মিডিয়ায় বেআব্রু ‘নারী’: রাষ্ট্র ও অন্যান্য নিপীড়কবৃন্দ

রিফাত হাসান
Published : 19 Nov 2010, 11:39 AM
Updated : 19 Nov 2010, 11:39 AM

ভারতীয় উপমহাদেশে একটা 'দেশ'-এর ধারণা আছে, যার ভাবচরিত্র হলো নারী, মা। এই 'দেশ' রাষ্ট্র নয়– যে রাষ্ট্র নাগরিক চুক্তি ও সম্মতির ভাব ধরে মূলত নিপীড়ণের মূলনীতির উপর গড়ে ওঠে। নিপীড়ণ এবং বলপ্রয়োগ। নারী-পুরুষ-নাগরিক নির্বিশেষে সবার উপর প্রতাপি পুরুষ যে। মূলত এই 'দেশ' হল মা। সেই নারী, যে তার বুকের ফসল দিয়ে সন্তানদের তিল তিল করে তৈরি করে, বাঁচায়। প্রতিপালন করে। রক্ষা করে। আশ্রয় দেয়। আলো দেয়। ব্রিটিশ শাসনের শেষদিকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের শ্লোগান ছিল 'বন্দে মাতরম'। মানে, মা-এর বন্দেগী করি। মা-এর জয়গান গাই, এসো। এমন কি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গৃহীত জাতীয় সংগীতের শেষ দিকে যে মায়ের কথা উচ্চারণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ, তাও এই 'দেশ', রাষ্ট্র নয়–'মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়নজলে ভাসি।'

উর্ধ্বকমাভূক্ত এই দুটি লাইনেরই যদিও ভিন্ন রাজনৈতিক তাৎপর্য ও আলোচনা বিদ্যমান। তবুও এই আলোচনার জন্য দেশরূপ নারীর ধারণা অবদমিত হয় না। বরং দেশ ও নারীর শত্রুমিত্র ভেদ-জ্ঞান, রাষ্ট্র ও দেশ-এর অভেদমুহূর্ত, তার ভাষা ও বিভঙ্গসমূহ বোঝার জরুরত অনুভূত হয়।

তাহলে রাষ্ট্র এসে যখন দাঁড়ালো 'দেশ'-এর সামনে, নারীর ভূখণ্ড বা শরীরের উপর, সে ও তার সন্তানদের শাসক হয়ে, তখন এই রাষ্ট্র ও নারী মুখোমুখি দাঁড়াবে, এই স্বাভাবিক। কারণ রাষ্ট্র নিপীড়ক, আর নিপীড়ণের বিরুদ্ধে নিপীড়িত মুখ তুলে দাঁড়াবে, সাহস ঘোষণা করবে। এখানে দেশ, নারী, সন্তান সমার্থক। বিপরীতে রাষ্ট্র নিপীড়ণের নানা উপায়ের উদ্ভাবক; ইভটিজার, ধর্ষক, খুনি হিসেবে এগিয়ে আসে। রাষ্ট্র দেশরূপ নারী ও তার সন্তানদের উপর নিয়ত নিয়ন্ত্রণ, নিপীড়ণ ও ফেমিসাইড ঘটায়। তাই রাষ্ট্র, তার সহযোগী ও স্বীকৃত সব প্রতিষ্ঠান, যেমন সরকার, মিডিয়া, আইএসপিআর, পুলিশ এইসব প্রপঞ্চ বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রে নারীর প্রতি নিপীড়ণের জায়গা থেকে আমাদের পাঠ্য হতে পারে।

২.

এই পর্যায়ে আমরা আমাদের এই পাঠকে ১৪ নভেম্বর পড়ন্ত বিকালে সেনানিবাসে একজন নারী খালেদা জিয়ার বাসভবনের ঘটনাপঞ্জির সামনে দাঁড় করাতে চাই। খালেদা জিয়ার বাসভবনে এই সময়ে ঘটে যাওয়া নারীর প্রতি মিডিয়া, আইএসপিআর ও সরকারের অভূতপূর্ব ভূমিকার সামনে। তাঁর বাড়ি নিয়ে আইনি, দলীয় ও পাতি-রাজনৈতিক যেসব আলোচনা সম্ভব সেইসবের বাইরে থেকেই এই পাঠের চেষ্টা। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে একজন বিরোধী দলীয় নেত্রী নন খালেদা, রাষ্ট্রের তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নন, বাংলাদেশের অসম্ভব জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন নন, এমন কি মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্ত্রীও নন। তিনি খালেদা জিয়া, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একজন সামান্য নাগরিক, এবং নারী। যিনি সেইদিন উপরের ওইসব পরিচয়ের একটিরও কোন সুবিধা পান নাই রাষ্ট্রের কাছ থেকে, বরং স্রেফ একজন সাধারণ নাগরিক, বৃদ্ধ, অসহায়, নিঃসঙ্গ এক নারী হিসেবেই নির্যাতিত হয়েছিলেন, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের সহযোগী মিডিয়া, আইএসপিআর, পুলিশ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে।

এই পাঠের গুরুত্বপূর্ণ প্রপঞ্চ ও সাক্ষ্য হিসেবে সেদিন ও তার পরবর্তী দিনগুলোর কিছু ঘটনাপঞ্জিকে হাজির করা যেতে পারে। যেমন আইএসপিআর ও শাসক রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়ার সৌন্দর্যচর্চা নিয়ে কটাক্ষ (দীর্ঘক্ষণ ধরে রূপচর্চা ও প্রসাধনরত ছিলেন ইত্যাদি: আইএসপিআর-এর পরিচালক ও আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক সম্পাদকের সংবাদ সম্মেলন দ্রষ্টব্য), যা যে কোন নারীর প্রাত্যাহিক যাপন ও কাজকর্ম শুরুর প্রস্তুতির অংশ। তারপর মিডিয়া কর্মীদের নিয়ে গিয়ে খালেদা জিয়ার বেডরুম, সূচিতার ঘর ও অন্যান্য গোপনীয়তার স্থান ও সামগ্রীর বেআব্রু প্রদর্শন, ভিডিও এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচারের ব্যবস্থা। যেমন, একটি জনপ্রিয় চ্যানেলে রিপোর্টের উপসংহার টানা হয়েছে খালেদা জিয়ার বেডরুমের অভ্যন্তরের দৃশ্যকে নেপথ্যে রেখে। লক্ষণীয়, খালেদা জিয়ার বাসা খালি করা বা ছেড়ে দিতে বলা আইনী প্রক্রিয়ার অংশ বা আইনের ভায়োলেশন হতে পারে, কিন্তু এটি করতে গিয়ে তার বাসার বেডরুম ভিডিও করে দেখানো–এটি স্রেফ আইনের ভায়োলেশনের প্রশ্নে বিচার্য নয়, বরং এই পাঠে বাংলাদেশে নারীর সামাজিক অবস্থান, সংস্কৃতি, আবেগ, অনুভূতি, গোপনীয়তা, আব্রুতা এইসবের লঙ্ঘন হিসেবেই প্রশ্ন তোলা জরুরী।

ব্যক্তিগত ও গোপনীয় নোটপত্র ও ডকুমেন্টস সাংবাদিকদের কাছে হস্তান্তরের ঘটনাও ঘটেছে। যেমন, খালেদা জিয়ার কাছে লেখা শফিক রেহমানের গোপনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ নোট, একটি অনলাইন নিউজ এজেন্সিতে যার স্কেন-কপি প্রকাশিত। সর্বশেষ খালেদা জিয়ার বেডরুমের ড্রয়ার থেকে নতুন ঝকঝকে কয়েকটি আপত্তিকর ছবিসমৃদ্ধ ম্যাগাজিনের উদয় এবং তার ছবিসমেত প্রচারের ঘটনাটি নারীকে বেআব্রু শুধু নয়, পৌরাণিক কাহিনীর নারীদের 'কলঙ্কিনী' ও 'চরিত্রহীন' করার চেষ্টার মত বিশুদ্ধ পুরুষালী ও নিপীড়ক প্রয়াস হিসেবে বিচার্য। বাংলাদেশে নারীর উপরে নিপীড়ণের বেশির ভাগ ঘটনায় দেখা যায়–কিছু লোক, যারা নারীর নিপীড়ণে আগ্রাসী, তারাই অপরাধ করে নারীর উপর তার জন্য শাস্তিও চাপিয়ে দেয়। নারীকে কলঙ্কিনী উপাধি দিয়ে এই অপরাধে তাকে সমাজচ্যুত ও বাস্তুছাড়া করে। মনে রাখা দরকার, খালেদা জিয়ার ঘটনায় মূলত কোন সাবোটাজ হয়েছে কিনা–এই সত্য-মিথ্যা বিতর্কের আলোচনা এখানে নয়। বরং এই পাঠের অভিমুখ হলো ঘটনার ইনটেনশন ও নারীর প্রতি মনোগত নিপীড়ক অবস্থানকে নির্দেশ করা।

তবে, মনে রাখা দরকার, খালেদা জিয়া নিজেই এই নিপীড়ক রাষ্ট্রব্যবস্থার শাসকশ্রেণীর মানুষ। তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী, তখন, এবং যখন বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে তৎপর হন, তখনও। এই বাস্তব অবস্থা মাথায় রেখেই এই আলোচনার সূত্রপাত করলাম, কারণ, শুধুমাত্র এই কারণেই নারী হিসেবে খালেদা জিয়ার উপর এই নির্যাতন উপেক্ষা করা যায় না। সাথে এই সম্ভাবনাও জারি আছে, খালেদা জিয়া নিজেই একদিন শাসনক্ষমতায় আসবেন এবং হয়তোবা এইভাবে বা ভিন্ন উপায়ে নারী, নাগরিক, দেশ এবং জন-ইচ্ছার উপর নিয়ন্ত্রক ও নিপীড়ক ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন। এখানে দুইটি চমকপ্রদ বিষয় হাজির আছে, তা হল এই নিপীড়ক রাষ্ট্রের বর্তমান প্রধান নির্বাহীও একজন নারী। আবার যিনি রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্যাতনের শিকার তিনিও নারী। এই কারণে কেউ যদি এটাকে নারীর বিরুদ্ধে নারীর নিপীড়ণ হিসেবে বিচার করতে বসেন, তাহলে ভুল করবেন অথবা ইচ্ছেকৃত ফ্যালাসিতে ভুগবেন। কারণ, যদিও রাষ্ট্রপ্রধান একজন নারী হয়ে থাকুন না কেন, নারীবাদি ইতিহাসপাঠ বলে যে, তিনি এই জায়গায় স্রেফ নিপীড়ক পুরুষের প্রতিনিধিত্ব করেন মাত্র। তাহলে, নারীর বিরুদ্ধে নারী নয়, মূলত নারী, দেশ, মানুষ, নাগরিকতা– এইসবের বিরুদ্ধে নিপীড়ক হিসেবেই রাষ্ট্রের এই ভূমিকাকে বিচার করতে হবে।

২১ নভেম্বর ২০১০, চট্টগ্রাম।


রিফাত হাসান:
আইন, ধর্ম, রাষ্ট্র ইত্যাদি নিয়ে লেখালেখি করেন।