ভিন্ন প্রেক্ষিতে এবারের বিজয় দিবস

আবেদ খান
Published : 15 Dec 2013, 03:31 PM
Updated : 15 Dec 2013, 03:31 PM

বিয়াল্লিশ বছরের ভেতরে বাঙালি জাতি এই প্রথম একটি অন্যরকম বিজয় দিবস পালন করছে। একাত্তরের বিজয় দিবস ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তার দোসরদের বিরুদ্ধে বাঙালির চূড়ান্ত বিজয়। সেই বিজয়ের ভেতর দিয়ে বাঙালি জাতি তার আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং সেই সময়ের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ।

এরপর বুড়িগঙ্গায় অনেক পানি গড়িয়েছে, আমাদের রাজনীতিতে যে টানাপড়েন চলেছে তার প্রতিফলন ঘটেছে এই বিজয় দিবসের ওপরও। দিবস দিবসের চেহারা পাল্টেছে একটু একটু করে। যুদ্ধের যে চেতনা, সেটা ক্রমশ দূর থেকে সুদূরপরাহত হয়ে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির ক্রমান্বয়ে অনুপ্রবেশ ঘটেছে রাষ্ট্রপরিচলনার অন্দরে। এ সময় থেকে বিজয় দিবসটি খণ্ডিত ও বিপর্যস্ত হতে শুরু করে। আজ এই বিয়াল্লিশ বছর পর বিজয় দিবসটি অন্য মাত্রা পেয়েছে, ভিন্ন এক শক্তি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। আমাদের এক বৃহৎ সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে এই বিজয় দিবসের আগমন।

আক্ষরিকভাবে দেখতে গেলে এটা সত্য বটে যে, একাত্তর সালের ডিসেম্বর মাসের ১৬ তারিখে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। যেহেতু পাকিস্তানি বাহিনী একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে আমাদের শত্রু হিসেবে পরিগণিত, সেহেতু আমরা ধরে নিতে পারি যে ওইদিন আমাদের চিহ্নিত শত্রুরা অস্ত্রসমর্পণের মাধ্যমে পরাজয় মেনে নিয়েছিল।

ব্যাপারটি সর্বাংশেই যুদ্ধক্ষেত্রের। যুদ্ধে এক পক্ষের জয় হয়েছে এবং অন্য পক্ষ পরাজিত হয়েছে। কিন্তু এ থেকে কি এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাবে যে বাংলাদেশ একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয়েছে? তা-ই যদি হবে তাহলে পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ কেন সংঘটিত হল? কেন তেসরা নভেম্বর জেলহত্যা হল?

পুরো পঁচাত্তরেই তো চলেছে নির্মম হত্যাযজ্ঞ এবং হত্যাকারীদের পুনর্বাসনের কার্যক্রম। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রায় সপরিবারে হত্যা করা হল। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা সরকারের যে চার নেতা ছিলেন, তাদের হত্যা করা হল, হত্যা করা হল প্রতিশ্রুতিশীল রাজনীতিক শেখ ফজলুল হক মণি ও তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে। রক্ষা পেলেন না বঙ্গবন্ধুর ভাই কিংবা ভগ্নিপতিও। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কোনো চিহ্ন যেন না থাকে তার চেষ্টা করা হল এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাদেরও অনেকে রেহাই পেলেন না। হয়তো কোনোমতে প্রাণরক্ষা করতে পেরেছেন কেউ কেউ, কিন্তু কেউ কি পেরেছিলেন ওদের প্রতিহত করতে? কেন ঘটল এতসব ঘটনা?

দেশ যদি একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বর শত্রুমুক্তই হয়ে থাকে তাহলে শাহ আজিজুর রহমান নামের একজন মুসলিম লীগার, যিনি পাকিস্তানের পক্ষ থেকে জাতিসংঘে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ অবস্থান নিয়েছিলেন, কী করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন? কী করে গোলাম আযমকে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার ছাড়পত্র দেওয়া হয় এবং একসময় দিয়ে দেওয়া হয় নাগরিকত্বও? কী করে শর্ষিনার পীরকে দেওয়া হয় স্বাধীনতা পদক?

দেশ যদি বিয়াল্লিশ বছর আগের ষোলোই ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয়েই থাকে, তাহলে চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতে ইসলামী কী করে দেশে রাজনীতি করতে পারে, নির্বাচন করতে পারে, একটা সময়ে সরকারের অংশীদার হতে পারে? কিংবা নিজামী-মুজাহিদের মতো আলবদর বাহিনীর নেতারা কী করে পাঁচ বছর মন্ত্রিত্ব করতে পারেন?

একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বরের পরদিন থেকেই আসলে স্বাধীনতার শত্রুদের তৎপরতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। মুক্তির উৎসবে আমরা এতই আপ্লুত হয়েছিলাম যে স্বাধীনতার শত্রুদের অস্তিত্ব অনুভব করতে তো পারিই-নি, বরং তাদের ক্ষমতা তুচ্ছ জ্ঞান করেছি। অথচ স্বাধীনতার শত্রুরা কখনও অপ্রস্তুত ছিল না। একাত্তরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকেই তারা বুঝতে পেরেছিল যে তাদের পরাজিত হতেই হচ্ছে সামরিকভাবে; তাই তারা আলবদর-আলশামস বাহিনী তৈরি করেছিল বাংলাদেশকে বুদ্ধিজীবীশূন্য করার লক্ষ্যে।

পোড়ামাটি নীতি গ্রহণের মাধ্যমে তারা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছিল একাত্তরের শেষ দিনগুলোতে। প্রশাসনে যারা ছিল, তারা আত্মরক্ষার জন্য একদিকে যেমন নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছিল, অন্যদিকে তেমনি সুযোগমতো গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান বাছাই করার চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছিল। মাত্রাতিরিক্ত আবেগ আমাদের বাস্তবতা থেকে ক্রমাগত দূরে ঠেলে দিচ্ছিল আর ওরা দুর্বল মুহূর্তগুলোর পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার করে চলেছিল এবং সুবিধামতো জায়গায় অবস্থান নিয়ে নিচ্ছিল।

এখানে একটা লক্ষণীয় বিষয় হল, মুক্তিযুদ্ধের পর যখন আওয়ামী লীগ এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন স্তরের নেতার মধ্যে পরিত্যক্ত সম্পত্তির প্রশাসক হওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়, তখন ঘাপটি মেরে থাকা প্রতিপক্ষ সুকৌশলে ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল ক্ষেত্রগুলো সঙ্গোপনে কব্জা করে ফেলে। আমদানিই হোক আর গ্র্যান্ট কিংবা কোনো ধরনের বৈদেশিক সাহায্য বা ঋণ– যা-ই হোক না কেন, সবকিছুরই নিয়ন্ত্রক হয়ে বসে তারাই। এর কুফল ফলতে যে দেরি হয়নি সেটা সে সময়কার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দিকে চোখ রাখলেই বোঝা যাবে।

বাহাত্তর সাল থেকেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের প্রশ্নে সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়ে ওঠে। যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে ঘিরে সিন্ডিকেট শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তার পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন তৎকালীন সেই মন্ত্রী, যিনি পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট এবং তার পরবর্তী দিনগুলোর কর্মকাণ্ডের নেপথ্যের মূল নায়ক। তিনি সেই মানুষ, যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগারে রেখে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। চুয়াত্তরে মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ এরই ফসল।

পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনার পরের সুদীর্ঘকালের ইতিহাস তো একচেটিয়াভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী শক্তির আস্ফালনের ইতিহাস। আমরা শুধু দেখেছি কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি পশ্চাদপসরণ করতে করতে ক্রমাগত কোনঠাসা হয়ে পড়ছে; কীভাবে সমাজের বিভিন্ন স্তরে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি নানা কৌশলে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করছে।

স্বাধীনতার পর বাহাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনার আলোকে আমাদের যে সংবিধান রচিত হয়েছিল, সেই সংবিধানটিকে নানা সময়ে বার বার কাটাছেঁড়া করে বিপন্ন করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এই চেতনার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ মূল চার নীতি কাটছাঁট করা হয়েছিল, সম্প্রতি সেই অসাম্প্রদায়িক ও কল্যাণকর রাষ্ট্রনীতি নতুন করে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হয়েছে, যদিও সে চেষ্টা সামগ্রিক ও সম্পূর্ণ রূপ পরিগ্রহ করতে পারেনি।

তারপরও এক এক করে আমাদের সংবিধানকে কলঙ্কমুক্ত করা গেছে। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে পঁচাত্তরের ঘাতকদের চিহ্নিত করে বিচার করা হয়েছে এবং বিচারের মাধ্যমে চূড়ান্ত শাস্তি প্রদান করা হয়েছে। এরই মধ্যে জাতির কাছে এক নতুন অঙ্গীকার এসে দাঁড়িয়েছিল, তা হল– একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দায়ী অপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করা।

আমরা দেখেছি, ছিয়ানব্বইয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসায় তারা সামান্য সময়ের জন্য থমকে গিয়েছিল বটে, কিন্তু তাদের চক্রান্তকারী তৎপরতায় এতটুকু ঘাটতি পড়েনি। ২০০১ সালের নির্বাচনে তাদের উত্থান ও নিষ্ঠুর প্রতিহিংসাপরায়ণতা থেকে বোঝা যায় তারা কী পরিমাণ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। জোট সরকারের আমল জুড়ে তারা জঙ্গিবাদ ও স্বাধীনতাবিরোধী মানসিকতার চাষাবাদ করেছে।

২০০৮-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের জয় আবার তাদের থমকে দিয়েছে, কিন্তু দমাতে পারেনি। পূর্ণোদ্যমে তারা চালিয়ে যাচ্ছে ষড়যন্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির সরকারের বিরুদ্ধে। অর্থাৎ একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় ঘটেছে বটে, কিন্তু বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়নি এবং নানামুখী ষড়যন্ত্রের মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে এই দেশ। স্বাধীনতার শত্রুরা এখন অনেক বেশি শক্তিশালী, অনেক বেশি সংগঠিত। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ।

২০১৩ সাল জুড়েই, বিশেষ করে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত অপরাধীদের এক একটি রায় ঘোষণার পর পর, আমরা দেখেছি কীভাবে অরাজকতা পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। কীভাবে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হয়েছে, নাশকতা করা হয়েছে রাষ্ট্রের ও সাধারণ মানুষের সম্পদের ওপর। আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে মানবতাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে। তা এখনও চলছে। বিশেষ করে একজন মানবতাবিরোধী অপরাধীর ফাঁসির রায় কার্যকরের পর এই অশুভ শক্তি নৃশংসতার সব উপায় নিয়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

২০১৪ সালে বাংলাদেশের নির্বাচনের মূল শক্তি হবে একটি নতুন প্রজন্ম। তারাই ২০০৮ সালে স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তিকে বিপুল ম্যান্ডেট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছিল। তারা পরিপূর্ণভাবে বাংলাদেশেরই প্রজন্ম। তাদের কাছে মুক্তিসংগ্রামের সুদীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছরের ইতিহাস অজানা– অজানা মুক্তিযুদ্ধের বিশাল পটভূমি কিংবা ঘটনাবলিও। তারা কীভাবে দেখবে দেশকে, কীভাবে দেখবে মুক্তিসংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে? এই নতুন প্রজন্মের কাছে দেশ এবং দেশের ইতিহাস যথাযথভাবে তুলে ধরার জন্য যে কাজ করার কথা ছিল পূর্বসূরিদের, তা কি তারা ঠিকমতো করতে পেরেছেন? কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে নতুন প্রজন্মের হাতেই চলে যাবে দেশটা।

প্রকৃতপক্ষে এবারের বিজয় দিবস হচ্ছে বাঙালির অস্তিত্বরক্ষার লড়াইয়ের দিবস এবং সেই অস্তিত্বের লড়াইয়ে নতুন প্রজন্মই নেতৃত্ব দেবে, যুদ্ধ করবে। এ এক ভিন্ন যুদ্ধ, কিন্তু এর আদর্শ ও চেতনা সেই একাত্তরের। একাত্তরের ঘাতকেরা দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ছত্রচ্ছায়ায় থেকে তারা লাখো শহীদের রক্তে রাঙা লালসবুজ পতাকাকে তাদের শকটে এবং বাসভূমিতে ওড়ানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিল যারা, আজকে তারাই আবার এই বিজয় দিবস এবং এই বিজয়ের মাস কলঙ্কিত করার জন্য নানা চক্রান্তের ফাঁদ পেতেছে।

এরই মধ্যে সমস্ত সংশয় দূর করে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল বিচারকার্য সম্পন্ন করেছে কতিপয় শীর্ষ মানবতাবিরোধী অপরাধীর। তাদের একজনের চূড়ান্ত বিচারের রায় কার্যকরও সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। আমাদের আশার জায়গা এখানেই। সকল প্রতিকূলতা অতিক্রম করে আমরা এগিয়ে চলেছি সামনের দিকে। সেই সামনে এগোনোর পথে যত বাধা আছে, তা সাময়িকভাবে যতই জঙ্গিশক্তিতে অরাজকতা সৃষ্টি করুক, নৈরাজ্য আনুক বাংলার প্রত্যন্ত জনপদেও, শেষ জয় আমাদের হবেই।

অর্থনৈতিকভাবে আমাদের উত্থান আগামীতে বাংলাদেশকে প্রভাবশালী রাষ্ট্রে পরিণত করবে। এমন 'স্বপ্নের বাংলাদেশ' অদূর ভবিষ্যতে বাস্তব রূপ পাবে, শুধু 'স্বপ্নের জগতে' আটকে থাকবে না। আমি নিশ্চিত।

আবেদ খান: সাংবাদিক, প্রকাশিতব্য দৈনিক জাগরণ-এর সম্পাদক।