স্বাধীনতার মাসে আক্ষেপ ও আত্মজিজ্ঞাসা

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 6 March 2014, 03:39 PM
Updated : 6 March 2014, 03:39 PM

ডিসেম্বর মাস আমাদের বিজয়ের মাস। ফেব্রুয়ারি মাস ভাষার মাস। মার্চ হচ্ছে স্বাধীনতার মাস। স্বাধীনতার মাসের শুরুতেই আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হওয়ার কোনো গরজ কি আমরা বোধ করছি?

উনিশ শ একাত্তর সালের পঁচিশে মার্চ কালরাতে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আকস্মিকভাবে নিরস্ত্র বাঙালি জাতির ওপর হামলা চালালে শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ। নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানের সামরিক একনায়ক ইয়াহিয়া খান টালবাহানা শুরু করলে একাত্তরের মার্চের প্রথম দিনই বাংলাদেশের বিক্ষুব্ধ মানুষের কণ্ঠে শ্লোগান উচ্চারিত হয়েছিল 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর'। বাঙালি সত্যি অস্ত্র হাতে তুলে নেবে এবং বাংলাদেশ স্বাধীন করবে– সেটা কিন্তু তখনও অনেকের কাছে ছিল অকল্পনীয়। কিন্তু কল্পনা শেষ পর্যন্ত বাস্তব রূপ পেয়েছে।

একাত্তরের পঁচিশে মার্চ থেকে ষোলই ডিসেম্বর। নয় মাসের অসম যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে বাংলাদেশের মানুষ। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছি আমরা। ত্রিশ লক্ষ মানুষের রক্ত, কোটি মানুষের দুঃসহ দুঃখবরণ, লাখ লাখ নারীর সম্ভ্রম হারানোসহ অনেক উচ্চমূল্য দিয়েই কেনা হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। শিল্পীর কণ্ঠে যখন ধ্বনিত হয়, 'দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারও দানে পাওয়া নয়', তখন তাতে সামান্য অতিরঞ্জন আছে বলেও মনে হয় না।

অনেক দামে কেনা এই স্বাধীনতার বিয়াল্লিশ বছর পর আমরা যদি আমাদের দেশের দিকে, দেশের মানুষের দিকে তাকাই, তাহলে এ কথা কি আমরা উল্লাস ও উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি যে, হ্যাঁ, এই স্বাধীনতাই আমরা চেয়েছিলাম? দেশে সংঘাত-সংঘর্ষের যে রাজনীতি চলছে, তা দেখে কি আমাদের মনে হয় যে, এমন রাজনীতিই আমাদের কাম্য ছিল? রাজনীতিবিদদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, আস্থা-বিশ্বাস ইত্যাদি থাকবে না, এটা আমরা কেউ আশা করিনি। দল থাকলে দলাদলি থাকবে তাই বলে সেটা কোনোভাবেই হানাহানিতে পরিণত হবে না। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে কিন্তু প্রতিহিংসা থাকবে না– তেমনটাই ছিল প্রত্যাশিত।

দেশের অসংখ্য মানুষ নিরক্ষর থাকবে, গৃহহীন থাকবে, বেকার থাকবে, অনাহারী থাকবে, চিকিৎসার সুযোগ বঞ্চিত থাকবে– এমন অবস্থার জন্য নিশ্চয়ই কেউ অস্ত্র হাতে তুলে নেয়নি, বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেয়নি? পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বৈষম্য ও জুলুমের শাসন কায়েম করে মানুষকে অধিকারহীন, মর্যাদাহীন করে দাবিয়ে রেখে মুষ্টিমেয় কিছু সংখ্যক সুবিধাভোগী অনুগতদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল বলেই তো আমরা পাকিস্তানি জিঞ্জির ভাঙার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েছিলাম।

স্বাধীনতার চার দশকের বেশি সময় অতিক্রম করে আমরা কি এটা সত্যি দাবি করতে পারি যে, আমরা আমাদের স্বপ্ন পূরণের কাছাকাছি আসতে সক্ষম হয়েছি? আমরা কি অপশাসনের জিঞ্জির ভাঙতে পেরেছি. নাকি নতুন খাঁচায় আবদ্ধ হয়েছি? অল্প সংখ্যক মানুষ কর্তৃক বেশি সংখ্যক মানুষকে দাবিয়ে রাখার উৎকট ব্যবস্থা আমাদের ওপর চেপে বসায় এখন আমরা অস্বস্তিতে ছটফট করছি আর বলছি রক্ত দিয়ে আমরা এমন স্বাধীনতা চাইনি।

আমরা গর্ব করে বলে থাকি যে, অনেক লড়াই-সংগ্রাম করে আমরা দেশে গণতন্ত্র কায়েম করেছি। সন্দেহ নেই যে বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রপ্রিয়; অবৈধভাবে বা চোরা পথে বন্দুকের জোরে যারা ক্ষমতা দখল করে, এ দেশের মানুষ তাদের মেনে নেয় না, নির্বিবাদে তাদের শাসন চালাতে দেয় না। তারপরও সত্য এটাই যে, স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে দুইবার আমাদের ওপর অগণতান্ত্রিক সামরিক শাসন চেপে বসেছিল। নানা বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে, বছরের পর বছর আন্দোলন করে ভোট দিয়ে সরকার বদলের একটি ধারা আমরা চালু করেছি।

প্রশ্ন হল, এটাই কি প্রকৃত গণতন্ত্র? দেশের মানুষ কি সত্যিকার অর্থে তার মর্যাদা ও অধিকার ফিরে পেয়েছে? দেশে কি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে কি আমরা বেরিয়ে আসতে পেরেছি? আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ে কি আমরা সন্তুষ্ট থাকতে পারছি?

বেশি মানুষ যাদের ভোট দেয়, তারা দেশ শাসনের অধিকার পায়– এই ব্যবস্থা আমাদের দেশে চালু হয়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে এই রীতিরও ব্যত্যয় ঘটেছে চরমভাবে। বেশি মানুষের ভোট পেয়ে যারা ক্ষমতায় যাচ্ছে তারা কিন্তু বেশি মানুষের কল্যাণ করছে না, কল্যাণ করছে অল্প সংখ্যক মানুষের। অল্প সংখ্যক মানুষ সুখে থাকবে, বেশি সংখ্যক মানুষ অসুখি থাকবে– এটা তো স্বাধীনতার মূল্যবোধ তথা ন্যায়ের কথা নয়, ইনসাফের কথা নয়। ভোট দেওয়ার অধিকার সবার আছে ঠিকই, কিন্তু সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার সীমাবদ্ধ থাকছে অল্প সংখ্যক মানুষের মধ্যে।

ফলে একদিকে কিছু সংখ্যক মানুষের ধন-সম্পদ বাড়ছে, অঢেল বিত্তের অধিকারী হয়ে তারা বিলাসী জীবন যাপন করছে; অন্যদিকে বেশি সংখ্যক মানুষের জীবনে নেমে এসেছে সীমাহীন কষ্ট-দুর্ভোগ। দিন যত যাচ্ছে, ততই ধনবৈষম্য বাড়ছে, বাড়ছে দারিদ্র্য। কোটিপতির সংখ্যা বাড়ছে, কমছে না হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা।

আমরা দাবি করে থাকি যে, আমাদের দেশের মানুষ রাজনীতিসচেতন। তারা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভুল করে না। সত্যি কি তাই? ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা কি সবসময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছি? একবার এ দলকে আরেকবার ও দলকে ভোট দেওয়ার নাম কি সঠিক গণরায়? কাকে ভোট দিই, কেন দিই, যাকে ভোট দিই তিনি আমাদের ভোটের মর্যাদা রক্ষা করেন কি-না, এগুলো কি সত্যি আমরা বিচার-বিবেচনা করি?

ভোটদানে আমাদের বিচক্ষণতার পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলা যেতে পারে যে, আমাদের ভোটে যারা ক্ষমতায় যায়, ক্ষমতায় গিয়ে তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করলে পরবর্তী নির্বাচনে আমরা তাদের ভোট দিই না। শুধু এটুকুতেই কি ভোটারদের সচেতনতার পরিচয় বহন করে? এ রকম বৃত্তবন্দি হয়ে থাকার নাম কি সচেতনতা? আমাদের এই বৃত্তের মধ্যে চলার কি শেষ হবে না? আমরা কি বৃত্ত ভাঙার কোনো চেষ্টা করব না? যারা ওয়াদা ভঙ্গ করছে বার বার, তাদের খারিজ করে দেওয়ার কথা আমরা ভাবব না?

সন্দেহ নেই যে, একানব্বইয়ের গণআন্দোলনে স্বৈরশাসক এরশাদ পতনের পর থেকে নির্বাচনের মাধ্যমেই আমাদের দেশে ক্ষমতার পালাবদল ঘটছে। একবার বিএনপি, একবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হচ্ছে। এবার তার ব্যতিক্রম হল এমন বিতর্কিত প্রক্রিয়ায় যাতে স্বস্তি নেই, আনন্দ নেই। বিএনপির নেতৃত্বে জোট অথবা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট– এই হল আমাদের গণতান্ত্রিক রাজনীতির উত্তরণ ও বিকাশ। ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা বদল হওয়া ছাড়া দেশে আর কোথাও গণতন্ত্রের চর্চা নেই।

রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্রচর্চার কোনো লক্ষণ নেই। দলের প্রধান নেত্রী বা নেতার ইচ্ছার বাইরে দল চলে না, সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। কোনো কোনো সময় কোনো কোনো দলের আনুষ্ঠানিক বৈঠকে কেউ কেউ কথা বলার সুযোগ পেয়ে থাকেন তবে আলাপ-আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব দেওয়া হয় দলীয় প্রধানের ওপর। আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা ওই পর্যন্ত!

আমরা জানি যে, একটি দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতা থাকে রাজনীতিবিদদের হাতে। তারাই দেশ চালান। কখনও সরকারে থেকে, কখনও বিরোধী দলে থেকে। আমাদের দেশে রাজনীতিবিদদের অক্ষমতা-ব্যর্থতা কি কারও নজর এড়ায়? রাজনীতিতে তাদের কমিটমেন্ট কী? তারা কতটুকু সৎ, বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী? তারা কি নিজেদের জন্য রাজনীতি করেন, নাকি মানুষের জন্য? যাদের পেশিশক্তির জোর বেশি, যারা রাতারাতি টাকাওয়ালায় পরিণত হয়েছেন– রাজনীতিতে আজকাল তাদেরই দাপট বেশি।

রাজনীতিতে ভালো মানুষের প্রান্তিক অবস্থান নিয়ে আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করি না, তা নয়, তবে ভালো মানুষরা রাজনীতিতে জায়গা পাক– তার জন্য আমাদের কোনো উদ্যোগ-প্রচেষ্টা নেই। আগে ব্যবসায়ীরা নিজেদের ব্যবসার প্রসার ও সুরক্ষার জন্য রাজনীতিবিদদের চাঁদা দিতেন, অর্থাৎ রাজনীতিবিদদের চলতে হত ব্যবসায়ীদের চাঁদার টাকায়। এখন ব্যবসায়ীরা আর টাকা দিয়ে রাজনীতিবিদ না পুষে নিজেরা সরাসরি রাজনীতিতে নামছেন। পেশাদার রাজনীতিকের সংখ্যা কমছে, বাড়ছে ব্যবসায়ী রাজনীতিকের সংখ্যা।

কিছু সংখ্যক রাজনীতিবিদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের ফলে রাজনীতি সম্পর্কেই মানুষের মধ্যে বিরূপ ধারণা তৈরি হচ্ছে। অথচ মানুষের মধ্যে আস্থার মনোভাব তৈরির জন্য কোনো উদ্যোগ রাজনীতিবিদদের নেই। ভালো হওয়ার প্রতিযোগিতা কারও মধ্যে নেই, খারাপ হওয়ার প্রতিযোগিতা আছে প্রবলভাবে। দেশের মানুষের কাছে শ্রদ্ধা-সম্মান পাওয়ার জন্য রাজনীতিবিদদের কোনো আগ্রহ দেখা যায় না। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকতেই রাজনীতিবিদরা আজকাল বেশি পছন্দ করেন। তারা বিতর্কে থাকতে চান, প্রচারে থাকতে চান, কারণ প্রচারেই যে প্রসার!

রাজনীতিবিদদের পরস্পরের প্রতি চরম সন্দেহ ও অবিশ্বাস দেশের রাজনীতিকে ক্রমাগত অসুস্থতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কেবল প্রতিপক্ষের প্রতি বিদ্বেষ বা বিরূপতা নয়, একদলে থেকেও সদ্ভাব-সদাচার রক্ষা করতে পারেন না অনেকেই। ফলে দলের মধ্যে দলাদলি-কোন্দল, রেষারেষি এখন চরমে। ঐক্য নয় বিভেদ, মিত্রতা নয় তিক্ততা– এটাই যেন রাজনীতির মূলমন্ত্র।

অস্থিতিশীলতা তৈরি করাই যেন এখনকার রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। একদল ক্ষমতায় থাকার জন্য মরিয়া, অন্য দল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য উদগ্রীব। ক্ষমতায় থাকার জন্য এবং ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নীতিহীনতার প্রতিযোগিতা বন্ধ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ক্ষমতায় থাকার জন্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবেলায় রাষ্ট্রযন্ত্রের যাবতীয় শক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার যেমন স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, তেমনি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আন্দোলনের নামে হরতাল-জ্বালাও-পোড়াও-ভাঙচুর অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে জান-মালের ক্ষতি সাধন করাও নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

ক্ষমতার রাজনীতির যাঁতায় পিষ্ট হচ্ছে সাধারণ মানুষ। ক্ষমতায় থাকা বা যাওয়ার জন্য ভোটের বিকল্প কিছু নেই, জানা সত্ত্বেও ভোটারদের স্বার্থ না দেখার দুঃসাহস রাজনীতিবিদরা কোথা থেকে পান? পাঁচ বছর পর মানুষের কাছে ভোটপ্রার্থী হতে হবে, তাদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে– এটা জেনেও কেন ভোটে জেতা বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যরা সংসদে যান না? সংসদ সদস্য হিসেবে তারা বেতন-ভাতা নেন, সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন, অথচ সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন না। এমন উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পৃথিবীর আর কোথাও আছে কি?

চলতি রাজনীতির ধারায় দুটি দল একে অপরের প্রতিপক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ায় এটা প্রায় নিশ্চিতভাবে ধরে নেওয়া হচ্ছে যে, 'এ' না হলে 'বি'– অবশ্যই ভোটে জিতবে। মানুষের সামনে আর কোনো ভালো বিকল্প না থাকায় এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতার রাজনীতি প্রবল হয়ে উঠছে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের দুঃখকষ্ট লাঘব করা কিংবা সুশাসন নিশ্চিত করা এখন আর বড় কথা নয়। সন্ত্রাস, দুর্নীতি, শক্তি প্রদর্শনই এখন রাজনীতির চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে।

আমাদের দেশের প্রকৃত উন্নয়ন-অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য মূলধারার প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে একটি সমঝোতা প্রয়োজন বলে অনেকেই মনে করেন। প্রশ্ন হচ্ছে, দুই বিপরীত ধারার দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে কোনো ধরনের সমঝোতা কি আদৌ সম্ভব? কেউ হয়তো বলবেন, এই দুই দলের মধ্যে আদর্শগত পার্থক্য এখন এতই কমে এসেছে যে, স্থায়ী না হলেও ইস্যুভিত্তিক সমঝোতা এই দুই দলের মধ্যে না হওয়ার কোনো যুক্তি নেই। অথচ যুক্তিহীনতাই যে এখন রাজনীতিকে বেশি প্রভাবিত করছে, তার কী হবে!

একদল বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী, অন্যদল বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী বলে এতদিন যে পার্থক্যরেখা টানা হতো, এখন আর তা টানা খুব সহজ নয়। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদীরা যদি বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে ইসলামি ভাবধারার মিশেলে বিশ্বাসী হয়, তাহলে বাঙালি জাতীয়তাবাদীরাও এখন ইসলামি ভাবধারা থেকে খুব দূরে অবস্থান করতে চাইছে না। দুই দলের পার্থক্যটা তাহলে কোথায়? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জিয়াউর রহমানের অবস্থান, সম্মান ও মর্যাদাই কি এখন দুই দলের বিরোধের কেন্দ্রবিন্দু?

যদি তা-ই হয় তাহলে প্রয়াত দুই নেতাকে এক কাতারে না নামিয়ে, দুই জনের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানকে স্বীকার করে বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক হিসেবে এবং মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার অবদানের কথা বিনা বিতর্কে মেনে নিলেই তো এই দুই দলের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য হলেও রাজনৈতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব। তাত্ত্বিক বিচার-বিশ্লেষণে এই সমঝোতা অসম্ভব বলে মনে না হলেও বাস্তবতা যে ভিন্ন সেটাও তো অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তাহলে হবেটা কী? আমরা করব কী?

আমরা মুখে বলি আমরা দেশের ভেতর রাজনৈতিক অস্থিরতা চাই না, সংঘাতের রাজনীতি চাই না। বাস্তবে এই অস্থিরতা সৃষ্টিকারীদেরই আমরা উৎসাহ দিই, মদদ দেই জ্ঞাতসারে অথবা অজ্ঞাতে। যারা এই অপরাজনীতিকে আঁকড়ে আছে তাদের আমরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করার সৎসাহস না দেখিয়ে পালাক্রমে তাদের কাছেই নিজেদের সমর্পণ করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছি। আমাদের এই সমর্পণবাদী মানসিকতা দূর না হলে রাজনীতি থেকে অস্থিরতা দূর হবে না, রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা আসবে না।

চার দশকের বেশি সময় হল আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি না হয়ে আর কত বছর আমরা কাটিয়ে দেব? আমরা কি বছরের পর বছর শুধু আক্ষেপ করে সময় কাটাব, নাকি ভালোর দিকে পরিবর্তন নিশ্চিত করার জন্য সাহসী ভূমিকা গ্রহণ করব– সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাদেরই।

বিভুরঞ্জন সরকার: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।