সবিতা চাকমার পর কে

রাহমান নাসির উদ্দিন
Published : 2 March 2014, 07:34 PM
Updated : 2 March 2014, 07:34 PM

"খাগড়াছড়ির সবিতা চাকমার লাশ পাওয়া গেছে সবজি ক্ষেতে। তার দেহে আঘাতের চিহ্ন এবং তাকে অনেকটা বিবস্ত্র অবস্থায় পাওয়া গেছে। এতে বোঝা যায় তাকে ধর্ষণের পর নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে। স্থানীয় পুলিশ এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত অপরাধীদের কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।"

এটা হচ্ছে একটা কমন স্টোরি-লাইন, যা পাহাড়ি আদিবাসী নারীদের জীবন, ধর্ষণ এবং মৃত্যুর (মানে খুন বা হত্যার) বিবরণ দিতে গিয়ে সর্বদা আমাদের সামনে উপস্থাপিত হয়। প্রতিবারই এ ধরনের ঘটনা ঘটে, ঘটনার পরবর্তীতে স্থানীয়ভাবে কিছু পাহাড়ি আদিবাসী সংগঠন প্রতিবাদ মিছিল করে, দোষীদের দ্রুত গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন করে। তার ধারাবাহিকতায় এবং এ দাবির সমর্থনে রাজধানীতে কিছু প্রতিবাদ-প্রদর্শনী হয়, দুয়েকজন বাঙালি মানবাধিকার কর্মীসহ ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিবাদকারীর ছবি সংবাদপত্রে ছাপা হয়। অতঃপর চ্যাপ্টার 'ক্লোজড'।

এভাবেই চলছে সবকিছু, দীর্ঘদিন থেকে এবং এটাই হচ্ছে পাহাড়ি কিংবা সমতলের আদিবাসী নারীর ওপর নির্যাতন, ধর্ষণ এবং মৃত্যুর দৃশ্যমান ঘটনাক্রম, ঘটনার ইতিবৃত্ত এবং ঘটনার ইতি। আর আমরা শহুরে-নাগরিক-মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত, এবং সংবাদপত্র পড়নেওয়ালারা আর দশটা গড়পড়তা সংবাদের মতই এ ঘটনা একটি সাধারণ নিউজ-আইটেম হিসেবে পাঠ করি; একটু সংবেদনশীল হলে হা-হুতাশ করি এবং অতঃপর সংবাদপত্রের পৃষ্ঠা উল্টিয়ে পরের পৃষ্ঠায় অন্য সংবাদে চলে যাই।

ইদানিং ইন্টারনেটের ক্রমবর্ধমান প্রসারের ফলে, এ ঘটনার সংবাদ সম্পর্কিত কিছু লিংক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, বিশেষ করে ফেসবুকে, কোনো-না-কোনোভাবে চলে আসে। আর আমরা সকলে না হলেও, কেউ কেউ দেখেশুনে 'লাইক' মারি। আমাদের এসব রুটিন রিচ্যুয়াল দেখে সবিতা চাকমা কিংবা তার মতো ভয়ংকর অভিজ্ঞাতার ভেতর দিয়ে পরপারে পাড়ি দেওয়া আরও অনেক আদিবাসী নারী এবং তাদের বিদেহী আত্মা আমাদের জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আমাদের ভোঁতা-চেতনা, নির্জীব-বিবেক এবং নির্বিরোধ-মানসিকতার প্রতি ঘৃণা ও করুণা নিক্ষেপ করে।

আর আমরা সে ঘৃণা ও করুণার প্রতিক্রিয়াহীন ভোক্তা হিসেবে, সবিতা চাকমার আরেক উত্তরসূরীর জন্য অচেতন মনে অপেক্ষা করি। যেভাবে আমরা অপেক্ষা করেছি সবিতা চাকমার ঘটনার জন্য, তুমাচিং মারমার ঘটনার পর। কেননা ২০১২ সালের ডিসেম্বরের ২১ তারিখ রাঙামাটিতে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী চৌদ্দ বছরের কিশোরী তুমাচিং মারমাকেও এভাবে ধর্ষণ ও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। তখনও একই রুটিন-কার্যক্রম চলেছিল।

এভাবেই চলছে এবং হয়তো চলবে আদিবাসী নারীদের জীবন ও মৃত্যুর পরম্পরা। আমি নিজেও কোনো-না-কোনোভাবে এ প্রক্রিয়া, প্রতিক্রিয়া এবং সিস্টেমের একজন হিসেবে লজ্জাবোধ করি এবং সংবাদপত্রের দু'কলম লিখে অক্ষম আহাজারি করি। কিন্তু রাষ্ট্রের কর্ণকুহরে কোনো কিছু যায় বলে মনে হয় না।

এ ঘটনার বিচার-বিশ্লেষণ এবং ব্যাখ্যা করবার জন্য রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের দায়িত্ব-কর্তব্য, নাগরিকতার প্রশ্ন, নাগরিক-নিরাপত্তা এবং ভিন্ন-সংস্কৃতির রাজনীতি প্রভৃতি বিষয় সামনে নিয়ে এসে, একটি আধুনিক উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যে ধারণা এবং আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যে সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি– সে দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতে হবে। বাংলাদেশ আদৌ উদার গণতান্ত্রিক, বহুজাতির, বহুভাষাভাষীর, বহুধর্মের মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক সমানাধিকারের নিশ্চয়তা প্রদানকারী কোনো রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে কিনা সেটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে।

কেননা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ধ্রুপদি সংজ্ঞার কাঠামোই একটা নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, একটা সরকার, সার্বভৌমত্ব এবং একদল জনগোষ্ঠী থাকলেই সেটা রাষ্ট্র হয়ে উঠে না। কাগজে-কলমে লেখা রাষ্ট্রের ধরন আর মানুষের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে প্রতিভাত রাষ্ট্রের চরিত্র এক নয়। সংবিধান হচ্ছে সবসময় কিছু 'গান্ধীবাদী', 'মহামানবীয়' এবং 'বিবেকানন্দ' ঘরানার নরমেটিভ ও অবজেকটিভ ট্রান্সক্রিপ্ট, যার প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন রাষ্ট্রের মতো একটি সাবজেকটিভ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব কিনা সেটা সংবিধান রচনার সময় ধর্তব্যের মধ্যে নেওয়া হয় না। এই যে তত্ত্ব ও প্রয়োগের ফারাকের বিষয়টি জেনেও সংবিধানে নানান আদর্শবাদী কথাবার্তা লেখা হয়, আমজনতার সঙ্গে এটা এক ধরনের প্রতারণা; বিশেষ করে যে সংবিধান জনগণকে রাষ্ট্রের মালিক বলে স্বীকার করে।

সেটা ভিন্ন বিতর্ক। তবে খুবই সাধারণ বিবেচনায় আমরা বুঝি যে, রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে, প্রকারান্তরে মালিক হিসেবে, সাধারণ জনগণের জানমালের হেফাজত করা। কিন্তু রাষ্ট্র সেটা কতটুকু করে বা করতে পারে সেটার পাশাপাশি জরুরি হয়ে উঠে সে নাগরিকের জাত-বর্ণ-ধর্ম এবং শ্রেণিপরিচয়। তাই সবিতা চাকমা যখন ধর্ষিত হয় এবং ধর্ষণের পর নির্মমভাবে খুন হয়, রাষ্ট্র তখন তার যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে প্রত্যাশিত ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসে না। একদিকে তো সবিতা চাকমার মান-মর্যাদা এবং সম্ভ্রমরক্ষায় রাষ্ট্র পুরোপুরি ব্যর্থ; অন্যদিকে একটি স্বাভাবিক জীবন যাপন করবার নিরপত্তা দিতেও রাষ্ট্রের অক্ষমতা আমাদেরকে এ প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করে যে, এ রাষ্ট্রের আসলে কাজ কী? এ রাষ্ট্র কার নিরাপত্তা দেয়? কার স্বার্থ রক্ষা করে?

এখানেই প্রশ্ন আসে রাষ্ট্রের তরফ থেকে অসম আচরণ ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতার রাজনীতির। কেননা সবিতা একদিকে যেমন একজন আদিবাসী এবং অন্যদিকে একজন নারী। ফলে নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি ও আদিবাসী মানুষের প্রতি রাষ্ট্রের বিমাতাসুলভ আচরণ সবিতা চাকমা ঘটনার মধ্য দিয়ে গভীর কোনো সাংস্কৃতিক রাজনীতির ইঙ্গিত দেয়। তাই সমাজের বিদ্যমান অসম ব্যবস্থা এবং সাংস্কৃতিকভাবে ভিন্ন জাতিসত্তার প্রতি রাষ্ট্রের যে আচরণ তা এ ধরনের ঘটনার সংঘটন এবং তার পরবর্তী পদক্ষেপ উপলব্ধির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের চরিত্র ও এর সাংবিধানিক দায়িত্ব-কর্তব্যের বিষয়টি আমাদের সামনে একটি নেতিবাচকতার ইমেজ নিয়ে হাজির করে। কেননা এই হত্যা ও ধর্ষণের হত্যার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখ, অথচ এখনও পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার তো দূরের কথা, এ ঘটনার জন্য দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপই স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি।

ঘটনার প্রতিবাদে ফেব্রুয়ারির ১৭ তারিখ খাগড়াছড়ির কমলছড়ি গ্রামের বাসিন্দারা (সবিতা চাকমা যে গ্রামের বাসিন্দা ছিল), পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি এবং হিল উইমেন ফেডারেশন বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ মিছিল বের করে খাগড়াছড়ি শহরে। কিন্তু প্রশাসন কেবল আশ্বাসের মধ্যেই তার কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রেখেছে। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং দোষী ব্যক্তিদের দ্রুত গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বেশ কয়েকটি সংগঠন (যেমন নাগরিক সমাজ, বাংলাদেশ ইন্ডিজেনাস উইমেন্স নেটওয়ার্ক, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, ঢাকা, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, ঢাকা, কাপেং ফাউন্ডেশন প্রভৃতি) মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করে। বিক্ষোভ সমাবেশে অভিযোগ করা হয়, একটি 'বিশেষ মহল' দোষীদের বাঁচানোর চেষ্টা করছেন।

এই 'বিশেষ মহল' কে বা কারা এবং বাংলাদেশের সামাজিক এবং রাজনীতির ক্ষমতা কাঠামোয় এদের অবস্থান কোথায়, সেটা পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে যারা খোঁজখবর রাখেন বা অল্পবিস্তর জানেন বা কোনো-না-কোনোভাবে সংযোগ রাখেন তারা জানেন। এটাও তাদের অজানা নয় যে, এ 'বিশেষ মহল'কে বাঁচানোর চেষ্টা পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসন (প্রায় সব সরকারের আমলেই) করে আসছে সুদীর্ঘকাল থেকে। তাই এটা কেবল একটি মামুলি 'অভিযোগ' নয়, এটা নিকট ইতিহাসের অভিজ্ঞতার গড়ে উঠা এক ধরনের 'তেতো সত্য'। এখানেই রাষ্ট্রের ভূমিকা ও সাংস্কৃতিকভাবে ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতি রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্নটি বড় করে হাজির হয়।

কেননা পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসন রাষ্ট্রকে স্থানীয়ভাবে প্রতিনিধিত্ব করে। অতএব সেখানকার স্থানীয় প্রশাসনের দায় ও দায়িত্ব দুটোই রাষ্ট্রকে নিতে হবে। তাই রাষ্ট্র যদি তার উপর অর্পিত সাংবিধানিক দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে এবং নাগরিক নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন করে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ ও তদারকির দায়িত্ব পালনে বাধ্য করে, তাহলে সবিতা চাকমার মতো অনেক আদিবাসী নারীকে তাদের সম্ভ্রম হারাতে হত না কিংবা নির্যাতনোত্তর নৃশংসভাবে খুন হতে হত না।

এখানে আরও একটি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া জরুরি যে, বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা সমাজে ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েই চলেছে। আর আদিবাসী নারী যেহেতু সমাজের ও রাষ্ট্রের অসম আচরণের শিকার, তাই তাদের জীবন সাধারণ আর দশটা বাঙালি নারীর চেয়ে অধিকতর বেশি বিপন্ন। এক হিসেব অনুযায়ী, গত এক বছরে সারাদেশে প্রায় ৬৭ জন আদিবাসী নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তন্মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১৫ টি; আর এর ১২টিই সংঘটিত হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এর কোনো ঘটনারই শেষ পর্যন্ত কোনো ফয়সালা হয় না। যে মিডিয়া সবিতা চাকমার ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা ফলাও করে প্রকাশ করে, সে মিডিয়া এটার আর কোনো কার্যকর ফলোআপ যথাযথভাবে প্রচার ও প্রকাশ করে না। এ ঘটনায় পরবর্র্তীতে প্রশাসন কী উদ্যোগ নিল, ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাউকে আদৌ গ্রেফতার করা হয়েছে কিনা, আদৌ কোনো বিচারপ্রক্রিয়া চলছে কিনা কিংবা বিচার হয়েছে কিনা, কিংবা কোনো ধরনের অগ্রগতি যে নেই, সেটাও তো একটা যথাযথ সংবাদ আইটেম হতে পারে।

কিন্তু সেটা আমাদের গোচরে আর আসে না। সবিতা চাকমার ঘটনা আর দশটা ঘটনার মতোই তলিয়ে যাবে আমাদের নাগরিক বিস্তৃতির অতলে। এভাবে নতুন কোনো ঘটনা ঘটবে। আমরা আবার একটু নড়াচড়া করব। আমরা কেউ কেউ মানবাধিকার কর্মী হিসেবে সংবাদপত্রে পোজ দেব। মিডিয়া দু'য়েকদিন গৎবাঁধা স্টোরি করবে সেই কমন স্টোরি-লাইনে। একই ধারাবাহিকতায় প্রতিবাদ-প্রতিরোধের প্রদর্শনী; ফটোসেশনসহ মানববন্ধন। অতঃপর যবনিকাপাত।

এভাবে আর কত? সবিতা চাকমা ধর্ষিত ও খুন হয়েছে; এরপর কে?

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন: ভিজিটিং ফেলো, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিক্স, ইংল্যান্ড ও সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।