হারিয়ে যাওয়া বিমান ও উড্ডয়ন-নিরাপত্তা

শোয়েব সাঈদ
Published : 17 March 2014, 05:45 PM
Updated : 17 March 2014, 05:45 PM

উড়োজাহাজকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ ভ্রমণ-বাহন এবং দ্রুত ছুটতে থাকা আধুনিক জীবনব্যবস্থার অন্যতম চালিকাশক্তি। যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে ব্যস্ত সময়ে উড়ন্ত উড়োজাহাজের সংখ্যা পাঁচ হাজারও ছাড়িয়ে যায়। নিরাপদ রাখার আয়োজনটি বর্তমানে এতটাই উঁচুস্তরের যে, এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে মারাত্মক বিমান দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা পঁয়তাল্লিশ মিলিয়ন ভাগের একভাগ! আর প্রতিদিন বিমানে ভ্রমণ করলেও মারাত্মক দুর্ঘটনার দেখা মিলতে সময় লাগবে ১২,৩০০ বছর!

মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের কথাই ধরুন। এরা প্রতিবছর লক্ষাধিক ফ্লাইট পরিচালনা করে। গত চল্লিশ বছরের ইতিহাসে এই এয়ারলাইনসের মাত্র তিনটি বিমান বড় দুর্ঘটনায় পড়েছে যাতে যাত্রী হতাহত হয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রধান দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল ছিনতাই-এর কারণে। দুর্ঘটনার ফ্রিকোয়েন্সির দিক থেকে এই নিরাপত্তার বিষয়টি সত্য। তবে সত্যের পেছনের মর্মান্তিক বাস্তবতাটি হচ্ছে প্রতিটি সিঙ্গেল ঘটনার ভয়াবহতা এবং এই পঁয়তাল্লিশ মিলিয়ন ভাগের একভাগের ভগ্নাংশটুকু যার কপালের লিখন, 'এক জীবনের তরে তাহাই একশতভাগ'।

বর্তমান মানবসভ্যতা এই মর্মান্তিক বাস্তবতাকে শুধু নিয়তির হাতে ছেড়ে দিতে রাজি নয়। আর তাই নিরাপদ রাখার প্রক্রিয়া ক্রমাগত সুসংহত করার প্রচেষ্টায় নতুন নতুন প্রযুক্তির দেখা মিলছে। এরই ফলশ্রুতিতে পশ্চিম ইউরোপ, আমেরিকা আর এশিয়ার এয়ারলাইনসগুলোর দুর্ঘটনা ক্রমশই বিরল হয়ে যাচ্ছে। ইঞ্জিন বিকল, মেটাল ফ্যাটিগ, যন্ত্রাংশ খুলে যাওয়া, লেভিগেশন ক্রটি ইত্যাদি কারণে কয়েক বছর আগেও যেখানে মাঝেমধ্যেই দুর্ঘটনার খবর মিলত। বর্তমানে এসব কারণে কমার্শিয়াল এয়ারলাইনসের দুর্ঘটনা বিরলই বলা যায়।

দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া বা ইঞ্জিনে পাখি ঢুকে যাওয়ার যে বিপদ, প্রযুক্তির স্পর্শে তাতেও এসেছে মানুষের নিয়ন্ত্রণ। মানবিক ক্রটির আশঙ্কাও অনেকটা কমিয়ে আনা হয়েছে। বিমানবন্দরের কঠোর নিরাপত্তার মাঝে অবশ্য সন্ত্রাসবাদ এখনও মাথাব্যথার কারণ হয়ে আছে। তবু সবকিছু মিলিয়ে উড়োজাহাজ বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ ভ্রমণ-বাহন।

সম্প্রতি মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের ৭৭৭-২০০ ইআর উড়োজাহাজের রেড আই অর্থাৎ রাত্রিকালীন ফ্লাইট এমএইচ ৩৭০ কুয়ালালামপুর থেকে বেইজিং-এর পথে ২৩৯ আরোহীসহ যেভাবে পেন-পেন বা মে-ডে জরুরি বার্তা ছাড়াই উধাও হয়ে গেল তা আধুনিক বিমানচালনার হাইটেক নিরাপদ ব্যবস্থায় একটি বড় ধরনের ধাক্কাই বটে।

পেশাগত কারণে বহু বছর যাবত যাত্রী হিসেবে গড়পড়তায় বছরে ৭০-৮০ টির মতো ফ্লাইটে উঠতে হচ্ছে। মাত্র তিন সপ্তাহ আগে ব্রুনেই সরকারের আমন্ত্রণে একটি সেমিনারে যোগ দিতে মন্ট্রিয়ল থেকে টোকিও আর সিঙ্গাপুর হয়ে দক্ষিণ চীন সাগর আর মালাক্কা প্রণালীর পাশ দিয়ে উড়তে হয়েছিল।

মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের হতভাগ্য ফ্লাইটটি বিশ্বমিডিয়ায় যে আলোড়ন তুলেছে তাতে বুঝা যায়, এই ধরনের পরিণতি মানুষ আর নিয়তি বলে মেনে নিতে চাচ্ছে না। বোয়িং ৭৭৭ কে বলা হয় বর্তমান প্রজন্মের সবচেয়ে নিরাপদ এবং আধুনিক উড়োজাহাজ। গত বছর সানফ্রান্সিসকো বিমানবন্দরে দক্ষিণ কোরিয়ার আসিয়ানা এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭৭৭ এর আছড়ে পড়ার ঘটনাটি যান্ত্রিক ত্রুটি না পাইলটের মিসক্যালকুলেশন তা এখনও মীমাংসিত নয়। তবে বড় সত্যটি হচ্ছে, ৭৭৭ এর হাইটেক সিটিং, উচ্চমানের অগ্নিনিরোধক ইনটেরিওর এবং অন্যান্য সেফটি ফিচারের কারণে ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। বিমানচালনায় অনাকাঙ্ক্ষিত নিয়তি নিয়ন্ত্রণ করবার মানবিক প্রচেষ্টার কিছু বিষয় পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাচ্ছি।

ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেলে 'ক্রাশ' অবধারিত এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। সবগুলো ইঞ্জিন একসঙ্গে বিকল হবার সম্ভাবনা খুবই বিরল। একটি বিকল হলে অন্যটির সাহায্যে অবতরণ করা যায়। বিরল দুর্ভাগ্যে সবগুলো ইঞ্জিন বিকল হলেও গ্লাইড করে জরুরি অবতরণ করা যায়। গ্লাইডার যেমন করে ইঞ্জিন ছাড়া পাখায় ভর করে নেমে আসে, উড়োজাহাজও তেমনি গ্লাইড করে অবতরণ করতে পারে। ৩৫,০০০ ফুট উচ্চতা থেকে গ্লাইড করে কোনো সমতলভূমিতে নেমে আসতে বেশ অনেকটা সময় পাওয়া যায়।

পাইলটের দক্ষতা এবং বিচক্ষণতা এখানে নিয়ামক। গ্লাইড করে সফল জরুরি অবতরণের অনেক উদাহরণ আছে। ২০০৯ সালে নিউইয়র্কের হাডসন নদীতে ইউএস এয়ারওয়েজের এয়ারবাস ৩২০ ফ্লাইটটির সফল অবতরণ সাম্প্রতিকতম উদাহরণ। কিলোগ্রাম আর পাউন্ডের ভুল বুঝাবুঝিতে ১৯৮৩ সালে এয়ার কানাডার বোয়িং ৭৬৭ জেটটি দুর্ঘটনায় পড়তে যাচ্ছিল। কিলোগ্রামে জ্বালানি ভরার অনুরোধের বিপরীতে পাউন্ডে জ্বালানি ভরা এবং কাকতালীয়ভাবে একই সঙ্গে জ্বালানি মিটারের ভুল রিডিং-এর কারণে মাঝপথে জ্বালানির অভাবে দুটো ইঞ্জিনই বন্ধ হয়ে যায়। পাইলট গ্লাইড করে বিমানটিকে নিরাপদে ভূমিতে নামিয়ে আনেন।

বর্তমানে উচ্চপ্রযুক্তির একাধিক রক্ষাকবচের কারণে এ ধরনের ভুল হবার সুযোগ নেই। বোয়িং ৭৭৭ এবং অতিআধুনিক ড্রিমলাইনার ৭৮৭ কিংবা এয়ারবাসের উচ্চপ্রযুক্তির প্লেনগুলোতে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেলে আবার অটো-রিস্টার্টের সিস্টেম থাকে। ইঞ্জিন চালু না হলে রেট (রেম এয়ার টার্বাইন) নামক একটি সিস্টেম আপনা থেকেই টের পাবে ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেছে। রেট তখন নিজ থেকেই খুলে যাবে এবং প্লেনের গতি কাজে লাগিয়ে এর ব্লেড ঘুরতে থাকবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যে। রেট জরুরি অবতরণের জন্যে ল্যান্ডিং গিয়ারসহ প্রয়োজনীয় অংশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে।

২০১২ সালে ফ্রান্সের তলুজ শহরের এয়ারবাসের ডাবল ডেকার ৩৮০ এর অ্যাসেম্বলিং প্ল্যান্ট ভিজিট করার সুযোগ হয়েছিল। এয়ারবাস ৩৮০ এর মোট ইলেকট্রিক্যাল ওয়্যারিং হচ্ছে ৫০০ কিমি-এর চেয়েও বেশি যা ব্যাপক হাইটেক নির্ভরতা প্রমাণ করে। এয়ারবাসের টেস্টিং ফ্লাইটের সময় নির্দিষ্ট অলটিচুডে ইঞ্জিন বন্ধ করে ইঞ্জিন রি-স্টার্ট, ব্যালান্স এবং গ্লাইড করার বিষয়টি পরীক্ষা করা হয়।

উড়োজাহাজ সাধারণত বজ্রপাতের সম্ভাব্য রুট এড়িয়ে চলে যদিও বজ্রপাতে উড়োজাহাজের কোনো সমস্যা নেই। তবে উড্ডয়নের পরপর বজ্রাঘাত হলে উড়োজাহাজ ফিরে আসার একটি প্রথা চালু আছে। বজ্রপাতের উচ্চ তাপমাত্রার কারণে এটি একটি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। একবার ফরাসী প্রেসিডেন্ট জার্মানির চ্যান্সেলরের সঙ্গে বৈঠকের জন্যে বার্লিন যাচ্ছিলেন। বিমানে বজ্রাঘাত হলে বিমানটি ফিরে আসে।

আধুনিক বিমানকে বলা হয় পারফেক্ট ফ্যারাডে কেজ, মানে খাঁচার মতো একটি মেটাল বক্স। অর্থাৎ বিদ্যুৎ খাঁচার ভেতরে প্রাণিদের কোনো ক্ষতি না করে খাঁচার মাধ্যমে পরিবাহিত হয়ে চলে যাবে। আধুনিক উড়োজাহাজ আড়াই লাখ এমস ধারণ করতে পারে। আর গড়পড়তায় একটি বজ্রপাত জেনারেট করে বত্রিশ হাজার এমস। তবে বজ্রপাতে সমস্যা হয় যদি তা বিমানের নোজে (নাকে) আঘাত করে। এই নোজকোনটি হচ্ছে উড়োজাহাজের একমাত্র নন-মেটাল অংশ যার মধ্যে রেডারটি থাকে।

টারবুল্যাঞ্চে কমবেশি সবাই অস্বস্তি বোধ করেন। তবে টারবুল্যাঞ্চের কারণে আধুনিক ভার্সনের এয়ারক্রাফটের সমস্যা হবার আশঙ্কা নেই বললেই চলে। মাঝারি মাত্রার টারবুল্যাঞ্চে ভেতর থেকে যাত্রীরা হয়তো ঝাঁকুনি অনুভব করবেন কিন্তু বাইরে থেকে দেখলে বিমানটি ঝাঁকাচ্ছে কিনা বুঝার উপায় নেই। জাপানের এয়ারলাইনসসমূহে টারবুল্যাঞ্চের সময় ঘোষণা দেওয়া হয় যে, "চিন্তার কোনো কারণ নেই"। আধুনিক উড়োজাহাজ টারবুল্যাঞ্চের সম্ভাব্য ম্যাক্সিমাম শক ধারণ করার কাঠামোয় তৈরি করা হয়।

উড়োজাহাজের সবচেয়ে স্ট্রেসড অংশ হচ্ছে পাখা। মাটিতে থাকাকালীন এই পাখা সমান্তরালভাবে রিল্যাক্স অবস্থায় থাকে। উড়ার মুহূর্ত থেকেই দেখবেন পাখা দুটো উপরের দিকে বেঁকে আছে। একে বলা হয় উইং ফ্লেক্স। লিফটিং পাওয়ারের স্ট্রেসের কারণে এমনটি হয়। এটি অনেকটা পাখির পাখার নিচে হাত দিয়ে পাখিকে উড়তে দেওয়ার মতো।

টারবুল্যাঞ্চের সময় এই উইং ফ্লেক্স আরও বেড়ে যায়। বোয়িং ৭৭৭, ৭৮৭ ইত্যাদি আধুনিক প্লেন তৈরির সময় উইং-এর টিকে থাকার ক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়। উড্ডয়নরত অবস্থায় ম্যাক্সিমাম বিরূপ পরিস্থিতির উইং ফ্লেক্সকে ১০০ ভাগ ধরে টেস্টিং প্ল্যান্টে পাখা না ভাঙা পর্যন্ত পরীক্ষা করা হয় যা উইং স্যাক্রিফাইজ টেস্ট নামে পরিচিত। বোয়িং ৭৭৭, ৭৮৭ এর পাখা প্রকৃতিতে প্রত্যাশিত ম্যাক্সিমাম ফোর্সের ১৫০ ভাগের অধিক ফোর্সেও টিকে থাকতে সক্ষম।

যদি মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের উচ্চপ্রযুক্তির ৭৭৭-২০০ উড়োজাহাজটি টেকনিক্যাল কারণে দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে থাকে তবে তা হবে নিরাপদ আকাশভ্রমণের সাম্প্রতিক প্রাযুক্তিক উৎকর্ষতাকেই চ্যালেঞ্জ করা। সর্বশেষ তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে বুঝা যাচ্ছে যে, যান্ত্রিক গোলযোগের সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে তথ্য-উপাত্তের ইন্টার-এজেন্সিস ক্রস-চেকের ভিত্তিতে ডেলিবারেট বা উদ্দেশ্যমূলক অ্যাকটিভিটির কথা নিশ্চিত করেছেন।

পাইলটের কোনো ভুলও আমলে নেওয়া হচ্ছে না। প্রশ্ন হচ্ছে, এই উদ্দেশ্যমূলক নিখোঁজ হয়ে যাবার পেছনে কে? কোনো ছিনতাইকারী, না বিমান-পরিচালনার সঙ্গে জড়িত কেউ, নাকি ষড়যন্ত্র তত্ত্বানুসারে দূর-নিয়ন্ত্রণের কারসাজি? ছিনতাই হলে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বড় ধরনের গলদ ছিল। বিমান-পরিচালনার সঙ্গে জড়িত কেউ এ কাজ করে থাকলে পরিচালনায় সংশ্লিষ্টদের অসৎ উদ্দেশ্য, মানসিক অসুস্থতা এবং আত্মহনন প্রবৃত্তি ইত্যাদি বিষয়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণের আধুনিকায়ন সময়ের দাবি। এটা যদি দূর-নিয়ন্ত্রনের কারসাজি হয়ে থাকে তবে প্রযুক্তির ক্রমাগত উৎকর্ষে ফাউল প্লেয়ারদের দক্ষতা নিরাপদ আকাশভ্রমণের নতুন অথচ জটিল এক অশনি সঙ্কেত।

মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস এমএইচ ৩৭০ এর এই হারিয়ে যাওয়া উড্ডয়ন-নিরাপত্তায় নতুন দুশ্চিন্তার সূচনা করল।

ড. শোয়েব সাঈদ: বায়োটেক নির্বাহী, কানাডা।