জেলহত্যাকাণ্ড: আবদুস সামাদ আজাদের সাক্ষাৎকার (পর্ব-১)

শারমিন আহমদ
Published : 21 Dec 2013, 02:14 PM
Updated : 21 Dec 2013, 02:14 PM

জেলহত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে ভূমিকা:

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম. মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানের নির্মম হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে যখন স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী (১৯৭২-৭৩) আবদুস সামাদ আজাদের সাক্ষাৎকারটি পত্রিকায় পাঠাচ্ছি, তখন সারা বাংলাদেশে বইছে চরম অস্থিরতার ঝড়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার নিরীহ মানুষের রক্তে প্লাবিত হচ্ছে মাঠ-ঘাট-রাজপথ, হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বলছে, ধ্বংস হচ্ছে জাতীয় সম্পদ, ধসে পড়ছে আশা ও স্বপ্ন। শিশু, কিশোর ও তরুণ যারা এই জাতির ভবিষ্যৎ, তাদের মধ্যকার সব সম্ভাবনা শ্বাসরুদ্ধ হচ্ছে এই নৈরাজ্যপূর্ণ ও কলুষিত রাজনৈতিক আবহাওয়ায়। হরতালে কিশোর মনিরের ভস্মীভূত দেহখানি আমাদের মৌন বিবেকের ওপর আর্তনাদ করে প্রশ্ন করেছে কেন আমরা জাতিগতভাবে মেনে নিচ্ছি এমন অন্যায়-অপরাধ?

হরতালকারীদের হিংস্রতার আরেক বলি, মাথার খুলি বিদীর্ণ হয়ে নিহত (২৭ নভেম্বর) মনোয়ারা বেগমের কন্যা শোকাহত নাসিমা ধিক্কার দিয়ে বলছে, "একজন রাজনীতিবিদের নাম দাও, যে এই হরতালের সহিংসতায় মৃত্যুবরণ করেছে?" আসলেই তাই, রাজনীতিবিদ যারা এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে তারা কিন্তু নিরাপদেই রয়েছে। তাদের নিয়োজিত কর্মীবাহিনী দেশকে জিম্মি করে ঘটিয়ে যাচ্ছে এইসব নারকীয় কার্যকলাপ।

সবই হচ্ছে জনগণের স্বার্থরক্ষার নামে। জনগণের স্বার্থরক্ষার নাম করে যখন জনগণকেই জিম্মি করে তাদেরকে হত্যা ও তাদের জান-মাল ভস্মীভূত করা হয় তখন সেই রাজনৈতিক দল/দলসমূহ হারায় জনগণের প্রতিনিধি হবার বৈধতা ও যোগ্যতা। কিন্তু বাংলাদেশের ভাগ্যেই ঘটছে ব্যতিক্রম। যুগ থেকে যুগে। সে যেই দলই হোক না কেন, পেশীবলে, অর্থবলে, প্রতারণা ও মিথ্যাচার বলে কোনো প্রকার রাজনীতিবিদের সিলটি যদি একবার গায়ে এঁটে যায় তখন তাকে সেই পদ থেকে হটানো হয় মুশকিল।

জনগণের অর্থ ও সম্পদ ডাকাতি করে,আত্মসাৎ করে (যাকে বলা হয় দুর্নীতি), রাহাজানি, খুন, গুম খুন ও সকল প্রকার অমানবিক কাজ ও অসভ্য আচরণ করেও এই পেশাদার রাজনীতিবিদ ও তাদের অনুসারীরা ভালোমতোই বেঁচে থাকে। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, কিন্তু যেখানে পুরো রাষ্ট্রপরিচালনা পদ্ধতিটিই কলুষিত সেখানে মুষ্টিমেয়র সততা ও ন্যায়নীতি কতটুকুই-বা পরিবর্তন আনতে পারে অথবা তাদেরকে কতদূরই-বা সত্যিকারের কাজ করতে দেওয়া হয়!

আজ বাংলাদেশে যে চরম নৈরাজ্যপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তার মূল কারণ হল এই আষ্টেপৃষ্ঠে দুর্নীতিগ্রস্ত মানসিকতাসম্পন্ন রাজনৈতিক দল, প্রশাসন ও রাষ্ট্রপরিচালনা পদ্ধতি। তারা জনগণের সেবক হবার বদলে পরিণত হয়েছে ভক্ষকে। স্বাধীনতার মহান আদর্শকে অপমানিত করে ব্যক্তি,পরিবার-স্বজন ও দলীয় স্বার্থে সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়া ও লালন করা দুর্নীতি, অনাচার ও আইনের শাসনের গতিপথ রুদ্ধ করার প্রবণতা– এই কারণগুলির শিকড় বেয়েই আজ উঠে এসেছে গণহত্যাকারী রাজাকার-আলবদর ও তাদের নির্লজ্জ সমর্থকরা।

আওয়ামী লীগ উন্নয়ন ক্ষেত্রে (বিশেষত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি) বিএনপির চাইতে অনেক ভালো করেও জনগণের আস্থা এবং জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে উল্লেখিত কারণগুলির জন্য। আর উল্লিখিত কারণগুলিসহ বিএনপির দুঃশাসনের চরম নমুনা সৃষ্টির প্রতিবাদে এক-এগারোই শুধু ঘটেনি এবং গত নির্বাচনে বিএনপি পরাজিত হয়নি, তারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিজেদেরকে নিক্ষিপ্ত করার আয়োজন করেছে একাত্তরের পরাজিত, পাকিস্তান-সৌদিপালিত সাম্প্রদায়িক ও গণহত্যাকারী দলের বাহন হয়ে।

তাদের এই অশুভ অ্যালায়েন্স লক্ষ শহীদের রক্তে অর্জিত বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্যই আজ হুমকিস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিএনপি এবং জামায়াত-এ-ইসলামসহ পবিত্র ধর্মের নাম বিক্রি করে চরম অধর্মপূর্ণ কর্মকাণ্ডের হোতা দলগুলির মধ্যকার আদর্শগত পার্থক্য আজ বিলীন হয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশের ভাগ্য হয়ে উঠছে জটিল থেকে জটিলতর। আর এমনি একটি অনিশ্চিত সময়ের প্রেক্ষাপটে আমি জেলহত্যার সাক্ষাৎকারের অবতারণা করছি।

ওই নির্মম হত্যাকাণ্ডগুলি এমন এক সময়ের ইতিহাস যাকে দল-মতের উর্ধ্বে উঠে বস্তুনিষ্ঠভাবে গবেষণা-বিশ্লেষণ না করা ও তার থেকে শিক্ষা না নেবার বিষয়টিও ছিল অন্যতম এক কারণ, যে জন্যে আমরা আজও পরিগণিত হতে পারিনি সভ্য এক রাষ্ট্ররূপে। যে কারণে আজও বাংলাদেশ লাভ করেনি মানসিক স্বস্তি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। এই বিষয়গুলি নিয়ে আমাদের দেশে মৌলিক গবেষণা হয়নি বললেই চলে।

আজকে জেল হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত সাক্ষাৎকারটি উল্লেখ করার আগে এক ঝলক চোখ বুলানো যাক সেই সময়টিতে। আজকের প্রজন্ম যারা সেই সময়টি সমন্ধে জানে না বা তাদেরকে আমরা সঠিকভাবে জানাতে ব্যর্থ হয়েছি, বিশেষত তাদের জন্যই সেই ইতিহাসের অতিসংক্ষিপ্ত এই বর্ণনা।

দেশ যখন স্বাধীন হল তখন যদি সদ্যস্বাধীন দেশটির প্রশাসনে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অনুযায়ী, আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ন্যায়বিচার সমুন্নত রাখা হত এবং নিজ দলের ভেতর লুকিয়ে থাকা স্বাধীনতাবিরোধী ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী প্রথম বাংলাদেশ সরকারবিরোধী মূল ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হত, তাহলে ভেতরের ও বাইরের কোনো চক্রই তাদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত করতে পারত না। আজকের দুঃখজনক এই প্রসঙ্গেরও অবতারণা হত না।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর পরিবারসহ নির্মমভাবে নিহত হন। বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন, তাঁর মন্ত্রিসভা ও বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী জুনিয়র আর্মি অফিসাররা ক্ষমতা দখল করে। অবৈধভাবে রাষ্ট্রপতির পদ দখলকারী মোশতাক অর্ডিন্যান্স জারি করে যে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার করা যাবে না।

মুক্তিযুদ্ধের সেনাপতি জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী যিনি বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত একদলীয় বাকশালের প্রতিবাদ করে তাতে যোগদান করেননি, তিনি নির্দ্বিধায় বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পদে যিনি ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুসহ নারী-শিশুর হত্যাকারীদের অন্যতম মোশতাকের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টার পদে নিয়োজিত হন। চিফ অব আর্মি স্টাফ মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে সরিয়ে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান তার স্থলভূক্ত হন।

তিনিও হত্যাকারীদের বিরদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেন না; বরং হত্যাকারীদের বিচার করা যাবে না এই অর্ডিন্যান্সকে পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি হবার পর সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনীর (৬ এপ্রিল, ১৯৭৯) মাধ্যমে বৈধতা দেন (বলাবাহুল্য, কোনো অন্যায় কখনওই আইনত বৈধ হতে পারে না, তা একদিন বাতিল হতে বাধ্য)।

১৫ আগস্টে হত্যাকাণ্ডের দুইমাস বিশ দিন পর ৩ নভেম্বর দিবাগত রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে (লেখার শুরুতেউল্লেখিত) মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধুর চার সহকর্মী নিহত হন। ওই একই রাতে অবৈধ মোশতাক সরকার ও বঙ্গভবন দখলকারী হত্যাকারী সেনা অফিসারদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং জিয়াকে গৃহবন্দী করে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এক রক্তপাতহীন অভ্যুথানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন।

তার মাত্র চার দিন পরে, ৭ নভেম্বর সিপাহী বিদ্রোহে (এই দিনটিকে সিপাহী-জনতার অভ্যূত্থান বলা হলেও, আসলে এই বিদ্রোহটি ছিল বামপন্থী জাসদ সংগঠিত এবং জনতার অংশগ্রহণ এতে ছিল না) নেতৃত্বদানকারী কর্নেল তাহের জিয়াকে মুক্ত করেন। ওই একই দিন খালেদ মোশাররফ ও তাঁর দুই সহকর্মী কর্নেল নাজমুল হুদা ও কর্নেল এ টি এম হায়দার নিহত হন।

তাদের বিরুদ্ধে অভ্যূথানকারীরা এই অপবাদ ছড়ায় যে খালেদ ও তার অনুগামীরা ভারতের দালাল। যারা খালেদ মোশাররফ সমন্ধে কিছুটা ধারণা রাখেন তারা জানেন যে এই অকুতোভয় স্বাধীনচেতা বীর মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে ওই কথাটি ছিল অপপ্রচার মাত্র।

পরবর্তীতে জিয়াকে মুক্তকারী, কর্নেল তাহেরকেই এক প্রহসনমূলক গুপ্ত বিচারের মাধ্যমে জিয়া ফাঁসি দিয়ে হত্যা করেন এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে একাত্তরের পরাজিত ঘাতক-দালালদের পুনর্বাসিত করেন। জিয়াউর রহমান পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পর মেজর জেনারেল মঞ্জুর নির্দেশিত আরেক ব্যর্থ সেনা অভ্যূথানে নিহত হন। জিয়ার বিএনপি সরকারকে এক রক্তপাতহীন ক্যু-এর মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় আসেন ১৯৮২ সালে।

এই এতগুলো বছরেও জাতির জনক ও স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী চার নেতা, যারা গোটা জাতিরই নেতা, তাদের হত্যার কোনো বিচার হয় না। তার জন্য অপেক্ষা করতে হয় আরও চৌদ্দ বছর; আওয়ামী লীগ সরকার দীর্ঘ একুশ বছর পর পুনরায় ক্ষমতায় আসার সময় পর্যন্ত।

১৯৮৭ সালে আমি যখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে এসে জেল হত্যাকাণ্ডের ওপর তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করি তখন অবাক হয়ে লক্ষ্য করি যে এই সম্পর্কে হত্যাকাণ্ডের সুদীর্ঘ বার বছর পরেও তথ্য, উপাত্ত এবং প্রমাণসহ গবেষণামূলক কোনো লেখনী প্রকাশিত হয়নি। জেল হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী ব্যক্তিবর্গ এবং এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গের সাক্ষাৎকার, ইতিহাসের উপাদান হিসেবে যার গুরুত্ব অনেক, তা সংগ্রহ করে জাতিকে জানাবারও কোনো প্রচেষ্টা নেওয়া হয়নি।

জাতির বিবেককে যারা নাড়া দেবেন বলে আশা করা যায় সেই বুদ্ধিজীবী সমাজ এই বিষয়টি সমন্ধে জানতে এবং জানাতে তেমন আগ্রহ প্রকাশ করেননি। আমাদের এমনিতর ইতিহাস সংরক্ষণ চেতনার অভাবের কারণেই তো ঘটে যায় আরও নির্মমতা এবং জাতি ঘুরপাক খায় বিভ্রান্তিতে। বৈহাসিকের পার্শ্বচিন্তা কলামে, প্রখ্যাত কলামিস্ট আবু জাফর শামসুদ্দীন, জাতীয় ইতিহাসের মর্মান্তিক ঘটনাবলী সম্পর্কে আমাদের এই সম্মিলিত উদাসীনতা ও অবহেলাকে চিহ্নিত করে জাতির কাছে কিছু প্রশ্ন রেখেছিলেন। জেলহত্যা দিবসে তিনি লিখেছিলেন–

"কী দোষ করেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ ও তাঁর তিন সহকর্মী এ প্রশ্নের জবাব এ পর্যন্ত কোনো সরকার দেয়নি। আমরা দেশবাসীও সোচ্চার হয়ে এ প্রশ্ন করিনি এবং তার জবাব চাইনি। এই যে প্রশ্ন করিনি এবং তার জবাব চাইনি এটাও আমাদের লজ্জার বিষয়– গণতন্ত্রের সমর্থকরূপে প্রশংসিত নাগরিকদের কর্তব্যকর্মে চরম ঔদাসীন্য ও অবহেলার প্রমাণ।" (সংবাদ , ৫ নভেম্বর, ১৯৮৪)

ঢাকায় পৌঁছে আমি যাদের কাছ থেকে তথ্য সংগহ করি ও সাক্ষাৎকার নিই তারা হলেন স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী (১৯৭২-৭৩) আবদুস সামাদ আজাদ, জেলহত্যা তদন্ত কমিশনের সদস্য, সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি কে এম সোবহান (৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণের পর তদন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়) স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এ এস মহসীন বুলবুল, ব্রিগেডিয়ার আমিনুল হক (ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নির্দেশে তিনি জেল হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী ডিআইজি প্রিজনস আবদুল আউয়ালের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার নেন) ও প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী আবদুল মোমিন।

উল্লিখিত প্রথম ও তৃতীয় সাক্ষাৎকারদাতা ১৯৭৫ সালে চার নেতার সঙ্গে জেলে বন্দি ছিলেন। এছাড়াও তাজউদ্দীন আহমদের শৈশব ও ছাত্রজীবন সম্পর্কে ওনার শিক্ষক ও ভাই-বোনদের সাক্ষাৎকার নিই। পঁচাত্তরে জেলে কর্মরত কর্তৃপক্ষর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। আরও যাদের সঙ্গে দেখা হয় তারা সে সময় আমাকে সাক্ষাৎকার দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

বঙ্গবন্ধু ও জেল হত্যাকারী লে. কর্নেল ফারুক ও রশীদ তখন দেশে ফিরে ফ্রিডম পার্টি প্রতিষ্ঠা করেছে। তারা প্রকাশ্যেই শেখ মুজিবের মরণোত্তর বিচার করবে বলে হুমকি দিচ্ছে। লে. কর্নেল ফারুক জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে ১৯৮৬ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেছে। মোশতাক দুর্নীতির দায়ে জেল খেটে বেরিয়ে তার আগা মসীহ লেনের বাড়িতে বহাল তবিয়তেই আছে (তাকে হত্যাকাণ্ডের জন্য বিচারের মুখোমুখি কখনওই দাঁড়াতে হয়নি, তার আগেই সে মৃত্যুবরণ করে)।

সুতরাং এই পরিস্থিতিতে, অনেকেই যে কোনো তথ্য বা সাক্ষাৎকার দিতে অপারগতা প্রকাশ করবে সেটাই হয়তো স্বাভাবিক। তারপরেও সেদিনের সাক্ষাৎকার হতে জেলহত্যা সম্পর্কে যে চিত্রটা মনে অস্পষ্ট ছিল তা অনেকখানি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জেল থেকে চিরতরে ও রহস্যজনকভাবে হারিয়ে যাওয়া তাজউদ্দীন আহমদের মহামূল্যবান ও ঐতিহাসিক ডায়েরিটি কে নিয়েছিল সে সমন্ধেও জানতে পারি।

১৯৮৭ তে সংগ্রহকৃত তথ্যাবলীর ভিত্তিতে রচনা করি "৩ নভেম্বরের জেলহত্যা ও বিবেকের আত্মাহুতি" প্রবন্ধ যা ১৯৮৮ সালে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত প্রথম নিয়মিত সাপ্তাহিক 'প্রবাসী' পত্রিকা এবং পরে বাংলাদেশের অন্যান্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তিন বছর পরে, ১৯৯১ সালে আমার ছোটবোন সিমিন হোসেন রিমি বহু কষ্টে অবসরপ্রাপ্ত ডিআইজি প্রিজনসের ঠিকানা যোগাড় করে তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে সমর্থ হয়। ডিআইজিসহ অবসরপ্রাপ্ত আইজি প্রিজনস নুরুজ্জামান, জেলর আমিনুর রহমান ও সুবেদার ওহায়েদ মৃধার সাক্ষাৎকার সে 'ভোরের কাগজ' পত্রিকায় এবং তার লেখা "আমার ছোটবেলা, ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমদ" বইয়ে প্রকাশ করে।

বলাবাহুল্য যে, নিজ পিতা ও তাঁর তিন সহকর্মীর নির্মম ও অন্যায় হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের কাজটি মনের দিক থেকেও সহজসাধ্য ছিল না। তারপরেও করতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের কাণ্ডারি অন্যন্য সংগঠক এক অসাধারণ চরিত্রের বাবার প্রতি অসীম ভালোবাসা থেকে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের তাঁর তিন সহযোদ্ধার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা হতে। রক্তস্নাত নির্মম অতীতের উত্তরসূরী, দিশাহীন এই বর্তমানের অন্ধকারাচ্ছন পথটিতে, নতুন প্রজন্ম একদিন আশা ও শান্তির আলো ছড়াবে সেই পরম প্রত্যাশা হতে।

আবদুস সামাদ আজাদের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার (প্রথম অংশ)

এই সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয় উনার কলাবাগানের বাসায়, ১৯৮৭ সালের ৫ জুলাই। সে সময় আমার সঙ্গে ছিলেন আমার মা সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিন।

শারমিন আহমদ: ১৯৭৫ সালের কোন সময় আপনি জেলে যান?

আবদুস সামাদ আজাদ: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর আমাকে ইন্টার্ন করে রাখল। তার বোধহয় ৭ দিন পর, যতদূর মনে হয় শবেবরাতের রাত ছিল, নামাজ পড়েছি সারারাত, রোজাও রেখেছি। সকালবেলা সূর্য তখনও উদয় হয়নি, হঠাৎ পিয়ন এসে বলল, 'একজন অফিসার এসেছে'। সঙ্গে দেখি আরও অফিসার এসেছে। তারাও ঘুম থেকে উঠে এসেছে। তারাও ঘটনা উপলব্ধি করতে পারছে না।

তারা বলল, 'স্যার আপনাকে আমাদের নিয়ে যেতে হবে'। আমার সন্দেহ হল। এর আগেও ঘটনা হয়েছে দুই একটা। আমি বললাম, 'আমি কাপড়-চোপড় চেঞ্জ করে আসি'। তারা বলল যে, 'আরও নেতাদের নেওয়া হবে তো, সেইভাবেই আসেন'। আমি তখন একটা ব্যাগে কাপড়-চোপড় ভরে এলাম। আমাদের বাড়ির কাছেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তারা একটি কন্ট্রোল রুম করেছে। সেখানেই তারা নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে দেখি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান সাহেব—ও আরও কিছু লোক অন্য রুমে আছেন। আমাকে সেখানে নিয়ে গেল। মোট ২৬ জন লোক। ১০ মিনিট পর দেখি তাজউদ্দীন সাহেব এলেন।'

শারমিন আহমেদ: দিনটি ২২ আগস্ট ছিল?

আ সা আ: হ্যাঁ, ২২ আগস্ট। তো তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে আমরা দুজন আলাপ করলাম। কেন এনেছে, কী ব্যাপার– উনি তো কেবিনেটেও ছিলেন না। (দল ও সরকার পরিচালনা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মতবিরোধের কারণে তাজউদ্দীন আহমদ ২৬ অক্টোবর, ১৯৭৪ অর্থমন্ত্রীর পদ হতে ইস্তফা দেন) একটু পরেই (মেজর শরিফুল হক ডালিম) ডালিম এল। কামরুজ্জামান সাহেবের সঙ্গে কথা বলে গেল। তখন কামরুজ্জামানকে জিজ্ঞেস করলাম– 'এ কে?' বললেন, 'এ-ই ডালিম'।

তখনও জানি না কী করবে না করবে, মেরে ফেলার জন্য এনেছে না কী করবে। একটু পরে (মেজর আবদুর রশীদ) রশীদ এল। সে ইলেকট্রিক কানেকশন আছে কিনা লোক লাগিয়ে পরীক্ষা করল। এরপর সৈয়দ হোসেন সাহেব এলেন। উনি আগেই অ্যারেস্টেড ছিলেন।

শা আ: সৈয়দ হোসেন কে?

সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন: বঙ্গবন্ধুর—-

আ সা আ: বঙ্গবন্ধুর ভগ্নীপতি। তো ওনার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে রশীদ বলছিল, "আপনাকে আমরা এনেছি, আপনি তো কারাগারেই আছেন–"(টেপের এই অংশটি অস্পষ্ট)। পরে আমরা জানতে পারলাম, রশীদের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল আমাদের মেরে ফেলবে। এমন ভাবসাব। কারণ ইলেকট্রিক ওয়্যারিং-টয়্যারিং করছে। একটু পর দেখি ফটোগ্রাফার এল।

একজন ফটোগ্রাফার আমার সঙ্গে অ্যাটাচড ছিল (বঙ্গবন্ধু প্রশাসনে মন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে) সে বলল, 'স্যার, আমাদেরকে ঘুম থেকে উঠিয়ে এনেছে'। তারপর দেখি টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যানও আছে। তারপর রশীদও চলে গেল। আমরা ভাবছি কীসের জন্য আনল না আনল-–এর মধ্যেই আরেকজন এসে বলল, 'আপনারা চলেন'। বললাম, 'কোথায়?' সে বলল, 'ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে?'

শা আ: কে এসে বলল?

আ সা আ: কোনো এক অফিসার। মিলিটারি অফিসার। বলল, 'সেন্ট্রাল জেলে চলেন।' তারপর আমাদেরকে কারে নিল। এই পাঁচ জনকে কারে নিল।

শা আ: আব্বুর সঙ্গে কি আপনি ছিলেন?

আ সা আ: হ্যাঁ, আমি, তাজউদ্দীন সাহেব, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান সাহেব।

সৈ জো তা: আহহা! (দুঃখ প্রকাশ)

আ সা আ: আমরা তো সেন্ট্রাল জেলে ঢুকলাম ওইদিনই এগারোটা সাড়ে এগারোটায়। দিনের বেলা।

শা আ: বেলা এগারোটা সাড়ে এগারোটা?

আ সা আ: মনে হয় ওই রকমই সময়।

শা আ: আব্বুকে ধরে নিয়েছিল ২২ আগস্ট বেলা–

সৈ জো তা: ৮ টায়।

আ সা আ: মনে হয় তখন রোদ উঠে গিয়েছিল। সেন্ট্রাল জেলে গিয়ে ঢুকলাম। কী সিচুয়েশন! সমস্ত জেলখানায় কয়েদীদের তালা বন্ধ করে রেখেছে। আমরা সলেম্ন অবস্থায়– কী হবে না হবে। আমি, তাজউদ্দীন সাহেব তো আগে থেকে জেলখাটা লোক। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। কয়েদিরা হৈচৈ করছে জানালা দিয়ে। জাসদ আছে, নকশাল আছে, তারা নাম ধরে ধরে ডাকছে। এরপরে আমাদের অ্যাপ্রুভার সেলে রাখল।

শা আ: কী সেল?

আ সা আ: অ্যাপ্রুভার। ওই যে রাজসাক্ষী হয়। খুব খারাপ সেল। ২০ নম্বর ওয়ার্ড। আমি প্রটেস্ট করলাম। এখানে থাকব না। আমরা তো জেল খেটেছি। সব ওয়ার্ড জানা আছে। জেলর বলল, "স্যার, জায়গা তো নাই। আপনাদের তো আলাদা রাখতে হচ্ছে।" জেনারেলি এইসব হৈচৈ-এর মধ্যে সৈয়দ সাহেবেরা বাহির হতে চান না। আমরা তো জেল খেটেছি।

শা আ: সৈয়দ নজরুল কি এর আগে জেল খাটেননি?

আ সা আ: সৈয়দ সাহেব তো জেল খাটেননি। এই অবস্থায় আমাদেরকে নিল পরে।(অন্য জায়গায়) আইজির অফিস ছিল একটা এরিয়ায়। সেটা তখন অফিস নাই। সেই বিল্ডিংটাকে (অফিস) খালি করে করে আমাদেরকে নিয়ে গেল বিকালবেলায়। সেটার নাম নিউ জেল। সেই জেলে রাস্তাও ছিল না, বাগানও ছিল না। তাজউদ্দীন সাহেব নিজেই বাগান করেছেন।

শা আ: যে সময় (ওখানে) ছিলেন তখুনি আব্বু বাগান করেছিলেন?

আ সা আ: হ্যাঁ। দুই মাস পর্যন্ত, বড় বাগান। কয়েদীদের নিয়ে নিজেই মাটি খুঁড়তেন। সুন্দর বাগান করেছিলেন। এরিয়াটাকে খুব সুন্দর করা আরকি। নিট এন্ড ক্লিন করা। ওটা বাজে জায়গা ছিল। ড্রেনগুলি পচা ছিল। সেগুলিকে সুন্দর করেন। এইভাবে জেলখানার জীবন চলছে। নানা রকমের রিউমার ডেইলি যায়। প্রথমদিকে ইন্টারভিউ দিচ্ছিল না। পরে ইন্টারভিউ দেওয়া শুরু হল। আমাদের সকলেরই।

শা আ: কে ইন্টারভিউ দেওয়া শুরু করল?

আ সা আ: আমাদের ফ্যামিলির সঙ্গে ইন্টারভিউ। আমাদের সঙ্গে ফ্যামিলি মেম্বাররা দেখা করা আরম্ভ করল।

সৈ জো তা: আমাদেরকে প্রথমদিকে দেখা করতে দেয়নি (অন্যদের সাক্ষাতের অনুমতি আগে মিললেও একমাস পরে তাজউদ্দীন আহমদের পরিবারকে সাক্ষাতের অনুমতি দেওয়া হয়)।

আ সা আ: হ্যাঁ, প্রথমদিকে দেয়নি। পরে ইন্টারভিউ দেয়। তারপরে ফ্যামিলি মেম্বারদের সঙ্গে যতটুকু সময় কাটাই, ফ্যামিলির সমস্যা ছাড়াও, বাইরের খবর-টবর কী অবস্থা এই সব জানি। ওরা তখনও আছে বঙ্গভবনে– মোশতাক, রশীদ, ফারুক (তদানীন্তন মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান)। এরা আছে এই খবর-টবর পাই। তার কিছুদিন পরে, প্রায় দুই মাস (তখন) হয়ে গিয়েছে, কোনো পরিবর্তন কি হবে? আমরা কি ছাড়া পাব? (এই চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়)
(অস্পষ্ট) —–ইনভেসটিগেশন শুরু করেছে স্পেশালি আমাদের এই কজনের। এখানে (ইনভেস্টিগেশনে) মিলিটারি অফিসারসহ চার-পাঁচজন বসেছে। তারা আমাদেরকে প্রশ্ন করে।

শা আ: তারা কী ধরনের প্রশ্ন করে?

আ সা আ: এই সমস্ত পার্সোনাল (বিষয়)– কার কোথায় কী আছে, না আছে। আমাদের বাড়ি-ঘর-প্রপার্টি ইত্যাদি সমন্ধে স্টেটমেন্ট দিতে হয়। ইনভেস্টিগেশন আর কি। পুলিশের লোক দুইজন আছে। বাকি মিলিটারি। জেলগেটেই।

সৈ জো তা: রাজনৈতিক অবস্থার ওপর তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে কী বলতেন?

আ সা আ: এটা পরে আলাপ করব। পলিটিক্যাল আলাপটি পরে করব। তোমার সঙ্গে (শারমিন আহমদকে লক্ষ্য করে) আলাপ করব আরেক সিটিংয়ে।

শা আ: আমি পুরো ঘটনাটি টেপ করে রাখতে চাচ্ছি। সে সময় কী পরিস্থিতি ছিল? হয়তো একদিন আমি বেঁচে থাকি কি আপনি বেঁচে থাকেন, কিন্তু ইতিহাস বেঁচে থাকবে।

আ সা আ: তারপরে আমাদেরকে প্রথমে ডিভিশন দেয়নি। প্রথম রাতে আমরা সাধারণ ঘরে—

শা আ: প্রথম কতদিন ডিভিশন দেয়নি?

আ সা আ: প্রথম দিন ও রাতটা ডিভিশন দেয়নি। পরদিন, বোধহয় একদিন পরেই আমাদেরকে ডিভিশন দিয়ে দিল। ক্লাস ওয়ান। প্রথম রুমটা ছিল ছোট। সবাই এই রুমে প্রথমে উঠেছিল। এরপরেই ওই বিল্ডিঙে আরেকটা রুম। তারপরে বড় রুমটা। ওই রুমটায় আমি চলে গেলাম। আমার সঙ্গে মনসুর আলী সাহেব ছিলেন (নিউ জেল বিল্ডিং)।

শা আ: আপনি কত নং রুমে ছিলেন?

আ সা আ: তিন নাম্বার রুমে।

শা আ: তিন নাম্বার রাজবন্দিদের?

আ সা আ: এই বিল্ডিঙটা আইজির অফিস ছিল। জেলের ভিতরেই। পরে নিউ জেল নাম দেয়। এটা, ফাঁসি দেয় যে এরিয়ায়, সেটা পার হয়ে– আরেকটা ওয়াল আছে, তারপরে এটা। সেটাতেই আমাদের জন্য জেল বানায়।

শা আ: আইজির অফিসের তিন নাম্বার রুমে ছিলেন?

আ সা আ: না। একটা বিল্ডিং আছে আইজি অফিসের। সেই বিল্ডিঙের তিনটা রুম। প্রথম রুম হল— আমরা নিজেরাই (নাম্বার) বলতাম আর কি। প্রথম রুমটায় গিয়ে বসলাম। সবাই ওই রুমে গিয়ে বসলাম। সন্ধ্যার দিকে দেখলাম ওই রুমে তো থাকা যাবে না। মাঝের রুমে গেলেন কামরুজ্জামান ও আরও কিছু লোক। লাস্ট রুমটায় আমি গেলাম। মনসুর আলী বললেন, 'আমি সেখানে থাকব'।

শা আ: আব্বু কোন রুমে থাকতেন?

আ সা আ: এই প্রথম রুমটায়। এই রুমটা ইতিহাস!

(বড় মর্মান্তিক ইতিহাস। এই এক নম্বর রুমটিতে অন্যান্যদের সঙ্গে থাকতেন তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম। বঙ্গভবন থেকে মোশতাক-রশীদের নির্দেশপ্রাপ্ত হত্যাকারীদের আদেশে দুই নম্বর অর্থাৎ মধ্যের রুম থেকে কামরুজ্জামান সাহেব এবং তিন নাম্বার বা শেষ রুম থেকে মনসুর আলী সাহেবকে প্রথম রুমে নিয়ে যায় জেল কর্তৃপক্ষ। বাকি নেতৃবৃন্দদের ওই রুম থেকে সরিয়ে রাতের গভীরে মুক্তিযুদ্ধের চার নেতাকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়।)

শা আ: আব্বুর সঙ্গে কেউ ছিলেন?

আ সা আ: হ্যাঁ, কিছু গেলেন এখানে (প্রথম রুমে) আর সবাই রইলেন তিন নম্বর রুমে। বিল্ডিঙটা এভাবে লম্বা। এই রুমটা পয়লা পাওয়া যায়। এরপর দুই নম্বর সেখানে কামরুজ্জামান ও সঙ্গে আরও কিছু লোক– সঙ্গে যারা ছিল– মায়া (শ্রমিক লীগের নেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী) ও আরও কয়জন। আর লাস্ট রুমে– এটা বড় রুম– তিন নম্বর– আমরা বলি আর কি। জেলের নম্বর কী আছে আমরা জানি না। তারপর সেই রুমে প্রথমে আমি আর মনসুর আলী পরে আরও বহু লোক (গেলেন)।

শা আ: আর সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব কোথায় থাকতেন?

আ সা আ: ওই এক নম্বর রুমে। সৈয়দ সাহেব, তাজউদ্দীন সাহেব, শেখ আবদুল আজীজ, মাখন (ছাত্রনেতা আবদুল কুদ্দুস মাখন), কোরবান আলী, শেষ পর্যন্ত যারা ছিল আর কি। মোট ৮ জন ছিল।

শা আ: দ্বিতীয় রুমে কামরুজ্জামান —

আ সা আ: কামরুজ্জামান ও আদার্স, প্রায় ১২ জন। তৃতীয়টায় যারা আসত (জেলে) তারা ওখানে যেত। কারণ বড় রুম তো। যেমন জোহা সাহেব–

সৈ জো তা: জোহা সাহেব তো অনেক পরে গেলেন।

আ সা আ: হ্যাঁ, পরে গেলেন। তিন নম্বর রুমে জায়গা বেশি ছিল। তারপর ১ তারিখে আমাদের ইন্টারভিউ হচ্ছে– বিভিন্ন খবরাখবর পাই—

শা আ: ১ তারিখ কোন মাসের?

আ সা আ: নভেম্বর মাসের। পয়লা নভেম্বর। জেলার–

শা আ: জেলরের নাম কী?

আ সা আ: মনে হয় মোখলেসুর রহমান। গোপালগঞ্জ বাড়ি। (সঠিক নাম আমিনুর রহমান যা পরে জানতে পারি) এখনও আছে।

শা আ: এখন উনি কোথায় আছেন?

আ সা আ: —-(অস্পষ্ট) সুপারিটেনডেনট ছিল। এখন কোথায় আছে জানি না।

শা আ: আর ডিআইজি প্রিজনের নাম জানেন?

আ সা আ: আউয়াল সাহেব (আবদুল আউয়াল), আর আইজি (প্রিজনস) ছিলেন নুরুজ্জামান।

শা আ: তারপর কী হল? পয়লা নভেম্বর?

আ সা আ: পয়লা নভেম্বর তাজউদ্দীন সাহেবের ইন্টারভিউ ছিল (বেগম জোহরা তাজউদ্দীনের সঙ্গে)। উনি ডায়েরি লিখতেন। তো বিকালবেলায় আমি ও ইনি একটু বেড়াতাম। সকালেও বেড়াতাম, বিকালেও ওই এরিয়ার ভেতরে। বেড়াবার সময় যা কথাবার্তা হত। মাঝে মাঝে মিলাদ পড়াতাম, খতম পড়তাম। এই সব সময় বসতাম। পার্সোনাল আলাপ-টালাপ হত বেড়াবার সময়। তো ওই দিন বিকালবেলা (১ নভেম্বর) তাজউদ্দীন সাহেব আমাকে প্রথম বললেন যে, ''জেলটা আমার যেন মনে হচ্ছে যে রেডক্রসে নিলে ভালো হয়। রেডক্রসের হাতে না নিলে জেলটা মনে হচ্ছে ডেঞ্জারাস—-"

শা আ: মাই গড! আব্বু এটা বললেন যে জেলটা–

আ সা আ: এটা পুরা একটা ইমপ্রেশন। ওনার ইমপ্রেশনটা বললেন। তারপর আমাকে বললেন, "আপনি দেখেন একটা কিছু করা যায় কিনা। আমিও চেষ্টায় আছি। আপনিও চেষ্টা করেন।"

সৈ জো তা: ইশশ! কী আতঙ্ক ঢুকে গিয়েছিল! বুঝে গিয়েছিলেন–

শা আ: ওহ! তখুনি আব্বু বুঝতে পেরেছিলেন—

সৈ জো তা: উনি বুঝে গিয়েছিলেন যে জেলে সিকিউরিটি নেই–

আ সা আ: তখন তো উল্টা আমাদেরকে খবর দেওয়া হয়েছে যে চার পাঁচ দিনের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হবে। তাজউদ্দীন সাহেব তো সেদিন কথায় কথায় ওনার ইমপ্রেশন বললেন যে, "আপনিও চেষ্টা করেন আমিও চেষ্টা করি যে কোনোভাবে রেডক্রসে খবর পৌঁছানো যায় কিনা।"

তারপর সন্ধ্যার পর মনসুর আলী সাহেব আমার পাশের সিটে ছিলেন (৩ নম্বর রুমে পাশাপাশি বিছানায়)। উনিও একটু আনমনা। আমাকে বললেন, "সামাদ সাহেব, কী যে এরা খবর-টবর বলে। এমনি কথায় কথায় শোনা যায় যে মনে হয় ছেড়ে দেবে– কোনো কেইস তো (দোষী সাব্যস্ত করে কেইস) দাঁড় করাতে পারছে না"। কিছুটা প্রাইভেটলি ওই জেলের ভেতর থেকে খবর যায়।

শা আ: মনসুর আলী সাহেবের সঙ্গে কথা হয় সেদিন সন্ধ্যায়?

আ সা আ: হ্যাঁ। সে তো আমরা এক রুমে থাকি। মনসুর আলী সাহেব ও আমি পাশাপাশি। মনসুর আলী সাহেব বললেন "সামাদ সাহেব আমাদের জেলখানাটা– মিলিটারির লোকরা আসে যায়—"।

একদিন রাতে আমাদের সবাইকে (জেল কর্তৃপক্ষ) এসে জানিয়ে গেল যে কিছু মিলিটারির লোকরা যাবে তো– এখানে গান বাজনা— বাচ্চারা তো গান-টান গায়– ছেলেরা (তরুণ রাজবন্দিরা সময় কাটানোর জন্য কখনও একত্রে গান গাইতেন), একটু হৈচৈ কম হলে ভালো হয়– এইসব বলছিল। দুইদিন আগে দেখেছিলাম যে রাতে কিছু মিলিটারির লোক ওইসব (নিউ জেল) এরিয়া দেখেছিল।

শা আ: ওইসব এরিয়া টহল দেয়?

আ সা আ: না, না– দেখতে গিয়েছিল। তখন তো কোনো গভরমেন্ট নাই। জেল কর্তৃপক্ষ জানে না তারা কী করছে। তারা এসে জানাল, "আজ রাতে মিলিটারির লোক এসে এরিয়াটা প্রদর্শন করবে।" আমরা তো তখন মিলিটারির রাজত্বে। খুব কড়া রাজত্ব। মোশতাকের গভরমেন্ট (নামে মাত্র সিভিলিয়ান গভরমেন্ট)– তারপর আনফরচুনেটলি মোশতাক ছিল আওয়ামী লীগের। মোশতাকের কেবিনেটও আওয়ামী লীগেরই। তার মানে আগে যারা মেম্বার (ছিল) তারাই মেম্বার ছিল কেবিনেটে।

তারপর মনসুর আলী সাহেব আমাকে বললেন রেডক্রসে খবর দিতে। আমি বললাম– "হ্যাঁ, তাজউদ্দীন সাহেবও আমাকে বলেছেন। দেখি আমি পারি কিনা।"

[চলবে]

কোস্তারিকা, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৩

শারমিন আহমেদ: শিক্ষাবিদ ও বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের জ্যেষ্ঠ কন্যা।