কংসমামাদের নিধনযজ্ঞে বিপন্ন সংখ্যালঘু

বীরেন্দ্র নাথ অধিকারী
Published : 7 Jan 2014, 08:35 AM
Updated : 7 Jan 2014, 08:35 AM

৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের দশম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। এই নির্বাচনের আগে ও পরে দেশব্যাপী ব্যাপক সংহিসতা ও অরাজকতা সংঘটিত হয়েছে এবং এখনও সেসব ঘটে চলছে। এই প্রবন্ধ লেখার সময় দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, যশোরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের উপর হামলা, অত্যাচার ও নির্যাতনের সচিত্র প্রতিবেদন বিভিন্ন টিভি চ্যানেল কিছুটা প্রচার করছে।

তাতে দেখা যাচ্ছে যে, কয়েক হাজার মানুষ ভিটেমাটি ছেড়ে মন্দির এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। নিপীড়িতরা জানিয়েছেন, হামলা বন্ধে অনুরোধ জানিয়ে বারবার ফোন করেও প্রশাসন এবং আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কারও কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। কবে এবং কীভাবে সংখ্যালঘুদের উপর এই হামলার অবসান ঘটবে তা সম্ভবত স্বয়ং বিধাতারও অজানা।

এই প্রথম নয়, অতীতেও এই জনগোষ্ঠী নির্বাচন এলেই বারবার শিকারের মূল লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন। তবে এবার তাদের ওপর হামলা, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন ইত্যাদির ব্যাপকতা অনেক অনেক বেশি। এসব বর্বরোচিত ঘটনাবলীর প্রতিকার এবং সেসব ভবিষ্যতে আর যাতে সংঘটিত না হয় তা নিয়ে আলোকপাত করা এই প্রবন্ধের মূখ্য উদ্দেশ্য।

গত প্রায় ৩ বছর যাবত দেশ-বিদেশের প্রায় সকল মহলেরই আলোচনার মূখ্য বিষয়বস্তু বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে বিবাদমান পক্ষগুলোর মধ্যে কীভাবে সমঝোতা হবে। এই সময়কালে হাজার হাজার ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষ হামলা ও অত্যাচারের শিকার হয়ে গ্রাম ছেড়ে কিছুটা নিরাপদ শহরে গিয়ে বসবাস শুরু করছেন। আবার শোনা যাচ্ছে, বহু মানুষ দেশান্তরিত হয়েছেন বা দেশান্তরিত হওয়ার চেষ্টা করছেন। উপদ্রুত এলাকার এই জনগোষ্ঠীর সবার বিনিদ্র রজনী কাটে, ঘরে-বাইরে হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে কোনো রকমে বেঁচে থাকতে হয় তাদের।

৫ জানুয়ারি সম্পন্ন হওয়া নির্বাচনের জের ধরে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর পরিচালিত হালের মধ্যযুগীয় হামলাই এর সর্বশেষ নিকৃষ্টতম উদাহরণ। সেই প্রেক্ষিতে দেশের সকল রাজনৈতিক দল, সরকার, ধর্মীয় সংখ্যাগুরু জনগণ, দেশ-বিদেশের মানবাধিকার সংস্থা, কূটনৈতিক কোর, উন্নয়ন সংস্থা, জাতিসংঘ, দেশি-বিদেশি মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, টকশো বক্তা প্রমুখের নিকট কতিপয় জ্ঞাতব্য, জিজ্ঞাস্য ও করণীয় বিষয় উপস্থাপনীয়।

এই ভূ-অঞ্চলে সভ্যতা বিকাশের গোড়াপত্তনকারী এবং হাজার হাজার বছর ধরে বসবাসকারী উন্নত বিশাল এক জনগোষ্ঠী দিন দিন বিপন্ন থেকে বিপন্নতর হচ্ছে। মূলত বিগত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভাজন কেন্দ্র করে তাদের এই বিপন্নতার সূত্রপাত ঘটে। উপমহাদেশের তৎকালীন রাজনীতিবিদদের ধর্মীয়, আঞ্চলিক, সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব, কূটচাল ও ক্ষমতালিপ্সার মদমত্ততায় ঐতিহাসিক ভুল সিদ্ধান্তের বলি বর্তমান বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু এই জনগোষ্ঠী– যাদের মধ্যে প্রায় ৯৯ শতাংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বী; বাকিরা বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী।

দ্বিজাতিতত্ত্বের কুফসল পাকিস্তান নামক একটি অস্বাভাবিক রাষ্ট্রে রাতারাতি তারা সবাই আপনা আপনিই অবাঞ্ছিত বনে যান। কারণ ধর্মভিত্তিক ওই তত্ত্বের একমাত্র ব্যাখ্যা হচ্ছে– পাকিস্তান কেবলমাত্র মুসলমানদের জন্য সৃষ্ট একটি রাষ্ট্র। ফলে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে অন্য জাতি-ধর্মের বিশাল জনগোষ্ঠী নিজভূমে পরবাসী হয়ে পড়েন। বাধ্য হয়ে লক্ষ লক্ষ সংখ্যালঘু মানুষ দেশান্তরিত হতে শুরু করেন।

আর যারা চৌদ্দ পুরুষের ভিটেমাটির মায়া কাটিয়ে দেশান্তরিত হতে চাননি তাদের জোরপূর্বক বিতাড়ণের পর্ব শুরু হয়। এ প্রক্রিয়ায় তৎকালীন সরকারের সরাসরি মদদ ও নিষ্ক্রিয়তায় এ অঞ্চলের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর ক্রমাগত অত্যাচার, নির্যাতন ও হামলা পরিচালনাসহ একাধিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে তাদের অধিকাংশই দেশত্যাগে বাধ্য হন। ব্যাপক এই দেশত্যাগের ফলে একসময়ের পূর্ব বাংলা, পরবর্তীতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সংখ্যা ২৩ বছরে (১৯৪৭–১৯৭০) অর্ধেকে নেমে আসে। অর্থাৎ এ দেশের মোট জনসংখ্যায় তাদের হার ৩০ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ১৫ শতাংশ হয়ে যায়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর কেবলমাত্র ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের দেশান্তরের ধারায় ছেদ পড়ে। এই সময়কালে রাষ্ট্রীয় উদার ও অসাম্প্রদায়িক নীতি এবং সে অনুযায়ী সরকার ও প্রশাসন পরিচালিত হবার ফলে, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাবোধ জাগ্রত হয় বিধায় তাদের দেশান্তরিত হওয়া সাময়িকভাবে কমে হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনককে নৃশংসভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে এই রাষ্ট্রের চরিত্র ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে দিয়ে পাকিস্তানি ভাবধারায় দেশপরিচালনা শুরু হয়।

ফলে এ দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা পুনরায় হুমকির মুখে পড়ে এবং নবপর্যায়ে তাদের দেশত্যাগ শুরু হয়। নব্বই দশকের প্রথম দিকে ভারতের বাবরি মসজিদে হামলা ও তা ধ্বংসের খেসারত দিতে হয় বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের। তাদের উপর তৎকালীন সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থনে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী হামলা, অত্যাচার ও নির্যাতন পরিচালিত হওয়ার ফলে স্বাধীনতার পর সেবারই প্রথম উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ধর্মীয় সংখ্যালঘু দেশত্যাগ করেন।

১৯৯৬–২০০১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা কিছুটা স্বস্তিতে থাকলেও, ২০০১ সালের ১ অক্টোবর নির্বাচনের পর তাদের উপর নেমে আসে মধ্যযুগীয় রর্বরতা। উক্ত নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের নেতা-কর্মীরা সংখ্যালঘুদের উপর ভয়াবহ অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়ন শুরু করে। তাদের ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ, শারীরিক হামলার মাধ্যমে জখম, হত্যা, ধর্ষণ, জোরপূর্বক ধর্মান্তর ও বিয়ে, জায়গা-জমি দখল, মিথ্যা মামলায় জড়ানো ইত্যাদি এমন কোনো অমানবিক ও পাশবিক নির্যাতন নেই যা তখন সংখ্যালঘুদের উপর পরিচালনা করা হয়নি।

এসব নারকীয় ঘটনাবলী বন্ধে কোনো প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ না করে, চারদলীয় জোটনেত্রী ও তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনে বিজয়োত্তর শুকরিয়া কামনায় ওমরাহ্ হজ্জ্ব পালনার্থে সৌদি আরব গমন করেন। আর তার দলের তৎকালীন মহাসচিব সে সময় বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারিত সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগের খবরের ব্যাপারে এই বলে মন্তব্য করেন যে, "কেউ যদি তাদের কৃতকর্মের দায়ে ভয় পেয়ে দেশ ছেড়ে চলে যায় তাতে সরকারের কী করার থাকতে পারে!''

জোট, দল এবং সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের এ ধরনের বক্তব্যে আস্কারা পেয়ে তৎকালীন চারদলীয় জোটের নেতা-কর্মীরা প্রশাসন এবং আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরব সমর্থনে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর টানা পাঁচ বছর অত্যাচার, নির্যাতন ও হামলা অব্যাহত রাখে। সংখ্যালঘুরা শুধু পড়ে পড়ে মার খেতে থাকেন।

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা ঘোষিত হলে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের মাত্রা কিছুটা হ্রাস পায়। এরপর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করলে তাদের উপর নির্যাতন সাময়িকভাবে বন্ধ হলেও তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। বিভিন্ন্ ধর্মীয় মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তি অল্প কিছুদিনের মধ্যে সুযোগ পেয়েই নানা অজুহাত ও কৌশলে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা শুরু করে।

দুঃখজনক হলেও সত্য, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে সরকার পরিচালিত হলেও সংখ্যালঘুরা হামলা থেকে রেহাই পাননি। দেশের সকল প্রান্তে থেমে থেমে হামলা পরিচালিত হয়েছে এ সরকারের আমলেও। সকল ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী কমবেশি হামলার শিকার হয়েছে। তবে গেল বছরের (২০১৩) ২৮ ফেব্রুয়ারি অন্যতম শীর্ষ ও নৃশংসতম যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষিত হওয়ার পর সংখ্যালঘুদের উপর দেশব্যাপী একযোগে সবচেয়ে বড় হামলা পরিচালিত হয়।

সেই থেকে অদ্যাবধি প্রতিনিয়ত দেশের কোনো না কোনো স্থানে তাদের উপর হামলা চলে আসছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনরত বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট বিভিন্ন কর্মসূচি পালনকালে তাদের উগ্র এবং সন্ত্রাসী কর্মীবাহিনী সংখ্যালঘুদের উপর হামলে পড়ছে। কোথাও কোথাও আবার সরকার সমর্থক সন্ত্রাসীরাও এ ধরনের হামলা পরিচালনা করছে।

২৫ নভেম্বর দশম নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হওয়ার পর, ১৮ দলীয় জোটের আন্দোলনের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের জঙ্গি কর্মীবাহিনী কর্তৃক সংখ্যালঘুদের উপর হামলার মাত্রাও বেড়ে যায়। বিশেষ করে জামায়াত-শিবির দেশের সর্বত্র সংখ্যালঘুদের উপর হামলা করতে থাকে। ১২ ডিসেম্বর আরেক শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী 'মিরপুরের কসাই' নামে পরিচিত কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হলে জঙ্গিদের হামলার মাত্রা তীব্রতর হয়।

১৬ ডিসেম্বর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে যৌথবাহিনীর অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আর ২৬ ডিসেম্বর থেকে ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত নির্বাচনকালীন স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে সেনাবাহিনী মাঠে রয়েছে। এতকিছুর পরও ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের দিনে এবং তার পরবর্তী সময়েও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলা বন্ধ হতে দেখা যাচ্ছে না। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী এবং নির্বাচনবিরোধী সকল পক্ষেরই সাধারণ লক্ষ্যবস্তু এই সংখ্যালঘুরা।

আগে থেকেই আশঙ্কা করা হচ্ছিল যে, নির্বাচনের আগে-পরে অব্যাহতভাবে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির হামলা থেকে তারা রেহাই পাবেন না। অবশেষে সেই আশঙ্কাই সত্য হল। চলমান এসব হামলার কিছু খবর হাতেগোনা কয়েকটি প্রিন্ট ও ওয়েব মিডিয়ায় আংশিক এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কদাচিৎ প্রচারিত হতে দেখা যায়। অথচ প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও তারা মার খাচ্ছেন; তাদের ঘরবাড়ি, ব্যবসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে; নারীদের ধর্ষণ ও জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত ও বিয়ে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

এই জনগোষ্ঠীকে দেশের সৃষ্ট প্রতিটি সংঘাতময় ঘটনায় মূল লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হচ্ছে। অথচ তাদের সংখ্যা কম করে হলেও দেড় কোটি। ২০১১ সালের সর্বশেষ আদমশুমারির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা মোট জনসংখ্যার ৯.৬ শতাংশ। তাতে বর্তমানে এ দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি বলে হিসাব করলেও মোদ্দাভাবে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা ১ কোটি ৫৩ লক্ষাধিক।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিশ্বের ১৯৩ দেশের মধ্যে মাত্র ৬৪ দেশে দেড় কোটির অধিক জনসংখ্যা রয়েছে; আর বাকি ১২৯ দেশের প্রত্যেকটির জনসংখ্যার চেয়ে বাংলাদেশের এই বিপন্ন জনগোষ্ঠী সংখ্যায় বেশি। অথচ বিশাল এই জনগোষ্ঠীর বিপন্নতা, অর্থাৎ বিশ্বের সম্ভাব্য সর্ববৃহৎ 'এথনিক ক্লিনজিং' নিয়ে দেশ-বিদেশের সংশ্লিষ্ট কোনো মহল থেকে কোনো প্রকার কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে বা তেমন কোনো আলাপ-আলোচনা করছে বা ভূমিকা রাখছে বলে দৃশ্যমান নয়।

এইসব মহল যা নিয়ে ব্যস্ত তা হচ্ছে নির্বাচন; অর্থাৎ এ দেশের নির্বাচন কবে কীভাবে হবে, নির্বাচনে কারা অংশগ্রহণ করলেন কি না করলেন, কতজন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলেন, কীভাবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা যায়, নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে কীভাবে বিবাদমান দুই পক্ষকে সমঝোতায় আনা যায় ইত্যাদি নিয়েই তারা প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পরও এই নির্বাচন এবং ভবিষ্যত নির্বাচন ঘিরেই সব আলোচনা।

এভাবে যারা বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অহর্নিশি প্রচেষ্টারত, তাদেরকে বলতে শোনা যায়– অতীতে, বিশেষ করে ১৯৯১, ১৯৯৬ (জুন), ২০০১ এবং ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল বিধায় দেশ-বিদেশে সেসব নির্বাচন কমবেশি প্রশংসিত হয়েছিল ও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। কিন্তু তাদের কখনও এ কথা বলতে শোনা যায় না যে, ওইসব প্রায় প্রত্যেকটি নির্বাচনের আগে-পরে এ দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর কমবেশি হামলা হয়েছে এবং কোনো কোনো নির্বাচনের পর তা কয়েক বছর পর্যন্ত অব্যাহতভাবে চলেছে।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জের ধরেও সেই একই দৃশ্যের অবতারণা হয়ে চলছে। তাহলে অনবরত যারা একটি অবাধ, সুষ্ঠূ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সোচ্চার রয়েছেন, তারা তো কোনো গ্যারান্টি দিতে পারছেন না যে, এ দেশের সংখ্যালঘুদের উপর কোনো প্রকার হামলা হবে না বা 'এথনিক ক্লিনজিং' হবে না!

অন্যদিকে নির্বাচন সংক্রান্ত যাবতীয় ব্যাপার নিয়ে সবাইকে উচ্চকিত হতে দেখা গেলেও, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার ব্যাপারে তাদের মুখ থেকে টু শব্দটি পর্যন্তে শোনা যাচ্ছে না কেন? সকলের অংশগ্রহণে সবার নিকট গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাইব বলে দেশের দেড় কোটি মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবব না?

বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে বিবাদমান পক্ষগুলোর মধ্যে যে সমঝোতার কথা বলা হচ্ছে, তার অন্যতম প্রধান শর্ত হতে হবে এ দেশের এই দেড় কোটিরও অধিক জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা বিধানের বিষয়টি। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট সকল মহলকেই সোচ্চার হতে হবে, নিশ্চয়তা দিতে হবে এবং সমঝোতার স্মারক এমনভাবে প্রণীত হতে হবে যাতে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিধানের শর্তাবলী মেনে চলতে বাধ্য থাকবেন এবং যারা সেসব অমান্য করবেন তাদের জন্য বিশেষ আদালতে আইনগতভাবে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিধানে আরোপ্য শর্তাবলী প্রণয়নের লক্ষ্যে সুপ্রীম কোর্টের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করতে হবে। এই কমিটিতে সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান, সরকার, সংসদ, রাজনৈতিক দল, দেশ-বিদেশের মানবাধিকার সংগঠন, জাতিসংঘ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের প্রতিনিধিরা অন্তর্ভুক্ত থাকবেন।

পাশাপাশি এই মুহূর্তে জরুরি ভিত্তিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলা বন্ধের ব্যবস্থা গ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা প্রদান ও পুনর্বাসন এবং হামলাকারীদের শনাক্ত করে কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা খুব জরুরি।

পুরানে আছে, মথুরার রাজা উগ্রসেনা ও রানি পদ্মাবতীর পুত্র কংস পিতাকে সিংহাসন থেকে জোর করে হঠিয়ে রাজা হয়ে যান। তারপর এক দৈববাণীতে তিনি জানতে পারেন যে, তারই সহোদরা দেবকীর গর্ভে জন্ম নেওয়া পুত্র তাকে হত্যা করবে। তাই তিনি দেবকী ও তার স্বামী বাসুদেবকে বন্দি করে রাখেন এবং বন্দি অবস্থায় দেবকীর গর্ভে জন্ম নেওয়া ছয়টি নবজাতককে হত্যা করেন। যাহোক, পৌরাণিক গল্পে অবশ্য তারপরও ভগবান বিষ্ণু ও দেবী পার্বতীর অলৌকিক লীলায় দেবকীর গর্ভজাত দুটি শিশু বেঁচে যান। তারা পরে বলরাম ও কৃষ্ণ হিসেবে বেড়ে উঠেন এবং কংসকে বধ করে মাতামহ উগ্রসনাকে সিংহাসন ফিরিয়ে দেন কৃষ্ণ।

পুরানের এ গল্পে কংসমামার নিধনযজ্ঞ থেকে বেঁচে যাওয়া কৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান বিষ্ণুরই অবতার। তিনি কংসের অত্যাচার থেকে মথুরাবাসীকে বাঁচাতে অবতার রূপে এসেছিলেন এই পৃথিবীতে। আধুনিক বাংলাদেশের সাম্প্রতিক এথনিং ক্লিনজিংয়ের হাত থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাঁচাতে, কংসমামাদের ধ্বংস করতে আমরা কি কোনো সমন্বিত উদ্যোগ নিতে পারি না?

দেশের সচেতন মানুষরা আশা করি বিষয়টি ভেবে দেখবেন।

বীরেন্দ্র নাথ অধিকারী: মুক্তিযোদ্ধা ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ।