আমি পথচারী, অপরাধী নই!

সৈয়দ মাহবুবুল আলম
Published : 15 Nov 2010, 11:29 AM
Updated : 15 Nov 2010, 11:29 AM

আমার প্রথম হাটা বাবা-মায়ের অনেকগুলো সুখের স্মৃতির মাঝে একটি। সময়ের সাথে সাথে সেই হাঁটতে শেখা আমি এই নগরে অনেকের মতোই পথচারী। একজন ব্যক্তি আরাম, স্বাচ্ছন্দ্য ও শারিরীক কষ্ট কমাতে গাড়ী ব্যবহার করে, লিফট ব্যবহার করে। আমি পথচারী হাটতে হাটতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি, কষ্ট হয়, হাতে বোঝা থাকে তাই কষ্ট এড়াতে পর্বত সমান ফুটওভার ব্রিজ না ডিঙ্গিয়ে সমতলে রাস্তা পারাপার করি।

পথচারীদের সুবিধার কথা বিবেচনা না করে, গত ১ নভেম্বর ২০১০ থেকে পথচারীদের ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে বাধ্য করতে জেল প্রদানের ঘোষণা করা হয়েছিল। পথচারীদের প্রতি এধরনের মানসিকতা সত্যিই বিস্ময়ের। একজন ব্যক্তি শারীরিক পরিশ্রম কমাতে গাড়ীতে বসে এসি চালিয়ে দিব্যি চলে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে, তার কোন কষ্ট নেই। আমি পথচারী কষ্ট কমাতে স্বাচ্ছন্দ্যে সেই একই রাস্তা দিয়ে পায়ে হেটে সমতলে যেতে চাইলে জেল। আমার নিরাপদ যাওয়ার জন্য জেব্রা ক্রসিং মুছে দিয়ে তৈরি হয়েছে পর্বত সমান ফুটওভারব্রিজ। আমি মানুষ, আমি পথচারী, এটা কি আমার অপরাধ? তাই হলে কি যন্ত্রদানব গাড়ীর চেয়ে আমার মূল্য কম?

ডিসিসির ওয়েব সাইটে বলা হয়েছে, গাড়ীর নিরবচ্ছিন্ন যাতায়াত নিশ্চিত করতে পথচারীদের জন্য ফুটওভার ব্রিজ। বিআরটিএর তথ্য অনুসারে প্রতিদিন প্রায় ১৮৫টি গাড়ী ঢাকার রাস্তায় নামছে। বর্তমানে ব্যক্তিগত গাড়ীর সংখ্যা প্রায় ২ লক্ষ ১০ হাজার, যা মাত্র ২% মানুষের। অথচ ঢাকা শহরের প্রায় পঁচানব্বই শতাংশ মানুষ হাঁটা, পাবলিক বাস, সাইকেল এবং রিকশাসহ অন্যান্য গণপরিবহনে যাতায়াত করছে। যার অধিকাংশ পায়ে হেটে চলাচল করে থাকে। নগরে মাত্র ২% মানুষের যাতায়াতের বাহনকে সুবিধা প্রদানের জন্য ৯৫% মানুষের যাতায়াতকে উপেক্ষা করা যুক্তিসংগত নয়।

ব্যক্তিগত গাড়ীর সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে বাধ্য করা বা বাধ্য করতে জেলের মাধ্যমে পথচারীদের অপরাধী হিসেবে পরিণত করার পরিকল্পনা, বাংলাদেশ সংবিধানের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার অনুচ্ছেদ-১১, কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তি অনুচ্ছেদ ১৪, সুযোগের সমতা অনুচ্ছেদ-১৯ (১) (২), আইনের দৃষ্টিতে সমতা অনুচ্ছেদ-২৭, জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধকরণ অনুচ্ছেদ ৩৪ (১), চলাফেরার স্বাধীনতা অনুচ্ছেদ-৩৬ এর পরিপন্থী।

গুটিকয়েক মানুষের সুবিধা নিশ্চিত করতে গিয়ে প্রাইভেট কারকে প্রাধান্য দেওয়ায় এক দিকে যেমন সৃষ্টি হচ্ছে যানজট, অপর দিক অধিকাংশ মানুষ দূর্ভোগের শিকার হচ্ছে। এইচডিআরসি এর গবেষনায় দেখা যায় ঢাকা শহরের ৭৬ শতাংশ যাতায়াত ৫ কিমি এর নীচে যার মধ্যে আবার অর্ধেক ২ কিলোমিটারের মধ্যে চলাচল করে। এই দূরত্বে হেটে যাতায়াত করা সম্ভব। কিন্তু ঢাকায় হাঁটা-পথের বর্তমান দূরবস্থা সকলেরই জানা। ঢাকা শহরে পরিবহন সংক্রান্ত নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়নে "পথচারী প্রধান নীতি" বলা হলেও তা কাগজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

মানুষ যতক্ষণ হাটতে পারে ততক্ষণই সুস্থ। হেটে চলাচলকারীরা যাতায়াতের সাথে ব্যায়ামের সুবিধাও পাচ্ছেন। মানুষকে হাটাতে বাধ্য করার প্রয়োজন নেই, উপযোগী পরিবেশ পেলে অনেকেই হাটতে উৎসাহী হবেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সুস্থ থাকতে এবং শরীরের অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণে প্রতিদিন কমপক্ষে ত্রিশ মিনিট থেকে এক ঘন্টা হাটা প্রয়োজন। নিয়মিত হাটার ফলে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়, উচ্চরক্তচাপ এবং ৩০ ভাগ হাইপারটেনশনের ঝুঁকি হ্রাস পায়, স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায় ২৫ ভাগ ও কোলন এবং বৃহদন্তের ক্যান্সারের সম্ভাবনাও কমে, মন ভালো থাকে, বিষন্নতা কমায় ৪৭ শতাংশ এবং দীর্ঘমেয়াদি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়, হাড়ের ঘনত্ব বাড়ে, ক্ষয় কম হয়, জোড়াগুলো থাকে সুস্থ এবং ঝুঁকি কমে বাতের ব্যাথার, পরিবেশ দূষণ, অপরাধ, যানজট হ্রাস পায়, সামাজিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়।

দিন দিন উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, শাসতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদী রোগ, এবং ক্যান্সার এর মতো অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়ছে। বিশ্বে অসংক্রামক রোগে মোট মৃত্যুর ৬০ ভাগের জন্য দায়ী এ সকল রোগ, যার মধ্যে ৮০ ভাগ মুত্যু হয় আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে। এ সকল রোগের প্রায় ৬০ শতাংশ পর্যন্ত প্রয়োজনীয় শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে প্রতিরোধ সম্ভব। প্রতিদিনের যাতায়াতে হেঁটে চলাচল করলে এই সুবিধা পাওয়া যাবে।

সকাল বেলা ঢাকা শহরের কিছু রাস্তায় দাড়ালে দেখা যায়, হেটে চলা মানুষের জনস্রোত। এ সকল রাস্তায় দাড়ালে হাটতে হবে না এমনিতেই মানুষের স্রোতে এক স্থান হতে অন্য স্থানে চলে যেতে হয়। এটি অধিকাংশ স্বল্প আয়ের মানুষের যাতায়াতের চিত্র। অপরদিকে সকাল-বিকাল শহরের বিভিন্নশ্রেণীর পেশার মানুষ হৃদরোগ, অতিরিক্ত মোটা হওয়া, স্ট্রোকসহ নানা সমস্যা হতে মুক্তি পেতে মাঠ পার্কগুলোতে হাটেন। অথচ পরিবেশ দূষণ, যানজট সৃষ্টিকারী গাড়ীর সুবিধার জন্য হাজার কোটি টাকার অবকাঠামো করা হচ্ছে। পরিবেশ দূষণ, যানজট, অবকঠামো খরচ বৃদ্ধি না করা পথচারীদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা সত্যিই বিস্ময়ের।

এক সময় ঢাকা শহরের প্রতিটি রাস্তায় হেটে পারাপারের জন্য জ্রেবা ক্রসিং ছিল। কিন্তু পথচারী অগ্রাধিকার দেওয়ার নামে মাত্র কয়েক বছরে এ সকল জেব্রা ক্রসিং তুলে দিয়ে স্থাপন করা হয়েছে ফুটওভার ব্রিজ। পর্বত সমান উচু এই ফুটওভার ব্রিজ কিভাবে পথচারী সহায়ক কার্যক্রম হয় তা বোধগম্য নয়। ফুটওভার ব্রিজ মানুষ কেন ব্যবহার করে না তা কি কখনো ভেবে দেখেছেন কেউ? ফুটওভার ব্রিজ প্রায় দুই/তিনতলা ভবনের সমান উচু, যা অতিক্রম করা খুবই কষ্টসাধ্য কাজ। মানুষ একটা নির্দ্দিষ্ট দূরত্ব হাটার পর এই উচ্চতা পাড়ি দিতে শারিরীকভাবে সমর্থ নয়। এছাড়া অসুস্থ, বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী, হৃদরোগী, গর্ভবতী মহিলা, শিশু, মালামালসহ পথচারীর জন্য এই উচ্চতা পাড়ি দেওয়া স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ এবং অসম্ভব একটি ব্যাপার। আর ঢাকা শহরের ফুটওভার ব্রিজ পাড়ি দিতে অনেকদূর পথ অতিরিক্ত হাঁটতে হয়।

যেখানে দুই মিনিটে একজন মানুষ সড়ক পার হতে পারতো, সেখানে সড়কের অনেকখানি ঘুরে ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে পার হতে যেমন অধিক পরিশ্রম হচ্ছে আবার সময়ও বেশি লাগছে। যারা ফুটওভার ব্রিজ তৈরির পরামর্শ দিয়ে থাকেন তাদের জন্য একটি অনুরোধ, ঘরে বা গাড়ীতে বসে পরিকল্পনা না করে, একজন সাধারণ মানুষের মতো নিয়মিত হেটে পরীক্ষা করে দেখুন, আপনি নিজে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করতে পারেন কি না? যদি পারেন তাহলেই ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের সুপারিশ করুন। যদি অধিকাংশ মানুষের জন্য পরিকল্পনা না করে, নিজ ও ধনীদের ব্যক্তিগত বাহনের যাতায়াত সুবিধা নিশ্চিত করতে চান, তবে একথা প্রাসঙ্গিক নয়।

বাংলাদেশে প্রচুর মানুষ আর্থরাইটিস ও হৃদরোগ সংক্রান্ত সমস্যায় ভোগেন। শারীরিক প্রতিবন্ধীর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য। যাদের মধ্যে অনেকেই হেটে যাতায়াত করেন। তারা কিভাবে এই পর্বত অতিক্রম করবে? আসলে যারা এই ফুটওভার ব্রিজের পরিকল্পনা করেন তারা হয়তো শৌখিন পথচারী। ঘরে বসে ও গাড়ীতে চড়ে পরিকল্পনা করতে করতে তারা সাধারণ মানুষের হাটতে কি কষ্ট হয় তা ভুলে গেছেন। সাধারণ মানুষের যাতায়াত সুবিধা নিশ্চিত করা তাদের মাথাব্যাথা নয়। নিশ্চিত করতে হবে গাড়ীর চলাচল।

এ শহরে যেখানে অধিকাংশ মানুষ হেটে চলাচল করে তাদের জন্য জ্রেব্রা ক্রসিং বৃদ্ধি না করে কেনই বা পর্বত সমান ফুটওভার ব্রিজ তৈরি করা হচ্ছে যা সত্যিই বিস্ময়ের বিষয়। বিদ্যমান ফুটওভারব্রিজগুলো যখন মানুষ ব্যবহার করছে না, তখন নতুন নতুন ফুটওভারব্রিজ তৈরির কোন যুক্তিকতা নেই। তথাপিও নতুন নতুন তৈরি হচ্ছে ফুটওভার ব্রিজ। কিছু স্থানে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকদের দিয়ে ব্রিজে উঠতে বাধ্য করানো হচ্ছে । ফুটওভার ব্রিজের স্থানে ব্যারিকেড তৈরি করা হচ্ছে যাতে মানুষ যত্রতত্র দিয়ে পারাপার না হতে পারে। এ প্রক্রিয়া জনগনের জন্য আরামদায়ক ও সুবিধাজনক নয়। কতিপয় ব্যক্তি মানুষের সুবিধা ও মতামত বিবেচনা না করে এ সকল কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। যা হাটা-মানুষের প্রতি উপহাস বা অবহেলা হিসেবে প্রতীয়মান হয়। রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থে সরকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অধিকাংশ মানুষের সুবিধার প্রতি অবহেলা অসংবিধানিক ও অগণতান্ত্রিক।

অবকাঠামোগত পরিবেশ মানুষের মনের উপর প্রভাব ফেলে তাই হাঁটার জন্য সুন্দর, মনোমুগ্ধকর আর প্রাকৃতিক পরিবেশ তৈরী করতে হবে। ফুটপাত এমনভাবে তৈরি করতে হবে একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিও যেন নির্বিঘ্নে সাড়া শহরে চলাচল করতে পারে। উন্নত দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, সড়কে সমতলে পারাপারের ব্যবস্থা থাকবে। ফুটপাত চওড়া ও সমতল হওয়া প্রয়োজন। ফুটপাতে গাছের ছায়া এবং রাতে আলোর ব্যবস্থা থাকবে, পথচারীদের আকর্ষণ ও নিরাপত্তা দিতে হকারদের নিয়ন্ত্রিতভাবে বসার ব্যবস্থা থাকবে, রাখা যেতে পারে শৌচাগার, পাবলিক বাসের স্ট্যান্ড, পথচারীদের বসার জন্য একটু ব্যবস্থা। শব্দ দূষণ, বায়ু দূষণ ও বেপরোয়া গাড়ীচালনা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। ফুটপাতে গাড়ী পার্কিং নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি ডাস্টবিনগুলো সরিয়ে ফেলা প্রয়োজন।

সড়ক পরাপারে নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্য চলাচল নিশ্চিত করতে ঢাকার সকল রাস্তায় নির্দ্দিষ্ট বিরতিতে পথচারী পারাপারের চাহিদা নিরূপন সাপেক্ষে জেব্রা ক্রসিং তৈরি, জেব্রা ক্রসিংয়ের পূর্বে সতর্কতামূলক সাইন স্থাপন, জেব্রা ক্রসিংগুলোতে গাড়ী গতি ধীর করতে এবং পথচারীদের অগ্রাধিকার দিতে চালকদের সচেতন করা, জেব্রা ক্রসিংয়ের পূর্বে গাড়ি থামানোর ব্যবস্থা, শহরে গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ করাসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।

তবে সর্বোপরি ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে বাধ্য করতে জেল জরিমানা প্রদানের মতো পরিকল্পনা বা মানসিকতা পরিবর্তন করা প্রয়োজন। গুটি কয়েক ব্যক্তির জন্য অধিকাংশ মানুষের সুবিধাকে অগ্রায্য করার মতো পরিকল্পনা বা কার্যক্রম জনমনে সরকার ও মন্ত্রণালয় বিষয়ে বিরূপ প্রভাব ফেলে। "পথচারী প্রধান নীতি" অনুসারে পথচারীদের অগ্রাধিকার প্রধান করা প্রয়োজন।

পথচারীদের অপরাধী হিসেবে না দেখে, হাটাকে যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা প্রয়োজন। কারণ হেটেচলা মানুষগুলো জায়গা কম দখল করে, পরিবেশ দূষণ, শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ করে না, তাদের জন্য ফ্লাইওভার, এলিভেটর এক্সপেসওয়ে বা পার্কিং প্রয়োজন হয় না।