শ্রীপুরের ঘটনাবলী ও যেভাবে চলছে দেশ

হাসান মামুনহাসান মামুন
Published : 7 May 2011, 04:04 AM
Updated : 15 March 2014, 04:29 AM

গাজীপুরের শ্রীপুরে উপজেলা নির্বাচনের আগ মুহূর্তে ক্ষমতাসীন দলের ভেতরকার যে পরিস্থিতি বেরিয়ে এসেছে, এতে তারা নিজেরাও স্বস্তিবোধ করবেন বলে মনে হয় না। ভালো যে, সেখানে রীতিমতো ভোটাভুটি হয়েছিল দল থেকে চেয়ারম্যান প্রার্থী বেছে নেওয়ার প্রশ্নে। কিন্তু এতে যিনি জয়ী হন, তাকে হতে হয় 'বিদ্রোহী প্রার্থী'। তাকে বসিয়ে দিতে একটি আলোচিত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কিছু সদস্য পর্যন্ত জড়িয়ে পড়েন। বিদ্রোহী প্রার্থীকে 'গ্রেফতার' নিয়ে রীতিমতো আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় সেখানে। পার্শ্ববর্তী মহাসড়ক অবরোধ, দু'পক্ষে অস্ত্রবাজি ও তার এক পর্যায়ে দলীয় ছাত্রকর্মী নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটে।

উপজেলা নির্বাচন সম্পন্নের কার্যক্রম যত এগিয়ে গেছে, ততই সহিংসতা বেড়েছে বলে মনে করছেন এর পর্যবেক্ষকরা। আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনাও বেড়েছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন (ইসি) সেভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনেরও আইনগত কর্তৃত্ব রয়েছে। প্রশ্ন হল, তারা নিজেরাই বিতর্কিত কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি সামাল দেবেন কীভাবে?

ওই ধরনের ঘটনা অবশ্য সব ক্ষেত্রে ঘটছে না। মিডিয়ার যে রকম প্রসার ঘটেছে, তাতে নির্বাচনে অনিয়ম চেপে রাখা কঠিন এখন। এ-ও ঠিক, দলীয় সরকারের অধীনেই এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে আর প্রশাসনে রয়েছে ক্ষমতাসীনদের দাপট। আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনাও সরকার-সমর্থিতরা বেশি ঘটাচ্ছেন।

এ কারণেই ইসি প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করছে কিনা, সে প্রশ্ন উঠবে। তবে শ্রীপুরে প্রাণহানিসহ যা ঘটে গেল, তার নিষ্পত্তি হবে আদালতে। ক্ষমতাসীন দলকেও এ বিষয়ে আত্মানুসন্ধান করতে হবে। নিবন্ধটি তৈরির পর খবর মিলল, শ্রীপুরে তৃণমূলের আস্থাভাজন 'বিদ্রোহী'কেই দল-সমর্থিত বলে ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। অনেক দেরিতে ও দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার পর সেখানে এক রকম উপলব্ধির পরিচয় দিলেন তারা। এতে ভোটে কী প্রভাব পড়বে, তা কিন্তু অজানা। ইসি আবার শ্রীপুরে নির্বাচন স্থগিত করেছে তার পরিবেশ নেই বলে।

বিদ্রোহী প্রার্থীর জন্যই উপজেলা নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা খারাপ করছেন কিনা, সে প্রশ্ন অনেকে তুলেছেন এর মধ্যে। একটিমাত্র কারণে কোনো দল খারাপ করে না জেনেও তারা দেখি ওই কারণ খুঁজে বের করেন। এতে সংশ্লিষ্ট দল সন্তুষ্ট না হলেই ভালো। একাধিক কারণে জনমত যে তাদের বিরুদ্ধে বইছে, সেটি বোধহয় ক্ষমতাসীন দলের কর্তাব্যক্তিরা জানেন। চলমান নির্বাচনের ফল দেখে তাদের অবাক বলে কিন্তু মনে হচ্ছে না। স্বভাবতই তারা চেষ্টা করছেন পরবর্তী নির্বাচনগুলোয় পরাজয় অন্তত সহনীয় পর্যায়ে রাখতে। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে জায়গায় জায়গায় যেন শ্রীপুরের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে দলের হাইকমান্ডকে।

সাধারণভাবে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব খারাপ বলে মনে হয় না। এদিকে বিএনপি জোটের নতুন করে আন্দোলন গড়ে তোলার প্রচেষ্টা লক্ষণীয় নয়। উপজেলা নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হচ্ছে ধাপে ধাপে। পুলিশ ও র‌্যাব চাইলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা তাদের পক্ষে কঠিন নয়। তাদের নিয়ন্ত্রক সরকারকে এটি চাইতে হবে।

ক্ষমতাসীন দলকেও পেতে হবে তেমন নির্দেশনা। দল-পরিচালনার নীতি রাতারাতি বদলাবে, এটি আশা করা যায় না। মধ্যমেয়াদেও বদলাবে না বলে ধরে নিতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে বদলাবে কিনা, সেটাও বলা যাচ্ছে না। ক্ষমতাসীনদের প্রতিপক্ষ দলও একই নীতি অনুসরণ করে চলেছে। সেখানেও তৃণমূলের মতামত নেওয়া হয় না বা তার কোনো দাম নেই। উপজেলা নির্বাচনে এদের মধ্যেও প্রচুর বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। কেউ কেউ জিতেও আসছেন।

এ নির্বাচন শেষ হতে হতে দেশের রাজনীতিতে কী পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, তা বলা কঠিন। এটুকুই বলা যায়, বিএনপি জোট দ্রুত আন্দোলন রচনার পথে নেই। তারা দল গোছাচ্ছেন এবং জোটে বাড়াচ্ছেন সমন্বয়। এর মধ্যে দেশের মানুষ ও বিশ্ব সম্প্রদায়কে তারা বোঝাতে চাইছেন যে, সরকার যেভাবে ক্ষমতাসীন হয়েছে, তাতে জনগণের সায় নেই। কিন্তু সায় না থাকলেও এ সরকার তো দেশ পরিচালনা করে চলেছে। প্রক্রিয়াটিকে 'অবৈধ' বলা যাবে না।

বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশ ও গোষ্ঠী যে এ সরকারের সঙ্গে কাজের ক্ষেত্রে অস্বস্তিতে রয়েছে, তাদের মুখ থেকেও সেটি নিঃসৃত হচ্ছে মাঝেমধ্যে। কিন্তু তারাও সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন না বা তুলতে পারছেন না। সম্প্রতি ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) মহাসচিব বাংলাদেশ সফরে আসেন। তিনি ধর্মীয় জঙ্গিবাদ প্রশ্নে যে বক্তব্য রেখে গেছেন, তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মিল লক্ষ্য করবেন অনেকে। খালেদা জিয়া অফিসিয়ালি আর বিরোধী নেত্রী নন বলে তার সঙ্গে ওআইসি মহাসচিবের সাক্ষাৎ নিয়ে বরং বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়।

বিএনপির সঙ্গে মুসলিম বিশ্বের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবেই ভালো। বর্তমান সরকার সেটি ধরে রাখার ক্ষেত্রে যে সফল, তা বলা যাবে না। আর কিছু না হলেও জনশক্তি রফতানির জন্য ওইসব দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা জরুরি। মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক, বিশেষত রফতানি বাড়ছে। পশ্চিমা অর্থনীতি যখন পেরোচ্ছে সংকটকাল, তখন তেলসম্পদে সমৃদ্ধ মুসলিম দেশগুলোর হাতে কিন্তু টাকাপয়সা কম নেই।

ভারত তাদের সঙ্গে কম ব্যবসা করছে না। চাইলে আমরাও এর সুযোগ নিতে পারি। মাঝে একটি বাংলা বিজনেস ডেইলি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যে, মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে দৃষ্টি নেই সরকারের। সম্পর্ক মেরামতের প্রয়োজনও উপস্থিত হতে দেখা যায়। গণতন্ত্রের অভিজ্ঞতা ও এ বিষয়ে আগ্রহ কম বলে আমরা কিন্তু দেখছি, বাংলাদেশে হয়ে যাওয়া নির্বাচনের মান বা সরকারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে তাদের উল্লেখযোগ্য বক্তব্য নেই।

এ ক্ষেত্রে বিএনপিও তাকিয়ে আছে পশ্চিমা বিশ্বের দিকে। তাদের কূটনীতিকদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা কম করছে না। উপজেলা নির্বাচনে জনমত পক্ষে থাকার বিষয়টি স্পষ্ট হলেও সে চেষ্টা অব্যাহত রাখছে বিএনপি। এটা আমাদের রাজনীতির দৈন্যই প্রকাশ করে কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক করা যাবে। এতে রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলাবে না।

গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি সামনে এনে সেটি আদায়ের প্রয়াস বিএনপি নতুন করে চালাবে, এটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে তারা পুরনো ধারায় চলবেন না বলেও আশা করব। পুরনো ধারা কী ছিল, সেটি আর স্মরণ করতে চাই না। এতে কে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার মূল্যায়ন হচ্ছে এখন। বিএনপিও চিন্তা করে দেখুক, এতে দল হিসেবে তারা আদৌ লাভবান হয়েছেন কিনা। উপজেলা নির্বাচনে ভালো করলেও বিএনপি ও জোটসঙ্গী জামায়াত মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি জোরেসোরে তুলতে পারছে না, এটি কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি।

দ্রুত জাতীয় নির্বাচন আদায় করা যাবে বলে তারা নিজেরাও মনে করেন না। নেতাদের 'বডি ল্যাঙ্গুয়েজ' দেখে তা-ই মনে হচ্ছে। নবগঠিত সরকারকে বেশি চটাতে চাচ্ছেন বলেও মনে হয় না। তারা জানেন, দুর্বল ম্যান্ডেটের সরকার বেশি আক্রমণাত্মক হয়। এ ধরনের সরকার দ্রুত সংকটেও পড়ে যায় অবশ্য। সেজন্য দেশ-পরিচালনায় তাদের অতিসতর্কতা কাম্য। 'হানিমুন পিরিয়ড' তাদের নেই বললেই চলে। তবে সরকারের জন্য আশার দিক হল, কয়েক মাসের জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন সত্ত্বেও অর্থনীতি খুব সংকটে নেই।

রাজস্ব আহরণে ঘাটতি দেখা দেওয়ায় তারা এর লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি কাটছাঁটের মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবেলা করছেন এখন। এ নিয়ে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে মন-কষাকষির খবর রয়েছে অবশ্য। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তার 'নিষ্পত্তি' হয়ে যাবে নিশ্চয়ই। রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয়ে আসায় বিনিয়োগও বেড়ে উঠবে। ব্যাংকে তো অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে। এ ধরনের সরকার বিদেশি সাহায্য লাভে সাফল্য দেখাতে না পারলেও এ সময়ে কিন্তু বিনিয়োগ আসতে পারে।

মিয়ানমারসহ এশিয়ার কয়েকটি 'উদার' হতে থাকা দেশে নামকরা বিদেশি কোম্পানিগুলো বিরাট আগ্রহ নিয়ে আসছে। বাংলাদেশ তাদের কাছে কম আকর্ষণীয় বলে বিবেচিত হওয়ার কথা নয়। মানসম্মত গণতন্ত্র বা মানবাধিকার নয়, তাদের কাছে মূখ্য হল বিনিয়োগ ও ব্যবসার পরিবেশ। অবকাঠামো বরং জরুরি তাদের কাছে। অবকাঠামো উন্নয়নেও বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারে সরকার– দুর্বল ম্যান্ডেট নিয়েও।

বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূতও সম্প্রতি যেভাবে কথা বললেন, তাতে মনে হল এখানকার রাজনীতির চেয়ে বাণিজ্যেই বেশি আগ্রহী তারা। বিনিয়োগেও আগ্রহ রয়েছে চীনাদের। এ অঞ্চলে তাদের ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবা হয়। বর্তমান সরকার নাকি চাইছে এশিয়ার এ দুই উদীয়মান শক্তিকে বাংলাদেশে এনে মেলাতে। সেটি সম্ভব হলে যুক্তরাষ্ট্রকে গুরুত্ব না দিয়ে চলার নীতিও উৎরে যাবে। এটি অবশ্য ঝুঁকিপূর্ণ কৌশল বলে বিবেচিত হচ্ছে।

জনমত বিপুলভাবে পক্ষে থাকলে এমন কৌশলে 'ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা' সহজ হয়ে পড়ে। ২০০৮-এর নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীনদের জন্য সে পরিস্থিতি ছিল বৈকি। এখন তা ভিন্ন। সুশাসনে অগ্রগতি এনেই তারা পারেন এ ক্ষেত্রে বিরোধীদের সঙ্গে একটা 'উইন-উইন' সিচুয়েশন তৈরি করতে। সেটি ঘটার আগ পর্যন্ত তারা অন্তত নির্বাচনে যেতে চাইবেন না।

এমনটিও বলতে থাকবেন যে, জাতীয় নির্বাচন তো পাঁচ বছর পর অনুষ্ঠিত হবে! এ পরিস্থিতিতে সরলভাবে মন্তব্য করার সুযোগ অনুপস্থিত বলেই মনে হচ্ছে।

হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলামিস্ট।