বিভেদের রাজনীতি নয়, শক্তিশালী উপজেলা পরিষদ

ধীরাজ কুমার নাথ
Published : 29 Jan 2014, 09:56 AM
Updated : 29 Jan 2014, 09:56 AM
নির্বাচন কমিশন স্থানীয় সরকারসহ সকল প্রকার নির্বাচন সময়মতো অনুষ্ঠানের ব্যাপারে খুবই তৎপর হয়েছে। অতীতের ইতিহাস হচ্ছে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার দু'তিন বছর পরও স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হয়নি। এবারের নির্বাচন কমিশন বোধহয় সময়ের প্রতি অতিশয় যত্নশীল হয়েছেন, যার ফলে খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচন মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার তিন মাস আগেই সম্পন্ন করেছেন, যা ছিল অভূতপূর্ব।

গাজীপুরসহ পাঁচটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ফলাফল দেশের রাজনীতিতে নতুন ভাবনা ও মেরুকরণের সুচনা করেছিল। এবারের উপজেলা নির্বাচন কী জাতীয় ভাবনার জন্ম দেয় বিচক্ষণ রাজনীতিবিদেরাই বলতে পারেন। তবে অনেকে বলছেন এ হচ্ছে বিরোধী দলসমূহকে ব্যস্ত রাখার একটি প্রক্রিয়া। প্রধান উদ্দেশ্য সরকারের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার আন্দোলন যেন গড়ে উঠতে না পারে তার জন্য রাজনৈতিক অঙ্গনকে ভিন্নমুখে প্রবাহিত করা। উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, সময়মতো নির্বাচন হওয়াই বাঞ্ছনীয় এবং এর ফলে স্থানীয় সরকারসমূহ সচল থাকে এবং এভাবে নির্বাচিতরা যেন এলাকার উন্নয়ন ও জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতে পারেন তার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

উপজেলা পরিষদের প্রথম দফায় নির্বাচন হবে ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪। প্রথম পর্বে ১০২ উপজেলায় নির্বাচন হবে। এ সকল উপজেলার মেয়াদ শেষ হল ২৮ জানুয়ারি। দ্বিতীয় দফায় নির্বাচন হবে ২৭ ফেব্রুয়ারি, অপর ১১৭ উপজেলায়। মোট ৬ দফায় ৪৮৭ উপজেলা পরিষদের নির্বাচন সমাপনের প্রস্তুতি নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তবে অধিকাংশ উপজেলার ৫ বছরের মেয়াদ শেষ হবে মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে। এছাড়া জুন মাসেও মেয়াদ শেষ হওয়ার মতো উপজেলার সংখ্যা অর্ধশতাধিক। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী এলাকায় সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

উপজেলা পরিষদ যাত্রা শুরু করেছিল এখন থেকে প্রায় বত্রিশ বছর পূর্বে, ১৯৮২ সালে। স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ এবং উপজেলা প্রশাসন পুনর্গঠন) অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে পরিষদের যাত্রা শুরু হয়। লক্ষ্য ছিল, স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করে দায়িত্ব বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে উন্নয়নের গতিধারা তৃণমূলে সঞ্চার করে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের ভিত্তি রচনা করা। দু'বার নির্বাচনের পর ১৯৯১ সালে উপজেলা পরিষদ পদ্ধতি বাতিল হয়ে যায়।

অবশেষে ২০০৯ সালের ৬ এপ্রিল বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে উপজেলা পরিষদ (রহিতকরণ আইন, পুনঃপ্রবর্তন এবং সংশোধন) বিল অনুমোদনের ফলে উপজেলা পদ্ধতি স্থানীয় সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এবং প্রশাসনিক স্তর হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। স্থানীয় সরকার পদ্ধতির অগ্রযাত্রার পথে উপজেলা পদ্ধতির পুনঃপ্রবর্তন হচ্ছে সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত এবং বিশাল মাইলফলক।

যে সকল কারণে অতীতে উপজেলা পরিষদের কার্যকারিতা নিয়ে বির্তকের সূচনা হয়েছিল, সে সব জটিলতার এখনও অবসান হয়নি। আইন সংশোধন করে বর্তমান সরকারই স্থানীয় সংসদ সদস্যদের উপদেষ্টা নিয়োগ করেছিলেন। শুধু উপদেষ্টা নয়, স্থানীয় সংসদ সদস্যের সুপারিশ উপজেলা পরিষদের জন্য বাধ্যতামূলকও করে দিলেন। উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টার সম্মতি ছাড়া সরকারের নিকট যোগাযোগও করতে পারবেন না, এমন অনুশাসনও জারি হল্। উপদেষ্টা মোটামুটিভাবে একজন উপজেলার গভর্নরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন।

জাতীয় সংসদের একজন আইন প্রণয়নকারী সম্মানিত ব্যক্তিত্ব একই সঙ্গে উপজেলার প্রধান নির্বাহীর ভূমিকা পালন করতে শুরু করলেন। একজন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেন কিন্তু তার কার্যপরিধি এবং ক্ষমতা নিয়ে শুরু হল বিভ্রাট। এসব কারণে উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানগণ দারুণভাবে অসন্তুষ্ট হলেন। চাঁদপুর সদর উপজেলার চেয়ারম্যান ইউসুফ গাজী হতাশাগ্রস্ত হয়ে বলেছিলেন, ''আইনটি এমন হয়েছে যে সংসদ সদস্যকে না জানিয়ে কবর জেয়ারত বা দাওয়াত খেতেও যাওয়া যাবে না।''

গাজীপুর থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সাহেব সংসদেই এর বিরুদ্ধে বিল উত্থাপন করেছিলেন। তবে প্রাক্তন মন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু উপজেলা নির্বার্হী অফিসারকে পরিষদের প্রধান নির্বাহী অফিসারের পরিবর্তে পরিষদের সচিব হিসেবে চিহ্নিত করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং সংসদে তা গৃহীত হয়েছে। আমলাতন্ত্রকে হেয় প্রতিপন্ন করার এমন দৃশ্যমান উদ্যোগ অতীতে পরিলক্ষিত হয়নি।

লক্ষ্যণীয় যে, উপজেলা পরিষদের সংখ্যা হচ্ছে বর্তমানে ৪৮৭, কিন্তু সংসদ সদস্য হচ্ছেন ৩৪৫ জন। অর্থাৎ কয়েকজন সংসদ সদস্য একাধিক উপজেলার উপর খবরদারি করবেন, অথচ এ কাজের জন্য জনগণ তাকে ভোট দেয়নি।

বাংলাদেশ উপজেলাসমূহের র সমন্বয়ে গঠিত কোনো ফেডারেল সরকার নয়, এ কথা সত্য কিন্তু এটাও মেনে নেওয়া যায় না যে, বাংলাদেশের সর্বত্র সকল কর্মকাণ্ড– বিবাহ বিচ্ছেদ থেকে শুরু করে চুরি-ডাকাতির মামলা– সবই কেন্দ্রীয় সরকার করবেন এবং জাতীয় সংসদের সম্মনিত সদস্যগণ কচুরিপানা নির্মূল অভিযান থেকে শুরু করে গ্যাস ও তৈল অনুসন্ধান কেন্দ্র স্থাপন সবই তদারকি করবেন! এমনটি হয়ও না এবং জাতির বৃহত্তর স্বার্থে বাঞ্ছনীয়ও নয়। এ জাতীয় ভাবনা ও কেন্দ্রীয়ভাবে ক্ষমতা প্রয়োগের অভিসন্ধি জাতীয় চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এবং সংবিধানের নবম অনুচ্ছেদের নির্দেশনার পরিপন্থী।

উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের পূর্বে এ সকল বিষয় ভাবনার এবং সমাধানের প্রয়োজনীয়তা দীর্ঘদিন থেকে অনুভব করা হচ্ছিল। অনেক বির্তকের অবসান করা প্রয়োজন আলোচনার মাধ্যমে, কার্যক্রমের স্থায়িত্বের প্রয়োজনে এবং জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জনের স্বার্থে। দেশের সকল অঞ্চল ও জাতিসত্তাকে সমানভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী, পিছিয়ে পড়া অধিবাসীগণ এবং দুর্গম এলাকায় বসবাসকারীদের জন্য তাদের নিজস্ব ভাবনার আলোকে প্রগতির পথ সুগম করাই হবে স্বাধীনতার চেতনার বহিঃপ্রকাশ। সংসদীয় গণতন্ত্রের এখানেই হচ্ছে উৎকর্ষ এবং যে কোনো জনদরদী সরকারের আদর্শ প্রতিফলনের অন্যতম সুযোগ।

স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে ভূমি প্রশাসন ও ভূমি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা, খাসজমি ভূমিহীন চাষীদের মধ্যে বিতরণ, কৃষিতে উৎপাদনের লক্ষ্যে বিনিয়োগ ও উপকরণ বিতরণ, মৎস্য পশুপালন ও পোল্ট্রি শিল্পে উৎকর্ষ আনয়ন, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকাণ্ডে গণসচেতনতা বৃদ্ধি, মহিলাদের ক্ষমতায়ন ও নারী নির্যাতন নিবারণ, শিক্ষায় উৎসাহদান, দুগ্ধ উৎপাদন ও সমবায়ের মাধ্যমে পণ্য বিপণনের সুযোগ সৃষ্টি– এ সকল কর্মকাণ্ড ছেড়ে দিতে হবে স্থানীয় সরকারের হাতে। এ সকল কাজে সংসদ সদস্যগণ অর্থবহ উপদেশ দিতে পারেন কিন্তু নির্বাহী ভূমিকা পালনের সুযোগ হতে হবে অবশ্যই সীমিত।

অনাবশ্যক বিরোধের সূত্রপাত হতে পারে অথবা স্থানীয় প্রতিভা বিকাশের সুযোগ বাধাগ্রস্ত হতে পারে এমন কার্যক্রম বা ক্ষমতা প্রয়োগের অভিপ্রায় বর্জন করাই হবে সময়োপযুগী কৌশল। কেন্দ্রীয়ভাবে এবং সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে ক্ষমতা প্রয়োগের ভাবনা হচ্ছে গণবিরোধী এবং দারিদ্র্য বিমোচন ও আর্থ-সামাজিক উত্তরণের পরিপন্থী।

তবে দেশের সর্বত্র সমানভাবে আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি নিশ্চিত করার স্বার্থে, দুর্গম এলাকার জনগণের দুয়ারে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের প্রয়োজনে এবং পিছিয়ে পড়া মানুষের জীবনে আধুনিক সভ্যতার স্পর্শ অনুভবের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করার বিকল্প নেই। শুধু নির্বাচনের নামে দলাদলি ও বিভেদের রাজনীতির রোপণ করা হলে জাতি সামনে অগ্রসর হতে পারবে না।

তাই সামরিক বাহিনী দিয়ে ভয় দেখিয়ে নির্বিঘ্নে নির্বাচন করাই বাহাদুরি নয়। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে হলে প্রয়োজন সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ। বাজেট পদ্ধতি থেকে শুরু করে প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে আনতে হবে অনেক পরিবর্তন। জননিরাপত্তার কাজ এবং জঙ্গীবাদ নিরসনের দায়িত্ব দিতে হবে উপজেলা পরিষদকে। ইউনিয়ন পর্যায়ে গ্রাম-সালিশি বা বিচার ব্যবস্থার ভাবনায় বাস্তব রূপ দিতে হবে এবং প্রয়োজনে বর্তমান পদ্ধতিসমূহে অনেক পরিবর্তন সাধন করা যেতে পারে।

লক্ষ্যণীয় যে, প্রতিটি সরকার যখন ক্ষমতায় আসে তখন তাদের দলের মহাসচিবকে করা হয় স্থানীয় সরকারের মন্ত্রী। অন্যতম কারণ হচ্ছে, তিনি স্থানীয় সরকারের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন। প্রভাব বিস্তারের কাজটি অনেক ক্ষেত্রে নেতিবাচকও হতে পারে। যেমন কোনো চেয়ারম্যান সরকারের সমালোচনা করলে, নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদকে বাতিল বা সুপারসিড করতে পারেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী। আমরা বলব, এমন কালাকানুন অবশ্যই প্রত্যাহার করতে হবে।

উপজেলা পরিষদ শক্তিশালী করতে হলে শুধু সুষ্ঠু নির্বাচন যথেষ্ট নয়, স্থানীয় সরকারকে সকল নীতিনির্ধারণের ক্ষমতা দান করে 'মিনি' সরকারের প্রতিচ্ছবি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তবেই কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি জনগণের আকর্ষণ দূরীভূত হবে। স্বনির্ভর অর্থনীতি ও স্থানীয় অবকাঠমো নির্মাণের মাধ্যমে এলাকার নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো সম্ভব হবে। রাজধানীকেন্দ্রিক রাজনীতি, নগরভিত্তিক বসবাস, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার জন্যে শহরমুখী হওয়া থেকে বিরত থাকতে পারলে জনজীবনে দুর্গতি অনেকাংশে হ্রাস পাবে। জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাস তৃণমূলে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।

এ কথা সত্যি যে একটি শক্তিশালী উপজেলা পরিষদ সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, বাল্যবিবাহ নিরোধ, ভূমিদস্যুদের উপদ্রব বন্ধ এবং হিংসার রাজনীতি প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবে। তাছাড়া দেশের অবহেলিত অঞ্চলের উন্নতি সাধনসহ বঞ্চিত জনগণের অগ্রগতির জন্যও অবদান রাখতে পারবে।

উপজেলা পরিষদ শক্তিশালী না করে বারবার নির্বাচন করা হবে বিভেদের রাজনীতি তৃণমূলে প্রসার করার অপকৌশল মাত্র।

ধীরাজ কুমার নাথ: সাবেক সচিব