মঞ্চ: সদা দীপ্ত রহে অক্ষয় জ্যোতি

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 7 April 2014, 07:08 AM
Updated : 7 April 2014, 07:08 AM

আমাদের ইতিহাসে গণজাগরণ মঞ্চ এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ভঙ্গুর চেতনা আর নিজেদের কলহে দীর্ণ জাতির জীবনে নবপ্রেরণার শাহবাগ আমরা কোনোদিন ভুলব না। সে আমাদের কী দিয়েছে? কী পেয়েছি আমরা তার কাছ থেকে?

বায়ান্নকে যেমন আমরা ভাষার সংগ্রামে উজ্জ্বল দেখি, ভাষা ফিরে পাবার জন্য সম্মান করি, অতটা না হলেও শাহবাগ আমাদের মুখে আবারও বাঙালির বিজয়মন্ত্র ফিরিয়ে দেওয়ার কাজ করেছে। যে ধ্বনি উচ্চারিত না হলে আমরা স্বাধীন হতাম না, যে ধ্বনি আমাদের ঐক্য ও প্রগতির প্রতীক, তাকে প্রায় কোণঠাসা করে ফেলেছিল শত্রুরা। 'জয় বাংলা'কে ধর্মীয় আবরণ আর সাম্প্রদায়িকতার দোসর বানিয়ে নির্বাসনে পাঠানোর মানেই হচ্ছে বাঙালিত্বকে অপমান করা, তার সবচেয়ে বড় একটি অস্ত্র কেড়ে নেওয়া।

তাই যদি না হবে, জিয়ার আমল থেকে শুরু করে এরশাদের আমল পর্যন্ত 'জয় বাংলা'র ওপর এত আক্রোশ থাকবে কেন? মুক্তিযোদ্ধা জিয়ার 'জয় বাংলা' ছেড়ে 'জিন্দাবাদ' বেছে নেবার কারণ বুঝতে খুব বেশি মেধার দরকার পড়ে না।

'জয় বাংলা' বাঙালির আর 'জিন্দাবাদ' বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ নামে উদ্ভাবিত নব্য-পাকিস্তানিদের অস্ত্র– যে কারণে তার গায়ে আওয়ামী জোব্বা চাপিয়ে মিডিয়ায় নিষিদ্ধ করেছিল তারা। সে মূলমন্ত্র আমাদের ফিরিয়ে দিয়েছে শাহবাগ। শুধু ফিরিয়ে দেয়নি, স্মৃতিভ্রষ্ট প্রবীণ ও দিশেহারা ইতিহাস-বিভ্রান্ত তারুণ্যের মনে আবার তার সঞ্জীবনী সুধা এনে দিয়ে শাহবাগ জানিয়েছে– 'জয় বাংলা' মরে না, তার অমিত শক্তিও অবিনশ্বর। বাঘকে বেড়াল বানিয়ে রাখা ভুল আয়না সরিয়ে 'জয় বাংলা'র আয়নায় আবারও ব্যাঘ্র বানিয়েছে শাহবাগ।

সে এক আশ্চর্য সময়, আশ্চর্য ইতিহাস! আমরা এমন প্রাণস্পন্দন, এমন আবেগ আর দেশপ্রেম বহুকাল দেখিনি। সত্যি কথা বলতে কী, শাহবাগ না হলে আজ যে সরকার দেশ চালাচ্ছে তারাও এ অবস্থানে থাকত কিনা তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়। জামায়াত-বিএনপি এদেশের তারুণ্যের সমর্থনপুষ্ট এবং নারী ও তারুণ্য তাদের দিকে– এমন মিথ্যা অপপ্রচারের মুখে চড় কষিয়ে জেগে উঠেছিল নির্ভীক কিছু তরুণ-তরুণী। সেই শুরু।

তারপর বাংলার জনপদে ছড়িয়ে পড়া আন্দোলন আর সমবেত মুক্তিযুদ্ধের শক্তি এদেশে রাজাকারের ফাঁসি দিয়ে ইতিহাসকে করে তুলল নির্মল ও পরিশুদ্ধ। তারপরও আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারলাম না। তুচ্ছ কারণে মতবিরোধিতা আর শত্রুদলের অপকৌশলে আজ এই অর্জনকেও ফেলতে চাইছি কঠিন পরীক্ষায়।

আমাদের বৈরীরা চিরদিনই কৌশলী। তাদের ষড়যন্ত্র করার শক্তি ও সাফল্য প্রমাণিত। এদের পেছনে দেশি-বিদেশি এজেন্ট, টাকা ও লবিং থাকায় এরা সাধারণত ব্যর্থ হয় না। তবে এদের যে কোনো আঘাতই সাময়িক। তারপরও সুযোগ পেলেই এরা আমাদের আহত করে, আমাদের অর্জন কেড়ে নেয়।

এর মূল কারণ আমাদের দ্বিধাবিভক্তি আর কোন্দল। কোনো বিষয়েই না আমরা ঐক্যবদ্ধ, না সংহত। নানা কারণে আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবও ঠিকমতো ধরে রাখতে পারিনি। নির্মম দুঃসময় ও ধারাবাহিক শত্রুতায় অনেক অর্জনই প্রায় ম্লান। কিছু কিছু হয়ে আছে প্রশ্নবিদ্ধ। যে দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে লাখো মানুষ প্রাণ দিয়েছে, সে সংখ্যাটাও আমরা মানতে রাজি নই। সে সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক তোলার মতো মূর্খ জাতি নিজের শহীদ সন্তানের প্রতি অবিচারেও পিছপা নয়।

জামায়াত-বিএনপির গাঁটছাড়া আর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনীতি তারুণ্যকে পথহারা করার পাশাপাশি, আমাদের ইতিহাসেও ছাড় দেয়নি। ঘোষক-তোষক, রাষ্ট্রপতি, পতাকা, সঙ্গীত– সবকিছু নিয়ে মিথ্যার মায়াজালে বন্দি জাতি ভুলতে ভুলতে নিজের চেহারা, পরিচয় এমনকি জেগে ওঠার মন্ত্রও ভুলে গিয়েছিল।

সে জাতি যে শাহবাগকে ঔজ্জ্বল্য দিয়ে মাথার মুকুট বানিয়ে রাখবে এমন ধারণা করিনি। এর সঙ্গে আছে রাজনীতির নষ্ট খেলা। সরকারি দল বা বিরোধী দল, কেউ-ই তাদের দখল বা অভিভাবকত্ব হারাতে চায় না। শাহবাগের গোড়ার দিকে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে থাকা রাজনীতি অকুণ্ঠ সমর্থন দিলেও, একসময় তারা পিছু হটতে থাকে।

এর দুটো কারণ– এক. শাহবাগ তাদের নেতৃত্বে তৈরি হয়নি; দুই, তাদের পোষ্য নয়, সবসময় তাদের হয়ে কথাও বলেনি। এই স্বাধীনচেতা মনোভাব মানুষের পছন্দ হলেও ছাত্রলীগের হয়নি। গোড়ার দিকে তারা 'বঙ্গবন্ধু নেই বা বঙ্গবন্ধুর নাম নেই' বলে হৈ চৈ শুরু করলেও আসলে তাদের চাওয়া ছিল নেতৃত্ব আর নিজেদের কর্তৃত্ব। একদিকে জামায়াত-শিবির ছদ্মবেশি প্রতিক্রিয়াশীল সুশীল নামের সমাজ, অন্যদিকে ছাত্রলীগ– এই দ্বিমুখী আক্রমণের পরও শাহবাগ তার চেতনা হারায়নি। কারণ তার উত্থান হয়েছিল তারুণ্যের ভেতর থেকে।

কী দেখিনি আমরা? দেশের সর্বাধিক বিক্রিত কাগজে শ্লোগানকন্যা খ্যাত লাকিকে নিয়ে কেচ্ছা ছাপানো হল। শফিক রেহমানরা ব্যঙ্গ করে বললেন, 'শাহবাগের মূলমন্ত্র নাকি জয় লম্বা বাংলা'। অর্থাৎ 'জয় বাংলা' শ্লোগানটিকে যে টেনে বলা হয় তার গুষ্টি উদ্ধার! চ্যানেলে চ্যানেলে শুরু হয়ে গেল বাকযুদ্ধ। 'এতদিন কোথায় ছিলেন' গোছের বাক্যবাগীশরা নানা তত্ত্ব আর মনগড়া বক্তব্যে ঝাল মেটাতে শুরু করলেন।

সাম-আপ বা উপসংহার করলে যার মানে একটাই– ''কেন বাপু আবার মুক্তিযুদ্ধ? কেন এই আন্দোলন? আস, সবাই ভাগ-বাটোয়ারা করে খাই। তোমাদের কেন এত সাহস? ইসলামী ব্যাংক বা ধর্মীয় চেতনার নামে গজিয়ে ওঠা মিডিয়ার নামে কথা বল? কোন সাহসে তোমরা পাকিস্তানি পণ্য বর্জনের ডাক দাও?''

আজ যখন এ লেখা লিখছি, তখন এক মধ্যপন্হী কথাসাহিত্যিককে দেখলাম ছদ্মবেশ খুলে বেরিয়ে আসছেন– 'মঞ্চ' নাকি আমরা, মানে জনগণ বা সচেতনরা বানায় না, 'মঞ্চ' বানিয়ে অন্যের কথা বলাতেই যত বিপত্তি! শুনে মনে হবে নির্দোষ মন্তব্য। এ জাতীয় মন্তব্য তলে তলে রাজাকারির উৎকৃষ্ট নমুনা। কারণ এরা 'শাপলা' নিয়ে একটা কথাও বলে না। আর যদি বলেও, দেখবেন তার ভেতর প্রচ্ছন্ন সমর্থন লুকিয়ে। ইনিয়ে বিনিয়ে বলবে, আহা বেচারারা! ওরা তো সৎ নিরীহ, কিছু ধর্মান্ধ মাদ্রাসার মানুষজন ধরে না আনলে ওরা আসত না! ছেলেমানুষী কথাবার্তা!

এত সব বিরোধিতা আর হিপোক্রেসির মুখে ছাই দিয়েও টিকে ছিল, টিকে আছে গণজাগরণ মঞ্চ। কিন্তু এর ওপর শেষ আঘাতটি হানল এদেশের নিরাপত্তা বাহিনী। যে সরকার এদের সমর্থন করার কারণে নাস্তিকতার সার্টিফিকেট পেয়ে যাচ্ছিল এবং সে সার্টিফিকেট খারিজের জন্য তারুণ্যকে জেলে পুরে শাস্তি দেওয়া থেকে একসময় গণজাগরণকেও গুটিয়ে দেওয়া হল, তারাও আজ না-সমর্থন না-বৈরিতার মাঝামাঝি এক অবস্থানে।

ছাত্রলীগ সরকারের অঙ্গসংগঠন বটে, কিন্তু কী কাজে লাগে তারা? এই যে দেশব্যাপী নৈরাজ্য আর সন্ত্রাস, জামায়াত-শিবির ও বিএনপির নাশকতা– এর একটিও কি তারা মোকাবেলা করেছিল? মরেছেন আমাদের পুলিশ ভাইয়েরা। আক্রান্ত হয়েছিল নির্মূল কমিটির আয়োজন আর গণজাগরণ মঞ্চ। কতবার যে তারা ধেয়ে আসতে চেয়েছিল আর কতবার যে তরুণপ্রাণ ভয় ভুলে রুখে দাঁড়িয়েছিল, সে কথা আমরা কেউই ভুলে যাইনি।

তাই আজ ছাত্রলীগের হাতে নির্যাতিত গণজাগরণ মঞ্চকে দেখে আমি ব্যথিত হই। সব আন্দোলন বা সংগ্রামেরই একটা রেখা থাকে। যখন তা তুঙ্গ স্পর্শ করে ফেলে তখন তার কিছুটা নিম্নগামী হবার বিকল্প থাকে না। কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। সাহস ও সংগ্রামের মূলমন্ত্র 'জয় বাংলা' ও বঙ্গবন্ধু যেমন দুঃসময়ে ফিরে ফিরে আসে, শক্তি যোগায়– শাহবাগও একদিন আবার শক্তির উৎস হতে বাধ্য।

এমন জায়গাটি কে বা কারা নষ্ট করতে চাইছে? ছাত্রলীগ না অন্য কোনো অপশক্তি? সরকারে ও প্রগতিশীল রাজনীতিতে আমাদের দুশমনরা ঢুকে আছে। খবর পাই, খুনিদের ছানাপোনারাও নাকি আজকাল প্রগতির জোব্বা পরে চলে। জামায়াত-শিবির ও প্রতিক্রিয়ার রাজনীতি চতুর। তাদের মুরুব্বির অভাব নেই, ছলেরও অভাব নেই। আমি নিশ্চিত, এরাও এর পেছনে সক্রিয়।

পাশাপাশি, এটাও মানি, জাতীয় জীবনের সব বিষয়ের মতো শাহবাগ আন্দোলনেও সবাই সমান উত্তীর্ণ বা সৎ নয়। তাছাড়া এটা কোনো একক নেতৃত্বের হাতে ছেড়ে দেওয়ার বিষয় বা জিনিসও নয়। ফলে একক কোনো ব্যক্তি বা গুটিকয় মুখচেনা তারুণ্যের পরিবর্তে এর নেতৃত্ব ছড়িয়ে পড়ুক সবার ভেতর, সেভাবে তার বিন্যাস হোক, শুরু হোক নতুন পথচলা। যে সব অনভিপ্রেত ঘটনা এই আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে তার উত্তর দেওয়া হোক। যে মুরুব্বিরা এর শুরুতে মঞ্চে উঠে মুখ দেখিয়েছিলেন, তারাই-বা কোথায়? কোথায় দেশের আপামর সংস্কৃতিসেবী ও বুদ্ধিজীবী?

গণজাগরণ মঞ্চের অপমান বা নির্যাতনে ব্যক্তি-আনন্দ ব্যতীত আর কোনো লাভালাভ নেই। বহুকাল পর জ্বলে ওঠা আশার সলতে মুক্তিযুদ্ধ ও 'জয় বাংলা'র এই প্রদীপটি যেন নিভে না যায়। তার প্রয়োজন ফুরোয়নি। বরং যতদিন এদেশে রাজাকার ও দালালদের আস্ফালন থাকবে, যতদিন ষড়যন্ত্র আর ছদ্মবেশি রাজাকারদের 'বাংলাস্থান' বানানোর চক্রান্ত চালাবে– ততদিন শাহবাগেরও প্রয়োজন থাকবে।

তাই আমরা দেশে-বিদেশে আশা-ভরসা উসকে দেওয়া এই মঞ্চের বিরুদ্ধে যে কোনো আক্রমণ ও ষড়যন্ত্রের অবসান চাই। ঐক্য ও সমঝোতায় মতবিরোধ নিরসন করে তাকে বাঁচিয়ে রাখার কাজটি চালু রাখাই হবে কাজের কাজ। এমন আলোকিত আন্দোলন আমরা আগে দেখিনি। দেখিনি এমন স্বতঃর্স্ফূততাও।

'জয় বাংলা'র জয় হোক। তবে আবার তার ঔজ্জ্বল্য ফিরে আসুক সবার অংশগ্রহণে।

সিডনি

৬ এপ্রিল, ২০১৪