যুদ্ধদিনের স্মৃতি: হামজাপুরের টাইগারদের সঙ্গী

Published : 16 Dec 2013, 06:34 AM
Updated : 16 Dec 2013, 06:34 AM

১৯৭১ সালের মে মাস। মুক্তিফৌজে যোগ দেবার জন্যে সীমান্তের ধার দিয়ে এগুনোর সময় ঘটনাচক্রে আমি গিয়ে ঠেকলাম পশ্চিম দিনাজপুর জেলার সদর দপ্তর বালুরঘাটের কাছাকাছি এক ইয়ুথ ক্যাম্পে। সেখানে দেখা হয়ে যায় আমার হাফ ডজন হুল্লোড়বাজ ঢাকাইয়া বন্ধুর সঙ্গে, যার মধ্যে একজন গ্রেগরিয়ান স্কুলের সহপাঠী তান্না, ঢাকা ক্লাবের বর্তমান প্রেসিডেন্ট, দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে উন্নত করার শপথ নেবার কিছুদিন পরই যুদ্ধে যোগ দেবার জন্য যে ঘর ছাড়ে। সেই ক্যাম্পে কয়েক হাজার কিশোর ৩ দিনের বিশেষ মিলিটারি প্রশিক্ষণের জন্য অপেক্ষা করছিল যারা, তার পরপরই প্রশিক্ষিত গেরিলা হিসেবে ছোট ছোট ভাগে ভাগ হয়ে দেশের অধিকৃত এলাকাগুলোতে আক্রমণ চালাবে। অপেক্ষার এই সময়টুকুতে ওরা সেখানে বয় স্কাউটের মতো ড্রিল চালিয়ে যাচ্ছিল।

এ রকম সময়ে ৭নং সেক্টর হেডকোয়ার্টার লাগোয়া এই ক্যাম্পটিতে এল একটি দল যারা অফিসার্স ট্রেনিং ক্যাম্পের জন্য যুবকদের বাছাই করতে বিভিন্ন ক্যাম্পে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। আমি আর আমার বন্ধুরা সাক্ষাৎকারের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। লেফেটেন্যান্ট কর্ণেল কাজী নুরুজ্জামানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের নির্বাচক দলে ছিলেন কর্ণেল সাফায়াত জামীল আর সেক্টর ৭ এর ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার মেজর নাজমুল হক (শহীদ)। নির্বাচিত হয়ে (ক্লাব মেম্বার?) কাইয়ুম খান আর আমি রওয়ানা হলাম ভুটান বর্ডারের কাছাকাছি জঙ্গলঘেরা পাহাড় আর চা-বাগানের মধ্যে অবস্থিত ছবির মতো মিলিটারি স্টেশন 'মুরতি'তে।

চলচ্চিত্র প্রেমিকদের জন্য জানাচ্ছি, 'মি. অ্যান্ড মিসেস আইয়ার' যে জঙ্গলবাড়িতে রাত কাটিয়েছিল তা এই 'মুরতি'তেই। এই ক্যাম্পে আমার অভিজ্ঞতা নিয়ে Strike a Heroic Pose শিরোনামে ইংরেজি এক দৈনিকের সাহিত্য পাতায় বিস্তারিত লিখেছি (আগ্রহী পাঠকরা পড়ে দেখতে পারেন), তাই আর এখানে এ নিয়ে কিছু লিখছি না।

অক্টোবরের ৯ তারিখ, ৬১ জন ক্যাডেটের আমাদের এই ব্যাচকে নির্বাসিত বাংলাদেশ সরকার সেনাবাহিনীতে অর্ন্তভুক্ত করে আর এক সপ্তাহের মধ্যেই আমাদের পোস্টিং দেওয়া হয়। এর মধ্যে শেখ কামাল কর্নেল ওসমানির এডিসি হয়ে কোলকাতা যান। আমাদের বাকি ৬০ জনকে পাঠানো হয় ১১ নং সেক্টর আর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিভিন্ন ইউনিটে। অর্থাৎ বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী ৬০ জন সদ্যপ্রশিক্ষিত কোম্পানি কমান্ডার পেল যারা চলমান যুদ্ধকে তীব্র রূপ দিতে পুরোপুরি প্রস্তুত।

আমিসহ ৫ জনকে পাঠানো হল ৭ নং সেক্টরে, যার দায়িত্বে ছিলেন কর্নেল জামান। ক্যাম্পে গিয়ে কর্নেলের তাঁবুতে ঢুকেই আমরা দেখলাম, সবুজ পোশাক পরা গোলগাল ছোটখাট উৎসাহে টগবগ করা একজন অফিসার খুব উত্তেজিতভাবে কোনো একটা ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছেন। তিনি সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন ইদ্রিস যার সঙ্গে বালুরঘাট ক্যাম্পে থাকার সময় আমার আর কাইয়ুমের একবার দেখা হয়েছিল। এক সকালে আমরা তার ক্যাম্পে গিয়ে আবিষ্কার করেছিলাম তিনি বিশৃঙ্খল একটা দলকে কিছু একটা বোঝাচ্ছিলেন যারা এরপর বাংলাদেশের ভিতর টহল দিতে যাবে।

পেশাগত জীবনে ক্যাপ্টেন ইদ্রিস ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার যিনি কিছুদিনের জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইলেকট্রিক্যাল, মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে কাজ করেছিলেন। বাঙালিদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক কিছু একটা বলায় পাঞ্জাবি সিইও'র গায়ে হাত তোলার অপরাধে তাকে কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে বরখাস্ত করা হয়। যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন তিনি জয়পুরহাট চিনিকলে কাজ করতেন। সে সময় তিনি একদল স্বেচ্ছাসেবক একত্র করে যথাসম্ভব অস্ত্রসস্ত্র জোগাড় করে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। তিনিই ছিলেন হামজাপুর সাব-সেক্টরের দায়িত্বে, যে ক্যাম্পের নামকরণ হয় এর সদর দপ্তর লাগোয়া এক গ্রামের নামে।

"স্যার, আপনি যদি ভারতীয় কামানের ব্যবস্থা করতে পারেন, তাহলে এক সপ্তাহের মধ্যেই আমরা দিনাজপুর আক্রমণ করব।" তার বাহিনী যেখানে অবস্থান নিয়েছে মানচিত্রে সেই জায়গাটা দেখাতে দেখাতে কর্নেলকে বলছিলেন। প্রস্তাবটি নিঃসন্দেহে উত্তেজনাকর। কর্ণেল তার সাধ্যমতো সাহায্য করার আশ্বাস দিয়ে আমিন আর আমাকে ক্যাপ্টেন ইদ্রিসের সঙ্গে দিলেন। অস্ত্রসস্ত্র ও অন্যান্য দরকারি জিনিস বোঝাই দুটি জিপ নিয়ে আমরা সেই সন্ধ্যাতেই হামজাপুরের উদ্দেশে রওয়ানা হলাম।

সেখানে পৌঁছে প্রচণ্ড বিষ্ময়ে আবিষ্কার করলাম যে ক্যাম্প লোকে লোকারণ্য। ক্যাপ্টেন সেক্টর হেডকোয়ার্টারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার পরই আকষ্মিক আক্রমণ শুরু হয় এখানে, আর লোকজন যে যেদিকে পারে ছুটে নিজেদের রক্ষা করতে চেষ্টা করে। একজন মারা গেছে, কয়েকজন আহত। প্রচণ্ড রাগে ক্যাপ্টেনের মুখ দিয়ে মেশিনগানের মতো তুবড়ি ছুটতে লাগল। বিশেষ করে এক ভিতু এক্স ইপিআর এনসিও-কে উদ্দেশ্য করে বলতে বলতে একটা ভারি কাঠের চেয়ার তুলে নিয়ে বসে পড়লেন। আমিন আর আমি ভীষণ হতাশ হয়ে পড়লাম; বিষণ্নমুখে আমাদের জন্য নির্ধারিত ক্যাম্পে চলে গেলাম।

পরের দিন সকালে ক্যাপ্টেন অনেকটা শান্ত হয়ে এলেন। তার মতো যুদ্ধাভিজ্ঞ একজন কমান্ডার যিনি অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে এসেছেন, জানেন যে কীভাবে খারাপ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হয়। পুরো বাহিনীকে বেরিয়ে পড়ার জন্য তৈরি হতে আদেশ দিলেন তিনি। নাস্তা শেষ করেই আমরা ৩ ইঞ্চি মর্টার নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ২ ইঞ্চি মর্টারের মতোই বহুল প্রচলিত এই অস্ত্রটি দিয়েও নিশানা ছাড়াই তাক করতে হয়। কিন্তু আমাদের মর্টারম্যান রহমানের সঙ্গে এই অস্ত্রের এতই সখ্যতা যে একজনের পক্ষে যতটা সম্ভব প্রায় ততটাই অব্যর্থ হয় এর নিশানা।

পুনর্ভবা নদীর দক্ষিণভাগ পার হয়ে আমরা কয়েক কিলোমিটার দূরের সীমান্তের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে হতাশা, দুঃখ, আতঙ্ক নিয়ে দেখলাম পাকিস্তানিদের তাড়া খেয়ে ধেয়ে আসা বাংলাদেশি শরণার্থীদের ঢল। ক্যাপ্টেন ইদ্রিস কোথায় যেন উধাও হয়ে গেলেন। আমাদের এখন আাবার সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হবে। কামদেবপুর হাই স্কুলের খেলার মাঠের কাছাকাছি পৌঁছুতেই আমাদের লক্ষ্য করে বিশৃঙ্খলভাবে গোলাগুলি শুরু হয়। একটা নির্দিষ্ট এলাকা নিরাপদ করে আমরা সারা এলাকা ঘোরাঘুরি করে আর বিচ্ছিন্ন ছোটখাট কিছু যুদ্ধ করে দিন কাটিয়ে দিলাম। অন্ধকার নেমে এলে মৃত সতীর্থদের লাশ নিয়ে আমরা হামজাপুর ফেরত এলাম।

প্রায় এক সপ্তাহ পর, সেক্টর হেডকোয়ার্টারে আমার আর ক্যাপ্টেন ইদ্রিসের ডাক পড়ে। ২০০ জন গেরিলা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নতুন যোদ্ধাদের নিয়ে দল গঠন করার দায়িত্ব পড়ে আমাদের উপর। পিএমএ থেকে পালিয়ে আসা সাইফুল্লাহ আর বজলুর রশিদ নামের তার এক বন্ধুর যোগ দেয় আমার সঙ্গে। দেরি করে আসায় তাদের পরের ব্যাচের সঙ্গে যোগ দিতে বলা হলেও তারা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে মরিয়া হয়ে পড়েছিল।

আমরা দিনরাত আমাদের প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাচ্ছিলাম আর অপেক্ষা করছিলাম প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র সরঞ্জামের। এর মধ্যে একদিন কর্নেল আমাকে আর সফিউল্লাহকে তার সঙ্গে এক মিশনে যোগ দিতে ডাকলেন। মাঝরাতের দিকে রওনা হয়ে অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা হামজাপুর পৌঁছুলাম। দেখা গেল সেক্টর কমান্ডার দলের হয়ে আমাদের এক যুদ্ধে যোগ দিতে হবে। গন্তব্য, পাকিস্তানি সৈন্য অধিকৃত খানপুর বিওপি। আলো নিভিয়ে আস্তে আস্তে ভারতীয় গোপন অস্ত্রের স্তূপ, ট্যাংক বহর, জিপ পেরিয়ে আমরা মিলিত হলাম হামরাপুর দলের সঙ্গে। আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে আসা এলএমজিগুলো তাদের হাতে হস্তান্তর করলাম।

ছোট্ট একটা পুকুরের পাড় ঘেঁষা গাছের আড়ালকে অবজারভেশন পোস্ট হিসেবে বাছাই করেছিল কর্নেল যেখান থেকে হামজাপুরের কয়েকজন এলাকাটা পাহারা দিচ্ছিল। চারপাশ সুনসান, ঘন কুয়াশা পড়েছে ক্ষেতের ফসলে। তখন রমজান মাস। শহরে এ রকম সময় সাইরেন বেজে উঠে সেহরির সময় জানাতে।

এখানে তার বদলে আর্টিলারি শেলের বারুদ ঢেকে দিল সমস্ত বাতাস। শত্রুপক্ষ তাদের হাতে থাকা সব ছোট অস্ত্র দিয়ে জবাব দিতে লাগল আমাদের। আর্টিলারির বজ্রগম্ভীর আওয়াজ, গোলাগুলির একঘেয়ে উন্মত্ততা, উত্তেজনায় আমাদের দেহ থরথর করে কাঁপতে লাগল। সাইফুল্লাহ আর আমার কাজ হল ছোট ছোট অস্ত্রের শব্দ দিয়ে ওদের মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করা। কিন্তু এই ভয়ংকর শব্দে তা নিতান্তই অর্থহীন।

একসময় আমরা ধানক্ষেতের ভিতর দিয়ে আক্রমণকারীদের পালিয়ে যাওয়ার শব্দ বুঝতে পারলাম। আমার কোর্সমেট আমিন ছিল সেদিনকার হামলার নেতৃত্বে। গোলাগুলি আস্তে আস্তে দূর থেকে দূরতর হতে হতে একসময় মিলিয়ে গেল। ফিকে হয়ে আসা অন্ধকারের মধ্যে থেকে কুয়াশা ভেদ করে ৪ নং মাদ্রাজ রেজিমেন্টের ভারতীয় সৈন্যরা এগিয়ে এসে হামজাপুর দলের সঙ্গে যোগ দেয়। কর্নেলকে সঙ্গে নিয়ে আমরা তাদের সঙ্গে কমান্ড পোস্টের দিকে এগুতে এগুতে দেখতে পাই মাদ্রাজ সিও আর ক্যাপ্টেন ইদ্রিসকে।

পাকিস্তানিদের সঙ্গে যুদ্ধ তখনও চলছিল। হঠাৎ করে কেউ একজন সাঁজোয়া বাহিনী কালো পোশাক পরা কাউকে লক্ষ্য করল। শত্রুপক্ষের কামান হতে পারে ভেবে ভারতীয় সিও তৎক্ষণাৎ সহায়ক দল চেয়ে রেডিও বার্তা পাঠাল। মূহুর্তের মধ্যেই একটা দল এসে দাঁড়াল আমাদের পেছনে। "এবার কিছুটা ঝামেলা হতে পারে", সিও বলল। সম্পূর্ণ নতুন মোড় নিল যুদ্ধ। ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সমন্বিত আক্রমণের সময় এখন। সফিউল্লাহ আর আমার স্বল্প ট্রেনিংপ্রাপ্ত বাহিনী সঙ্গে নিয়ে স্বল্পচেনা পুনর্ভবার পশ্চিম পাড়ে যুদ্ধের মুখোমুখি আমরা।

যুদ্ধের পরিস্থিতি দাঁড়াল এ রকম: পুনর্ভবার পূর্বপ্রান্তে হামজাপুরের মূল বাহিনী ক্যাপ্টেন ইদ্রিস আর আমিন, সেই সঙ্গে মাদ্রাজ বাহিনী লে. কর্নেল মালহোত্রার নেতৃত্বে। পুনর্ভবার পশ্চিম পাড়ে নবপ্রশিক্ষিত আলফা বাহিনী নিয়ে আমি আর সফিউল্লাহ। দিনাজপুর শহর আর সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত বিখ্যাত ঢিবি রামসাগর ঘিরে পাকিস্তানি রক্ষণভাগ। সাবসেক্টরের পুরোনো বাসিন্দারা ইতোমধ্যেই খাঁটি বাঙালি ভঙ্গিতে তরুণ যোদ্ধাদের নাম দিয়েছে 'হামজাপুর টাইগার'। যাদুর মতো কাজ করে যখন বলি "তোমরা হামজাপুর টাইগার দলের সদস্য।" শেষবার যখন আমি এখানে এসেছিলাম নদীর পশ্চিম প্রান্তে তার থেকে কিছু পরিবর্তন হয়েছে।

ক্যাপ্টেন ইদ্রিসের বাহিনী পিছু হটলে আশেপাশের গ্রামের বাংকার থেকে পাকিস্তানি বাহিনী যোগ দিতে থাকে ওই এলাকা দখল করতে। দক্ষিণ দিনাজপুরের দুপাশের সীমান্ত এলাকাজুড়ে শালবন যেখানে রয়েছে সাঁওতাল বসতি। বনের উত্তর পাশ ঘেঁষে পাকিস্তানি বাংকার সীমাবদ্ধ। আমার ধারণা তারা ভয় এই ভেবে যে গেরিলা বাহিনী বনের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে ঝটিকা যুদ্ধ চালিয়ে আবার বনের ভিতরেই পালিয়ে যেতে পারে। (এ পর্যায়ে এসে এখন আমার মনে হচ্ছে আমার গল্প সংক্ষেপ করতে হবে। কিন্তু আমি আর আমার বন্ধু আমিন আরও কিছু জানাতে চায়।)

সামনে আমরা দুটো লক্ষ্য ঠিক করেছিলাম: পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে ওই গ্রামগুলো মুক্ত করা আর তাদের বাংকারগুলো সরাতে বাধ্য করা। আমরা গ্রামগুলো ঘেরাও করে এলাকাগুলো রীতিমতো চষে ফেলি। শত্রুর শক্তিক্ষয়ের জন্যই এ যুদ্ধ। অস্ত্রের অভাব সত্ত্বেও (রাইফেল, স্টেনগান, এলএমজি, ২ ইঞ্চি মর্টার, একটা ৮১ মিমি মর্টার, গ্রেনেড কিন্তু নেই কোনো রকেট লাঞ্চার, এমনকি গ্রেনেড ছোঁড়ার রাইফেল পর্যন্ত ছিল না; ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের সঙ্গে থাকা কাইয়ুমের কাছে অবশ্য কিছু ছিল)। আমার মূল শক্তি ছিল লোকবল। অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর সেখানেই দুর্বলতা।

শত্রুপক্ষের বেশ কিছু মরিয়া চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এক সকালে তারা নদীর পার দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা করে ধাওয়া খায়। অন্য এক রাতে বনের দক্ষিণ পাশে শুরু হয় প্রচণ্ড গোলাগুলি। আমাদের একটা দল শালবনের প্রান্তে ঘাঁটি গেড়েছিল। সারারাত সজাগ থেকে পরের দিন সেখানে ছুটে গিয়ে দেখি, গোলাগুলি এতই বেশি হয়েছিল যে আমাদের লোকজন বনের ভিতর পালিয়ে গেছে।

অবাক ব্যাপার হল, শত্রুপক্ষের উদ্দেশ্যই মনে হচ্ছিল কেবল ভয় দেখানো। হঠাৎ আমাদের একজন চেঁচিয়ে উঠে আলগা মাটির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করল আমার। উপরের মাটিটা সরাতেই প্লাস্টিক বেরিয়ে আসতে দেখে খুব সাবধানে আরেকটু মাটি খুঁড়ে বের করি প্লাস্টিক অ্যান্টি-পার্সোনাল মাইন যেটা একটা বিশাল অ্যান্টি-ট্যাংক মাইনের সঙ্গে জোড়া ছিল। সেদিন ও রকম চারটা মাইন আমি নিষ্ক্রিয় করেছিলাম। আমাদের একজন নির্মম রসিকতা করে বলেছিল, ''একটা ভুল পদক্ষেপ আমাকে কিমা বানিয়ে ছেড়ে দিত।''

মাইন সব যুদ্ধেই একটা বড় সমস্যা। একটা ট্রিপ-ওয়্যার মাইনের আঘাতে আমাদের বেশ কয়েকজন ছেলে আহত হয়েছিল। যুদ্ধশেষে দিনাজপুর এলাকার সবগুলো মাইন সংগ্রহ করে একটা স্কুলে রাখা হয়েছিল যেখানে আবার মুক্তিবাহিনীর লোকজনও থাকত। এদের মধ্যে অন্তত থেকে গিয়েছিল যেটা নিস্ক্রিয় হয়নি যার ফলে পুরো বিল্ডিংটাই প্রচণ্ড বিস্ফোরণে উড়ে যায়, মারা যায় প্রায় ৩০০জন। সুদূর বগুড়া থেকে এ শব্দ শোনা গিয়েছিল। বদলি সুবাদে আমরা তখন সেখানেই ছিলাম। লোকজন আমাদের কাছে ছুটে এসে জানতে চাইছিল কী হয়েছে। একজন তো ভেবেছিল আমেরিকা ভয় দেখাতে দেখাতে সরাসরি আঘাত হেনেছে।

শত্রুপক্ষের আকষ্মিক হামলায় ৪নং মাদ্রাজ বাহিনীর একজন অফিসার এবং কয়েকজন জওয়ান তাদের হাতে আটক হওয়ার পর তাদের জায়গায় আসে ১২ নং গাড়ওয়াল রাইফেলস বাহিনী। আমাদের তখন ফিল্ড টেলিফোন আছে। একদিন আর্টলারি ওপি এসে আমার সঙ্গে টহল দিতে বেরিয়ে শত্রুবাহিনীর বাংকারে আঘাত হানে।

আরেকদিন খুব সকালে আমরা শত্রুপক্ষের দক্ষিণপ্রান্তের বাংকার নেটওয়ার্ক ছারখার করে দেয়। অন্য আরেকটা গ্রাম ঘেরাও করতেই শত্রু কোনো রকম প্রতিরোধের চেষ্টা না করেই পালিয়ে যায়। একটি নতুন গেরিলা দল আমাদের সাথে যোগ দেয় যার ফলে আমাদের পক্ষে গ্রামগুলোর আরও গভীরে যাওয়া তখন সম্ভব হচ্ছিল। এক গ্রামে একদিন একটা ছেলে আমাদের কাছে কেঁদে কেঁদে বলছিল কীভাবে তার আর বোনের উপর অত্যাচার হয়েছিল। সেই যন্ত্রণাকাতর অভিব্যক্তি আমি জীবনে কখনও ভুলব না।

আমাদের সঙ্গে দুটো বাহিনী থাকায় আমরা তখন দুটো ভাগে ভাগ হয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করি। তখন আমাদের কাছে ওয়াকিটকি পর্যন্ত এসে গেছে (এগুলো মর্টার ছুঁড়তে বলার জন্য খুব কাজের)। কয়েকটা মোটরবাইকও জোগাড় হয়েছে যার ফলে আমরা অনেক সহজে আমাদের ঘাঁটিগুলো পরিদর্শনে যেতে পারি। তখন সাইফুল্লাহ থাকে একটা দলের সঙ্গে এক গ্রামে আর আমি অন্য একদল নিয়ে অন্য গ্রামে। মাঝখানে বিস্তৃত ধানী জমি। প্রতিদিন আমরা দুজন দিনের কর্মসূচি ঠিক করার জন্য দেখা করতাম।

একদিন সাইফুল্লাহ ঠিক করল মাঠ পেরিয়ে আমার ওখানে আসবে, ভেবেছিল কুয়াশা তাকে শত্রুদের চোখ থেকে আড়াল করে রাখবে। হঠাৎ করেই গোলাগুলি শুরু হয়। একটা ছেলে এসে আমাকে খবর দেয় যে সাইফুল্লাহ আহত হয়েছে। বেরিয়ে যেতেই দেখি ও প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। আমি দৌড়ে গিয়ে পড়ে থাকা গাছের আড়ালে তাকে টেনে আনি। গুলি তখনও চলছিল। মূহুর্মুহু গুলির ঘা লাগছিল পড়ে থাকা গাছগুলোর গায়ে। চিৎকার করে আমি একটা এলএমজি চাইলাম। তারপর গাছের গুঁড়ির উপর সাবধানে রেখে গুলি যেখান থেকে সেখানটা তাক করে গুলি ছুঁড়ি। পাল্টা গুলি বন্ধ হয়ে যায়। সাবধানে সাইফুল্লাহকে সেখান থেকে নিয়ে এসে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করি। ভাগ্যক্রমে গুলি হাড় ভেদ করেনি।

দুঃসাহসী সাইফুল্লাহকে অবশ্য হাসপাতাল বেশিদিন আটকে রাখতে পারেনি। ঝোলানো হাত নিয়ে হাসপাতাল পালিয়ে রণক্ষেত্রে হাজির হয় ও, মুখে হাসি নিয়ে। ততদিনে যুদ্ধের চূড়ান্ত সময় ঘনিয়ে আসছে। এর মধ্যে একবার রামসাগর আক্রান্ত হল। ১২ নং গাড়োওয়াল্যান্ডকে সঙ্গে নিয়ে আমরা দিনাজপুর জিতে নিতে পারতাম কিন্তু ভারতীয় সিও কৌশলগত কারণে আমাদের থেমে থাকতে বললেন। তা অবশ্য আমাদের মারমুখো প্যাট্রোলিং কিংবা ক্যাপ্টেন ইদ্রিসকে তার শেষ মরিয়া চেষ্টা থেকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। তাঁর এবং আমাদের ২ প্লাটুন করে সৈন্য, সঙ্গে আমার মর্টার আর সাইফুল্লাহকে সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে সঙ্গী করে তিনি ঠিক করলেন জেলার পশ্চিম সীমান্তের বিরলের দিকে এগুবেন।

ডিসেম্বরের ১৪ তারিখ হঠাৎ শত্রুর এক ফাঁদে পড়ে ক্যাপ্টেনের শরীরের নিচের অংশে আঘাত লাগে। পরবর্তীতে তাঁকে 'বীরপ্রতীক' উপাধিতে ভূষিত করা হয়, যদিও যুদ্ধ শেষে তাঁকে অনাড়ম্বরভাবেই দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি দেওয়া হয়। এই ১৪ তারিখেই বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর মোহদিপুর যুদ্ধে নিহত হয়। পরের দিন শত্রুপক্ষ দিনাজপুর ছাড়ে।

এবার শেষ করার পালা। ১৯৭১ সালের সেইসব অকথিত হিরোদের শ্রদ্ধা জানাতে চায় যারা অত্যন্ত সাধারণ মানুষ হয়েও দেশের জন্য তাদের সর্বস্ব বাজি রেখেছিল। আমার দলের ছেলেদের মধ্যে কেউ বিশ্ববিদ্যলায়ের ছাত্র ছিল না। এর মধ্যে একজন ছিল পনের বছর বয়সী ক্লাস নাইনের একজন– হাসিখুশি ও সাহসী ছেলে। কিছু কলেজপড়ুয়া ছাত্র যারা প্লাটুন কমান্ডার হয়েছিল; এদের মধ্যে একজন ছিল খুব সাহসী এক্স ইপিআর জেসিও। বাকিরা গ্রামের সাধারণ যুবক, কৃষক যারা স্বপ্ন দেখত স্বাধীন দেশ হবে শান্তিময় আর সমৃদ্ধশালী।

আমি তাদের বুঝানোর চেষ্টা করতাম ও রকম আকাশ কুসুম না ভাবতে যদিও আমার মনে হয় না তারা আমার এ কথায় পাত্তা দিত। উন্নত এক দেশ গড়তে তারা উৎসুক ছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুর্নগঠনের জন্য স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর কথা ভাবা হলেও পরে তা বাতিল করা হয়। আমাদেরকে বলা হয় প্রত্যেককে ৫০ টাকা করে দিয়ে নিজ নিজ জায়গায় ফেরত পাঠিয়ে দিতে।

সে সময় দুঃখ আর অপরাধবোধে আমার ভিতরটা গ্রাস করেছিল। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার লেখাপড়া শুরু করতে চাইছিলাম। অন্তত তিনবার আবেদনের প্রেক্ষিতে অবশেষে ১৯৭২ সালে আমি ছাড়পত্র পাই। কিন্তু তারপরও আমার দলের সবার মতোই আমিও ভাবি যে, আবার যদি একই জীবন যাপন করতে হত, আবার আমি এদের সঙ্গেই কাটাতে চাইতাম।

হামজাপুরের বাঘ পরিবারের একজন হিসেবে আমার গর্বের শেষ নেই।

অনুবাদ: রেশমী নন্দী

কায়সার হক: কবি, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক, সাহিত্যসমালোচক ও শিক্ষক।