বাংলাদেশের সংকট দুর্যোগে রাজদূত ও শান্তির দূত

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 17 March 2014, 06:29 AM
Updated : 17 March 2014, 06:29 AM

দুনিয়ার কোনো দেশে এমন নজির নেই, এমন কোনো দৃষ্টান্ত নেই, এমন কোনো মানুষও নেই যিনি পৃথিবীবিখ্যাত হবার পরও এতটা আত্মকেন্দ্রিক বা স্বার্থপর। উপমহাদেশের খ্যাতিমান বাঙালি বিবেকানন্দ বলতেন, পৃথিবীর ইতিহাস মূলত কিছু মানুষের ইতিহাস। আসলে মানুষই ইতিহাস-নির্মাতা। মানুষ যা পারে আর কোনো প্রাণি তা পারে না। সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে তাদের শ্রম, মেধা আর ত্যাগে নির্মিত এই পৃথিবী আজ সুন্দর। কালে কালে মানুষই মানুষকে স্বীকৃতি দিয়ে উৎসাহিত করে আরও প্রাণবন্ত আর তেজী করে তুলেছে।

বলাবাহুল্য মানুষ স্বার্থপর আর সুযোগসন্ধানীও বটে। হিউম্যান ন্যাচার বলে যে শব্দটি, তার আগাগোড়াই এর প্রমাণে ভরা। কালে কালে চালাক ও চতুর মানুষরা দুর্বল দেশ ও সমাজের ওপর ছড়ি ঘুরাতে শিখেছে। তাদের শাসন-শোষণ করে নিজেরা স্ফীত হবার পর কিছু দয়া বা দান করতেও ভুল করেনি তারা। এই প্রক্রিয়ায় তাদের পছন্দমতো মানুষ খুঁজে নিয়ে নানা গালভরা পুরস্কারে ভূষিত করে। এদের সর্বজনগ্রাহ্য করার চেষ্টাও নতুন কিছু নয়।

যে কোনো কারণেই হোক, আমাদের এই গরীব দেশের কয়েকজন মানুষও বিশ্বের সেরা পুরস্কার বলে পরিচিত নোবেল পেয়ে আমাদের ধন্য করেছেন। করেছেন চিরঋণী। সঙ্গে একটা বিষয়ও ঢুকে পড়েছে বানের পানির মতো। সবাই সমান দীপ্র নয়, নয় সমান উজ্জ্বল। বিশেষত যখন দেশ ও সমাজ বিপদে পড়ে বা কোনো সংকটের মুখোমুখি হয়, তখন জাতির সামনে দাঁড়ানোর শক্তি-সাহসই বলে দেয় কে জেনুইন আর কে পোষা বা আপোসকামী।

আজ বাংলাদেশে নানাবিধ সংকটে। আমাদের এই দেশে একদা যে মুক্তির লড়াই ও আধুনিক হবার সংগ্রাম, দুশমনরা তাকেও ছেড়ে কথা বলছে না। মৌল বিষয়ে নিজেদের খাপ না-খাওয়া অস্তিত্ব আর প্রতিক্রিয়াশীল চক্রান্তে তারা আজ বাংলাদেশের ফুসফুসে আঘাত করছে। তার হৃদয় ছিঁড়ে নিতে চাইছে। এদের যাবতীয় কর্মকাণ্ডে এটা স্পষ্ট যে, আর যাই হোক তারা শান্তি চায় না। অশান্তি আর অকল্যাণের পথে নিতে চাওয়া এই গোষ্ঠী আজ উগ্র। তাদের জ্বালায় মানুষ শান্তিতে বসবাস পর্যন্ত করতে পারছে না।

প্রায় এক বছর ধরে এরা আমাদের দেশকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে চলেছে। কোনো কিছুতেই বশ বা শান্ত থাকতে নারাজ। আমরা এ কথা বলি না যে, সরকার ধোয়া তুলসী পাতা। বরং এই সরকারের ভেতর বা ছদ্মবেশী প্র্রগতিবাদীদের ভেতরও অনেক ঝামেলা। তাদের মুখের কথার সঙ্গে অন্তরের ভাবনার মিল নেই। মুখে বললেও নানা স্বার্থে জঙ্গীদের সঙ্গে একাত্ম। এদের কারণে অনেক সহজ সমস্যা জটিলতার বৃত্ত ভাঙতে পারছে না।

প্রধানমন্ত্রী চাইলেও তাঁর দলে, তাঁর চারপাশে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাবিরোধী মানুষরা জঙ্গীবাদ বা ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অবসান চায় না। বাকি বড় দল বিএনপি তো আগাগোড়াই জঙ্গীবাদের দোসর। তারা ছলে-বলে-কৌশলে গদিতে যাবার লোভে এদের পৃষ্ঠপোষক। হবারই কথা। বিএনপির জন্ম ও বেড়ে ওঠার নেপথ্য মদতদাতা জামায়াত। জামায়াতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সর্বনাশ আর মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রহননে অগ্রগামী এই দল ও জঙ্গীবাদ কখন যে সমার্থক হয়ে উঠেছে তারা নিজেরাও জানে না।

ফলে এমন কঠিন বাস্তবতায় দেশ ও জাতির সামনে কিছু মানুষ, তাদের আদর্শ, ব্যক্তিত্ব আর চেতনাই ভরসা। ভরসা সংস্কৃতি, বাঙালি-বোধ আর বিশ্বশান্তির দূতদের প্রকাশ্য ভূমিকা। আগেই বলেছি, রাম-শ্যাম-যদু-মধুর কথা বলা আর আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত গুণী মানুষের কথা বলার ভেতর অনেক ফারাক। আমাদের এই গরীব দেশের পিছিয়ে পড়া সমাজ আর সংকটাপন্ন জীবনের ভেতর থেকে নোবেল পেয়ে মুখ উজ্জ্বল করা মানুষটি আজ কোথায়? কোথায় তাঁর ভূমিকা?

তিনি যে দেশ যে সমাজ ও যে মানুষদের কারণে এই পুরস্কার পেয়েছেন তারাই যদি শান্তিতে না থাকে– তাদের দেশ ও সমাজ যদি মৌলবাদের থাবায় পথ হারায়– তাঁর এই সম্মানের মূল্য কোথায়? তিনি যে তা বোঝেন না তাও নয়। কিন্তু ওই যে গোড়াতে বলছিলাম, কারও কারও মাথা বিক্রিত। তারা যত বড় পুরস্কারই লাভ করুন না কেন, তাদের মগজ বন্ধক পড়ে আছে অন্যত্র। শত বিপদেও তারা মুখ খুলবেন না। খুলবেন কী উপায়ে?

যারা এদের পরিচালক সেই দেশের রাজদূতের ভূমিকা দেখুন। আমাদের দেশে ভোট কীভাবে হবে কে জিতবে কে হারবে, নির্বাচনের দিন গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে তিনি তা তদারকি করলেও অশান্তির প্রতীক ভয়াবহ জঙ্গীদের বিষয়ে তিনি বরফশীতল। যে দেশে প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশ মেরে বন্দি ছিনিয়ে নেওয়া হয়, সে দেশে সে মাটিতে বসবাস করেও তিনি চোখ বন্ধ করে থাকেন। এরাই নাকি বিশ্বব্যাপী জঙ্গীবাদবিরোধী আন্দোলন বা জঙ্গী দমনের নেতা!

একইভাবে আমাদের দেশের সুযোগসন্ধানী সুশীলদের দেখুন। আওয়ামী-বিরোধিতা আর প্রগতি-বিরোধিতায় এদের মুখ-চোখ-নাক-কান খোলা সরব। আর কথায় কথায় গোল-লম্বা-চৌকো টেবিলের দরকার পড়লেও এখন তাদের টুঁ শব্দটি পর্যন্ত নেই। আসলে সব একসূত্রে গাঁথা। রাজদূত মুখ না খুললে গোলটেবিল বসে না। গোলটেবিল না বসলে প্রথম অন্ধকার মুখ খোলে না। আর নোবেলবিজয়ী তো তখন উধাও।

এ জাতীয় আচরণই আমাদের বিপদে ফেলছে। জঙ্গীরা যতটা ভয়াবহ বা বিপজ্জনক এরা তার চেয়ে কম কিছু নয়। বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাই জনাব ড. ইউনূস, এ দেশ ও দেশের মানুষের বিপদে কি আপনার কিছু বলার নেই? কিছু করার নেই? আপনি যদি নিরবতার ভেতর দিয়ে এদের সমর্থন না করে থাকেন সেটা অন্তত খুলে বলুন। অন্যথায় আমরা ভাবতে বাধ্য হবে যে, সব রসুনের কোষ এক জায়গায়। আর তা যদি সত্য হয়, একদিন আপনি বা আপনার মতো বিখ্যাত জনও ছাড় পাবেন না।

অমর্ত্য সেন মোদীর চৌদ্দ গোষ্ঠী ধুয়ে দিলেও তাঁকে কেউ স্পর্শ করতে পারে না, যেমন পারে না আর্চ বিশপ টুটোকেও। কীসের ভয় আপনার? না এ কোনো অলিখিত শর্ত? দেশের ঘোর দুর্দিনে, অশান্তিতে, জঙ্গীবাদের মারাত্মক আক্রমণের পরও আপনি কথা না বললে, সামনে না এলে এই নোবেল একদিন কলঙ্কখচিত মালা হয়ে গলায় ঝুলবে। বাংলাদেশ জানতে চায় আপনি আসলে কার?

সময় ফুরোবার আগেই জবাব দিন। এটাও সময়েরই চাহিদা।