সড়ক নিরাপত্তা দশকে আমাদের করণীয়

অপূর্ব সাহা
Published : 9 March 2014, 02:30 PM
Updated : 9 March 2014, 02:30 PM

১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪। যশোরের চৌগাছার ঝাউতলা এলাকায় রাত সাড়ে আটটার দিকে একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। যে বাসটি দুর্ঘটনায় পতিত হয সেটি ছিল একটি পিকনিক বাস। বেনাপোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তিনটি বাসে করে সকালে মেহেরপুরের মুজিবনগরে পিকনিকে করতে গিয়েছিল। ফেরার পথে ঝাউতলা ইটভাটার কাছে মাটিবাহী একটি ট্রাককে পাশ কাটাতে গিয়ে একটি বাস পাশের পুকুরে পড়ে যায়।

পিকনিক বাসের নিহত যাত্রীদের বয়স সাত থেকে এগারোর মধ্যে। ছোট ছোট এই শিশুদের লাশের ছবি বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছে। দেখে মনে হয়, নিষ্পাপ এই শিশুরা বুঝি ঘুমিয়ে আছে। গোটা দেশ এই ঘটনায় শোকে স্তব্ধ হয়ে যায়। আগেও স্কুলশিক্ষার্থীদের বহনকারী যানের এমন দুর্ঘটনায় পড়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে ফেব্রুয়ারিতে চৌগাছার ওই দুর্ঘটনার শিকার শিশুদের বয়স এতই কম যে, এই মৃত্যু মেনে নিতে কষ্ট হয়েছে সবার।

এভাবে নানা দুর্ঘটনার নানা বয়সী মানুষের মৃত্যুর মিছিল আমরা সবসময়ই দেখে এসেছি। নভেম্বর ৯, ২০১৩। আসন্ন উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থী মতিঝিল আইডিয়াল কলেজের একজন ছাত্রী কলেজ থেকে টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে রিকশাযোগে বাসায় ফিরছিল্। পথে মতিঝিল শাপলা চত্বরের কাছে একটা ডাবল ডেকার বাস ধাক্কা দিল রিকশাটিকে। প্রাণ হারাল মেয়েটি। আমাদের মনে আরও একটা ক্ষত তৈরি হল। ১২ অক্টেবরের ঘটনার ক্ষত তখনও দগদগে, যেদিন কমলাপুরে র‌্যাব কর্মকর্তার স্ত্রী বাসের ধাক্কায় প্রাণ হারালেন। কিংবা ২৪ সেপ্টেম্বর, যেদিন সাঁইত্রিশ বছর বয়সী এক মা রায়েরবাগে তার ছোট্ট শিশুকন্যার চোখের সামনে বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে গেলেন।

এইভাবে আমরা যত পেছনের দিকে যেতে থাকব, ততই হারিয়ে যেতে থাকব সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের ভিড়ে। একদিকে লাশের মিছিল, অন্যদিকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারানো মানুষের পঙ্গুত্বের দীর্ঘশ্বাস। এই দীর্ঘশ্বাস বয়ে যাচ্ছে ঢাকা মহানগর থেকে দেশের প্রতিটি মহাসড়ক ধরে অলি-গলি পর্যন্ত। সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনাকে তাই তো কখনও বলা হচ্ছে 'মানব-সৃষ্ট দুর্যোগ', কখনও 'নিঃশব্দ মহামারি'।

সরকারি হিসাবমতে, দেশে প্রতি বছর ৩০০০ এর বেশি প্রাণহানি ঘটছে, যেখানে আরও কয়েক হাজার মানুষ বরণ করছে পঙ্গুত্ব। যদিও প্রাণহানির সংখ্যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রাক্কলন অনুযায়ী বছরে ১৭,২৮৯ জন। সড়ক দুর্ঘটনার আগ্রাসী আর্থ-সামাজিক প্রভাব, আইনি কাঠামো, করণীয় ইত্যাদি নিয়ে আলোচনার পূর্বে আসুন আমরা একটু দেখে নিই এটা কী মাত্রায় গ্রাস করে ফেলেছে সারা পৃথিবী।


সড়ক দুর্ঘটনা: বিশ্ব ও বাংলাদেশ

সড়ক দুর্ঘটনা এবং তার আর্থ-সামাজিক প্রভাব এতটাই ব্যাপক আর ভীতিপ্রদ যে, বৈশ্বিকভাবে একে অন্যতম উদ্বেগের বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রণীত সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ক 'গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট ২০১৩' সড়ক দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিকে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ও উন্নয়নের সমস্যা হিসেবে ব্যাখ্যা করেছে। বিশ্বে প্রতি বছর দুর্ঘটনায় মারা যায় ১.২ মিলিয়ন মানুষ; আর আহতের সংখ্যা ২০ থেকে ৫০ মিলিয়ন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, নিম্ন ও মধ্যম-আয়ের দেশগুলোতে হতাহতের সংখ্যা (প্রতি ১ লাখ মানুষে যথাক্রমে ২১.৫ ও ১৯.৫ জন) উচ্চ-আয়ের দেশগুলোর (১০.৩ জন) তুলনায় অনেক বেশি। লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হচ্ছে, সারাবিশ্বের রেজিস্ট্রিকৃত যানবাহনের মাত্র ৪৮ শতাংশের শেয়ার নিয়ে নিম্ন ও মধ্যম-আয়ের দেশগুলোকে ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনার দায় কাঁধে নিতে হচ্ছে। গত ৪ থেকে ৫ দশক ধরে উচ্চ-আয়ের দেশগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে; তথাপি এসব দেশে এখনও সড়ক দুর্ঘটনাকে মৃত্যু, আঘাত ও পঙ্গুত্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

যারা রাস্তায় মারা যান তাদের অর্ধেক হচ্ছেন পথচারী, সাইক্লিস্ট ও মোটরসাইক্লিস্ট– যাদের অভিহিত করা হয়ে থাকে 'ঝুঁকিপূর্ণ সড়ক ব্যবহারকারী' হিসেবে। কিন্তু স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে এভাবে মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি।

নিম্ন ও মধ্যম-আয়ের দেশগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা যেমন ক্রমাগত বাড়ছে, তেমনি দ্রুত গতিতে বাড়ছে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি। উদাহরণস্বরূপ, সাম্প্রতিককালে জাম্বিয়ার অর্থনীতিতে সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তাদের জিডিপির ৩ শতাংশ।

অর্থনীতিতে সড়ক দুর্ঘটনার দৃশ্যমান (tangible) ও অদৃশ্যমান (intangible) উভয় ধরনের ক্ষতি রয়েছে। দৃশ্যমান ক্ষতির মধ্যে রয়েছে– যানবাহনের ক্ষয়-ক্ষতি (প্রতিস্থাপন ও মেরামত খরচ), প্রশাসনিক খরচ, চিকিৎসা-ব্যয়, মৃত্যু কিংবা আহত হওয়ার কারণে উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাওয়া, বীমা-খরচ ইত্যাদি। অন্যদিকে অদৃশ্যমান ক্ষয়-ক্ষতির মধ্যে রয়েছে– যন্ত্রণা, দুর্দশা, দুর্ভোগ এবং দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার ঝুঁকি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া তথ্যমতে, সড়ক দুর্ঘটনার কারণে বাংলাদেশে জিডিপির ক্ষতির পরিমাণ ১.৬ শতাংশ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০০৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন মোট ২৯৫৮ জন (পুরুষ-৮৫ শতাংশ; নারী-১৫ শতাংশ)। সড়ক ব্যবহারের ধরন অনুযায়ী ভাগ করলে দেখা যায়, এদের ৪১ শতাংশ পথচারী, ১৯ শতাংশ কার ও হালকা যানবাহনের যাত্রী, ১৬ শতাংশ ২ অথবা ৩ চাকার মোটরযান চালক, ৯ শতাংশ বাসের চালক ও যাত্রী, ৪ শতাংশ কার ও হালকা যানবাহনের চালক এবং ৩ শতাংশ সাইক্লিস্ট।

৪১ শতাংশ পথচারী এবং দুর্ঘটনার শিকার অন্যান্য শ্রেণির ব্যক্তিদের একটা বড় অংশ হচ্ছে, সমাজের নিম্ন কিংবা মধ্যম-আয়ের মানুষ। ফলশ্রুতিতে, দুর্ঘটনার পর কেউ মারা গেলে বা পঙ্গু হয়ে গেলে, পরিবারকে চিকিৎসার জন্য দীর্ঘমেয়াদে একটা বড় ধরনের ব্যয়ভার বহন করতে হয়; আর নয়তো মৃত্যুর ক্ষেত্রে পুরো পরিবারটিই হয়ে পড়ে আর্থিকভাবে বিপদাপন্ন। পরিস্থিতির চাপে পড়ে, পরিবারগুলো দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর বা অতিদরিদ্রে পরিণত হয়।

সড়ক নিরাপত্তায় আইন ও নীতি: বাংলাদেশের অবস্থান

বাস স্টেশন, ফেরি টার্মিনাল ও স্টপেজগুলো অপরিকল্পিতভাবে প্রতিষ্ঠিত যা পরিবহণ খাতের ব্যাপক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। অপরিকল্পিত বাস-রুট, যুক্তিহীনভাবে অবস্থিত বাস-স্টপসমূহ, বিভিন্ন ইন্টারসেকশনের কাছাকাছি মালামাল এবং যাত্রী ওঠানামা করানোর কারণে অযথা যানজটের সৃষ্টি হয় এবং যাত্রীদের ফেলে দেয় মারাত্মক দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে। বাস-রুটের পুনঃপরিকল্পনা, বাস স্টেশন ও স্টপেজগুলোর অবস্থান পরিবর্তনের জন্য সরকারের প্রয়োজন এমনভাবে গণপরিবহণ পরিকল্পনা হাতে নেওয়া, যাতে অধিকতর সমন্বয় এবং সর্বোপরি যাত্রী-নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। বিক্ষিপ্তভাবে কিছু পরিকল্পনা নেওয়া হলেও, প্রকৃতপক্ষে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন চোখে পড়ছে না।

রাস্তায় উন্নত পর্যায়ের নিরাপত্তা এবং নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার বিষয়টি অনেকগুলো উপাদানের উপর নির্ভর করে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, ট্রাফিক আইন-কানুনের কার্যকরী প্রয়োগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তার স্ট্যাটাস রিপোর্টে বাংলাদেশে আইনের প্রয়োগ সম্পর্কে যা বলছে তা অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। সংস্থার র‌্যাংক অনুযায়ী, আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শূন্য থেকে নয় স্কেলে ৩ বা ৪ নম্বর অবস্থানে আছে।

অন্যদিকে আইনের পর্যাপ্ততা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। আইন বলতে তো মহাসড়ক (নিরাপত্তা, সংরক্ষণ ও চলাচল নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০১ (হাইওয়ে অ্যাক্ট ১৯২৫ এর ৪ ধারার প্রদত্ত ক্ষমতাবলে প্রণীত) এবং মোটর ভেহিকেল অধ্যাদেশ ১৯৮৩, যেখানে নানাবিধ নিয়ম লঙ্ঘনের দণ্ড এককথায় বলা যায় 'নামমাত্র'। বিষয়টি অনুধাবন করে বাংলাদেশ সরকার 'রোড ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড ট্রাফিক অ্যাক্ট' শিরোনামে একটি নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। খসড়া হয়েছে। কিন্তু আইনটি আজও আলোর মুখ দেখেনি, যদিও উদ্যোগ শুরু হয়েছিল সেই ১৯৯৬ সালে।

অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ক্ষেত্রে দেখা যায়, সড়ক নিরাপত্তা সংক্রান্ত নেতৃত্বদানকারী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল। কাউন্সিলে জাতীয় বাজেট থেকে অর্থায়ন করা হয় না। তাছাড়া প্রতি ছয়মাস পর পর কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও, প্রয়োজনীয় গতিশীলতার অভাব ও সমন্বয়হীনতার কারণে কখনও কখনও তা অনুষ্ঠিত হতে বছর পার হয়ে যায়।

নিরাপদ সড়ক আন্দোলন: বাংলাদেশের অবস্থান

সারাবিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের প্রেক্ষাপটে, জাতিসংঘের সাধারণ সভা ২০১১-২০২০ সালকে সড়ক নিরাপত্তা দশক (Decade of Action) ঘোষণা করেছে। ২০১১ সালের ১১ মে ১০০টিরও বেশি দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়, যার লক্ষ্য ২০২০ সাল নাগাদ সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ মিলিয়ন মানুষের মুত্যু রোধ করা। দশকওয়ারি বৈশ্বিক পরিকল্পনা থেকে জাতীয় কর্মোদ্যোগে এসে অনেক দেশ সড়ক নিরাপত্তা উন্নীত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যার মধ্যে রয়েছে সম্পূর্ণ দশকের জন্য জাতীয় কর্মপরিকল্পনা তৈরি (যেমন- অস্ট্রেলিয়া, মেক্সিকো, ফিলিপাইন), নতুন আইন প্রণয়ন (যেমন- চিলি, চীন, ফ্রান্স, হন্ডুরাস) এবং বিদ্যমান আইনসমূহের বাস্তবায়ন জোরদার (যেমন- ব্রাজিল, কম্বোডিয়া, রাশিয়ান ফেডারেশন)।

সড়ক নিরাপত্তা দশকের সঙ্গে বাংলাদেশ একাত্মতা ঘোষণা করেছে। 'ন্যাশনাল রোড সেফটি স্ট্র্যাটিজিক অ্যাকশন প্লান ২০১১-২০১৩'-র দিকে তাকালে বোঝা যায়, সড়ক নিরাপত্তা আমাদের কম প্রাধান্য নয়। এই পরিকল্পনার ভিশন স্থির করা হয়েছে, আগামী ১০ বছরের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের পরিমাণ ৫০ শতাংশ হ্রাস করা এবং সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ ৩০ শতাংশ কমিয়ে আনা। আর লক্ষ্য হচ্ছে, ২০১৩ সালের শেষ নাগাদ বার্ষিক সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হ্রাস করা।

বাংলাদেশে এটি ষষ্ঠ পরিকল্পনা। এই কর্মপরিকল্পনায় বাংলাদেশে সড়ক নিরপত্তার বিভিন্ন সমস্যা নিরসনে ন'টি ভিন্ন ভিন্ন খাতে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। খাতগুলো হচ্ছে–

১. সড়ক নিরাপত্তা সংক্রান্ত পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়;

২. সড়ক দুর্ঘটনা বিষয়ক ডাটা সিস্টেম বা উপাত্ত সংরক্ষণ ব্যবস্থা;

৩. সড়ক নিরাপত্তা প্রকৌশল;

৪. সড়ক ও যানবাহন সংক্রান্ত আইন;

৫. ট্রাফিক এনফোর্সমেন্ট;

৬. চালকদের প্রশিক্ষণ ও পরীক্ষা;

৭.যানবাহনের নিরাপত্তা;

৮. সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ক শিক্ষা ও প্রচার;

৯. সড়ক দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের চিকিৎসাসেবা।

এই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য দায়-দায়িত্ব বণ্টন করে দেওয়া হয়েছে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল, বিআরটিএ, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, এলজিইডিসহ অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে।

২০১৩ সাল তো শেষ হয়ে গেছে। অর্জন কতটুকু হয়েছে তা খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। তবে দৃষ্টিশক্তি প্রয়োগ করে যা প্রতীয়মান হচ্ছে, তা সন্তুষ্টি-বিন্দু থেকে অনেকটা দূর।

এ মুহূর্তে যা প্রয়োজন

পৃথিবীর যেসব দেশে সড়ক নিরাপদ রাখার জন্য কোনো আচরণবিধি বা কোড নেই, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। এ ধরনের আচরণবিধি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পৃথিবীর অধিকাংশ উন্নত দেশেই রয়েছে এবং দেশের প্রতিটা নাগরিক তা যথাযথভাবে মেনেও চলেন। নিরাপদ সড়ক আচরণবিধি হচ্ছে সেই ডকুমেন্ট, যেখানে কোন্ আইনের কোন্ ধারা লঙ্ঘনে কী ধরনের দণ্ড রয়েছে তা উল্লেখ করাসহ সড়কে চলাচলকারী বিভিন্ন যানবাহনের চালক, হেলপার, যাত্রী, পথচারী, ট্রাফিক পুলিশসহ সব ধরনের রাস্তা ব্যবহারকারী কোন্ পরিস্থিতিতে কী ধরনের আচরণ করবে তা বর্ণিত থাকে।

এখানে একটা প্রশ্ন আসতে পারে, আমাদের দেশে এ রকম একটা আচরণবিধি না হয় তৈরি হল, কিন্তু অন্যান্য আইনের মতো সেটাও যে বইয়ের পৃষ্ঠায় আটকে থাকবে না তা কে বলতে পারে? ঠিক তাই। এই আচরণবিধি কীভাবে জনসাধারণের মাঝে প্রচারণার মাধ্যমে জনপ্রিয় করে তুলতে হবে, প্রচারণার দায়িত্বে কারা থাকবে, কীভাবে পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, গাড়িচালনা শেখার স্কুলগুলোতে কীভাবে বাধ্যতামূলক পাঠ্য করতে হবে ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে সেখানে সময়ানুগ এবং সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে। আচরণবিধি কতখানি আইন আমি জানি না, তবে মানুষকে আইনমুখী করার জন্য এটা হতে পারে অত্যন্ত শক্তিশালী এক হাতিয়ার।

পরিশেষে

গণমাধ্যম গণজাগরণের হাতিয়ার। জাতির বিভিন্ন ক্রান্তিকালে গণমাধ্যম 'মুশকিল আসান' হিসেবে কাজ করেছে। কী প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কী রাজনৈতিক অস্থিরতা, কী অন্যান্য আপদকালীন সময়– সর্বদা বাংলাদেশের গণমাধ্যম সেগুলো উত্তরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে আসছে। তাদের অতন্দ্র প্রহরীর মতো ভূমিকা পালনের কারণে বাংলাদেশে সামাজিক ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলন, তা আজ ভীষণভাবে বেগবান।

আর সড়ক দুর্ঘটনা যে এখন আর নিছক দুর্ঘটনা নয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা মনুষ্যসৃষ্ট এক দুর্যোগে পর্যবসিত হয়েছে– এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি দুর্ঘটনামুক্ত নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অন্যতম অনুঘটক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে মিডিয়া। কখনও কখনও সড়কে অপূরণীয় ক্ষতি বা অসহনীয় ট্র্যাজিডির প্রেক্ষাপটে আমরা দেখেছি, গণমাধ্যমের তেজস্বী ভূমিকা। মিরেরসরাই ট্র্যাজিডি কিংবা তারেক মাসুদ-মিশুক মনিরের অকালপ্রয়াণের পর জনগণকে তীব্রভাবে আন্দোলিত হতে দেখেছি, মিডিয়ার কল্যাণে।

সেসব আন্দোলন কিন্তু ব্যর্থতায় গিয়ে শেষ হয়নি। সিদ্ধান্তগ্রহীতাদের বাধ্য করেছে সড়ক নিরাপদ করার জন্য নানাবিধ পরিকল্পনা হাতে নিতে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ৪ লেনে উন্নীতকরণ থেকে শুরু করে ঢাকা-মানিকগঞ্জ সড়কে দুর্ঘটনাপ্রবণ ব্ল্যাক-স্পট দূরীকরণ, ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের উন্নয়ন ইত্যাদি সেসব পরিকল্পনারই অংশ। ঢাকা মহানগরীর দুঃসহ যানজট নিরসনকল্পে একের পর এক মাথা তুলছে ফ্লাইওভারসহ যেসব অবকাঠামো, সেখানে মিডিয়ার ভূমিকা অগ্রগণ্য।

কোনো কোনো মিডিয়া হাউজ ইতোমধ্যে সড়ক নিরাপত্তা ইস্যুতে প্রাধান্য দিয়ে এ সংক্রান্ত কাভারেজের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে। এখানেই শেষ নয়, সড়ক নিরাপদ করার জন্য চলমান বিভিন্ন গবেষণায় অন্যতম তথ্যসূত্র হিসেবে কাজ করে গণমাধ্যম। কারণ দুর্ঘটনা সংশ্লিষ্ট সরকারি উপাত্ত প্রকৃত সংখ্যা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে। আর সেই দূরত্ব কমিয়ে দেয় গণমাধ্যম।

পরিশেষে আশাবাদ, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের অন্যতম কাণ্ডারী গণমাধ্যমের জোরালো ভূমিকা এবং সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ একদিন আমরা একটা নিরাপদ সড়ক আচরণবিধি হাতে পাব, যা সড়কে অযাচিত দুর্ঘটনা বা বিপত্তি থেকে মুক্ত করার প্রচেষ্টায় অন্যতম অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে। পাশাপাশি, সড়ক নিরাপত্তা বিষয়টি উন্নয়নের মূলধারার কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে সরকারি কর্মপরিকল্পনায় বিশেষ গুরুত্ব পাবে।

অপূর্ব সাহা: ব্যবস্থাপক, ব্র্যাক সড়ক নিরাপত্তা কর্মসূচি।