কান পেতে রই

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া
Published : 5 Dec 2013, 07:19 AM
Updated : 5 Dec 2013, 07:19 AM

নভেম্বর মাসের শুরুতে গাজীপুরে মনিরকে রাজনীতির আগুনে দগ্ধ হতে দেখে আমরা শিউরে উঠেছিলাম। আমরা সে কথা বলেছি বিভিন্নভাবে। ভেবেছি সেটাই শেষ পুড়িয়ে মারার ঘটনা হবে। কিন্তু যতদিন যায়, এই তালিকা দীর্ঘ হতে থাকে।

আমাদের ভাগ্যের নির্ধারকরা আমাদের স্বার্থের জন্য একের পর এক পুড়িয়ে মারতে থাকেন আমাদেরই শ্রেণির আরও মানুষ। আমরা চুপচাপ থাকি এই ভেবে যে, এসবই তো আমাদের ভালোর জন্য। ভোট দিয়ে,আমাদের আপন ভেবে, যাদের শাসন করতে পাঠিয়েছি তারা তো আমাদের ভালো ছাড়া মন্দ চাইবেন না।

আমাদের বলা হয়েছে, আমাদের সব ভালোর জন্য, সংবিধান নামে একটি বই আছে তাতে আমfদের জন্য খুব ভালো ভালো কথা লেখা আছে। আমাদের বলা হয়েছে, সেই বই অপরিবর্তনীয়। অর্থাৎ আমাদের জন্য যা কিছু ভালো, তা কেউ পরিবর্তন করতে পারবে না। শুনেছি সেই বইয়ে লেখা নিয়ম মতে, যারা নির্বাচনে বেশি ভোট পেয়েছে তারা 'সরকার' গঠন করেছে আর অপেক্ষাকৃত কম ভোট যারা পেয়েছে তারা 'ছায়া সরকার' গঠন করেছে।

আমাদের কী আনন্দ, আমাদের দুটি সমান্তরাল সরকার আছে যারা আমাদের ভালো-মন্দ দেখে! ভোটের দিনটিকে আমাদের দেশে যারা 'বুদ্ধি দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন' তারা বলেন 'ভীষণ আনন্দমুখর' দিন! সত্যিই তাই। আমরা অনেক যুগ কিছুই পাইনি। এখন আমরা নিজেরা নিজেদের শাসন করছি, তাই আনন্দ তো হবেই। কত সহজে আমরা বলতে পারি, 'আমার ভোট আমি দিব, যাকে খুশি তাকে দিব।'

আমাদের নিজেদের লোক বলে কথা। কেউ আমাদের আর জোর করে ইংরেজি কিংবা উর্দু ভাষায় কথা বলতে বাধ্য করতে পারবে না। জোর করে কোনো সিদ্ধান্ত আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে পারবে না। তাই যা কিছু হয় সব আমাদের ভালোর জন্যই। এছাড়া আর কী? কেউ যদি এর বাইরে কিছু ভাবেন তবে তিনি নিশ্চিত দেশদ্রোহী। নিজের ভালো পাগলেও বোঝে!

আমাদের প্রধানমন্ত্রী বা তার সরকারের সকল কাজ তাই কেবলই জনগণের স্বার্থে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যা করেন 'ছায়া সরকার' হিসেবে তা-ও কেবল আমাদেরই স্বার্থে। গর্বে আমাদের বুক ফুলে ওঠে। কে কবে ভেবেছিল, এমন বড় বড় মানুষগুলো, আমাদের মতো না খেতে পাওয়া, অর্ধমৃত মানুষগুলোর কথা বলবেন! তাও আবার এমনভাবে বলবেন যে, তারা আমাদের নির্দেশে আমাদের ভালোর জন্য সব কাজ করছেন!

আমাদের পেটে ভাত না থাকলেও তাই আমরা সম্মানিত বোধ করেছি। আমাদের বোমা আর পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে মারলেও আমরা ভেবেছি এ-ও আমাদের ভালোর জন্যই। সবার ভালোর জন্য কারও কারও মৃত্যুরও নিশ্চয়ই প্রয়োজন আছে। আমাদের মাঝে কেউ কেউ কখনও-সখনও বিভেদ তৈরি করার চেষ্টা করেছে; বলেছে, আমাদের ঠকানো হচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করিনি। আমাদের মনে হয়েছে, ওরাই আমাদের ভালো চায় না। তাদেরই কোনো না কোনো দুরভিসন্ধি আছে।

কেউ কেউ আবার ইসলামের নাম করে দেশ শাসন ও পরিচালনার অনুমতি চেয়েছে। আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে চব্বিশ বছর থাকার অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি, ওরা ধর্মের কথা বললেও অধর্ম করে বেশি। তাই তাদের কখনও-ই অনুমতি দিইনি। এই দেশের মালিক যখন আমরা, তখন আমরাই সিদ্ধান্ত নিব কাকে দিয়ে কোন কাজটি করাব।

কথা সেটাই, দেশের মালিক আমরা। এই আমরাই তো না খেয়ে, নিজেদের সুখের কথা চিন্তা না করে, দিনরাত পরিশ্রম করে যাই যেন আমাদের দেশের রাজারা থাকেন দুধে-ভাতে। আমাদের পাঁজর ভেঙে হলেও তাদের পাজেরো যেন চলতে পারে। আমাদের ঘরে আলো না জ্বললেও রাজবাড়িগুলোতে আলোর ঝলকানি তাই আমাদের মনে প্রশ্ন তোলে না। আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকি তাঁরা যেন নিমেষে চলে যেতে পারেন। কেননা ওরা যে আমাদেরই লোক, আমাদেরই জন্য কাজ করছেন। ওরা কাজ করলে একদিন আমরাও……।

আমরা আশায় বুক বাঁধি। দেশ এগোবে। আমরা এগোবো। কিন্তু ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা মানুষগুলোকে চোখের সামনে মরতে দেখে আমাদের স্বপ্নের ঘোর ভাঙে। ২৮ নভেম্বর শাহবাগে একটি যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে মারলে ১৯ জন বাসযাত্রী অগ্নিদগ্ধ হন। বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নাহিদ আর রবিন আমাদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলে গেছেন এরই মধ্যে। দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে দেখা যায়, চলতি বছরের ২৬ অক্টোবর থেকে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত শুধু যানবাহনে দেওয়া আগুন ও পেট্রোল হামলায় পুড়েছেন ৫৫ জন, মারা গেছেন ৯ জন আর ৩৮ জন এখনও চিকিৎসাধীন আছেন। তাদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

৩০ নভেম্বর রাতে মালিবাগে একটি বাসে আগুন দিলে বাসটি চাপা দেয় গার্মেন্টস ব্যবসায়ী হাবিবকে। তিনি মাত্র এক মাস সাত দিন আগে বিয়ে করেছেন। তার আত্মীয়দের কান্না আর বিলাপ আমাদের গায়ের মধ্যেও যেন আগুন ধরিয়ে দেয়। হাবিবের ভাই চোখের জল ফেলে বলছিলেন, এই দুনিয়ার আদালতে এই হত্যার বিচার না হলেও আল্লাহর আদালতে একদিন নিশ্চয়ই বিচার হবে।

সত্যি তাই, এতগুলো হত্যা অথচ এখন কোনো হত্যা মামলা হয়নি। মৃত ব্যক্তিদের পরিবারের কারও-ই দেশের বিচার ব্যবস্থার উপর আস্থা নেই। কোন পথে যাচ্ছি আমরা? রাজনৈতিক দলগুলো যখন একে অপরের প্রতি দোষ চাপানোর চিরচেনা রাজনৈতিক অশিষ্টাচারে ব্যস্ত থাকেন তখন হত্যাকারীরা এক ধরনের 'ইমপিউনিটি' পেয়ে যায়। এরই ফল– বিচারব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা।

১ ডিসেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঢাকা মেডিকেল কলেজর বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অগ্নিদগ্ধদের দেখতে গেলে অবরোধের সময় বাসে পেট্রোল বোমা হামলায় দগ্ধ গৃহবধূ গীতা সরকার তাঁকে বলেন "আমরা আপনাদের তৈরি করছি, আপনারা আমাদের তৈরি করেন নাই। আমরা আমাদের স্বামীরটা খাই। আপনারা আমাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন।… আমরা ভালো সরকার চাই… আমরা অসুস্থ সরকার চাই না।''

চলমান রাজনৈতিক সহিংসতার বিরুদ্ধে এটিই শেষ কথা। মাননীয় বিরোধী দলীয় নেত্রী এখনও এসব মৃত মানুষ আর প্রায় মৃত মানুষদের জন্য শোক ও সমবেদনা জানানোর প্রয়োজনও বোধ করেননি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সহযোদ্ধারা আমাদের বুঝিয়ে যাচ্ছেন, বিএনপি-জমায়াত চক্র দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্যে মানুষ পুড়িয়ে মারছে।

এক কথায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন। কিন্তু তিনি গীতা সরকারের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি। পারবেনও না। আমাদের রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে যদি আপনাদের ক্ষমতায় বসিয়ে থাকি তবে সেটা করতে না পারার ব্যর্থতার পাশাপাশি ক্ষমতার লড়াইয়ে আমাদের তুচ্ছ জ্ঞান করে, আমাদের দোহাই দিয়ে দেশকে অশান্ত, অস্থিতিশীল করার জন্যে আপনারা দুই দলই সমানভাবে দায়ী।

আমরা যাদের 'ছায়া সরকার' বলে জেনে এসেছি তারাও আমাদের ভালোর জন্যে সব করছেন বলে দাবি করছেন। আমাদের জ্বালিয়ে, বোমার আঘাতে হত্যা করে আমাদের কোন ভালোটা করছেন তা আমরা সত্যিই বুঝতে পারছি না। স্বৈরাচারী সরকার উৎখাতের নামে রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট করে, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ মেরে কোন সরকার উৎখাত হবে– তা আমরা মোটেই বুঝতে পারছি না।

স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের রেললাইনের সংকোচন ছাড়া বৃদ্ধি হয়নি। রাজনীতিতে যুক্ত থাকা 'বাসমালিকদের' স্বার্থের পরিপন্থী বিধায় কোনো রেলমন্ত্রীই কম খরচের এই সেবাখাতকে মূল যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে গড়ে তুলতে পারেননি। গত দু'সপ্তাহের অবরোধে রেলের যে পরিমাণ ক্ষতি করা হল তা কার স্বার্থে এটা বোঝা দরকার।

সড়ক ও রেলপথ অবরোধ না করে, বিরোধী দল যদি দেশের নির্বাচন কমিশন ও তার আঞ্চলিক অফিসগুলো অবরোধ করতেন, যদি বলতেন সচিবালয় ঘেরাও করবেন– তাতেও আমরা বুঝতাম যুদ্ধটা আমাদের বিরুদ্ধে নয়।

প্রধান বিরোধী দলের পাশাপাশি এই সহিংসতার অন্যতম শরিক দল জামায়াতে ইসলামী। তাদের দল আগামী নির্বাচনে আদালত কর্তৃক অযোগ্য ঘোষণার পর নির্বাচন নিয়ে তাদের উদ্দেশ্য আর বিএনপির উদ্দেশ্য এক হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু আমরা দেখছি এই দলটি আমাদের পুড়িয়ে মারার পেছনে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। তারা অবশ্য কখনও বলেনি তারা আমাদের প্রয়োজনে রাজনীতি করছে। তাই তাদের কাজের পেছনে যুক্তি আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু বিএনপির মতো একটি দল তাদের এজেন্ডার সঙ্গে কীভাবে খাপ খায় সেটা আমরা বুঝি না।

এসব কথা বলার বিপদ হল– আমাদের আক্ষেপের অধিকাংশ বক্তব্য কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে যায় আর তারা ভাবতে শুরু করেন কীভাবে একে আরও 'তাদের পক্ষে' ব্যবহার করা যায়। শাহবাগের আন্দোলন সে অভিজ্ঞতাই বয়ান করে। চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা প্রতিরোধে সরকার ব্যর্থ, রাষ্ট্র তার নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। এই ব্যর্থতার কারণে ফুঁসে উঠছে সাধারণ মানুষ। কিন্তু তারা সত্যিকারের প্রতিরোধে রাস্তায় নামতে দ্বিধাগ্রস্ত।

প্রধান দুই দলই রাজনৈতিক বিভাজনের শুরু থেকে চাইছিলেন যেন সাধারণ মানুষ রাস্তায় নামেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ হালুয়া-রুটির ভাগাভাগির অংশ হতে চাননি। ক্ষমতার রাজনীতিতে সাধারণ মানুষ কোনো ভূমিকা রাখেন না বলে প্রধান দুই দল এখনও তাদের অরাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে পারছেন।

শুরু থেকে আমাদের বোঝানো হচ্ছে, নির্বাচন হলেই আমাদের দেশে গণতন্ত্র সুসংহত হবে। দেশ সুখ আর সমৃদ্ধিতে ভরে উঠবে। তাই যদি হত, এদেশ ১৯৯০ সাল থেকে গণতন্ত্রের পথে হাঁটছে। তেইশ বছর পরও আমাদের নির্বাচন কীভাবে হবে তা নিয়ে এত সংকট তৈরি হত না। কথায় কথায় প্রধান দুই দল, নিজেদের গণতান্ত্রিক দল হিসেবে দাবি করেন। অথচ আমরা তাদের আচার-আচরণে এই গণতান্ত্রিক চর্চার কোনো প্রতিফলন দেখি না। গণতন্ত্র আমাদের মতো দেশের জন্য আদৌ সঠিক শাসন ব্যবস্থা কিনা, এ নিয়েই আমাদের সন্দেহ দানা বাঁধছে। গণতন্ত্রের ফাঁকা বুলি আমাদের আর আশ্বস্ত করে না।

নির্বাচনী শব্দগুলোর অভিধানে কিছু চালু শব্দ আছে; যেমন, ''রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিদেরই সমাধান করতে হবে, কোনোভাবেই অরাজনৈতিক ব্যক্তির হস্তক্ষেপ কাম্য নয়।'' বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তাঁবেদার বুদ্ধিজীবীরা এ নিয়ে ভীষণ উচ্চকণ্ঠ টেলিভিশনের টকশোগুলোতে। আমরাও বিশ্বাস করতে চাই আপনাদের এই বুলি।

বাতাসে গুজব ভেসে আসে– যে কোনো মুহূর্তে সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারে। মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিজ দপ্তরে আলাপকালে ২ ডিসেম্বর বলেই ফেললেন, "১০-১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে জরুরি অবস্থা জারি হতে পারে।" যে কোনো অবস্থাতেই আমরা সেনা শাসন চাই না। আমরা ধারণা করি, বর্তমান অবস্থা তৈরির পেছনে, প্রধান দুই দলেরই সুপ্ত ইচ্ছা সেনা শাসন।

প্রধান দুই দল, যে "পয়েন্ট অব নো রিটার্নে" চলে গেছেন তাতে তারা আশা করবেন সেনাবাহিনী এসে তাদের এই পঙ্কিল অবস্থা থেকে টেনে তুলবেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর কী দায়? তারা যদি দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকতে না পারেন, তাহলে রাজনৈতিক দলের ময়লা পরিষ্কার করার কাজে কেন সেনাবাহিনী আগ্রহী হবেন– তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়।

সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের চাওয়া একটাই– শান্তি। সেটি কীভাবে আনবেন তা ভাবার দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের। আমরা অনেক সয়েছি। আমরা অনেক জীবন অপচয় করেছি গণতন্ত্রের নামে। আমাদের মেরেই যদি বারবার গণতন্ত্রের ভিত শক্ত করতে হয়, তাহলে আমরা আর চাই না সেই গণতন্ত্র। অন্য কোনো তন্ত্রের কথা বলুন।

আমরা কান পেতে রই।

ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট।