জামায়াত শিবিরের হেডকোয়ার্টার কিন্তু লাহোর!

অমি রহমান পিয়ালঅমি রহমান পিয়াল
Published : 19 Dec 2013, 05:38 AM
Updated : 19 Dec 2013, 05:38 AM

অনেকের নিশ্চয়ই মনে আছে গোলাম আযমের সেই সাফাই সাক্ষাতকারটির কথা। ২০১১ সালের ১৩ ডিসেম্বর কয়েকটি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকদের ডেকে একাত্তরে নিজের এবং তার দল জামায়াতে ইসলামীর যুদ্ধাপরাধ অস্বীকার করেছিলেন সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান আমির। সেই সাক্ষাতকারেই তিনি বলছিলেন জামায়াতের হেডকোয়ার্টার তখনও লাহোরে ছিল, এখনও লাহোরে। না, এটা মোটেও ব্লুপার কিংবা মুখ ফস্কে বেরিয়ে যাওয়া কোনো ভ্রান্তি ছিল না। এটাই বাস্তব। জামায়াতে ইসলামীর সদর দফতর লাহোরেই। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এখনও তাদের আঞ্চলিক সংগঠন হিসেবেই নথিবদ্ধ।

ইউটিউবে এই সাক্ষাৎকারটির ভিডিও এই লিংকে দেখুন–

কথাগুলো নতুন করে বলতে হচ্ছে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে। ক'দিন আগে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করেছে বাংলাদেশ সরকার। এরপর নানা বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে বিভিন্ন মাধ্যমে। অনলাইনে এতদিন সবচেয়ে আলোচিত ছিল অভিযুক্ত কাদের মোল্লা আর একাত্তরের কসাই কাদের নাকি এক ব্যক্তি নয়। এই বিতর্ক আরও উস্কে দিয়েছিলেন সরকারদলীয় সাংসদ গোলাম মওলা রনি।

তিনি একটি চিরকুট প্রকাশ করেছেন ফেসবুকে, দাবি করেছেন সেটা কাদের মোল্লার লেখা এবং চিরকুটে তাকে অনুরোধ করা হয়েছে জনগণকে এটা জানাতে যে কাদের মোল্লা আরেকজন কাদেরের দায় নিয়ে ফাঁসিতে ঝুলছেন। রনির চিরকুট এবং সম্পূরক স্ট্যাটাস বার্তাটি যে ডাহা মিথ্যা তা প্রকাশ হয়ে যায় যখন কাদের মোল্লার স্ত্রীকে লেখা একটি চিঠি অনলাইনে আসে। দুটো চিঠির লেখনী এবং নাম স্বাক্ষরে পার্থক্যেই ধরা পড়ে রনি বানোয়াট গল্প ফেঁদেছিলেন।

তবে পুরো ব্যাপারটিকে ভিন্নমাত্রায় নিয়ে গেছে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া। কাদের মোল্লাকে একজন প্রকৃত 'পাকিস্তানপ্রেমিক' হিসেবে প্রশংসা করে তার ফাঁসির নিন্দা জানানো হয়েছে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে। এই বিবৃতিতে আমাদের মনে আর কোনো দ্বিধা থাকার কথা নয় জামায়াতের যুদ্ধাপরাধ ও পাকিস্তান-প্রেম নিয়ে। তাদের পক্ষে পাকিস্তানের স্বীকৃতির এই রূপ দেখে আমাদের অবাক হওয়ারও কিছু নেই।

জামায়াতে ইসলামীকে আমরা যে একটা যুদ্ধাপরাধী দল বলি এবং এর শীর্ষনেতারা সব যে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত, সেটা কোন ভিত্তিতে? এর একটা বড় কারণ আমাদের বুদ্ধিজীবী হত্যা। এই দায়টা প্রমাণিতভাবেই আল-বদর বাহিনীর কাঁধে পড়ে। আর কে না জানে এই আল-বদর বাহিনী গঠিত হয়েছিল ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের নিয়ে। ১৯৭১ সালে ছাত্র সংঘের পাকিস্তান সভাপতি মতিউর রহমান নিযামী, পূর্ব পাকিস্তান সভাপতি আলী আহসান মুজাহিদ, হাই কমান্ডের মীর কাশেম আলী, কামারুজ্জামান– এরাই তো যুদ্ধাপরাধের দায়ে গ্রেফতারের আগে জামায়াতের নেতৃত্বে ছিলেন।

এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আসাটা কোন অর্থে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক? নাকি বলতে চান আল-বদর বাহিনী যে ইসলামী ছাত্র সংঘই গঠন করছিল তার প্রমাণ দিতে হবে আগে! সেটা তো আছেই ভুরিভুরি। নাকি বাঙালি প্রমাণে চলবে না, খাঁটি পাকিস্তানি প্রমাণ লাগবে?

চাইলে সেটাও দেওয়া যাবে। তার আগে একটা প্রাসঙ্গিক তথ্য। জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠনের নাম 'ইসলামী জমিয়াত তালাবা' (আইজেটি)। পূর্ব পাকিস্তানে এটারই বাংলা নাম ছিল 'ইসলামী ছাত্র সংঘ'। স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক অধিকার ফেরত পাওয়ার পর এরা নাম নেয় ইসলামী ছাত্র শিবির (দুই সংগঠনের লোগোতেও ব্যাপক মিল)। ১৯৭১ সালে ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের আল-বদর নামের 'খুনে' বাহিনীতে রিক্রুট করার দায়িত্ব ছিল আইএসআই-এর মেজর রিয়াজ হুসেইন মালিকের ওপর। বলা হয়, আল-বদর নামটাও তারই দেওয়া। সংশোধন করে বাদ দেওয়ার আগে উইকিপিডিয়াতে লেখা ছিল–

The name Al-Badar was given by major Riaz Hussain during the passing out ceremony of first Al-badar group.

১৯৯৭ সালে জমিয়াতের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে একটা প্রামাণ্যচিত্র তৈরি হয় 'জমিয়াত কি পঞ্চাশ সাল' নামে। সেই বিশাল প্রামাণ্যচিত্রে পূর্ব পাকিস্তানের ইসলামী জমিয়াতে তালাবা সম্পর্কে রিয়াজ হুসেইনের প্রশংসাধন্য বয়ান মিলে। প্রামাণ্যচিত্রটির একটা সংক্ষিপ্ত ভার্সন আছে ইউটিউবে। 'আল-বদর ১৯৭১' নামের ওই ফুটেজটি পাকিস্তানিদেরই আপলোড করা। ফুটেজটির ভূমিকায় দেখা যায়, সমাজতান্ত্রিক ও সেকুলার ছাত্রদের (ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন) মোকাবেলায় যোগ্য প্রতিপক্ষ হিসেবে আইজেটিকেই মানা হয়েছে; সেকুলাররা যখন বন্দুক ধরেছে (মুক্তিবাহিনী হিসেবে) তখন তাদের ঠেকাতে ছাত্র সংঘের বন্দুক ধরাও ফরজ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।

রিয়াজ হুসেইন কয়েকটি ঘটনার বর্ণণা দিয়ে এদের মাহাত্ম্য প্রচার করেছেন (একদম ইসলামী ছাত্র সংঘ নামটা উল্লেখ করেই)। যেমন একজন ছাত্র সংঘ সদস্য নাকি তার আপন ভাইকে পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিয়েছিল, কারণ তার ভাইটি ছিল মুক্তিবাহিনীর সদস্য এবং সে সুবাদে 'ভারতের দালাল'। তার যুক্তি– 'এমন ভাইয়ের মরে যাওয়াই উচিত যে আমার কোটি মুসলমান ভাইয়ের সঙ্গে বেঈমানি করছে'!

আরেকজন সদস্য তার ভাইয়ের জানাজা পড়েই আবার ডিউটিতে এসে হাজির। একজন সদস্য দেখতে ছোটখাটো বলে রিয়াজ তাকে সরিয়ে দিয়েছিলেন 'তোমার বয়স কম' বলে। জবাবে সে পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে বলেছে– 'এখন তো বড় হয়ে গেছি'! তার জেহাদী তাগদে মুগ্ধ রিয়াজ তাকে রিক্রুট করছিলেন। আর সেই আল-বদরের নামে নাকি মুক্তিবাহিনী ভয়ে কাঁপত!

মূল জামায়াতের বক্তব্যে বেশ আফসোস এই কারণে যে এই আল-বদরদের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারেনি পাকিস্তান। সেই ফুটেজে আমাদের স্বাধীনতার পর এদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে বলে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। কোন ফুটেজটা ব্যবহার করা হয়েছে জানেন? আমাদের বুদ্ধিজীবীদের লাশের। তারা যে গণহত্যাকাণ্ডের দায়ে অপরাধী, সেই হত্যাকাণ্ডকেই নিজেদের সঙ্গী-সাথীদের হত্যাকাণ্ড বলে প্রচার করছে বিশ্বজুড়ে!

আফসোস হয় যখন পাকিস্তান ক্রিকেট দলের ভক্ত বাঙালিদের দেখি। মুসলমান ক্রিকেটার হওয়ায় তাদের সমর্থন করাটাকে ঈমানের অংশ মনে করে তারা। ২০০৯ সালে পাকিস্তানের ফয়সালাবাদ ইসলামী জমিয়াতে তালাবা একটা ফুটবল-ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজন করে যার নাম ছিল 'আল-বদর স্পোর্টস ফেস্টিভ্যাল ২০০৯'। সেই ক্রীড়ানুষ্ঠান উৎসর্গ করা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে শহীদ (!) আল-বদরদের উদ্দেশ্যে। সেই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ইসলামী ছাত্র শিবিরের নেতারাও উপস্থিত ছিলেন।

নিচে রয়েছে একটি ভিডিও ফুটেজের স্ক্রিনশট, যেখানে ইনফোতে লেখা আছে–

Nazim e Ala Islami Jamiat Talaba Pakistan,Br. Ateeq ur Rehman Khan Speaks in IJT Punjab Medical College's Albadar Floodlight Sports Festival 2009. Dedicated to the martyrs of Albadr East Pakistan

পাকিস্তানের জমিয়তে তালাবার সঙ্গে ইসলামী ছাত্র শিবিরের যোগসূত্রটা মিথ্যা মনে হচ্ছে? তাহলে সরাসরি তাদের ওয়েবসাইটে ঢুঁ মারতে পারেন। দুটো স্ক্রিনশট দেওয়া হল প্রমাণ হিসেবে (যার ওপরের দিকে ইউআরএল আছে এবং সেখানেই সত্যমিথ্যা যাচাই হয়ে যাবে)। মতিউর রহমান নিযামী ১৯৬৯ সালে প্রথমবারের মতো জমিয়তে তালাবার সভাপতি নির্বাচিত হন (যদিও জামায়াতি প্রচারণা হচ্ছে তিনি তখন হাফপ্যান্ট পরে স্কুলে যেতেন)। ১৯৭১ সালে নিযামী পুনঃনির্বাচিত হন। এই নিযামী এবং তার গোলামী সম্পর্কে বিশেষ প্রশংসাসূচক বাক্য লেখা আছে জমিয়াতে তালাবার ব্লগস্পটে।

নিযামী সম্পর্কে সেখানে বলা হয়েছে–

Motiur Rahman Nizami (Born 31 March 1943) : Motiur Rahman Nizam is the current chief (Ameer) of the Jamaat-e-Islami Bangladesh, which is the largest Islamic political party in Bangladesh. Nizami rose in the ranks of the Jamaat-e-Islami in East Pakistan in the 1960s, after being a leader of a student organization, Islamic Chhatro Shango (now Islami Chhatro Shibir). During the liberation war of 1971, Nizami actively supported the cause of West Pakistan and formed the Al-Badr Force in which he acted as the supreme commander of the Al-Badr Militia).

অন্য আরেকটি স্ক্রিনশটে দেখা যায়, ১৯৮১ সাল থেকে জমিয়তে তালাবা পাকিস্তান তাদের 'বেংলাদেশি' (Bengladesh– বানান লক্ষ্যণীয়) সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীগুলোয় অংশ নেয়; তাদের পূর্ব পাকিস্তানি ভাইয়েরাও 'বেংলাদেশ' থেকে তাদের অনুষ্ঠানে যায়। আল-বদর ফ্যান ক্লাবও ফেসবুকে আছে। সেখানে জমিয়তে তালাবার 'পাকি' আর 'বেঙ্গা' দুই অংশেরই ব্যাপক অংশগ্রহণ।

এর বাইরে আরও কিছু ওপেন আর ক্লোজ গ্রুপ আছে বদরদের সম্মানে।

এবার একটা গানের কথা বলি। তার আগে জমিয়াতে তালেবার পতাকাটা দেখুন, লাল-সবুজটা কাকতালীয় হলেও ওটায় কিন্তু পাকিস্তান লেখা নেই, লেখা আছে 'বাগেস্তান'। গানটা ওদের দলীয় সঙ্গীত। ঠিক ২ মিনিট ৬ সেকেন্ডে শুনবেন 'বাঙাল' আর 'আল-বদর'।

সবশেষে একটি ছবি দেখাই। ২০১১ সালের বিজয় দিবস উপলক্ষে একটি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজন করে ইসলামী ছাত্র শিবির। দেখতেই পাচ্ছেন সেই টুর্নামেন্টের বিজয়ী কারা! পাকিস্তানের জার্সি পরিয়ে জেতানো এই অবুঝ কিশোরদের বিপরীতে কারা খেলেছিল? কোন দল?

একটু মাথা খাটালেই উত্তরটা পেয়ে যাবেন। জ্বি, বাংলাদেশ।

অমি রহমান পিয়াল:ব্লগার, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট।