বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা প্রসঙ্গে

মুহম্মদ নূরুল হুদামুহম্মদ নূরুল হুদা
Published : 22 Feb 2014, 01:28 PM
Updated : 22 Feb 2014, 01:28 PM

আমি বিজ্ঞানের ছাত্র নই। তবে প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার সময় সাধারণ বিজ্ঞান নামক একটি বিষয় পড়তে হয়েছে, যেখানে বিজ্ঞানের মীমাংসিত নানা প্রসঙ্গ ও তত্ত্ব সম্পর্কে অধ্যায়-ভিত্তিক আলোচনা ছিল। বিষয়গুলো যেহেতু জটিল ছিল না, তার ব্যাখ্যাও তেমন দুর্বোধ্য ঠেকেনি। এখন বুঝতে পারছি, ওই বিষয়গুলো উচ্চতর বিজ্ঞান বা নব-উদ্ভাবনশীল বৈজ্ঞানিক বিষয় বা তত্ত্ব ছিল না।

আমি এ-সব বিষয় বাংলায় পড়েছি। বলাবাহুল্য, এটি এখন পর্যন্ত আমার প্রথম ব্যবহারিক ভাষাও বটে। এ বিষয়গুলো স্পষ্ট করার জন্যে যে বাংলা বাক্য ও বর্ণনা ছিল, তার মান উঁচু ছিল না কিনা মনে নেই; তবে বুঝতে যে অসুবিধা হয়নি তা বেশ মনে আছে।

কথাটি বলছি এ-জন্যে যে, আমার সাধারণ অভিজ্ঞতা বলে, বাংলাভাষাভাষী পাঠক-পাঠিকার জন্যে বিজ্ঞানের যে কোনো বিষয় যদি বোধগম্যভাবে বাংলা ভাষাতেই বর্ণনা করা যায়, তাহলে তা পাঠককে আকর্ষণ না করার কোনো কারণ নেই। 'বোধগম্যতা' শব্দটির উপর আমি বিশেষ জোর দিতে চাই। এই 'বোধগম্যতা' প্রথম প্রয়োজন লেখকের। লেখক নিজেই যদি বিজ্ঞানের (বা অন্য কোনো শৃঙ্খলার) যে বিষয়টি নিয়ে লিখছেন তা 'স্পষ্টভাবে' উপলব্ধি না করেন, তা হলে তা বাংলা, ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষায় ব্যক্ত করতে পারবেন না। আসলে লেখকের দিক থেকে বিষয়ের 'স্পষ্ট উপলব্ধি' বোধগম্যতার প্রথম শর্ত। তারপর আসে ভাষার প্রশ্ন।

আমি এখানে ভাষা বলতে 'মাতৃভাষা' না বলে বলতে চাই সংশ্লিষ্ট লেখকের লিখন-পঠনের 'ব্যবহারিক ভাষা', যে ভাষাটি তিনি পারঙ্গমতার সঙ্গে ব্যবহার করতে পারেন। তা যদি বাংলা হয় ক্ষতি নেই, তা যদি ইংরেজি বা অন্য ভাষা হয় তাতেও ক্ষতি নেই। তবে মোদ্দা কথা, যে ভাষায় তিনি লিখছেন সেটি তাঁর ব্যবহারিক মাধ্যম হওয়া চাই। সেইসঙ্গে সেই মাধ্যমে নিজেকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করার গ্রহণযোগ্য দক্ষতা থাকাও তাঁর জন্যে অত্যাবশ্যক।

মাতৃভাষা আর ব্যবহারিক ভাষা যে এক নয় তার উদাহরণের জন্যে বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। সেই উদাহরণ স্বদেশেই আছে ভুরি ভুরি। যে সব মাদ্রাসায় বাংলা বা ইংরেজি বিষয় নেই, সেখানে যারা লেখাপড়া করে, তাদের মাতৃভাষাও বাংলা। কিন্তু বাংলায় তারা সক্ষমভাবে তেমন কিছু লিখতে পারেন না। কেননা, বলতে গেলে, মাতৃভাষায় তারা প্রায়-নিরক্ষর।

আবার যে সব উচ্চবিত্তের শহুরে ছেলেমেয়ের মাতৃভাষা বাংলা, অথচ পশ্চিমা ধাঁচের ইংরেজি স্কুলে লেখাপড়া করার সুবাদে বাংলা শেখেনি বা অপেক্ষাকৃত কম শিখেছে, তাদের জন্যে প্রথম ব্যবহারিক ভাষা মাতৃভাষা বাংলা নয়, বরং ইংরেজি। ফলে শিশুশ্রেণি থেকেই তারা ইংরেজিতে দক্ষতর। তারা হয়তো একই সঙ্গে দুটি ভাষা শিখছে, কিন্তু সমভাবে দ্বিভাষী হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে যে কোনো বিষয় যথাযথ উপলব্ধির পর নিজের মতো বর্ণনা করার ক্ষেত্রে তারা মাতৃভাষা বাংলার চেয়ে ব্যবহারিক ভাষা ইংরেজিতেই অধিক দক্ষ।

এ ছাড়াও আরেক শ্রেণির শিক্ষার্থীর কথা মনে আসে, যারা প্রথম পর্যায়ে (বিদ্যালয় বা কলেজ জীবনে) বাংলাকে ব্যবহারিক ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করার পর উচ্চতর শিক্ষা বা গবেষণা বা পেশাগত জীবনে কঠোর নিষ্ঠার সঙ্গে ইংরেজি বা অন্য কোনো বিদেশি ভাষা রপ্ত করে সেই ভাষাতেই দক্ষতর হয়ে উঠেছে। তখন বাংলায় প্রশংসনীয় লিখন-পঠন দক্ষতার পাশাপাশি দ্বিতীয় ভাষাটিতেও তারা তাদের চিন্তা-চেতনা ও অভিব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রায় সমানভাবে স্বচ্ছন্দ।

সাধারণত পেশাগতভাবে কূটনীতিক, ব্যবসায়ী, অধ্যাপক, গবেষক ও অনুরূপ বহুমাত্রিক ও দ্বিভাষী (বা বহুভাষী) ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এমনটি হয়ে থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে ভাষিক মাধ্যম হিসেবে তাদের প্রথম পছন্দ হয়ে ওঠে দ্বিতীয় ভাষাটি। এঁদের মধ্যে এমন ব্যক্তিও দুর্লভ নয়, যারা প্রথম ও দ্বিতীয় উভয় ভাষাতেই প্রায় সমান দক্ষ। তেমন ব্যক্তিরা উভয় ভাষাকেই যে কোনো বিষয় (বিজ্ঞান, দর্শনসহ যে কোনো শাস্ত্র) উপস্থাপনের জন্যে উপযোগী মনে করেন।

আমার ধারণা, যারা মাতৃভাষা বাংলায় বিজ্ঞানচর্চায় কোনো অসুবিধা বোধ করেন না, তারা এই শেষোক্ত শ্রেণির দ্বিভাষী চর্চাকারী। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চায় ইংরেজি (বা জার্মান বা জাপানি) ভাষার মতো সুদীর্ঘ ঐতিহ্য না থাকা সত্বেও এ-ক্ষেত্রে তাদের ইতিবাচক মনোভাবের কারণ একাধিক। কেবল মাতৃভাষার প্রতি আনুগত্য, ভক্তি ও বিশ্বাস নয়, সেইসঙ্গে যুক্ত হয়েছে এই ভাষাকে সক্ষমভাবে ব্যবহরের ক্ষেত্রে তাদের আপন আপন আস্থা। তারা মনে করেন, ভাষিক ঐতিহ্য ও পারিভাষিক অপূর্ণতার কথা চিন্তা করে বাংলায় (অর্থাৎ মাতৃভাষায়) বিজ্ঞানচর্চা থেকে বিরত থাকা মানে বাংলা ভাষার অগ্রগমন থামিয়ে দেওয়া। না, এটি হতে দেওয়া যায় না। ইংরেজি শিখতে বা সেই ভাষায় চর্চা করতে আপত্তি নেই, কিন্তু পাশাপাশি বাংলাকে বাদ দেওয়া যাবে না। এই প্রক্রিয়া কেবল বিজ্ঞান নয়, অন্য যে কোনো ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য।

এ পর্যায়ে প্রাসঙ্গিক জিজ্ঞাসা: তাহলে পুরো জাতিকেই দ্বিভাষী করলে বা শিক্ষার মাধ্যমও দ্বিভাষিক (বা বহুভাষিক) করা হলে ক্ষতি কী? এই প্রশ্নের উত্তর সহজে দেওয়া যাবে না। কেননা বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশের বিপুল শিশু-কিশোরকে প্রাথমিক বা মাধ্যমিক পর্যায় থেকে দ্বিভাষিক শিক্ষা দিতে হলে যে পরিমাণ শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক-শিক্ষিকা আর শিক্ষা-উপকরণ দরকার, তা সংগ্রহ করা অসম্ভবপ্রায়। শহরে বা গ্রামে কিছু কিছু কিন্ডারগার্টেন নামীয় ইশকুলে বিত্তবানদের জন্যে এ-ধরনের সীমিত বিদ্যালয় (বর্তমানে যে-রকম পাওয়া যায়) থাকা সম্ভব, কিন্তু এদেশের সর্বস্তরের ও সর্বসামর্থ্যের শিশুকিশোরের জন্যে এমন ব্যবস্থার কল্পনা করা যায় না। বস্তুতপক্ষে তার প্রয়োজনও নেই।

কেননা বিদ্যালয় ও কলেজ পর্যায়ে বিজ্ঞানের যে বিষয়গুলোর পাঠ দান করা হয়, তা এই শাস্ত্রের পূর্বজ্ঞাননির্ভর সুস্পষ্ট বিষয়। সাধারণ জ্ঞান হিসেবে এটি প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্যে জরুরি। এই জ্ঞান বাংলা ভাষায় বিতরণ করলেই চলে। আর তা না করে, ইশকুলে যদি শুরু থেকে ইংরেজি ভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়া হয়, তাহলে দেশের প্রতিটি শিশু-কিশোর যে কালে কালে একেকজন উদ্ভাবনশীল বিজ্ঞানী হয়ে উঠবে, তেমনটি আশা করা যায় না। তাই যদি হত, বিলাতের ইংরেজি ভাষাভাষী প্রতিটি শিশু-কিশোরই একেকজন উদ্ভাবনশীল হকিংস হয়ে যেত!

আসলে জ্ঞানার্জনের সাধারণ পর্যায় ও বিশেষায়িত পর্যায় সমস্তরের নয়। ইশকুল-কলেজের বুনিয়াদী শিক্ষার পর প্রত্যেক শিক্ষার্থী স্নাতকোত্তর বা তৎপরবর্তী উচ্চতর পর্যায়ের শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে যে সাধনা করেন, তখন তার জন্যে অন্যান্য বিশ্বভাষার দুয়ার উন্মুক্ত করা অত্যাবশ্যক। নির্বাচিত সংখ্যক সৃষ্টিশীল, তর্কশীল ও উদ্ভাবনশীল শিক্ষার্থীই এই কাজে রত হবেন। এটাকে এক ধরনের সামাজিক বৈষম্য মনে হলেও প্রকৃতিগতভাবে এটিই স্বাভাবিক। এটিই মানব মেধা ও প্রতিভার প্রাকৃতিক খেলা। যে কারণে একই গুরুর অধীনে একই বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণকারী সকল শিক্ষার্থী সমভাবে সফল বা ব্যর্থ নন। আমাদের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বা মানবিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তনের ফলে সমাজ যদি সদাচারী ও সমবণ্টনশীল হয়ে ওঠে, তাহলে সমাগ্রিক অবস্থার উন্নতি হবে অবশ্যই; কিন্তু ব্যক্তিমেধা ও প্রতিভার তারতম্য বিলীন হবে বলে মনে হয় না।

এবারে আরও কিছু প্রিয়-অপ্রিয় প্রসঙ্গে আসা যাক। প্রথম প্রসঙ্গটি হচ্ছে, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার ঐতিহ্য স্বল্পকালের। না, এ কথা কেউ অস্বীকার করবে না। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার শ্লোগান ও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের পর (যদিও তুলনামূলকভাবে অপর্যাপ্ত) এই ঐতিহ্য সম্প্রসারিত হচ্ছে। আর এই চর্চা যে মননশীল ডিসকোর্সে পরিণত হচ্ছে তার একটি দৃষ্টান্ত বর্তমান বিতর্ক। দ্বিতীয় অভিযোগটিও অতিপরিচিত: বাংলা ভাষায় যথাযথ বিজ্ঞান পরিভাষা নেই।

অস্বীকার করার উপায় নেই, কথাটি সত্য। শুধু বিজ্ঞান কেন, মানবিক বিজ্ঞানের অনেক শাখাতেও এই পারিভাষিক শব্দের অপর্যাপ্ততা রয়েছে। একটু আগেই 'ডিসকোর্স' শব্দটি ব্যবহার করেছি এইমুহূর্তে যুৎসই পরিভাষা পাইনি বলে। একটা কিছু যে তৈরি করা যেত না, এমন নয়। আমি তার প্রয়োজন বোধ করিনি। বরং মূল ইংরেজি শব্দটি গ্রহণ করেছি। ইংরেজিতে আমরা 'বাউল'কে যেমন অবিকৃত প্রয়োগ করে থাকি। আসলে সমাধানও কিন্তু এটি। ভাষার পরিগ্রহণ ক্ষমতা ব্যবহার করে এই ধরনের পরিভাষা উৎস-ভাষা থেকে গ্রহণ করতে দোষ নেই। বাংলা ভাষা লিখিত পর্যায়ে অন্তত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকেই এই পরিগ্রহণ ক্ষমতার স্বাক্ষর রেখেছে।

উপরন্তু গত চার দশকের ব্যবধানে বাংলাদেশে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় সব শাখায় পারিভাষিক শব্দকোষ প্রণীত হয়েছে। এই সব পরিভাষার সবগুলো যে গৃহীত হয়েছে বা হবে, এমন নয়। যেগুলো টিকবে না, সেগুলোর ক্ষেত্রে উৎস-ভাষার শব্দটিই চলছে ও চলবে। যেমন চেয়ার (অবিকৃত), টেবিল (ঈষৎ-পরিবর্তিত), অক্সিজেন (বাংলা পরিভাষা 'অম্লজান' প্রায়-অগৃহীত) ইত্যাদি। আমাদের মতে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাবৎ আন্তর্জাতিক পরিভাষা গ্রহণ করাই যুক্তিযুক্ত। দ্বিভাষী চর্চাকারীরাই এই ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারেন।

তৃতীয় প্রসঙ্গটি হচ্ছে 'স্পষ্ট চিন্তা' বা 'ক্লিয়ার থিংকিং'। আসলে চিন্তার নিজস্ব কোনো ভাষা আছে কিনা সন্দেহ, বরং সদ্যআবির্ভূত কোনো চিন্তারই অব্যবহিত বাহন হয়ে ওঠে অন্য কোনো ভাষা। এ ক্ষেত্রে ইংরেজি বা বাংলা বা প্রথম বা দ্বিতীয় ভাষা নয়, সর্বাগ্রে আসার কথা সংশ্লিষ্ট 'চিন্তা'-বিদের সর্বাধিক রপ্ত ও পরিশীলিত ভাষা। 'চিন্তা-বিদ' যদি দ্বিভাষী হন, তাহলে যে ভাষা তাঁর কাছে অধিকতর রপ্ত ও হালনাগাদ, তিনি তার মস্তিষ্কজাত চিন্তা সে ভাষায় ধারণ ও ব্যক্ত করবেন। পরবর্তীকালে অন্য ভাষায়ও তা ব্যক্ত করতে পারেন। দ্বিতীয় ভাষায় ব্যক্ত করার এই প্রক্রিয়া অনুবাদের গোত্রভূক্ত। কেননা উপলব্ধি যথার্থ হলে তিনি তার অধিগম্য অন্য যে কোনো ভাষায় তা প্রমিত আকারে পুনর্ব্যক্ত করার যোগ্যতা রাখেন।

আরেকটি প্রশ্ন এসেছে, নিজে একটি বিদেশি ভাষা (যেমন ইংরেজি) শিখে অন্যকে তা শিখতে নিরুৎসাহিত করা হিপোক্রেসি বিশেষ। এই অভিযোগটি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কেননা এটি সামাজিক বৈষম্যের শামিল। সদিচ্ছা, উদ্যোগ ও সামর্থ্য অনুসারে যে কোনো শিক্ষার্থীর জন্যে যে কোনো ভাষা (কিংবা জ্ঞান) শিক্ষার সুযোগ অবারিত রাখা একটি সমাজের সুশীলতা ও সুশাসনের দ্যোতক। আফসোস, অন্য অনেক কিছুর মতো এটিও আমাদের এই ক্ষমতালিপ্সু সমাজে তিরোহিতপ্রায়।

আরেকটি অভিযোগও শোনা যায় মাঝে মাঝে। সেটি হচ্ছে, অধিকতর ইংরেজি চর্চা করলে বাঙালি আর অবিমিশ্র বাঙালি থাকবে না। সেহেতু আরও অধিকহারে বাংলা চর্চা জরুরি, এমনকি বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রেও। এ প্রসঙ্গে শুধু এটুকু নিবেদন করতে চাই, দুশ' বৎসরাধিক কাল ইংরেজি ও ইংরেজিয়ানা অনুশীলন করেও আদলে ও চরিত্রে বাঙালি মিশ্রবর্ণের বাঙালিই রয়ে গেছে। কোট-হ্যাট-টাই পরেও, ইংল্যান্ড-আমেরিকা-কানাডায় প্রবাসী বা অভিবাসী হয়েও, এককালের তহবনধারী বাঙালি নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে অবাঙালি হতে পারেনি। কাজেই ইংরেজি বা জার্মান বা জাপানি ভাষায় বিজ্ঞান বা দর্শন বা অন্যকিছুর চর্চা করলে বাঙালির জাতিচ্যুতির কোনো সম্ভাবনা নেই। বিবর্তিত বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস এই কথাই বলে।

আসলে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান বা অন্য কোনো জটিল বিষয় চর্চার মূল সীমাবদ্ধতা তৈরি করে রেখেছি আমরাই। আমরাই সচেতনভাবে আমাদের ভাষার চর্চা করি না। যেমন অফিসে আদালতে, তেমনি প্রাত্যহিক জীবনাচরণে। জীবনের প্রায় প্রতিটি অঙ্গনে অধিকাংশ চর্চাকারী বাংলাকে সহজতম মাধ্যম মনে করে যেন-তেনভাবে ব্যবহার করে চলেছেন। এমনকি পত্রপত্রিকায় বানান বিভ্রাট আর বাক্যগঠনজাত অসঙ্গতিও নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। বেসরকারি বাণিজ্যিক অফিসে বাংলার ব্যবহার ন্যূনতম। সরকারি-আধাসরকারি অফিসে ফাইল-পত্তরে বাংলার ব্যবহার কম শোচনীয় নয়। এ থেকে মুক্তির উপায় কেবল মাতৃভাষার প্রতি অঙ্গীকৃত শ্রদ্ধা নয়; বরং তার পাশাপাশি বিশুদ্ধ চর্চার সচেতনতা ও তার প্রয়োগ।

বাংলা ভাষার সামর্থ্য ও পরিগ্রহণের স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি পাবে মূলত এ পথেই। এ পথ হয়তো সুকঠিন, কিন্তু অনতিক্রমণীয় নয়।

মুহম্মদ নূরুল হুদা: কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।