কম্পার্টমেন্টাল পরীক্ষায় ফেল মানেই ফেল

আবেদ খান
Published : 24 Feb 2014, 04:20 PM
Updated : 24 Feb 2014, 04:20 PM

আমাদের সময় এসএসসি-এইচএসসি ছিল না, ছিল ম্যাট্রিক-আইএ। সে সময় এসব পরীক্ষার একটা নিয়ম ছিল যে, একটা বিষয়ে অকৃতকার্য হলে তিন মাসের মধ্যে কম্পার্টমেন্টাল পরীক্ষা দিতে হত নির্ধারিত দিনে। সেই পরীক্ষায় ফেল করলে পুরোপুরি ফেল।

আমার এক বন্ধু ছিল, এখন প্রয়াত– সাহিত্য, ভূগোল, ইতিহাসে ভালো নম্বর পেলেও অঙ্কে কিছুতেই পাশ নম্বর পেত না। শূন্য ছিল বরাদ্দ। মাঝে মধ্যে হয়তো ডাবল ডিজিটের কাছাকাছি পৌঁছতে পারত। কাজেই ক্লাসে তার স্থান ছিল নির্ধারিত– অনেকটা সুকুমার রায়ের সৎপাত্রের মতো– ঊনিশটি বার ম্যাট্রিকে সে/ঘায়েল হয়ে থামল শেষে। আমার বন্ধুটি অবশ্য ঊনিশবার নয়, বার সাতেক-আটেক পর পড়াশোনায় ইতি টেনে ব্যবসায় মন দিয়েছিল।

আমার সেই প্রয়াত বন্ধুটির কথা মনে হল আওয়ামী লীগের কথা মনে পড়ে। আওয়ামী লীগ আবার অঙ্কে কম্পার্টমেন্টাল পেয়েছে এবং কম্পার্টমেন্টাল পরীক্ষা দিয়েও ফেল করেছে এর আগে একাধিকবার। আওয়ামী লীগ সরকার তো অধিকাংশ বিষয়ে ভালো করেছে– এ কথা সবাই, এমনকি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদেরও অনেকে শতমুখে স্বীকার করেন। অসহনীয় বিদ্যুৎ বিপর্যয় রোধ করে রেকর্ড পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে, কলকারখানা সচল হয়েছে, উৎপাদন বেড়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি পণ্য আবার ঠিকমতো প্রবেশ করতে শুরু করেছে।

জনশক্তি রপ্তানির মন্দাভাব কাটতে শুরু করেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি হয়েছে। খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জিত হয়েছে, সাধারণ মানুষের অন্নাভাব ঘুচেছে প্রায় সর্বাংশেই। নারীর মর্যাদা এবং সামাজিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারে, এমনকি এই সরকারের কট্টর সমালোচক বিশ্ব ব্যাংক পর্যন্ত বিস্ময় প্রকাশ করেছে। পাশ্চাত্য বিশ্ব বিস্ময় বিমূঢ়ভাবে বাংলাদেশের সামাগ্রিক উন্নয়নসূচকে প্রশংসা করে বলেছে যে, বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নতুন অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে উঠে দাঁড়াচ্ছে।

এই যখন অবস্থা তখন বারবার অঙ্কে ফেল করছে কেন সরকার? বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় পর্যায়ে যত নির্বাচন হয়েছে, তার অধিকাংশেরই ফল অত্যন্ত হতাশাজনক। পৌরপিতার আসন থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে কুলিয়ে উঠেতে পারেনি। খুইয়েছে অধিকাংশ মেয়র পদ– চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী, বরিশাল, গাজীপুর– কোনোটাই আওয়ামী লীগ নামক ঐতিহ্যবাহী এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বপ্রদানকারী দলটির দখলে নেই। সর্বশেষ নজির এই উপজেলা নির্বাচন। লজ্জাজনক ফল হয়েছে প্রথম পর্যায়ের উপজেলা নির্বাচনে।

২.

আমার কাছে মনে হয়েছে এই প্রতিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগই আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এমনকি এই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন, যেখানে কোনো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না, সেখানেও এই সমস্যা ছিল প্রকট। এমনকি অনেক ভারী প্রার্থীও দলীয় সমর্থন নিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছে। এক একটি নির্বাচনের পর সরকার পক্ষ, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে খুব গৌরবের সঙ্গে বলা হয়– দেখ, আমরা প্রমাণ করে দিচ্ছি যে, নির্বাচন কমিশন খুবই নিরপেক্ষ। আমরা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোনো রকম হস্তক্ষেপ করিনি। আমরা প্রশাসনকে কোথাও ব্যবহার করিনি। আমরা প্রমাণ করেছি দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব…।

আবার আওয়ামী লীগের কোনো কোনো উচ্চপর্যায়ের নেতা আত্মপ্রসাদের সুরে বলেছেন, বড় দলে এ রকম একটু আধটু ওলটপালট হয়ই। এতে দলের তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। কোনো কোনো নেতার রসিক মন্তব্য– আমাদের দলে গণতন্ত্র আছে বলেই তো প্রার্থী অথবা নির্বাচনেচ্ছুরা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে যাচ্ছেন। এটা তো গণতন্ত্রের জন্য শুভ লক্ষণ।

অবাক ব্যাপার। এ যেন দিল্লির মসনদে বসে থাকা বাহাদুর শাহ জাফরের অবস্থা। সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছে, ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ পরাস্ত, ফাঁসি দেওয়া হয়েছে তাঁতিয়া টোপিকে। একের পর এক প্রতিরোধব্যুহ পড়ছে ভেঙে। ইংরেজ সেনাপতি হাডসন দিল্লির রাজপথে গুলি করে হত্যা করেছে বাদশাহের দুই দৌহিত্রকে। আর নির্বিকার বাদশা অধীর হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাঁর কবিতা রচনার দোয়াত-কলম। অদ্ভূত প্রতিক্রিয়াহীন সম্রাট যেন বুঝতেই পারছেন না যে, তাঁর মসনদ আর নেই। একটু পরেই তাঁকে হাওদাবিহীন হস্তীপৃষ্ঠে বসিয়ে দিল্লি থেকে নির্বাসনে পাঠানো হবে রেঙ্গুনে।

আজ যারা নির্বাচনসমূহে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান নির্ণয়ের পরিবর্তে নিরপেক্ষতার উষ্ণীষ শিরে ধারণ করে পরম তৃপ্তির সঙ্গে কালাতিপাত করছেন, তারা কিন্তু ঈশান কোণের এক খণ্ড কালো মেঘই উপেক্ষা করছেন চরম অবহেলায়। ওরা বুঝতেই পারছেন না, আত্মকলহ আত্মহননের নামান্তর। কোনো দলের পতনের অঙ্কুরোদ্গম হয় কোন্দল থেকে। মুসলিম লীগের মতো একটি বিশাল সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর একের পর এক আত্মকলহে নিমজ্জিত হয়ে একসময় নিঃশেষ হয়ে যায়। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ধীরে ধীরে এই দলের শেষ চিহ্নটিও মুছে যায় বাংলাদেশ থেকে।

১৯৫৭ সালে বাম প্রগতিশীল ধারার সূত্রপাত ঘটেছিল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির আত্মপ্রকাশের ভেতর দিয়ে। খান আবদুল গাফফার, খান ওয়ালী প্রমুখ আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত রাজনীতিক মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গঠন করেছিলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি। সমগ্র পাকিস্তানে এই রাজনৈতিক সংগঠনটির বিস্তৃতি ছিল বিস্ময়কর। শ্রমিক-কৃষক থেকে শুরু করে দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং প্রগতিশীল তরুণ ও যুবক কর্মীমহলে ছিল এই সংগঠনটির বিস্তর প্রভাব।

কিন্তু এই জনসম্পৃক্ত সংগঠনটিও ক্রমান্বয়ে শক্তিহীন হতে থাকে শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সংঘাত এবং নিত্যনতুন দার্শনিক ও তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার প্রকোপে পড়ে। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানে এই দলটির নামটিই পাল্টে গেছে। বাংলাদেশে সেটা খণ্ড-বিখণ্ড হতে হতে ও বিভিন্ন নামে পরিচিত হতে হতে একসময় সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক ধারায় বিলীন হয়ে যায়। অর্থাৎ রাজনৈতিক দলকে টিকিয়ে রাখতে হলে এবং গতিপথ বেগবান করতে হলে দলীয় শৃঙ্খলাকে কোনো অবস্থাতেই হালকাভাবে দেখলে চলবে না।

আওয়ামী লীগকে কিন্তু সতর্ক সংকেত জনসাধারণ দিয়েই চলেছে অনেক আগে থেকে। চতুর্দিকে যত উন্নতির নহর বয়ে যাক না কেন, সাফল্য সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগানোর জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ বাহন হচ্ছে রাজনৈতিক সংগঠন। এটা না থাকলে বোকার ফসল পোকায় খাবে এবং তাই-ই তো হচ্ছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিটি নির্বাচনে দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর ছড়াছড়ি। দলীয় শৃঙ্খলা যদি কঠোরভাবে মানা হত, যদি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কঠোর হত, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যদি নিজেদের গোষ্ঠীগত চিন্তা পরিহার করে দলের বৃহত্তর স্বার্থে দলপরিচালনা করার জন্য নিবেদিত হত, যদি কর্মীদের ভেতরে দলীয় রাজনীতির উদ্দীপনা ছড়িয়ে দিতে সচেষ্ট হত– তাহলে কি ঘটতে পারত এই বিপর্যয়?

যে রূঢ় কথাটি উচ্চারণ করা উচিত তা হল আওয়ামী লীগই বিভিন্ন আসন উপহার হিসেবে জামায়াত-বিএনপির হাতে তুলে দিয়েছে। এমনটি ঘটার কারণ একাধিক।

প্রথমত, জোট সরকারের আমলে পিটিয়ে পাটিয়ে আওয়ামী লীগের কর্মীদের এলাকাছাড়া করার পর যখন ২০০৯ সালে বিপুলভাবে আওয়ামী লীগের পক্ষে জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, সে সময়ই ছিল সংগঠন সাজানোর উপযুক্ত সময়। কিন্তু আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব সে সময় মর্মান্তিক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিল। জোয়ারের সময় জয়ী হওয়া নেতৃত্বের অনেকে ধরাকে সরা জ্ঞান করেছেন। ফলে কর্মীদের সঙ্গে দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, এমন কতিপয় আত্মঘাতী নীতি গ্রহণ করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণভাবে সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে এবং ব্যক্তিস্বার্থপ্রণোদিত হয়ে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, উপজেলা নেতৃত্বে এবং সংসদ সদস্যের মধ্যে দায়িত্বের প্রসঙ্গটি। এর ফলে তিনটি সঙ্কট তৈরি হয়–

ক) সংসদ সদস্যের সঙ্গে উপজেলা নেতৃত্বের সম্পর্ক বৈরী হয়েছে; খ) সংসদ সদস্যের সঙ্গে স্থানীয় সংগঠনের সম্পর্ক বিপর্যস্ত হয়েছে, যা স্থানীয় জনগণকে হতাশাগ্রস্ত করেছে; গ) এর ফলে নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগকেই মাশুল গুণতে হয়েছে সংগঠনগতভাবে।

তৃতীয়ত, স্থানীয় কর্মীরা অনুভব করেছে যে, আঞ্চলিক পর্যায়ে সংগঠন অকার্যকর এবং কোন্দলের কারণে বহুধা বিভক্ত। ব্যক্তিপ্রভাব দলীয় কার্যক্রমের ধারা প্রায় স্তব্ধ করে দিয়েছে। অনেক নিবেদিতপ্রাণ কর্মী দায়িত্ববঞ্চিত হওয়ার কারণে নিষ্ক্রিয়। ফলে দেশের শতকরা কমপক্ষে আশি ভাগ অঞ্চলে হয় সাংগঠনিক কমিটি মেয়াদউত্তীর্ণ, নয় তো কতিপয় স্বার্থান্বেষীর মুঠোর মধ্যে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় নিপতিত। এর ফলে কর্মীরা কর্মহীন হয়েছে, আর এই কর্মহীনতাই তাদের দুর্নীতিগ্রস্ত ও সুবিধাবাদী দখলদারী চাঁদাবাজে পরিণত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।

এ সুযোগটাই গ্রহণ করেছে জামায়াত। তাদের বিপুল বিত্ত এবং নানাবিধ প্রলোভনের ঝাঁপি এই সমস্ত হতাশাচ্ছন্ন কর্মী বা স্থানীয় নেতৃত্বকে প্রলুব্ধ করেছে বিপুলভাবে। আমরা দেখলাম, জামায়াত-বিএনপি কত পরিকল্পিতভাবে প্রার্থী নির্বাচন করল; পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগের প্রতিটি পদে তিন-চার-পাঁচ জন বিদ্রোহী প্রার্থী এবং রহস্যজনকভাবে তাদের অধিকাংশই সিদ্ধান্তে অনড়। এই অনড় অবস্থানের পেছনে দলীয় শৃঙ্খলার কোনো ভূমিকা নেই, রাজনৈতিক নৈতিকতার কোনো অবস্থান নেই! তাহলে কী আছে? অনুমান করতে কষ্ট হওয়ার কথা না।

প্রশ্ন হল, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তবে কী কাজ? শুধু আত্মপ্রসাদ লাভ করা যে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়? অথবা নির্বাচন কমিশন খুব নিরপেক্ষ? কিংবা কোনো কোনো কেন্দ্রীয় নেতার চটকদারি আফসোসবাণী যে, দলের সমন্বয়ের অভাব রয়েছে– এ কথা বলা? দলের নিম্নস্তরে কর্মী কিংবা ক্ষুদ্র নেতারা বেপরোয়া দুর্নীতিগ্রস্ত অথবা পণ্যে পরিণত হয় কখন– যখন আঞ্চলিক অথবা স্থানীয় নেতৃত্বে অসংগঠিত অস্তিত্বহীন অথবা জবাবদিহিহীন থাকে। আর এই অবস্থা সৃষ্টি হয় তখন, যখন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে জবাবদিহিতার অভাব থাকে, কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা কিংবা শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় শৈথিল্য থাকে।

৩.

আওয়ামী লীগ এবং এই সরকার যদি মনে করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের কোনো কোনো শক্তিশালী চিরস্থায়ী মিত্র আছে, তারাই সবসময় খুব উদারভাবে এবং অন্ধভাবে তাদের সবকিছু সমর্থন করে যাবে, তাহলে তা হবে ঐতিহাসিক ভুল। কূটনীতির মূল কথা হল, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোনো স্থায়ী মিত্র বা শত্রু নেই। সকলেই সম্পর্ক স্থাপন করে নিজ নিজ স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে।

জঙ্গীবাদের কার্ড খেলতে গিয়ে জঙ্গীবাদকে প্রশ্রয় দেওয়ার মতো অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার চাষ করলে তো আস্থার সঙ্কটই তৈরি হবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়টি নিয়মিত ও সুচারু পরিচর্যার ব্যাপার। বাগানে সুন্দর সতেজ ফুল ফোটাতে হলে কোন মওসুমে কোন ফুল ফোটাতে হবে, তা জানতে হবে। নিয়মিত জলসিঞ্চন করতে হবে এবং দক্ষতার সঙ্গে আগাছা পরিস্কার করতে হবে। রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগকে বুঝতে হবে আন্তর্জাতিক মহলেরও অঙ্ক আছে। তারাও লাভ ক্ষতির হিসেব করে। তারা যে সবসময় দুর্বল রোগগ্রস্ত ঘোড়ায় বাজি ধরবে– এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই।

তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হলে নিজেকে প্রয়োজনীয় এবং আস্থা স্থাপনের যোগ্য হিসেবে প্রমাণ করতে হবে। পাশ্চাত্য বিশ্ব প্রত্যেকটা নির্বাচন লক্ষ করছে গভীর মনোযোগের সঙ্গে। নির্বাচনকে নিয়ে তারাও খেলছে নানাভাবে। কাজেই এইসব আন্তর্জাতিক খেলার মোকাবিলা করতে হলে নিজের ভিতটা শক্ত করতে হবে। কোনো নমনীয়তা দেখিয়ে দলীয় কাঠামো দুর্বল করার এতটুকু অবকাশ নেই। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের অতীত ইতিহাস থেকে কিছু তথ্য উপস্থাপন করছি।

আজ এখনও পর্যন্ত যে আওয়ামী লীগ দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে টিকে আছে, তা সম্ভব হয়েছিল স্বাধীনতার অব্যবহিত পরপরই কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের জন্য। বঙ্গবন্ধুর দায়িত্বগ্রহণের তিন মাসের মধ্যে, অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ৬ এপ্রিল, দুর্নীতি ও দেশবিরোধী তৎপরতার অভিযোগে দলের ১৬ জন সাংসদকে বহিস্কার করেন। ৯ এপ্রিল একই অভিযোগ বহিস্কার করা হয় আরও ৭ জনকে। ২২ সেপ্টেম্বর আরও ১৯ জনকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়।

এর ফলে দলের মধ্যে জবাবদিহিতা ফেরত এসেছিল, দলীয় শৃঙ্খলা ফিরেছিল। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর এ ধরনের শক্ত এবং কঠিন সিদ্ধান্ত দলীয় নেতৃত্বের প্রতি কর্মীদের আস্থার সংকট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। বঙ্গবন্ধুকে এই শক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করেছিলেন তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান ও মনসুর আলীর মতো সাথীরা। আবার যে উদারতা ও ক্ষমাশীলতা পঁচাত্তর ডেকে এনেছিল এবং বঙ্গবন্ধুকে তাজউদ্দিন সাহেব কিংবা সৈয়দ নজরুল, মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামান থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল সেটা ভিন্ন বিষয়।

তবে সমস্ত অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক চক্রান্ত, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সর্বস্তরের অপতৎপরতা সত্ত্বেও আঘাতের পর আঘাত মোকাবিলা করে আওয়ামী লীগ যে বারবার জনগণের কাছে ফেরত আসতে পেরেছে– তার প্রধান কারণ সূচনাতেই বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় পদক্ষেপ।

৪.

তাই অঙ্কে বারবার কম্পার্টমেন্টাল পাওয়ার কোনো উপায়ই নেই। কম্পার্টমেন্টাল পরীক্ষায় ফেল করা মানেই ফেল করা। আর এখন আওয়ামী লীগ পরাস্ত হওয়া মানে দেশ-জাতি-মুক্তিযুদ্ধ পরাস্ত হওয়া, শুভশক্তি পরাস্ত হওয়া, উপমহাদেশের স্থিতিশীলতা পরাস্ত হওয়া।

আর এখন পরাস্ত হলে আন্তর্জাতিক বিশ্ব বাংলাদেশ প্রশ্নে নতুন অঙ্কের ছক সাজাবে।

২৪-২-২০১৪

আবেদ খান: সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ।