ভাবিতে উচিত ছিল প্রতিজ্ঞা যখন

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 25 March 2014, 10:52 AM
Updated : 25 March 2014, 10:52 AM

সব বিষয়ে আমাদের ভাবাবেগ বড় বেশি। এত আবেগ একসময় নিজেদের জন্যই কাল হয়ে দাঁড়ায়। গণজাগরণ মঞ্চ যখন তুঙ্গে তখন হঠাৎ করেই বিভিন্ন দাবি-দাওয়া মাঠে আসতে শুরু করল। শুরুটা হয়েছিল ভালোই। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপর্বেও ছাড় দিল না রাজনীতি। কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানোর মানুষগুলো মনে করলেন, এই তো সুযোগ! তাদের ঝোলায় যত ধরনের বেড়াল ছিল সবগুলো বের করতে লাগলেন তারা। শুনলে উত্তেজনা হয় বা মানুষ লাফায় এমন ধরনের ইস্যু তৈরিতে পোক্ত নেতারা নিষিদ্ধকরণের চাহিদা নিয়ে দেশ গরম করতে শুরু করলেন।

বাস্তবতা আর স্বপ্ন এক নয়। অতীত আর বর্তমানও নয় এক। এদেশে নানা কারণে বহু কিছু জায়েজ হয়ে গেছে। এটা সময়ের ব্যাপার। এমন জায়েজীকরণও নতুন কিছু নয়। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমাদের চেয়েও ভয়াবহ বাস্তবতা ও সংগ্রামের দেশে সমঝোতাতেই শান্তি নেমেছে। এখন সমঝোতাটা কী বা কতটা, সেটাই হল মূল বিষয়।

এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য যে, কেউ এ বিষয়ে খাঁটি কোনো কথা বলে না। কারও কোনো নির্দিষ্ট এজেন্ডা নেই। সব দলেই জেদ আর পাওয়ার গেইম। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া আর দেশগঠনের নেতৃত্ব দেওয়া ভিন্ন ব্যাপার। অতীতের পাপমোচন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি জরুরি সবাইকে নিয়ে বসবাস।

বলাবাহুল্য, দেশের মৌল কাঠামো, নীতিমালা ও অস্তিত্ব নিয়ে বাড়াবাড়ি করা রাজনীতির ভেতর পড়ে না। তারা অপরাধী– অপরাধী তারা যারা রক্ত-ত্যাগে অর্জিত এই দেশ মানে না– মানলেও আবার পাকিস্তান চায় বা নতুন ফর্মের পাকিকরণে উৎসাহী। এই বিষয়গুলো পরিষ্কার না করেই হঠাৎ কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে একশ আশি ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলের অবস্থান তখনই আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল।

বিশেষ করে যারা এগুলো নিয়ে টকশো মাতানোসহ লেখা বা নানাভাবে মত্ত হয়ে উঠেছিলেন, তাদের অচিরে আত্মসমর্পণ বা সটকে পড়া ছিল সময়ের ব্যাপার। তাই ঘটেছে শেষ পর্যন্ত। এ তালিকায় ইসলামী ব্যাংকের নাম ও তাদের নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটানোর মানুষগুলো এখন কোথায়!

গোড়াতেই বলে নিই, আমার জানামতে, অনেক অমুসলিমও এই ব্যাংকের নিয়মিত গ্রাহক। এদের কেউ কেউ আমার ব্যক্তিপরিচিত। জোশ যখন তুঙ্গে তখন এদের অনেকেই জানতে চেয়েছিলেন, "দাদা, আমাদের টাকা ঠিক থাকবে তো"?

আমি বলেছিলাম "বিলকুল, কেউ কিছু বিগড়াতে পারবে না"।

কারণ আমি জানতাম যত গর্জে তত বর্ষে না। আর হিসেব-নিকেশ বিষয়টা আসলেই জটিল। তাছাড়া ইসলামী ব্যাংক অবৈধ কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। তারা ন্যায্য লাইসেন্স নিয়েই ব্যবসায় নেমেছে। যতদূর জানি, এদের লেনদেন বা হিসাবও চলছে ঠিকভাবে। এখন সুদ না মূলধন, মুলধন না লভ্যাংশ, সে তো অন্য বিষয়।

আরও জটিল বিষয় এদের টাকার উৎস বা কোথায় ব্যয় হয় তা নিয়ে কথা বলা। ইসলামী ব্যাংককে সিঙ্গেল আউট করার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জবাবদিহিতার কথা উঠবে। এতদিন ধরে তাদের সহ্য করা রাজনীতি হঠাৎ করে তাদের বন্ধ করার কোনো কারণ কি আসলেই দেখাতে পেরেছে? না তা সম্ভব?

আমি জানি আমার এই লেখায় অনেকেই নাখোশ হবেন। ধর্মীয় পরিচয়ে হিন্দু হবার পরও আমাকে পাকপন্হী ভেবে আনন্দ পেতে শুরু করবেন। তাতে কিছু যায় আসে না। আমি জানতে চাই, হঠাৎ করে কি এমন কোনো কঠিন সিদ্বান্ত নেওয়া সম্ভব, না দরকারি? যা করা অসম্ভব তা নিয়ে বাড়াবাড়িতে কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কোনো লাভ হল? না আমরাই তাকে ঠেলে দিলাম প্রশ্নের কঠিন ময়দানে?

বেশি দিন কি সবুর করতে হয়েছে? গত দুয়েকদিন ধরে মিডিয়া, বিশেষত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় বইছে– প্রধানমন্ত্রী ইসলামী ব্যাংকের চেক নিয়েছেন। গোড়াতে জানলাম, এই টাকা জাতীয় সঙ্গীত গাইবার কাজে ব্যয় হবে। পরে জানলাম, সে টাকা নাকি টি-টোয়েন্টির কাজে লাগবে। মন্ত্রীরাও ভাগ হয়ে গেলেন। একেকজন বলছেন একেক কথা।

প্রশ্ন হচ্ছে, জাতীয় সঙ্গীত গাইবার জন্য ব্যয় করা নাজায়েজ হলে অন্য কাজে জায়েজ হয় কীভাবে? তার মানে এই যে– সুনির্দিষ্ট কোনো রুপরেখা নেই। তাই যদি না থাকে, চেতনা কি নিজ থেকে মাথা তুলে দাঁড়াবে? না তার শরীরে ময়লা জমবে?

এমনিতেই দেশের জনগণ ত্রিধাবিভক্ত। তাদের একবার স্বপ্ন দেখিয়ে আরেকবার অন্ধকারে ঠেলে দেবার কারণেই দ্রোহ-বিদ্রোহ সব আজ জগাখিচুড়ি। এর মধ্যে আবার এই সংশয় ও বিভাজন কেন?

জাতীয় সঙ্গীত কোনো ব্যাংকের টাকায় গাইবারই দরকার ছিল না। জনগণ নিজেই তা করতে পারে। জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে বিশ্ব রেকর্ড করার আগে ঘরের আগাছা সাফ করা প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ যে কত বিপদে আছেন সেটা বুঝিয়ে বলারও দরকার দেখি না। কয়েক মাস আগে শাপলা ও শাহবাগভিত্তিক যে বৈরীতা, সে তো রাষ্ট্রকাঠামোকেই চ্যালেঞ্জ জানিয়ে গেছে। তাকে মোকবেলা করার জন্য মাদ্রাসা বা ধর্মভিত্তিক লেখাপড়াকে জাতীয় স্রোতে না এনে, শুধু সঙ্গীতে আদৌ কি কোনো লাভ হবে?

ওই যে আবেগ। সে আবেগ এখানেও একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন রেখে গেল।

আসলে রাজনীতি নিজেই নিজের শত্রু। যে দেশে ধর্ম-অধর্ম, সাম্প্রদায়িকতাই এখনও ফ্যাক্টর, সেখানে কোন ব্যাংক বাদ আর কোন ব্যাংক থাকবে, সেটা আসলেই হাস্যকর। মুক্তিযুদ্ধের দেশে খেলার মাঠে চরম দুশমন দেশের পতাকা মুখে এঁকে খেলা দেখতে যাই আমরা। আমাদের চরিত্রে এখনও পাকি গন্ধ লেগে আছে। সব ব্যাংক সব প্রতিষ্ঠান সব জায়গায় দেশবিরোধী আর দেশপ্রেমীদের লড়াই বিরাজমান। সেখানে ইসলামী ব্যাংকের টাকা নিলে কী আর না নিলেই-বা কী?

তাছাড়া আরও কয়েকটা জরুরি বিষয় মাথায় রাখা প্রয়োজন। সমঝোতার জায়গাটা নড়বড়ে থাকায় আমাদের প্রগতি হাঁটুভাঙ্গা, কে কাকে সামাল দেবে? একদা মুক্তিযোদ্ধারা ভোল পাল্টে রাজাকার। একদা বঙ্গবীর প্রমাণ করেছেন, যোদ্ধাও পথ হারাতে পারে। বলাবাহুল্য সবকিছুর পেছনে আছে স্পর্শকাতর ধর্মের বিষয়টি।

ইসলামী ব্যাংক তার নামের জন্যও এক ধরনের সহানুভূতি আর সমর্থন পেয়ে থাকে। দরিদ্র ধর্মপ্রাণ মানুষের মনের এই জায়গাটিতে যে অন্ধকার তা দূর করতে হলে নিরন্তর উদারতা আর অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা করতে হবে, সে কাজ কি হচ্ছে?

সে কাজ না করে, পাঠক্রম থেকে জীবনের সব পর্যায়ে অন্ধত্ব বজায় রেখে একদিকে আলো জ্বালালে কোনো কিছুই আলোকিত হবে না। বরং দূর থেকে সেটিকে আলেয়া মনে হওয়াই স্বাভাবিক। আলো ও আলেয়ার এই দ্বন্দ্বই মন্ত্রীদের দিয়ে দ্বিবিধ কথা বলাচ্ছে।

আমরা আছি ফাঁপড়ে। বুঝতে পারছি না ইসলামী ব্যাংকের টাকা নেওয়াটাই অন্যায়, না জাতীয় সঙ্গীতের জন্য নেওয়াটা অবৈধ? টি-টোয়েন্টির জন্য টাকা নিতে পারলে জাতীয় সঙ্গীতের বেলায় সে উৎস নাজায়েজ হবে কেন? তার মানে কি এই যে, এই ব্যাংকটির বেলায় আপত্তি নেই, আপত্তি আসলে কোন কাজে লাগছে তা নিয়ে?

তাছাড়া যে ব্যাংক বন্ধ করে দেওয়ার জন্য এত আহাজারি, হৈ চৈ, তার ব্যাপারে এমন দোটানা বা দ্বিমাত্রিক অবস্থান কেন? এর ফলে জনমনে আরও সংশয় আর সন্দেহ তৈরি হবে এটাই তো স্বাভাবিক। অন্যদিকে ইসলামী গ্রুপ ভাববে– দেখলে তো, একেই বলে চেতনা!

আগেই বলেছি, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখা কম্বোডিয়া, ভিয়েতনামসহ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর সমঝোতা প্রক্রিয়া বলছে, এভাবে হয় না, কঠিন হবার সময় গেলে কৌশলের বিকল্প নেই। আর যে কোনো বিষয়ে অতি-আবেগ সবসময় বিপজ্জনক।

এখনও সময় আছে, আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন বাংলাদেশ ও তার তারুণ্যকে একাত্তরের আবেগ বিষয়ে দোদুল্যমানতায় রাখা অনুচিত। অযথা ভয় বা ঘৃণারও দরকার নেই। দরকার আধুনিক হবার। তখন ধর্মের নামে ব্যাংক খোলার যেমন প্রয়োজন পড়বে না, তেমনি এ নিয়ে রাজনীতিও করা চলবে না; তাকে হাতিয়ার বানিয়ে ধর্মান্ধতার প্রসার বন্ধ হবে।

সব দেশ ও জাতির একটা স্বপ্ন থাকে, আদর্শ থাকে। যে দেশগুলো আগুয়ান, যে দেশগুলো আধুনিক, তাদের জীবন ও ইতিহাস আধুনিক। তারা প্রগতি ও ভালোবাসায় দেশ গড়ে। সেটা না করে সোনার বাংলা গাইলেও আসলে কি কোনো লাভ আছে? এ দেশের জনকের পরিচয়ই এখনও শক্ত ও সর্বজনগ্রাহ্য করতে পারিনি আমরা। পারিনি সবার মনে দেশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাঁচিয়ে রাখতে। পাকিস্তান ও ভারত এ দুই দেশের দালালি করার মানুষও আছে ভুরি ভুরি। সেখান থেকে সরে এসে সোনার বাংলার নিজস্ব হবার সংগ্রামটাই জরুরি।

ইসলামী ব্যাংক বিতর্ক আসলেই আমাদের জন্য দুভার্গ্যজনক। কারণ এমন প্রতিজ্ঞা করে অনুচিত যা ভাঙার জন্যে করা হয়। কথায় বলে, ভাবিতে উচিত ছিল প্রতিজ্ঞা যখন। ইসলামী ব্যাংকের বেলায়ও সেটা মানিনি আমরা।

কী যে হবে আমাদের!

সিডনি

১৯ মার্চ ২০১৪