যৌতুক ও যৌতুকের ব্রিটিশ সম্পৃক্ততা

আলিমুল হক
Published : 12 June 2008, 12:22 PM
Updated : 11 Nov 2010, 03:24 PM

বাংলাদেশে যৌতুকের প্রচলন হলো কী ভাবে? এ প্রশ্নের একটি কৌতুহল উদ্দীপক ব্যাখ্যা আছে আমার কাছে। তবে সে ব্যাখ্যায় যাবার আগে একটি প্রশ্ন করতে চাই: স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত কতো নারী যৌতুকের শিকার হয়েছেন? অসংখ্য নারী। নির্যাতনের শিকার হয়ে কেউ মারা গেছেন, কেউ পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, কেউ ঘরহারা বা আশ্রয়হারা হয়েছেন, কাউকে বাধ্য হয়ে পতিতাবৃত্তি বেছে নিতে হয়েছে, এবং অসংখ্য নারী আমাদের চোখের আড়ালে প্রতিনিয়ত যৌতুকের কারণে এখনো নির্যাতনের শিকার হয়েই চলেছেন। এমনই এক 'গ্রহণের কালে' গত মাসের শেষের দিকে মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে ৫৫ ব্যক্তি শপথ নিলেন যৌতুকের বিরূদ্ধে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক তাদের শপথ বাক্য পাঠ করান। সংবাদপত্রের পাতায় সংবাদটি ছাপা হবার পর, যৌতুক নিয়ে কলম ধরার ইচ্ছা জাগলো মনে।

ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম হেনরি তার বিয়ের সময় যৌতুক (dowry) হিসেবে কনেপক্ষের কাছে দাবি করেছিলেন বিপুল পরিমাণ অর্থ ও ফ্রান্সের দু-দুটি ভূ-খন্ড (Aquitaine I Normandy)। ফ্রান্সের রাজা ষষ্ঠ চার্লস-এর কন্যা ক্যাথেরিন (Catherine) ছিলেন বিয়ের কনে। ইতিহাস সাক্ষী, কনেপক্ষ ওই যৌতুকের দাবি মেনে নিতে অস্বীকার করলে ১৪১৫ সালে রাজা পঞ্চম হেনরি ফ্রান্স আক্রমণ করেন এবং ১৪২০ সালের জুনে, দাবিকৃত যৌতুকসহ, অনেকটা জোর করেই রাজকুমারী ক্যাথেরিনকে বিয়ে করেন। পরবর্তী কালে ক্যাথেরিনের গর্ভেই জন্ম নিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ হেনরি।

সবাই জানেন, ইংরেজরা পাক-ভারত-বাংলাদেশ উপমহাদেশ জোর করে শাসন করেছিল প্রায় দু'শ বছর। তবে কি বিয়েতে যৌতুক নেয়ার কুপ্রথা ইংরেজদের কাছ থেকেই আমাদের পূর্ব-পুরুষরা শিখেছিলেন? নাকি, ইংরেজদের আগমনের অনেক আগে থেকেই এ অঞ্চলে যৌতুক-প্রথা ছিল? এসব প্রশ্নের বিতর্কে যাবো না। শুধু বলি, যৌতুক-প্রথা আমাদের সমাজকে পূর্বেও কুরে কুরে খেয়েছে, এখনো খাচ্ছে; যৌতুক নারী-নির্যাতনের একটি মূল কারণ হিসেবে পূর্বেও ছিল, এখনো আছে। ইংরেজ চলে গেছে। ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান এবং পরবর্তী কালে পাকিস্তান ভাগ হয়ে বাংলাদেশ হয়েছে, কিন্তু যৌতুকের করালগ্রাস থেকে মুক্তি মেলেনি এদেশের নারীসমাজের।

আধুনিক ছোটোগল্পের প্রথম গ্রন্থ হিসেবে চিহ্নিত করা চলে জগদীশচন্দ্র গুপ্তের 'বিনোদিনী'-কে। ১৯২৭ সালে প্রকাশিত এ-গ্রন্থটির মধ্যে স্থান-পাওয়া অনেকগুলো ছোটোগল্পের একটির নাম 'পয়োমুখম্'। গল্পটিতে তৎকালীন হিন্দু সমাজে যৌতুক-প্রথার নিষ্ঠুর ও ভয়াবহ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। প্রশ্ন হচ্ছে: হিন্দু সমাজে যৌতুক-প্রথা কেমন করে শেকড় গেড়ে বসতে পারলো? এক সময়, হিন্দু আইনে পিতার সম্পত্তিতে কন্যার অধিকার স্বীকৃত ছিল না। হতে পারে, সে-কারণে বিয়ের সময় পিতা কন্যাকে উপহারস্বরূপ যা-কিছু সম্ভব দিয়ে দিতেন এবং সেটিই পরবর্তী কালে সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিতে পরিণত হয়েছিল। আর সমাজে যখন কোনো রীতি একবার প্রতিষ্ঠা লাভ করে, তখন তাকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করা সহজ কাজ নয়। হিন্দু সমাজের যৌতুক-প্রথার ক্ষেত্রেও হয়েছিল তা-ই। ১৯৫৫ ও ১৯৫৬ সালে ভারতে আইন করে পিতার সম্পত্তিতে কন্যার উত্তরাধিকার নিশ্চিত করবার পরও দেখা গেল, যৌতুক-প্রথা লোপ পায়নি। ১৯৬১ সালে তো ভারতে খোদ যৌতুককেই 'বে-আইনী' ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তারপরও ভারতে পুরোপুরি লোপ পায়নি এ-কুপ্রথা। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা এ-প্রসঙ্গে বলছে: "যদিও দীর্ঘকাল ধরে যৌতুক-প্রথা কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা-মাতার ওপর অসহনীয় বোঝা হয়ে ছিল, সামাজিক ও ধর্মীয় রীতি এমনই শক্তিশালী যে, যৌতুক-বিরোধী আইন (ভারতে) পুরোপুরি সফল হয়নি।"

যৌতুক-বিরোধী আইন পুরোপুরি সফল হয়নি আমাদের এই বাংলাদেশেও। বাংলাদেশে যৌতুক-প্রথার হাল-হকিকত নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে গেলে শুরুতেই আমাদের মনে অবধারিতভাবে যে-প্রশ্নটি জাগবে, সেটি হচ্ছে: বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে যৌতুক-প্রথা পাকাপোক্ত স্থান করে নিতে পারলো কীভাবে? পিতার সম্পত্তিতে কন্যার অধিকার তো ইসলামী আইনে বরাবরই স্বীকৃত! তা ছাড়া, ইসলামে কন্যাপক্ষের কাছ থেকে বরপক্ষের যৌতুক নেয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্যও বটে। ইসলামী আইন অনুসারে বিয়ের সময় বর-ই বরং কনেকে নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ (যাকে আমরা 'মোহরানা' বলি) দিতে বাধ্য (ইসলামী আইন অনুসারে, স্ত্রীর সম্পত্তি বা আয়ের ওপর স্বামীর কোনো অধিকারও নেই। স্ত্রী খুশীমনে স্বামীকে নিজের অর্থকড়ি বা আয় ভোগ করতে দিলে অবশ্য ভিন্ন কথা)। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত যৌতুককে কেন্দ্র করে নারী-নির্যাতনের যে-সব ঘটনা ঘটে, সেগুলো ঘটায় মুসলমানরাই (দুএকটা ব্যতিক্রম থাকতে পারে)। আমার প্রায় চৌদ্দ বছরের সাংবাদিকতা-জীবনে আমাকে এ-ধরনের অসংখ্য ঘটনার করুণ বর্ননা সংবাদপত্রের পাতায় পড়তে হয়েছে এবং এখনো পড়তে হচ্ছে। যৌতুককে কেন্দ্র করে নারী-হত্যার ঘটনা ঘটছে প্রায় প্রতিদিন।

অনেকে বলেন, প্রতিবেশী হিন্দু সমাজের কাছ থেকেই বাংলাদেশের মুসলমানরা যৌতুক দেয়া-নেয়া শিখেছে। যেখান থেকেই শিখে থাকুক, এ-শিক্ষার চর্চা তাঁরা করে যাচ্ছে বেশ দক্ষতার (!) সঙ্গেই। বাংলাদেশের যৌতুক-সমস্যাকে তো 'মুসলিম সম্প্রদায়ের সমস্যা' বললেও বাড়িয়ে বলা হবে না (মধ্যপ্রাচ্যেও একধরনের যৌতুক সমস্যা আছে বলে জানি। ওখানে যৌতুক নেন কনের বাবা)। শুধুমাত্র মুসলমানদের মন-মগজ থেকে যৌতুকের ভূত তাড়ানো গেলেই এ-সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বাংলাদেশে। কী করে এ-ভূত তাড়ানো সম্ভব? মুসলমানদের মধ্য থেকে অজ্ঞতা, কুশিক্ষা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব ইত্যাদি দূর করবার মাধ্যমে। বাংলাদেশের মুসলমানরা সাধারণভাবে ধর্মভীরু। কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ও স্বচ্ছ জ্ঞানের অভাবেই তাদের মধ্যে ধর্মীয় ও মানবিক মূল্যবোধ জেগে উঠছে না। এ-অভাব দূর করতে হবে, তাদের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে হবে ধর্মীয় মূল্যবোধকে। ধর্মের বিধি-নিষেধ মেনে চলবার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে যখন তাঁরা সচেতন হবে তখন, অন্যসব নিষিদ্ধ কাজের সঙ্গে যৌতুক আদান-প্রদানের মতো হারাম কাজটিও করা থেকে বিরত থাকবে বলে আশা করা যায়।

না, বলছি না যে, কেবল মসজিদের ইমাম সাহেবরা এবং ইসলামী চিন্তাবিদরাই বক্তৃতা ও লেখনির মাধ্যমে যৌতুকের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করবেন। যৌতুক-বিরোধী সামাজিক সংগঠনগুলির প্রয়োজনীয়তাও আমি সমানভাবে স্বীকার করছি। এখানে এসে সাধুবাদ জানাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনের অনুষ্ঠানে যৌতুকের বিরদ্ধে শপথ নেয়া ৫৫ জনকেও। যৌতুকের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার মতো এধরনের প্রতিষ্ঠান সমাজে যতো বাড়বে ততোই মঙ্গল। যেসব প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে কাজ করছে, তাদের কাজের গতিও বাড়াতে হবে। এই তো গেলো প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের কথা।  ব্যক্তিগত পর্যায়েও আমাদের সকলের উচিত যৌতুক তথা নারী-নির্যাতনের সবগুলো হাতিয়ারের বিরুদ্ধে নিজ নিজ গন্ডির মধ্যে থেকে হলেও সোচ্চার হওয়া। এ-প্রসঙ্গে মনে পড়ছে নিয়াজী সাহেবের কথা। না, এই নিয়াজী সেই পাকিস্তানী জেনারেল নিয়াজী নন। কিশোরগঞ্জের ভৈরবের এই নিয়াজী বছরের পর বছর ধরে লড়েছেন যৌতুকের বিরুদ্ধে। সুযোগ পেলেই তিনি রাস্তার পাশের দেয়ালে, রিকশার গায়ে বা লোকজনের গেঞ্জিতে লিখে ফেলতেন যৌতুক-বিরোধী শ্লোগান। তিনি চাইতেন, অন্তত একজন তার লেখা পড়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে যৌতুক ছাড়া বিয়ে করুক। তিনি এখনো তার এই মহতী কাজ করা অব্যাহত রেখেছেন কি না জানি না; তবে সমাজে নিয়াজী সাহেবের মতো লোক দ্রুত বাড়া দরকার।

দেশে যৌতুক-বিরোধী যে-আইনটি আছে সেটি ১৯৮০ সালে পাস হওয়া। আইনটির যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না বলে অভিযোগ আছে। অনেকে মনে করেন আইনটি সংশোধন করে আরো যুগ উপযোগীও করা দরকার। সবই ঠিক আছে। কিন্তু শুধূ আইন-এর মাধ্যমে যৌতুকের মতো একটি সামাজিক সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান হবে না বা হতে পারে না। ভারতেও তা করা সম্ভব হয়নি। যথাযথ আইন, আইনের প্রয়োগ ও পাশাপাশি এর বিরুদ্ধে তীব্র সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমেই কেবল যৌতুক নামক বিষবৃক্ষের কবল থেকে আমাদের সমাজ রেহাই পেতে পারে। আলোচ্য শপথ-গ্রহণ অনুষ্ঠানেও একই মত প্রকাশ করা হয়েছে।

আলিমুল হক :     লেখক ও প্রাবন্ধিক। ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটিতে গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপ পরিচালক ও প্রধান।