এখনও বহন করে চলেছি। পাকিস্তানের ঋতু ও কালের সঙ্গে তাল রেখে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী এ সময়সীমা নির্ধারণ করেছিল– যা বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র্য ও যুগ যুগ ধরে চলে আসা বাঙালির অর্থনৈতিক জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না।

বাঙালি সংস্কৃতির কোনো উপাদান এ ক্ষেত্রে গুরুত্ব পায়নি। বাংলাদেশের ঋতু, আবহাওয়া, কৃষিব্যবস্থা, ফসল তোলার সময়, দীর্ঘকালের গ্রামীণ অর্থব্যবস্থার হিসাবনিকাশ, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মুখ্য ভূূমিকা পালনকারী কৃষকের নিজস্ব বাংলা সন-তারিখ, সর্বোপরি বাংলা নববর্ষে বাঙালির জেগে ওঠার যে আত্মশক্তির উদ্বোধন হচ্ছে, সেসব বিবেচনায় আনা হয়নি কখনও।

বর্তমানে ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার– যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ও বাঙালি সংস্কৃতির ধারক-বাহক বলে অহংকারবোধ করেন– তারা এ বিষয়ে অনায়াসে ভূমিকা রাখতে পারে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন জাতিসংঘে গিয়ে বাংলায় ভাষণ দেন, বাংলাকে জাতিসংঘের অন্যতম ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে বিশেষভাবে ভূমিকা রাখছেন, তখন আমরা উৎসাহিত হই। এই সূত্র ধরেই তাঁর কাছে আমাদের দাবি– প্রচলিত অর্থবছর পরিবর্তন করা বা অর্থবছরের সময়কাল পরিবর্তন নিয়ে তাঁকে ভাবতে হবে।

এ জন্য তাঁকে কারও কাছে ধর্না দিতে বা দাবি তুলতে হবে না। এ জন্য দরকার বাঙালি হিসেবে তাঁর মননধর্মী ও শিকড়স্পর্শী ইচ্ছেশক্তি আর কিছু প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। প্রধানমন্ত্রী যদি তাঁর বর্তমান শাসনামলে অর্থবছরের সময় পরিবর্তন করেন, তাহলে তা হবে বাঙালির সংস্কৃতি বিকাশে একটি বড় ধরনের মৌলিক পরিবর্তন– যার দ্যোতনা ও প্রেষণা বাঙালির আপন পথচলাকে করবে আরও দৃঢ় ও লক্ষ্যমুখী।