স্মৃতিতে ১৬ ডিসেম্বর: ঐতিহাসিক সেই বিকেল

একে খন্দকার
Published : 16 Dec 2013, 12:15 PM
Updated : 16 Dec 2013, 12:15 PM

১৬ ডিসেম্বর এলেই স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসতে হয়, মনে পড়ে যুদ্ধদিনগুলোর কথা। কী গভীর দেশপ্রেম নিয়ে যুদ্ধটি চালিয়ে নিয়ে গেছি আমরা। গুটিকয়েক দেশদ্রোহী ছাড়া গোটা দেশের মানুষ তাদের সর্বস্ব উজাড় করে যুদ্ধ করেছে নয়তো তাতে সহযোগিতা করেছে।

যুদ্ধদিনের প্রতিটি দিনই তো বিশেষ। তবে আমার কাছে সবচেয়ে স্মরণীয় হয়ে আছে ১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৪.৩১ মিনিটে তখনকার রেসকোর্স ময়দানে, এখনকার রমনা মাঠে, যৌথবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ঘটনাটি। কীভাবে এই ঘটনাটি ঘটল তা যেন এখনও মনের চোখে দেখতে পাই।

আমি তখন কোলকাতায়। ১৬ ডিসেম্বর সকালের দিকে কিছু কাজে বাইরে গেছিলাম। ফিরলাম বেলা দশটার দিকে। ফিরে দেখি আমার জন্য কিছু লোক অপেক্ষা করছেন। তাদের কাছেই জানলাম পাকিস্তানি বাহিনী সেদিন বিকেলে যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে। সেজন্য ঢাকার রেসকোর্সে একটি ছোট্ট অনাড়ম্বর অনুষ্ঠান হবে। আর আমাকে সে অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ও মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করতে হবে।

প্রবাসী সরকারে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ছিলেন জেনারেল এম এ জি ওসমানী। তাঁকে বাদ দিয়ে আমাকে প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে বেছে নেওয়ার কারণ ছিল তখন জেনারেল এম এ জি ওসমানী ছিলেন সিলেটে। মনে রাখতে হবে তখন তো এত মোবাইল বা এ জাতীয় কোনো মাধ্যম ছিল না যে তাঁর সঙ্গে খুব দ্রুত যোগাযোগ করা যেত। তাই আমাকে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ডেকে নেওয়া হয়েছিল।

যাহোক, আমাদের তখনই আগরতলা হয়ে ঢাকায় রওনা দেবার কথা ছিল। আমাদের জন্য তখন কোলকাতার দমদম এয়ারপোর্টে বিশেষ বিমান অপেক্ষা করছিল। আমরা তাই চলে গেলাম দমদমে। আমার সঙ্গে ছিলেন জেনারেল শিশু ও আরও দুজন এখন যাদের নাম আর মনে করতে পারছি না।

দমদমে পৌঁছে বিমানের সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম; উঠব—এমন সময় দেখি ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে প্রতিনিধিত্বকারী জেনারেল অরোরা সস্ত্রীক এসেছেন একটি জিপে করে। তিনি বয়সে আমার অনেক সিনিয়র। তাই তাঁকে সম্মান দেখিয়ে আমি বিমানের দরজা থেকে সরে দাঁড়ালাম। তাঁকে আগে যেতে অনুরোধ করলাম।

কিন্তু জেনারেল অরোরা বিমানে উঠলেন না; তিনি আমার পিঠে হাত দিয়ে বললেন, ''আপনি মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার, আপনিই আগে উঠুন।'' আমি অরোরার এ ব্যবহারে সত্যিই মুগ্ধ হলাম। আমাকেই আগে উঠতে হল, এরপর উনার স্ত্রী ও সবশেষে উনি নিজে। বিমানের দরজা বন্ধ হল। আমরা রওনা দিলাম আগরতলা বিমানবন্দরের উদ্দেশে।

ঢাকার ওপর দিয়েই উড়ে গেলাম আমরা। কেন ঢাকা বিমানবন্দরে না গিয়ে আমরা আগরতলায় গেলাম সে প্রশ্ন থাকতে পারে। ঢাকা বিমানবন্দরের রানওয়ে তখন এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে কোনো বিমান সেখানে অবতরণ করার মতো অবস্থা ছিল না। তাই আমরা আগরতলা পৌঁছে সেখান থেকে হেলিকপ্টারে ঢাকায় যাব—এমনই পরিকল্পনা।

আগরতলা বিমানবন্দরে পৌঁছে দেখলাম, সাতটি হেলিকপ্টার আমাদের জন্য প্রস্তুত, আমাদের ঢাকায় নিয়ে যেতে। আমরা রওনা দিলাম। ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছে দেখি লোকে লোকারণ্য। আমাদের আসার খবরে সাধারণ মানুষ সেখানে অপেক্ষা করছেন। কোনো রকমে ভিড় ঠেলে আমাদের যেতে হল। জিপে উঠে রেসকোর্সে পৌঁছুতে পৌঁছুতে দেখি পথে পথে হাজারও মানুষ নেমে এসেছেন। ময়দানেও তেমনই, হাজার হাজার লোকের ভিড়। সবার মধ্যে বিরাট আনন্দ আর কৌতূহল।

এত ভিড়ের মাঝে সামান্য একটু জায়গা ফাঁকা রাখা ছিল, সেখানে একটি টেবিল পাতা। সামনেই ঢাকা ক্লাব, সেখান থেকে দুটো চেয়ার এনে বসার ব্যবস্থা করা গেল। বসলেন ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে জেনালে অরোরা এবং পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে জেনালে নিয়াজী। তারপর আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করলেন দুজনে।

স্বাক্ষরের পরপরই সিনিয়র পাকিস্তানি অফিসারদের ওখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হল। কারণ আত্মসমর্পণ করেছে বলে পাক সেনা অফিসারদের নিরাপত্তার দায়িত্বভার আমাদের ওপরই বর্তে গেছে। ওদিকে আশেপাশে ঘিরে থাকা হাজার মানুষ উল্লাসে মুখর হয়ে ঊঠলেন। অনেকেই এগিয়ে এসে আমাদের জড়িয়ে ধরলেন। কাঁদছিলেন প্রায় সবাই। কাঁদতে কাঁদতে তারা বললেন, ''আজ থেকে আমরা শান্তিতে ঘুমাব।''

সত্যিই তো, কী নিদারুণ কষ্ট, দুঃসহ ব্যথা আর উদ্বেগ নিয়ে তারা এতগুলো মাস কাটিয়েছেন। আজ তাদের তাই কান্নার দিন, সুখের কান্না সেটা, ভারহীন মুক্ত জীবনের স্বপ্ন দেখার দিন।

আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান শেষেই আমাদের রওনা দিতে হল। আবার সেই হেলিকপ্টারে আগরতলা এবং আগরতলা থেকে বিমানে করে কোলকাতায় ফিরে যাওয়া।

প্রেতি বছর ১৬ ডিসেম্বর এলেই আমার সে মানুষগুলোর কথা মনে পড়ে যারা আমাকে বলেছিলেন, ''আজ থেকে আমরা শান্তিতে ঘুমাব।'' একাত্তরে যে ছবি দেখেছি, যেটি অনুভব করেছি সেটি মনের মধ্যে গেঁথে আছে। সেটা আমি কোনোদিন ভুলব না, ভুলব না সেই অশ্রুজলে মাখা আকুতি।

সেদিনও একটি কথা আমার বেশ মনে হয়েছিল, আজও মনে হয়— যে লাখ লাখ মানুষ এই স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিলেন, যাদের ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের এত আনন্দ– তাদের কথা কতটা মনে রেখেছি আমরা? মনে করছি আমরা?

যে দেশের মানুষ রক্ত দিয়ে দেশটিকে স্বাধীন করেছে সে দেশেরই আরও কিছু লোক মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানের পক্ষে উল্লাস করতে পারে– এটা যে কত বড় লজ্জার তা বলে বোঝানো যাবে না।

এখন তো এদেশে দু ধরনের লোক বাস করে। এক ধরনের মানুষরা হলেন দেশপ্রেমিক; আরেক ধরনের মানুষরা প্রকাশ্যে আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে। এ ধরনের মানুষদের চরম শাস্তি দিতে হবে– তরুণরা সে শপথ নিক সেটাই চাইব।

এবারের বিজয় দিবসের ঠিক চারদিন আগেই কাদের মোল্লা নামের এক কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় কার্যকর হল। এতে যতই খুশি হই না কেন আমরা, আমি বলব এটা বিরাট এক কর্মযজ্ঞের শুরু মাত্র। আরও অনেকদূর যেতে হবে। যে ক্ষতি, যে অপমান, যে দুঃসহ ব্যথা সইতে হয়েছে আমাদের জাতিকে— একজন দুজন নয়, হাজারও যুদ্ধাপরাধীর জন্য— তাদের প্রাপ্য শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

আমার বিশ্বাস নতুন প্রজন্ম সে কাজে এগিয়ে নেবে। ওদের ওপর আস্থা রাখাই যায়।

এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) একে খন্দকার: মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান সেনাপতি।