নৈঃশব্দ কি ঝড়ের পূর্বাভাস: বিএনপি কোথায় অবস্থিত

মানস চৌধুরী
Published : 22 Oct 2017, 11:50 AM
Updated : 11 Feb 2014, 08:01 AM
এ রকম একটা নাটকীয় এবং বহুব্যবহারে ক্লিষ্ট শিরোনাম আসলে আমার পছন্দ নয়। কিন্তু শিরোনামটা দিয়ে বসলাম। ইচ্ছে করল তাই দিলাম। দেওয়াতে কোনো অপরাধ হয়নি। কিন্তু নিজের তৈরি ইমেজের নিচে মানুষ আকছার চাপা পড়ে থাকেন। আমার উসখুসানিটাও সে রকম। সহসা কোনো ক্লিষ্ট অলঙ্কার প্রয়োগ করি না বিধায় আজ খানিক অশান্তি লাগছিল।

তবে অন্তত দুটো দিক থেকে এই পরিস্থিতিতেও কিছু আরাম আমি পেতে পারি। আসলে কিছু আরাম আমি অতিগুরুত্বপূর্ণ আমার গুটিকতক পাঠককেও দিতে পারি। একটা হল, বিডিনিউজে বহুদিন লিখি না। একদম সুনির্দিষ্ট কারণে লিখি না। লিখতে এমনিতেই আমার বুক ধড়ফড় করে, মানে ডেডলাইনের চাপে। তার মধ্যে কোনটা নিরাপদ কোনটা আপদ, কিংবা কোনটা নিয়ে কথা কওয়া যাবে না এসব ব্যাপারে মুদ্রিত পত্রিকার মতো অনলাইন পত্রিকারও বহু রকমের ফ্যাঁকড়া থাকে। প্রায়শই সেসব ফ্যাঁকড়া সরল প্রকাশ্য স্বীকারোক্তিতে থাকে না। কিন্তু লিখিয়েদের, অন্তত কারও কারও, সেসব অভিজ্ঞতা হয়। তো, আমারও হয়েছিল। ফলে এই ওয়েবপত্রিকায় আমার নৈঃশব্দ খানিক ঘটনাপ্রসূত।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ বিশেষ কোনো নৈঃশব্দের দেশ নয়। এখানে সবচেয়ে সুলভে যা মেলে তা হল শব্দ। পদার্থবিজ্ঞানীয় অর্থে শব্দ। রাজনৈতিক হুংকার অর্থে শব্দ। প্রতিশ্রুতির বাকোয়াস অর্থে শব্দ। শব্দময় এক দেশ আমাদের। নৈঃশব্দ এখানে বড়জোর একটা রূপকার্থক কথা। আর ঝড় বাংলাদেশে এমন কোনো চমকদার ঘটনা না যে তা নিয়ে কাবু হয়ে পড়তে হবে। প্রাকৃতিক ঝড়ঝঞ্ঝা বরং খানিক কমে থাকতে পারে বাংলাদেশে, সামাজিক ঝড়ের কোনো পূর্বাভাসেরই দরকার নেই এদেশে। আর তা নিয়ে কেউ মোটেই কাবু থাকে না। সাধারণভাবে বাংলাদেশে এবং বিশেষভাবে বিগত এক বছরের বাংলাদেশে, সড়ক থেকে মাঠঘাটে যতভাবে ও যে হারে মানুষজন হরেদরে বিচিত্র সব পদ্ধতিতে মারা পড়েন তাতে ঝড়ের পূর্বাভাস নেহায়েৎ বাড়াবাড়ি রূপক। এদেশে। এক্ষণে।

আওয়ামী লীগ বলতে যদি শেখ হাসিনা এবং তাঁর একান্ত লোকজনকে বোঝানো হয়ে থাকে তাহলে আওয়ামী লীগের পক্ষে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা এবং তৎপরবর্তী ব্যবস্থাপনা বিশ্লেষকরা যা ভেবেছিলেন তার থেকে ঢের ঢের পোক্তভাবে হয়েছে। হচ্ছে। বিশ্লেষকদের কথা যদি বাদও দিই, খোদ বিএনপির হাইকমান্ড, নীতিনির্ধারকগণও এটা আশা করেননি। আওয়ামী লীগের শক্তির জায়গাগুলো কী সেটা তাঁরা নিজেরা যেমন জানেন, ঠিক তেমনি জানা থাকার কথা বিএনপিরও।

তবে বিএনপির লাগাতার কাজকর্মে সেই জানা থাকার কোনো নজির পাওয়া যায়নি। তার একটা মানে হল, বিএনপির আসলে বিশ্লেষণ বা হিসেব-নিকেশে গুরুতর গোলমাল ছিল, কিংবা এখনও আছে। এই সংক্রান্ত বিষয় বলবার কালে আমি সতর্ক আছি যে আওয়ামী লীগ কিংবা শেখ হাসিনার সরকার যা এবং যেভাবে করলেন তাকে আর যাই হোক গণতন্ত্র বলা বাতুলতা মাত্র। কিংবা আদৌ আওয়ামী লীগের (বা বিএনপির) কাছ থেকে আমি নিজে গণতন্ত্র বিশেষ একটুও কামনা করে থাকি।

এ বিষয়ে আরও সতর্কভাবে আমি এও বলতে চাই যে, বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকেও আসলে টেলিভিশন সম্প্রচার ঘণ্টা ভর্তি করা ছাড়াও আমি বিশেষ কিছু আশা করি না। কিন্তু কথা আসলে আমাকে নিয়ে হচ্ছে না। হচ্ছে প্রায় অবোধগম্য বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে। পরিস্থিতিটা আসলে কী? উপরন্তু, সেই পরিস্থিতিতে কাগজে-কলমে-থাকা সরকার যাই করুক, কাগজ-কলমবিহীন প্রধান বিরোধী দল আসলে কী করছে সেটা একটা গবেষণার বিষয়বস্তু বটে।

গবেষণাটা আমি করে সেরে ফেলতে পারব সেই ভরসা আমার নেই। বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকদের মতোই এ বিষয়ে আমি অপারগ। কিন্তু কিছু বিষয়ে আলোকপাত করা হয়তো সম্ভব। সেগুলোর সবটাও হয়তো প্রমাণ করা মুশকিল হবে। তবে একটা আলাপচারিতার অংশ হিসেবে সামনে নিয়ে আসা যায়।

যদি একটা প্রস্তাবনা আকারে বলি যে 'হাওয়া ভবন'কেন্দ্রিক পরিচালনা (গভর্ন্যান্স) বিএনপির জন্য সবচেয়ে বড় আত্মঘাতী, প্রায় আত্মলুপ্তির, কারণ তাহলে অনেকেই হারেরেরে করে আসবেন মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য যে আওয়ামী লীগের মধ্যেও গণতন্ত্রও এতটুকু বেশি ধারালো নয়। বটেই! আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির মধ্যে গণতন্ত্র না খুঁজে আমরা সাধারণভাবে তাদের দ্বারা প্রদত্ত জনসাধারণের জন্য 'গণতন্ত্র' খুঁজি। আমাদের এই অনুসন্ধান হাস্যকর বললেও কম বলা হয়। কিন্তু এটাই বাংলাদেশে দস্তুর।

তবে 'হাওয়া ভবন' আর 'সুধাসদন'-এর মধ্যকার গভর্ন্যান্স তুলনাটা ভয়ানক রকমের অগণতান্ত্রিক একটা সমাজেও বিশেষ অকার্যকর। 'সুধাসদন' কিংবা সমরূপী শেখ হাসিনার দরবারগুলোকে 'হাওয়া ভবনে'র সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে, কিংবা হাওয়া ভবনের কার্যপ্রণালীর সঙ্গে অন্যপক্ষের কার্যপ্রণালী গুলিয়ে ফেললে গোঁয়ার তর্ক করা যাবে, কিন্তু পরিস্থিতিটা বোঝা যাবে না। অধিকন্তু, গণতন্ত্রহীন আওয়ামী লীগের মধ্যকার কেন্দ্র বা কেন্দ্রসমূহ শেখ হাসিনাকে চ্যালেঞ্জ করে না; বা আলামতযোগ্য কোনো মোকাবিলা পাওয়া যায় না।

বিপরীতে, গণতন্ত্রহীন বিএনপির কেন্দ্র, ধরা যাক হাওয়া ভবন, খোদ খালেদা জিয়া কিংবা বিএনপি হেডকোয়ার্টারের জন্য লাগাতার মাথাব্যথার কারণ হয়েছে। বাংলাদেশের নিরীহ জনগণ (মানে রাজনীতি বিশ্লেষকগণ) বুর্জোয়া পার্টিসমূহের ভিতরে গণতন্ত্র না চেয়ে যতই না কেন দেশের জন্য তাঁদের দরবারে গণতন্ত্র ভিক্ষা করুন, এই প্রবণতাটি লক্ষ্য না করলে তাঁদের চাকরিটাও নড়বড়ে হয়ে যাবে (মানে, বিশ্লেষকের চাকরির কথা বলছি। ধামাধরার চাকরি তো সহজে যায় না যা আমরা সবাই জানি)।

তাহলে আমি প্রথম যে প্রস্তাবনাটি রাখতে চাইছি তা হল বিগত বছরগুলোতে হাওয়া ভবনের অমিত শক্তি একটা অন্তত অগণতান্ত্রিক দলের কার্যপ্রণালীর ধারাবাহিকতা রাখতেও বিশেষ ধরনের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষয়ক্ষতি করে দিয়েছে। মাথায় রাখুন বরং।

জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখা নিয়ে বিএনপির সবচেয়ে কথা শুনতে হচ্ছে। কথা শুনতে হচ্ছে দেশের মধ্যে এবং এই মুহূর্তে বহির্বিশ্ব থেকেও। এই বদনামটা বিএনপিকে দিতে পারার ১৮ আনা কৃতিত্ব আওয়ামী লীগের চৌকষ লবিস্টদের। কিন্তু আমি নানান রকম ভেবেচিন্তেও এটাকে বিএনপির বর্তমান বিমূঢ়তার জন্য দায়ী করছি না। বরং যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রক্রিয়া শুরুর সঙ্গে এই কর্তব্যবিভ্রাটটা সম্পর্কিত। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির মৈত্রী নয়। যেভাবেই হোক না কেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হয়েছে।

সেটার রাজনৈতিক ফায়দা আওয়ামী লীগ যা হাসিল করতে পারবে বলেই ভাবুক না কেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করে দেবার মতো আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনা ধুম করে আওয়ামী লীগ করে ফেলবে সেটার জন্য বিএনপির পর্যাপ্ত প্রস্তুতিতে ঘাটতি ছিল। যখন সত্যি সত্যিই সেটা ঘটল, তখনও সেটা সামলাবার মতো কোনো চৌকষ পদক্ষেপ বিএনপি নিতে পারেনি।

যেমন, ধরা যাক, বিএনপির দেশীয় 'বুদ্ধিজীবী' মিত্র ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মিত্রদের সম্মিলিত উদ্যোগে এমন এক 'স্বাধীন যুদ্ধাপরাধী অনুসন্ধান কেন্দ্র' গঠন যার কাজ হতে পারত রাষ্ট্রকে সহায়তা প্রদান। বলাইবাহুল্য, এটার মূল গুরুত্ব হত প্রাদর্শনিক; বিএনপি মাঝেমধ্যেই মাঠে-ময়দানে আওয়ামী লীগের মধ্যে থাকা যুদ্ধাপরাধী নিয়ে যে হৈচৈ করেছে সেটারও পাটাতন মজবুত করা যেত।

যাহোক, এখানে আমার প্রস্তাবনা ছিল জামায়াতের সঙ্গ আলাদা করে বিএনপিকে ঝামেলায় ফেলেনি; যা কিছু বিব্রতি বা কর্তব্যবিভ্রাট তৈরি হয়েছে সেটা 'যুদ্ধাপরাধ' প্রসঙ্গটাকে ফ্রন্টলাইন এবং মিডিয়ালাইনে চৌকষভাবে সামলাতে না পারার কারণে। বরং জামায়াত ও বিএনপির যৌথ জমিনের জায়গা থেকে দুজনের কারও পক্ষেই স্থানত্যাগ করা সহজ নয়। কোনো বুদ্ধিসঙ্গত কারণও নেই।

এটাও পুরনো আলাপ এবং হাওয়া ভবনের সঙ্গেই সম্পর্কিত, সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বর্তমান রাজনৈতিক দলের ভোটার সংখ্যা দেখে কেউ বিচলিত না হওয়াই ভালো। কিন্তু বদরুদ্দোজা সাহেবকে বা তাঁর মতো মানুষজনকে বিএনপি চৌকাঠ থেকে সরিয়ে দিয়ে দীর্ঘকালীন ক্ষতি করেছে দেনদরবারকারী কমিয়ে। অনেকেই এখনও মুখস্তের মতো বলতে থাকেন, জনাব চৌধুরী জিয়াউর রহমানের প্রতি অসম্মান দেখানোর কারণে ইত্যাদি ইত্যাদি। তত্ত্ব হিসেবে এটা এতটাই দুর্বল এবং কৌতুককর যে দীর্ঘ আলাপের মানে হয় না। হাওয়া ভবনের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব আবিষ্কার করার জন্য হয়তো আমাদের গোয়েন্দাবৃত্তির প্রয়োজন পড়বে। তবে সাধারণ বোধবুদ্ধি দিয়ে সেই খরচটা কমিয়ে ফেলতে পারা যায়।

এখানে আমার আগ্রহ জনাব চৌধুরীর প্রতি বাড়তি কোনো সহমর্মিতা দেখানো নয়। আর তাঁর সেটা এখন বিশেষ কোনো কাজে আসবে বলেও মনে হয় না। কিন্তু আবারও পুরনো আলাপ স্মরণ করতে হয় যে, বাংলাদেশের ক্ষমতা প্রতিপক্ষতা আওয়ামী লীগ আর বিরুদ্ধ-আওয়ামী লীগের। জনাব চৌধুরীর মতো মানুষজন বিরুদ্ধ-আওয়ামী ঘাঁটিকে জবান দেবার জন্য অতীব জরুরি মুখ (ছিলেন)। আলাপ-আলোচনায় প্রায় তালকানা জনাকয়েক বঙ্গবীর দিয়ে সেই ঘাটতি কখনও-ই পূরণ হয়নি বিএনপির। আর পার্টির মধ্যকার কণ্ঠস্বর আর কাগুজে বাঘ কতকগুলো 'মোর্চাভুক্ত' দলের খাপছাড়া স্বর এক জিনিস নয়।

হেফাজতে ইসলামের ঐতিহাসিক 'শো-ডাউন' থেকে আসলে বিএনপি ফায়দা নিতে পারেনি। চূড়ান্ত বিচারে নিতে পারেনি আওয়ামী লীগও। প্রমাণ করতে না পারলেও উপলব্ধি করতে পারা যায় যে নিতে চেয়েছিল দুই দলই। তবে না নিতে পারার পরিস্থিতিতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিএনপি। হিসেবটা একটু জটিল। আওয়ামী লীগ বলপ্রয়োগ করে হোক বা জলপ্রয়োগ করে, এই জমায়েতকে হঠিয়েছে। সর্বোপরি, সেই হঠানোর কাজটা করতে গিয়ে বহুদিনের অবন্ধুসুলভ রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোকে একযোগে কাজ করানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে পেরেছে। আপাতদৃষ্টে সেটা লাভই।

কিন্তু পক্ষান্তরে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ হেফাজতের আস্ফালনের সঙ্গে কণ্ঠস্বর মিলিয়ে ফেলার কারণে তাঁদের হেফাজত-নির্ভর মনে হয়েছে এবং তাঁদেরকে রাষ্ট্র-নির্ধারিত 'অপরাধী'র জায়গা নিতে হয়েছে। আখেরে এমনকি হেফাজত যে 'হুলুস্থূল' তৈরি করবে বলে ভাবা হচ্ছিল তা তৈরি হয়নি। পুরো হেফাজত-কাণ্ডে বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশ ও দশের চিত্ত। মধ্যবিত্ত আত্মা প্রকম্পিত হয়েছে, আর সেটা নিয়ে আমার নিজের মায়াকান্না কম। কিন্তু অন্ত্যজ মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে একাধিক পক্ষ হেলাফেলার রাজনীতি করেছে। সেটা বেদনাদায়ক; আর সেই ক্ষতটির জন্য প্রত্যন্তের মানুষজন বিএনপিকেও দায়ী করবে, করছে।

গণজাগরণ মঞ্চের আকস্মিক ও নাটকীয় উত্থান নিয়ে নানারকম তত্ত্ব চালু আছে। বিস্তারিত আলাপে খতিয়ে দেখা যেতে পারে হয়তো প্রত্যেকটা তত্ত্বেরই কিছু না কিছু উজ্জ্বল দিক রয়েছে। সেই আলাপ এখানে বিস্তৃত করব না আজকের খেই তা নষ্ট করতে পারে বলে। তবে গণজাগরণ মঞ্চ ও তার দাবি নিয়ে বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের লাগাতার দ্বিধা বিএনপিকে কর্তব্যবিচ্যুত করেছে।

আমার বক্তব্য এই নয় যে বিএনপির গণজাগরণ মঞ্চের সমর্থন করতে পারা উচিত ছিল; বরং সেই সমর্থন আমি দেবার আগেও সত্তর বার চিন্তা করব। আমার বক্তব্য এই যে এই মোর্চার দাবি ও মোর্চার গঠন প্রসঙ্গে অবস্থান নিতে গিয়ে বিএনপি প্রথমত বিভ্রান্ত হয়েছে এবং শেষত 'আমার দেশ' তথা 'বাঁশের কেল্লা'র খপ্পরে পড়েছে। কোনো জাতীয় রাজনৈতিক দলকে এ রকম দ্বিধাগ্রস্ত বা ওয়েবসাইটের ছায়াতলে দেখতে থাকার মধ্য দিয়ে তার প্রতি প্রত্যয়হীনতা জন্মে।

আমার দেওয়া শিরোনামাটা আসলেই ক্লিষ্ট। এই মুহূর্তে রাজনৈতিক পদক্ষেপ প্রশ্নে বিএনপিকে দ্বিধাগ্রস্ত মনে হচ্ছে বললে পরিস্থিতি বেশি লঘু করে বলা হয়। বিএনপিকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় একটা সত্তা মনে হচ্ছে যার এমনকি কার্যকর কোনো চেইন-অব-কমান্ডও টের পাওয়া যাচ্ছে না। বিএনপির এই কমজোরী কেবল বর্তমান সরকারের বাহিনী ম্যানেজমেন্ট হিসেবে দেখলে বিএনপির বন্ধুরা ভুল করবেন। এমনকি বহুজাতিক বন্ধু ম্যানেজমেন্ট হিসেবে দেখলেও।

বিএনপির মিত্ররা বরং, বিনয়ের সঙ্গেই বলি, বিএনপির প্রবণতা ও তৎপরতা বিষয়ে আরও মনোযোগ দিলে পরিস্থিতিটা ভালো বুঝতে পারবেন। আওয়ামী পক্ষীয় লবিস্ট কিংবা চালদানকারীরা যদি বিএনপিকে কুণ্ঠিত, কমজোরী, দ্বিধাগ্রস্ত আর স্বার্থ-ভারাক্রান্ত সংঘর্ষময় একটা রাজনৈতিক দল হিসেবে দেখতে চেয়ে থাকেন, তাহলে তাঁরা একটা টোস্ট উদযাপন করতেই পারেন। অন্তত এই মুহূর্তে। ঝড়টা যদি খোদ বিএনপির মধ্যেই শুরু হয়, তাহলে আওয়ামী লীগের পার্টিরাত্রি আরও লম্বা হবে কেবল।

বিএনপি একটা কিম্ভূত নির্বাচনের বদলি নির্বাচন চাইতে থেকে দেশবাসীর কানে পৌঁছাতে চায়, নাকি রাষ্ট্রপরিচালনা ও সমাজ-সংস্কৃতির কিছু বিষয়, লোকদেখানো হলেও, বিবেচনায় এনে মনোগোচর হতে চায় সেটা বিএনপির নেতৃবৃন্দকেই ঠিক করতে হবে এবং এখনই এবং দেশের মধ্যে থাকা বুদ্ধিবল দিয়েই।

কেবল ময়দানে বক্তৃতার সময় নয়। কিছুতেই কেবল লন্ডন-মুখাপেক্ষী থেকে নয়।

[উত্তরা॥ ৩০-৩১ জানুয়ারি ২০১৪]

মানস চৌধুরী: লেখক, সংকলক ও অনুবাদক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞানের শিক্ষক।