বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াও

বৃন্দলেখক
Published : 24 Dec 2013, 03:31 PM
Updated : 24 Dec 2013, 03:31 PM

এক

শনিবার দুপুর আড়াইটায় প্রথমে কলারোয়া উপজেলার যুগীখালি গ্রামে পৌঁছালে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের মুখোমুখি হই আমরা। বাজারের সর্বস্ব লুট হয়ে যাওয়া দোকানগুলো দেখতে দেখতে আমরা গ্রামে ঢুকতে থাকি।

১০ ডিসেম্বর রাতে লুটপাট করে ধ্বংস করে দেওয়া নিমাই চন্দ্র হোড়ের দোকানের সামনে মানুষের বিশাল জটলা তখন। জনগণ চিৎকার করে বলছেন, ''সাতক্ষীরাকে জ্বালায়-পুড়ায় ৪ জনকে মেরে ফেলেছে ওসি।'' ''আমরা কি পাকিস্তানে, আফগানিস্তানে?'' ওসির পরিবর্তন চেয়ে তখন শ্লোগান দিচ্ছেন অনেকেই।

জানা গেল, ১০ তারিখ রাতে মুখে কাপড় বেঁধে ১৫০/২০০ মানুষ এসে লুটতরাজ চালায় এই বাজারে। হোটেল মালিক আবদুর রশিদ জানালেন, কাদের মোল্লার রায় কার্যকর হবার দু'দিন আগেই রাত এগারোটায় তার হোটেল ভেঙে দেওয়া হয়।

তবে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয় কলারোয়া ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের সভাপতি আজহারুল ইসলাম আজুর বাড়িতে উপস্থিত হলে। কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হবার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই কয়েকশ জামায়াত-শিবির কর্মী তাকে কুপিয়ে হত্যা করে। আজু জামায়াত কর্মীদের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য পিতার কবরের মধ্যে পালিয়েও রেহাই পাননি, বরং কবর থেকে ধরে এনে স্বজনদের সামনেই কুপিয়ে হত্যা করা হয় তাকে। এমনকি তার কবর দিতেও বাধ সাধে তারা।

দুই

সদর উপজিলার আগরদাড়ির তিন কিলোমিটার দূরে কুচপুকুর এলাকায় রয়েছে জামায়াত পরিচালিত মাদ্রাসা। স্থানীয় জনগণ বলে 'জামায়াতের ক্যান্টনমেন্ট'। এখানে ১ মার্চ আওয়ামী লীগের স্থানীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। নজরুল ইসলামের বাড়িতে গেলে সেখানেও কান্নায় ভেঙে পড়েন তার স্বজনরা।

সেখানেই দেখা হয়ে যায় তৃণমূল আওয়ামী নেতাদের সঙ্গে। তাদের সবাই কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। দোকান-পাট ভেঙে দেওয়া হয়েছে অথবা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অথবা মারধোর করা হয়েছে। এই এলাকাতেই নয় বছরের শিশু রিয়াদকে পানিতে ডুবিয়ে মেরেছে ঘাতকরা।

ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের বাড়ি। কুচপুকুর এলাকায় আওয়ামী লীগ নামে কোনো সংগঠন থাকবে না মর্মে ঘোষণা দিয়েছে জামাতের চেয়ারম্যান শেখ আনোয়ারুল ইসলাম।

তিন

দেবহাটা উপজিলার কুলিয়া ইউনিয়নের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ইছামতি নদী আর পশ্চিম দিকে ভারত। এ বছর ২৮ ফেব্রুয়ারির পর থেকেই আওয়ামী লীগ আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপর নেমে এসেছে চরম নির্যাতন। আওয়ামী লীগ নেতা আসাদুল হকসহ চারজনকে হত্যা করা হয়েছে এ পর্যন্ত।

মুখোশধারী হত্যাকারীরা পিটিয়ে হত্যা করেছে পারুলিয়ার আবু রায়হান, আলমগীর হোসেন, আবদুল আজিজকে। হাত-পা ভাঙা অবস্থায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন নারাণ সরকার, মো. বেলাল হোসেন, শেখ ফারুক হোসেন রতন, নাজিম হোসেন, আকিনুর, শরিফুল ইসলাম মিন্টু। বসতবাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, দোকানপাট পুড়িয়ে দেওয়ার রেকর্ড পাওয়া যাচ্ছে ৭৫ জনের। কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়ের পরেই চেষ্টা করা হয়েছে কুলিয়া শহীদ মিনার ভেঙে ফেলার।

তবে সকল তাণ্ডবের সাক্ষী হয়ে আছে বুঝি দেবহাটা থানার গাজীর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা সুভাষ ঘোষের বাড়িটি। ১৩ তারিখ সকালেই শত শত মানুষ এসে সম্পন্ন মজবুত দোতলা বাড়িটি পেট্রোল ঢেলে আর গান পাউডার দিয়ে পুড়িয়ে সর্বস্বান্ত করে রেখে গেছে মাত্র আধাঘন্টার মধ্যে। কাঠের দরজা-জানালাগুলো কয়লা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

পুরুষেরা কেউ বাড়িতে নেই। শুধু বেশ কয়েকজন নারী মূল বাড়ির পাশে একটা খড়ের চালার নিচে পাশাপাশি আতঙ্কিত দাঁড়িয়ে আছেন। শতাধিক বাড়ি আক্রান্ত হয়েছে এখানে। দেশত্যাগ করেছেন হিন্দু-মুসলিম অনেকেই।

চার

কালীগঞ্জে জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডবে নিহত হয়েছেন বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মোসলেম আলী, মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগের কর্মী শেখ আলাউদ্দিন। বাড়িঘর ভাঙচুর আর লুটপাট করা হয়েছে কৃষ্ণনগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মাজেদ আর সাধারণ সম্পাদক অমল কুমার ঘোষের। এই এক উপজেলাতেই ভাঙচুর আর অগ্নিসংযোগের শিকার হয়েছেন আওয়ামী লীগের ৪৫ নেতা-কর্মী।

কালীগঞ্জের নলতায় যখন আমরা জনসভা করি, তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে। অনেক মাসের মধ্যে এই প্রথম একটি জনসমাবেশ পেয়ে মানুষের আগ্রহ ছিল চোখে পড়ার মতো। তৃণমূল নেতাদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার বোধ এবং এলাকায় অনুপস্থিত সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় নেতাদের ব্যাপারে চরম অভিযোগে পাল্টাপাল্টি অবস্থান চোখ এড়ায় না।

পাঁচ

আশাশুনির বুধহাটা বাজারে প্রথমেই সহিংসতার সাক্ষ্য হিসেবে দেখা গেল চন্দন দেবনাথের 'সুলভ বস্ত্রবিতান'টি আর নেই। ১২ তারিখ রাতেই লুট করে আর আগুন জ্বালিয়ে শেষ করে দেওয়া হয়েছে সব। পাশেই তরুণ ঘোষের ক্ষতিগ্রস্ত স্টুডেন্ট টেইলার্স। তিনি কোনো কথাই বলতে পারলেন না। সম্পন্ন ব্যবসায়ী রাজ্যেশ্বর দাসের বাগদা চিংড়ির ঘের লুট হয়ে গেছে; তার দাবি মোট ৩০ লক্ষ টাকার সম্পদ হানি হয়েছে তার।

ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি এ টি এম আখতারুজ্জামানের আনিসুল আক্তার ট্রেডার্স গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে গোবিন্দ ব্যানার্জীর কম্পিউটার দোকান, আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন যুগ্ম সম্পাদক সাজউদ্দিন সাজুর ঘড়ির দোকান। আগুন দেওয়া হয়েছে রাসেল স্মৃতি এবং শ্রমিক লীগের অফিসে। আমরা পথসভা করেছি ভাঙা শহীদ মিনারের পাদদেশে।

বিএনপি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুল হান্নানের নেতৃত্বে এই অভিযান চালানোর অভিযোগ উঠেছে। জানা গেল, এই থানার আওয়ামী লীগের সভাপতি বা সিনিয়র কোনো নেতা কেউ-ই দেখতে আসেননি ক্ষতিগ্রস্ত জনপদকে অভয় দিতে।

ছয়

জনজীবন স্বাভাবিক হয়নি তখনও। তবে সকলেই বলেছেন, যৌথবাহিনীর অপারেশনের আগে যে অবস্থা ছিল সেখান থেকে উত্তরণ হচ্ছে। পথে পথে আমরা শত শত গাছের গুঁড়ি দেখেছি। এইসব গাছ ফেলে অভাবনীয় কায়দায় রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করে, রাস্তা কেটে আসলে পুরো এলাকার জীবন বিপর্যস্ত করে ফেলা হয়েছিল।

প্রশাসনিক এবং সাধারণ নাগরিকদের অনেক পর্যায়ে কথা বলেই জানা গেল যে, ওই অঞ্চলটিকে রাষ্ট্রের মধ্যে আরেকটি রাষ্ট্র বানিয়ে ফেলারই প্রচেষ্টা ছিল বলে তারা মনে করেন।

যৌথবাহিনীর অপারেশনের বেশ কয়েকদিন পার হয়ে গেলেও পথেঘাটে লোক চলাচল সীমিত ছিল। আতঙ্ক কাটছে না। চলতি পথে বিজিবি আর পুলিশের জোর প্রহরা। কিন্তু পুলিশ প্রহরায় যে জীবন সে জীবনকে আর যাই হোক স্বাভাবিক বলা যায় না।

সবচেয়ে বড় কথা, আতঙ্কের যে অভয়ারণ্যের ভেতর তারা ছিলেন, সেটি সমূলে উৎপাটিত না হওয়া পর্যন্ত এই আতঙ্ক কাটার কারণ নেই। আমাদের প্রতিনিধি দল কলারোয়া থেকে ফিরে আসার পরেই মৃত আজহারুল ইসলামের পরিবারে গিয়ে হুমকি দিয়ে আসা হয়েছে।

কীভাবে কাটবে এই অবরুদ্ধ দশা

আমাদের সামনে নির্যাতন ও তাণ্ডবের যতটুকু প্রকাশ পেয়েছে, তা প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি এবং তাণ্ডবের তুলনায় খুবই সামান্য এবং উপরিভাসা একটি অংশ বলে দাবি করেছেন প্রায় সবাই। গণমাধ্যমে সহিংসতা ও নির্যাতনের খবর যতটুকু প্রকাশিত হয়েছে বাস্তবে এর ভয়াবহতা অনেক বেশি।

প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রকৃত চিত্র উঠে আসা তো দূরে থাক, প্রচারিত হয়নি, অনেক স্থানের কথা এমনকি গণমাধ্যমে পৌঁছায়নি। ভয়াবহ এই সহিংসতায় এবং নিরাপত্তার অভাবে সাতক্ষীরার গ্রামাঞ্চল থেকে অনেকেই গোপনে দেশ ছেড়ে চলে গেছে। আওয়ামী রাজনীতি করার অপরাধে জামায়াত-শিবির তাদের উপর ক্রমাগত সহিংসতা চালালেও তাদের পাশে কেউ দাঁড়ায়নি।

সীমান্তের পাশ্ববর্তী এলাকা বলে চোরাচালানের অর্থনীতিও এই হামলাকারী শক্তিরই হাতে। তাদের অর্থনৈতিক শক্তি কত বেশি সেটি বোঝা যায় একটিমাত্র উদাহরণে যে, আন্তঃনগর বাস চলাচল চালু করা যাচ্ছে না, কারণ বাসগুলোর মালিকরা জামায়াত-শিবিরের। আমাদের প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাতক্ষীরায় যে জঙ্গি কার্যক্রম চলছে তার পেছনে আছে ইসলামী ব্যাংকসহ বিভিন্ন ইসলামি বাণিজ্যিক এবং সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের অর্থায়ন ও সক্রিয় সহযোগিতা।

সীমান্তের পাশে অবস্থিত সাতক্ষীরায় জামায়েতের রাজনীতি বরাবরই শক্তিশালী। ভারতবিরোধী ও আওয়ামীবিরোধী মনোভঙ্গি রয়েছে প্রবল। গত পাঁচ বছরে এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ তো করা তো দূরে থাক, বহুধাবিভক্ত জেলা আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। তৃণমূল নেতা-কর্মীদের পাশে আস্থা হয়ে দাঁড়াননি তারা।

সব মিলিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেবার কোনো তাৎক্ষণিক উপায় বাতলানো খুবই মুশকিল। যৌথবাহিনীর অপারেশন যে পর্যন্ত করেছে, সেগুলো ছিল প্রশাসনিক পদক্ষেপ। কিন্তু রাষ্ট্র ও জনগণের সেখানে থেমে গেলে চলবে না। প্রহরা থাকার পাশাপাশি কতগুলো কাজ আন্তরিকভাবে করা দরকার, নয়তো এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি থামানো যাবে না। একই সহিংসতা আমরা দেখতে পাচ্ছি লালমনিরহাটসহ সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতেও।

এই মুহূর্তের প্রয়োজন হল আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ানো। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা প্রতিরোধ করা। সরকারকে শক্ত হতে হবে। একই সঙ্গে আহবান জানাই গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল দলগুলোর প্রতি, তারা যেন দলীয় নেতা-কর্মীদের ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করে।

গণমাধ্যমের বর্তমান দায়িত্বশীল ভূমিকা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চলের ঘটনাগুলো তুলে আনার ক্ষেত্রে আরও সক্রিয় ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। এসব সংবাদ 'ব্ল্যাক-আউট' করা যাবে না।

এসব আশু কর্তব্য পালনের পাশাপাশি মূল যুদ্ধাপরাধী এবং সহিংস দল হিসেবে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার কোনো বিকল্প নেই। সাতক্ষীরার সহিংসতার ধরন প্রমাণ করে এসব সহিংসতা মোটেই নির্বাচনকেন্দ্রিক নয়, বরং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করা ও জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার যে দাবি উঠেছে তারই প্রতিক্রিয়া। এমনকি বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে অস্বীকার করতেও তাদের দ্বিধা নেই।

যারা একাত্তরে শুধু বাংলাদেশ রাষ্ট্র চায়নি এমন নয় বরং এদেশের মানুষের বিরুদ্ধে, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটন করেছে– সেইসব যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ত্বরান্বিত করে রায় দ্রুত কার্যকর করতে হবে। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে এগিয়ে নেবার জন্য প্রয়োজনীয় সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে দলীয় নেতা-কর্মীদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হবার প্রশিক্ষণ দিতে হবে। দেশকে তালেবানি রাষ্ট্র বানানোর যে পাঁয়তারা চলছে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তির ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ গঠন করে এই ফ্যাসিস্ট শক্তিকে পরাভূত করার কোনো বিকল্প নেই।

বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াও।

লেখকবৃন্দ:

আবেদ খান, জিয়াউদ্দিন তারেক আলী, সাদেকা হালিম, সানজিদা আখতার, জিয়াউর রহমান, রোকেয়া প্রাচী ও কাবেরী গায়েন।

(লেখকরা সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সাংস্কৃতিক কর্মী)

(সাতক্ষীরা থেকে ফিরে)