প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী: ভাবনার জগতে আসুক পরিবর্তন

সাবরিনা সুলতানাসাবরিনা সুলতানা
Published : 3 Dec 2013, 08:40 AM
Updated : 3 Dec 2013, 08:40 AM

বছর দুয়েক আগের কথা! ট্রেনে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ফেরার পথে পেছন থেকে হুইলচেয়ার সমেতই আমাকে 'মাল' আখ্যায়িত করে সুবর্ণ এক্সপ্রেসের মতোন চমৎকার একটি ট্রেনকে 'মালটানা গাড়ি' বলেছিলেন এ সমাজেরই প্রতিষ্ঠিত এবং সুশিক্ষিত এক সাংবাদিক। সুবর্ণ এক্সপ্রেসের অনুভূতিতে কতটা আঘাত লেগেছিল সে মূহূর্তে তা বোঝার অবকাশ পাইনি। গলার কাছে কুণ্ডলি পাকিয়ে থাকা একদলা ক্ষোভ, থরথর রাগ আর অপমানবোধের কম্পনে হাত-পা ক্রমশ শক্ত হয়ে উঠছিল আমার। যদিও ওইদিনকার রাগটা পড়ে গেছে খুব দ্রুত কিন্তু অদ্ভুতুড়ে সে মূহূর্তটা সম্ভবত কখনওই ভুলতে পারব না আমি।

একবার ট্রেনের টিকেট চেকার ঝাড়িমূলক উপদেশ দেবার চেষ্টা করেছিলেন, ''আপনি একা চলাচল কেন করেন। সাথে অবশ্যি কয়েকজন মানুষ রাখবেন!''

পরিবার বা সমাজ হরহামেশা আমাদের শুনতে হয়, ''তুমি একা পারবা না'', ''তুমি এইটা পারবা না'', ''তুমি ওইটা পারবা না''. ''ওইখানে এই সমস্যা'', ''সেইখানে সেই সমস্যা'', ''তুমি সামলাতে পারবা না'', ''তুমি একা যেয়ো না।''

সন্দেহ নেই, প্রতিবন্ধী মানুষের যোগ্যতা নিয়েই অমূলক সন্দেহ!

অল্পদিন আগেই বোটানিক্যাল গার্ডেনে আচমকা বজ্রবৃষ্টির তোপের মুখে পড়ে একটা ছাউনিতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন, ''আপু আপনার সমস্যা কী?''

পথ চলতে গিয়ে প্রায়ই এমন অদ্ভুত সব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় আমাকে। আমি দু'গাল হেসে উত্তর করি, "কই! আমার তো কোনো সমস্যাই নাই রে ভাইয়া!" কখনও উল্টো আমার বোকা বোকা প্রশ্ন, "ভাইয়া, কেন মনে হল সমস্যা, একটু বলেন তো প্লিজ?"

কিছুটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে চোখ গোল করে আমার দিকে খানিক্ষণ তাকিয়ে থেকে আপন মনে কী যেন বিড়বিড় করতে করতে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেন। অনেকের অবাক দৃষ্টির ভাবনায়ও পড়তে পারি আমি। "ইশ, কী কষ্টের জীবন! এত দুঃখে-কষ্টে কি আর মাথা ঠিক রাখা যায়!"

মনের এই উচ্চারণ কখনও-সখনও মুখ ফসকেও বেরিয়ে আসে। অনেকে আবার বলেন, "আফসোস কর না। কী আর করবা, আল্লাহ্‌ পরীক্ষা নিচ্ছেন। ধৈর্য্য রাখ।"

আমার কিন্তু কখনও মনেই থাকে না আমারও কিছু শারীরিক সীমাবদ্ধতা আছে। যাপিত জীবনের সমস্যাগুলোও খুব একটা ভাবায় না। তবে হ্যাঁ, সমস্যা বা কষ্টটা তখনই লাগে যখন আপনি, আপনারা আমাকে বারে বারে মনে করিয়ে দিচ্ছেন আমার এই সীমাবদ্ধতার কথা– আর তখনই ধৈর্য্য ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে আমার জন্য। নতুবা বিশ্বাস করুন আর না করুন, আমি দিব্যি আনন্দে বেঁচে আছি। আমি বিশ্বাস করি, এই শারীরিক সীমাবদ্ধতা আমার সমস্যা নয়। একটা অবস্থা মাত্র। যা নিয়েও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবন যাপন করা যায়।

প্রায় সময় দেখি অনেকেই বলছেন, "প্রতিবন্ধী শব্দটা না বললেই কি হয় না", "কাউকে প্রতিবন্ধী বলতে ভালো লাগে না", "তারা প্রতিবন্ধী নন তাই তাদের প্রতিবন্ধী বলা উচিত নয়"– ইত্যাদি ইত্যাদি হরেক রকমের মন্তব্য। অনেকেই আবার 'প্রতিবন্ধী', 'প্রতিবন্ধিতা' এবং 'প্রতিবন্ধকতা' এই শব্দগুলোকে এক করে ফেলেন!

প্রতি বছর ৩ ডিসেম্বর পালিত হয় 'প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক দিবস' (International day for persons with disabilities) হিসেবে। এ বছর Break barriers, open doors: for an inclusive society for all– এই প্রতিপাদ্যে বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে দিবসটি। যার বাংলা করা হয়েছে– 'ভাঙো বাধা, দুয়ার খোল, একীভূত সমাজ গড়'।

২০০৭ সাল থেকে 'আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস'-এর পরিবর্তে প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার বা মর্যাদারক্ষার সিআরপিডি সনদের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এর নতুন নামকরণ হয় International Day for Persons with Disabilities যার বাংলা হয় 'প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক দিবস' যা ২০০৮ সালের ৩ ডিসেম্বর থেকে এখনও পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে।

প্রতিবন্ধী মানুষের মর্যাদার বিষয়ে তাদের 'প্রতিবন্ধী ব্যক্তি' সম্বোধনের কারণেই এল প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার আইন। কিন্তু বিস্ময়করভাবে ছয় বছরেও বাংলাদেশে দিবসটির নাম পরিবর্তনের কথা ভাবা হয়নি। নতুন এই নামকরণের উদ্যোগ নেবেন সরকার সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারণী মহল, এটাই প্রত্যাশা।

এ দিবস উপলক্ষে লিখতে গিয়ে আজ তাই চেষ্টা করতে চাই প্রতিবিন্ধী ব্যক্তিদের বিষয়ে কিছু বলার মতোন দুঃসাহস দেখাতে। ভুল-ত্রুটি থাকলে বিজ্ঞজনেরা শুধরে দেবেন। কারণ আমার জানার গণ্ডি একেবারেই সীমিত। এখনও প্রতিদিনই নিত্যনতুন অনেক কিছু শিখছি। আমার বিশ্বাস, শেখার কোনো শেষ নেই। এখানে আমি কেবল চেষ্টা করব এতদিন যা কিছু শিখে এসেছি সেটুকু সম্পর্কে কিছু বলার।

যাহোক, ভূমিকা বড় না করে মূল আলোচনায় ফিরে যাই।

প্রতিবন্ধী, প্রতিবন্ধিতা এবং প্রতিবন্ধকতা

Convention on the Rights of Persons with Disabilities (CRPD) এই সনদ অনুযায়ী সারাবিশ্বে আজ স্বীকৃতি পেয়েছে Person with Disability সম্বোধনটি। যাকে বাংলা করে বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী মানুষ/ব্যক্তি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অনেকে আবার Differently Able People বলেন। তাকে বাংলা করা যায় 'ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষ'। কিন্তু এ নিয়েও রয়েছে দ্বিমত। যেমনটা আমাদের দেশের মানুষ 'প্রতিবন্ধী ব্যক্তি' সম্বোধন করতে চান না।

বর্তমান অবস্থাদৃষ্টে আমার মত হল, সামান্য নাম বা সম্বোধনে বৃথা তর্কে সময় নষ্ট না করে সবার উচিত তাদের সামাজিক উন্নয়ন ও অধিকারের বিষয়গুলো সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে মাথা ঘামানো। তাদের সম্পর্কে, তাদের অধিকার, জীবনযাপনের সহায়ক ব্যবস্থাগুলো সম্পর্কে জানা-বোঝা, সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করা।

লক্ষ্য করুন, 'প্রতিবন্ধী', 'প্রতিবন্ধিতা' এই দুটো শব্দের বানানে ছোট্ট একটি পার্থক্য আছে, তেমনি এর অর্থেও আছে কিছুটা ভিন্নতা। আর 'প্রতিবন্ধকতা' একেবারেই ভিন্ন ব্যাপার। এদেশে খোদ প্রতিবন্ধী মানুষ এবং তাদের পরিবারই অসচেতন নিজেদের মৌলিক অধিকারের বিষয়ে।

শারীরিক এবং মানসিকভাবে বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের নিয়ে সবার মনে একটি বদ্ধমূল ধারণা প্রচলিত আছে। আর তা হল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা অসুস্থ, রোগাক্রান্ত। আর রোগাক্রান্ত মানুষেরা কিছুই পারেন না, তাই তারা সমাজের বোঝা। শিক্ষা, বিনোদনের সুযোগ, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে কর্মক্ষম স্বাভাবিক জীবনযাপন তাদের পক্ষে কখনওই সম্ভব নয়। এই ভুল ধারণার বশবর্তী হয়েই তাদের হেয় প্রতিপন্ন করা হয়।

আমাদের জানাটা জরুরি, মানুষ জম্মগতভাবে বা জম্মের পর বিভিন্ন দুর্ঘটনা বা শারীরিক, মানসিক সমস্যা বা অসমর্থতার কারণে স্বাভাবিক জীবনযাপনে কিছুটা বাধাগ্রস্ত হন। এক কথায় এ বাধাগ্রস্ত অবস্থাটিকে 'প্রতিবন্ধিতা' এবং প্রতিবন্ধিতার সম্মুখীন সেই ব্যক্তিকে 'প্রতিবন্ধী ব্যক্তি' সম্বোধন করা হয়।

অনেকে আবার এমন ভাবেন, কোনো মানুষের শারীরিক সীমাবদ্ধতা থাকা মানেই মানুষটা প্রতিবন্ধী। এটিও ভুল ধারণা। শুধুমাত্র শারীরিক/মানসিক/ইন্দ্রিয়গত সীমাবদ্ধতা নয়, বিভিন্ন ধরনের barrier বা প্রতিবন্ধকতার কারণে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যখন এই মানুষগুলো সমাজের নেতিবাচক মনোভাব, অবকাঠামোগত বাধা/অসুবিধা ইত্যাদির কারণে বিভিন্ন কার্যক্রমে সমতার ভিত্তিতে পুরোপুরি অংশ নিতে পারেন না, তখন অংশ নিতে না পারা বা বিচ্ছিন্ন এই জনগোষ্ঠীকে 'প্রতিবন্ধী' সম্বোধন করা হয়।

আবারও বলছি, প্রতিবন্ধিতা কোনো রোগ বা অসুখের পর্যায়ে পড়ে না। এটি মানুষের একটি অবস্থা মাত্র। একজন মানুষ তার প্রতিবন্ধিতা নিয়েও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন এটি আমাদের দেশের মানুষ বিশ্বাস করতে পারেন না বা জানেন না। যারা প্রতিবন্ধিতার সম্মুখীন তারা কিন্তু কখনওই এটা মনে রাখেন না যতক্ষণ না তাদের সামনে একটি বাধা এসে দাঁড়ায়। হতে পারে সেটা অবকাঠামোগত কিংবা মানুষের আচরণগত।

যখনই অ-প্রতিবন্ধী মানুষ তাদের 'প্রতিবন্ধী' বলে বিদ্রুপ করেন, একটু অবাক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন, তাদের অদম্য মনোবল ভেঙে পড়তে থাকে। নিজেদের ভিনগ্রহের প্রাণি ভাবতে থাকেন তারা। যদিও প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব অসচেতনতার ফলেই তৈরি হয়।

আর অবকাঠামোগত বাধা সরিয়ে সহায়ক ও সহজ চলাচলের পথ তৈরি বা দূর করার প্রধান কারণ পারিবারিক ও সামাজিক অসচেতনতাবোধ। এর ফলেই নানান ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েই যায়। যারা এ ধরনের বৈরি পরিবেশ সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করার মানসিক শক্তির অধিকারী তারাই সফল কিন্তু তাদের সংখ্যা নিতান্তই কম।

আমাদের বিশ্বাস করতে হবে, যারা জন্ম বা পরবর্তী সময়ে নানা কারণে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধিতার সম্মুখীন হয়েছেন তারা তাদের অবস্থাটি সঙ্গে নিয়েই সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন। শুধু প্রয়োজন হয় সহায়ক কিছু ব্যবস্থার যা এদেশে নেই-ই বলতে গেলে। নিজের ভেতরের জেগে ওঠা সচেতনতাবোধ ছড়িয়ে দিতে হবে আশেপাশে। দেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে মানসিকতার পরিবর্তন হলেই সামাজিক অবকাঠামোগত পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী!

একটু ভেবে দেখুন, শুধুমাত্র সচেতনতা নেই বলেই এ দেশের অবকাঠামোগত বাধা সরিয়ে
সহায়ক ব্যবস্থা তৈরির ব্যাপারটা গুরুত্বই পায় না!

অসচেতনতা বা অজ্ঞতার ফলে অসফলতা

দেশের বিভিন্ন স্থানে গ্রামীণ ফোনের একটি বিজ্ঞাপনী বিলবোর্ডে দেখা যায় একজন অ্যাথলেটকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে 'বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিউলি সাথী' বলে। কারও সীমাবদ্ধতা কিছুতেই তার পরিচয় হতে পারে না। বিশেষ করে যা তার ইচ্ছেকৃত নয়। সম্ভবত প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীও যে 'ভিন্নভাবে সক্ষম হতে পারেন' এই উৎসাহটি দিতে গিয়েই গ্রামীণ ফোন কর্তৃপক্ষ অসচেতনতাবশত ভুলটি করে ফেলেছেন।

উৎসাহের ব্যাপারটি একটু ভিন্নভাবেও দেওয়া যেত! "শত বাধা পেরিয়ে" কিংবা "তারাও পারে", এর পাশাপাশি ''অপরাজিতা কিংবা অদম্য শিউলি সাথী'' হিসেবেও তার পরিচয়টি আসতে পারত।

টেলিকম কোম্পানি রবি সারাদেশের রেলওয়ে স্টেশনে পানি বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্ট স্থাপন করেছে। যেখানে প্রতিবন্ধী মানুষের সহজে পৌঁছানোর জন্য র‌্যাম্প বসানো হয়েছে। কিন্তু র‌্যাম্পটি পার হবার পরে হুইলচেয়ার নিয়ে পানির কলের কাছ পর্যন্ত পৌঁছুনোর আগে রয়েছে একটি বাধা যা সবার নজর এড়িয়ে গিয়েছে।

সত্যি কথা বলতে কী, সরকারি/বেসরকারি অনেক উচ্চ পর্যায়েও এমন ভুল হয়। এ কারণে প্রতিবন্ধী মানুষকে নিয়ে কোনো কাজ করতে গেলে সবসময়ই তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা বা পরামর্শ করেই কাজটি করা দরকার। যাতে করে ছোটখাট এই ধরনের ভুল এড়িয়ে চলা যায়।

প্রতিবন্ধী মানুষের সমস্যা একমাত্র তারাই ভালো বোঝেন। তারাই জানেন এ সমস্যা উত্তরণের উপায় কতটা সহজে ও কীভাবে নির্ণয় করা যায়। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপারটি হল, এটি কারও মনে থাকে না বা এর কোনো প্রয়োজন বোধ করা হয় না। এ কারণেই আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী মানুষদের নিয়ে যেসব কাজ হয় তার বেশিরভাগের সঙ্গে এই মানুষদের সম্পৃক্ততা থাকে না বলে, অজান্তেই এমনতরো অসম্মানজনক ব্যাপারগুলো ঘটে যায়। অন্যদিকে প্রতিবন্ধকতা থেকেও পাওয়া যায় না মুক্তি।

'প্রতিবন্ধী' শব্দের অপব্যবহার

ছোটবেলা থেকে শিখেছি ''কানাকে কানা, খোঁড়াকে খোঁড়া বলতে নেই''। সেটা সে জমানার কথা! এ জমানায় 'অন্ধ', 'কানা', 'ল্যাংড়া', 'খোঁড়া', 'আঁতুড়', 'পঙ্গু' এই জাতীয় সব শব্দ ব্যবহৃতই হয় না আর। এখন প্রতিবন্ধী শব্দটির পাশে সসম্মানে যুক্ত হয়েছে 'প্রতিবন্ধী ব্যক্তি' 'প্রতিবন্ধী মানুষ' ইত্যাদি সম্বোধন।

এই একবিংশ শতাব্দীতেও অবাক বিস্ময়ে মাঝেসাঝে দেখি, প্রতিবন্ধী তথা ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষদের সমাজের নিকৃষ্ট জীব হিসেবে গণ্য করা হয়। বিশেষত আমাদের দেশে অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে, কাউকে গালি দিতে, অপদস্থ বা ব্যঙ্গ করতে হলেই 'প্রতিবন্ধী', 'বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী', 'বিবেক প্রতিবন্ধী', 'পঙ্গু মন-মানসিকতা' এই ধরনের ব্যঙ্গাত্মক শব্দ ব্যবহারের। উঠতে-বসতে কিছু হলেই দিয়ে দিলাম গালি– 'প্রতিবন্ধী'!

কারও প্রতি রাগ উঠলে ব্যঙ্গ করতেই পারেন। গালিও দিতে পারেন। কিন্তু ব্যঙ্গাত্মক ইঙ্গিতবাহী শব্দ উচ্চারণের সময় প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তুলনা করে গালিটা দেওয়া হলে, প্রকারান্তরে নিরপরাধ এই মানুষগুলোকেই হেয় করা হয়, এই সাধারণ ব্যাপারটা সবার মাথায় রাখা প্রয়োজন।

যারা প্রতিবন্ধী তথা ভিন্নভাবে সক্ষম না হয়ে উঠতে পারা মানুষগুলোকে নিয়ে আফসোস করেন, তারা বুঝতে পারেন না তাদের এই জাতীয় অর্থহীন কথায় অবজ্ঞা নয়, করুণা বা ব্যঙ্গও নয়– প্রবল এক মায়া কাজ করে আমাদের ভেতরে। আমরা জানি আমাদের দেশের মানুষগুলোর ভেতরে নিষ্পাপ এক শিশুমন লুকিয়ে আছে। অনেক গভীরে কোথাও। আমরা নিশ্চয়ই সেইখানে পৌঁছুব কোনো একদিন!

তাদের অনুভবে এই উপলব্ধিটা আসবেই একদিন– "আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী মানুষেরা বেড়ে উঠছে কিছুটা অবজ্ঞা, কিছুটা অবহেলা এবং সেই সঙ্গে অনেকখানি করুণা নিয়ে। আর এই অবজ্ঞা বা করুণার কারণেই ভিন্নভাবে সক্ষম হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করাটা তাদের জন্য কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে।''

সেই দিন তারা বিশ্বাস করতে শুরু করবেন, সামাজিক বাধাগুলো ডিঙিয়ে বা নানা রকমের সহায়ক কিছু ব্যবস্থার সাহায্য পেলে খুব সহজেই এই সমাজে নিজেদের ভিন্নভাবে সক্ষম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে নিতে পারেন প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী। তখন আর আলাদাভাবে নয়, একসঙ্গেই কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে চলবেন সকলে। সেই দিন আর প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকবে না।

কারণ মানুষের মনুষ্যত্ববোধের পুরোটা বিসর্জন গেছে এমনটা কখনও হতে পারে না।

সাবরিনা সুলতানা: সভাপতি, বি-স্ক্যান।