গ্যারিসনে গণতন্ত্র

Published : 2 Oct 2010, 03:53 PM
Updated : 2 Oct 2010, 03:53 PM

মিয়ানমারে গণতন্ত্রের হাওয়া বইছে বলে সে দেশের সরকার সরকার প্রধান সিনিয়র জেনারেল থান শুয়ে মিডিয়ায় মুচকি হাসি ছড়িয়ে চীনে পাঁচ দিনের একটি শুভেচ্ছা সফর গিয়েছিলেন। কারো কারো মতে চীনের কাছ থেকে নির্বাচনী শুভেচ্ছা আদায়ের পর সন্তুষ্টচিত্তে দেশে ফিরেছেন। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে নির্বাচনের বিকল্প নেই সুতরাং নির্বাচনের তোড়জোড় বেশ চলছে। কিন্তু সেই তোড়জোড় যতটা না জনগণকে নিয়ে তার চেয়ে বেশি গ্যারিসনের অভ্যন্তরে।

যদি অপ্রত্যাশিত কোন দুর্যোগ/দুর্ঘটনা না ঘটে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ৭ নভেম্বর।

নির্বাচনের প্রধান প্রস্তুতি হিসেবে মিয়ানমারের সবচেয়ে জনপ্রিয় (১৯৯০-এর সাধারণ নির্বাচনের রায় অনুযায়ী) রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। ১৯৯০-এর মে মাসে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ (এবং প্রথম) সাধারণ নির্বাচনে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি মোট ৪৮৫ টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ৩৯২টি আসন লাভ করে। এই দলের প্রধান অং সান সুচি। তার নেতৃত্বেই তখন সরকার গঠিত হবার কথা। কিন্তু ক্ষমতার পালাবদল ঘটেনি। গ্যারিসন নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রযন্ত্র সুচি-কেই তখনই তার দল থেকে বহিঃস্কার করে দেবার হাস্যকর ফরমান জারি করে। সু চি-কে সরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করার জন্য ১৯৯২ সালের প্রস্তাবিত খসড়া সংবিধানে যোগ করা হয় কোন মিয়ানমার নাগরিক বিদেশিকে বিয়ে করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজ দেশের নাগরিকত্ব হারাবেন। এই প্রস্তাবনার ২০ বছর আগে ১৯৭২ সালে সু চি একজন ব্রিটিশ নাগরিককে বিয়ে করেছিলেন। সুতরাং তাকেই ধরতে হবে।

১৯৯০-এর নির্বাচন পরবর্তী কুড়ি বছরের প্রায় পুরোটাই সু চি কোন না কোন ধরনের বন্দি দশায় কাটিয়েছিল। ২০ সেপ্টেম্বর ২০১০ মিয়ানমানের জাতীয় ভোটার তালিকা প্রকাশিত হয়েছে এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের সুবিধের জন্য (!) ভোটার তালিকায় তার নামই রাখা হয়নি। তিনি ভোটার নন, সুতরাং নির্বাচনও করতে পারবেন না, ভোট দিতেও পারবেন না। সু চি ও তার দুই সহযোগী গৃহবন্দিদশায় আরোপিত শর্তাবলি লঙ্ঘন করেছিল– এই অভিযোগে গত আগস্টে তাদের অন্তরীণকাল আরও দেড় বছর বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

ফরমান জারির মাধ্যমে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি বিলুপ্ত ঘোষিত হওয়ায় এই দলের নেতাকর্মীদের সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকান্ড অবৈধ। নির্ধারিত সময়ে নিবন্ধন না করার অভিযোগে কেবল সু চির দলই নয়, আরও নয়টি দলও এই বিলুপ্তির শিকার হয়েছে।

সরকার এই দলের সদস্যদের হুশিয়ার করে দিয়েছে কোন ধরণের বিক্ষোভ সৃষ্টি করে নভেম্বরের গণতান্ত্রিক আয়োজনকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করা হলে তার পরিণতি খুব খারাপ হবে। বিশেষ করে নির্বাচন বানচালের উদ্দেশ্যে কোন ধরণের উস্কানি ও বিক্ষোভ করলে এক বছরের কারাদন্ড ও বড় অঙ্কের অর্থদন্ড ভোগ করতে হবে। সব মিলিয়ে একটি আতংকাবস্থা বিরাজ করছে বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবর বের হচ্ছে। জাতিগত দ্বন্দ্ব-সঙ্কুল ও সরকার-অবাধ্য ৩০০ গ্রামের বিশ লক্ষ ভোটারকে ভোট দেবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হবে। রাষ্ট্রীয় ভাষ্য হচ্ছেঃ নিরাপত্তার প্রশ্নে এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ায় জনগণের ভোট দিতে যাবার প্রয়োজন নেই, সে সব স্থান নির্বাচনী আওতার বাইরে।

ভোটার তালিকা ঘোষিত হওয়ার চার দিন পর সরকার জানিয়েছে, 'সুচি ভোট দিতে পারবেন, কিন্তু যেহেতু তিনি গৃহবন্দি, তার ভোট কেন্দ্রে যাবার প্রশ্নই আসে না।'

এদিকে মিয়ানমানের প্রধান মন্ত্রী আসিয়ান নেতাদের সম্মেলনে বলেছেন, তিনি খুবই আশাবাদী যে জাতীয় সংহতি সৃষ্টিসহ গণতান্ত্রিক উত্তরণে সু চি যে অবস্থায়ই থাকুন না সেনা সঠিক ভূমিকা পালন করবেন।

বন্দি অবস্থায় কি কোন ভূমিকা পালন করা সম্ভব?

তিনি তখন জানিয়েছিলেন, তিনি যদি সঠিক আচরণ করেন তা হলে কারাশর্ত কিছুটা শিথিলও করা যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত মেয়াদ কেবল বেড়েই চলেছে।

২০০৮ সালে জেনারেল থান শুয়ে সরকার 'রোডম্যাপ টু ডেমোক্র্যাসি' ঘোষণা করেছিল, সেই রোডম্যাপ এখন আবারও গ্যারিসনমুখী হয়ে পড়েছে কিনা নির্বাচনের পূর্বক্ষণে সে প্রশ্ন উঠারই কথা।

গত বিশ বছর যে সব সংবাদের পুনরাবৃত্তি হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে: সুচি ও সামরিক সরকারের দূরত্ব কমছে, আলোচনার পথ প্রশস্ত হচ্ছে, জাতিগত ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে এবং ক্ষমতার উপরি কাঠামোতে জেনারেলদের কিছুটা রদবদল হয়েছে। আরও একটি সংবাদ মাঝে মাঝে ঝিলিক দিয়ে উঠেছে- সুচির মুক্তি অত্যাসন্ন। কার্যত ক্ষমতা ধরে রাখার লড়াইয়ের রিং হচ্ছে মিয়ানমার সেনাছাউনি। সেখানে কার কী ভূমিকা সেটিই মূখ্য, জনগণের চাওয়া নয়।

এদিকে জাতিসংঘের অসহায় দশা আর একবার প্রকাশিত হয়েছে মহাসচিব বান কি মুনের অতি সাম্প্রতিক একটি আহ্বানে। তিনি এশিয় নেতাদের আহ্বান জানিয়েছেন নভেম্বরের নির্বাচনের আগেই তারা যেন একটা কিছু করেন। তিনি আরও বলেন, মিয়ানমার সরকার বিশ্ব সম্প্রদায়ের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে।

তারপরেও ১৯৬২ থেকেই ক্ষমতাসীন কোন না কোন জেনারেলের সরকার। অপশাসন এক সময়ের 'চালের ঝুড়ি' মিয়ানমারকে ভিক্ষার থালায় পরিণত করেছে।  অর্থনীতিবিদদের ধারণা।

এদিকে আর্থ রাইট ইন্টারন্যাশনাল এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে সামরিক সরকারকে তুষ্ট করে মিয়ানমারে কাজ বাগিয়ে নিতে 'এনার্জি জায়ান্ট' টোটাল ও শেভরণ তাদের হাতে তুলে দিয়েছে ৪.৮৩ বিলিয়ন ডলার। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে দেশিয় রাজস্ব থেকে 'বিলিয়নস অব ডলার' নিয়মিত এসে জমা হচ্ছে সিঙ্গাপুরের ব্যাঙ্কে।

৪ জানুয়ারি ১৯৪৯ জাতিগত অনৈক্য ও বিরোধের মধ্যেই স্বাধীন হয় তখনকার বার্মা। শান ও কাচিন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন প্রশমিত করতে ১৯৬০-এর এপ্রিলে তখনকার নির্বাচিত সরকারের পুনর্বহাল একটি বিশেষ ভূমিকা রাখে। ১৯৬২ সালে প্রধান মন্ত্রী নু যখন রেঙ্গুনে (এখন ইয়াঙ্গুন) একটি সর্বদলীয় বৈঠক আহবান করেন এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার পক্ষে বিভিন্ন জাতিভিত্তিক দেশসমূহের নেতারা একত্রিত হন জেনারেল নে উইন অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। সংহতি সম্মেলনে আগত নেতাদের গ্রেপ্তার করেন এবং বিপ্লবী পরিষদের নামে শাসক পরিচালনা করতে থাকেন।

ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই জেনারেল নে ইউন তার অবস্থান ব্যাখ্যা করার জন্য সাংবাদিক সম্মেলন ডাকলেন। সেনা ব্যবস্থাপনায় আহুত দেশি ও বিদেশি সাংবাদিকদের সামনে নে উইন যখন কথা বলতে শুরু করলেন, একজন সাংবাদিক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, জেনারেল, অভ্যুত্থান ঘটিয়ে আপনি যেভাবে ক্ষমতা দখল করেছেন তা যে একটি অবৈধ কাজ তা কি আপনি বোঝেন?

যে চেয়ারে তিনি বসা ছিলেন, ক্ষিপ্ত জেনারেল চেয়ার ছেড়ে পেছনে এসে সজোরে তাকে লাথি মারেন, আর এবাউট টার্ন হয়ে পেছন দিয়ে বেরিয়ে যান। সংবাদ সম্মেলনের সমাপ্তি সেখানেই; তারপর বহু বছর ক্ষমতায় ছিলেন নে উইন, আর সাংবাদিক সম্মেলন আহ্বান করেন নি তিনি।

এ ধরনের সরকারের জন্মভিত্তি ও আইনি বৈধতার হয়তো প্রয়োজনই হয় না। কিংবা অবৈধতায় আইনি প্রলেপে বৈধকরণে সাময়িক উপশম গঠতে পারে, শেষ পর্যন্ত তা অবৈধই থেকে যায়। নে উইনের সরকারের গালভরা নাম হল স্টেট ল এ্যান্ড অর্ডার রেস্টোরেশন কাউন্সিল যার লক্ষ বার্মা ইউনিয়নের ভৌগলিক অখন্ডতা রক্ষা করা, জাতীয় সংহতি অখন্ড রাখা এবং সার্বভৌমের সংহতি ও প্রবহমানতা বজায় রাখা। ডিক্রি ও সামরিক আইনে দেশ চালান এই কাউন্সিল। তারও আগে স্বল্প সময়ের জন্য কার্যকরী ছিল সিকিউরিটি এ্যান্ড এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সেন্ট্রাল কাউন্সিল।

ক্ষমতার দ্বন্দ্বটা যেহেতু গ্যারিশনে তাই এক সময়কার প্রচণ্ড ক্ষমতাধর নে উইনও এক সময় তার অনুগত জেনারেলদের হাতে ক্ষমতাচ্যুত হলেন। আরও কয়েক দফা নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার হাত বদলের পর এলেন সিনিয়র জেনারেল থান শুয়ে। তিনি তার সরকারের নাম দিলেন এসপিডিসি –স্টেট পিস এ্যান্ড ডেভলপমেন্ট কাউন্সিল। তিনি এই শান্তি ও উন্নয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। ক্ষমতা আরও সংহত হল গ্যারিসনে।

১৯৫৮ সালের অক্টোবরে ফিল্ড মার্শল আইয়ুব খানের নিয়ন্ত্রনাধীন সেনাবাহিনী পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে, বিচারপতি কায়ানির ঠাট্টাটি ছিল 'পাকিস্তানের সাহসী সৈন্যরা নিজের দেশই জয় করে ফেলেছে।'

নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক উত্তরণের নামে ৭ নভেম্বর ২০১০ মিয়ানমারের বীর সেনানিরা নতুন করে আবার না নিজ দেশ জয় করে ফেলে দূর থেকে হয়ত তাই পর্যবেক্ষণ করতে হবে। একটি শিখন্ডি সরকারকে সামনে রেখে হয়ত নতুন কোন সামরিক পরিষদ দেশ শাসন করে যাবে।