আমাদের যা জানার আছে

আবেদ খান
Published : 2 Dec 2013, 01:28 PM
Updated : 2 Dec 2013, 01:28 PM

ডা. এম এ হাসানের আবাসস্থল এবং আমার নিবাস খুব কাছাকাছি। উত্তরায় আমরা একই সেক্টরের বাসিন্দা– দুই থেকে আড়াই মিনিটের হাঁটা পথ। আমাদের দুজনের চলার পথও প্রায় এক এবং আদর্শিক, অবস্থানও অভিন্ন।

পেশায় তিনি চিকিৎসক এবং আমি সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত। তিনি গবেষণায় নিয়োজিত দীর্ঘকাল। অবশ্য এই গবেষণার মূল কেন্দ্র হচ্ছে একাত্তরের গণহত্যা। আর আমি অর্ধেক লেখক অর্ধেক অ্যাকটিভিস্ট।

ডা. হাসান ভালো লিখেন– বলা যায় আমার পরিমণ্ডলে তিনি সফলভাবে প্রবেশ করেছেন। কিন্তু আমার পক্ষে তো চিকিৎসাশাস্ত্রে প্রবেশ করার সামান্যতম সুযোগ নেই। সে জন্য দরকার আনুষ্ঠানিক ডিগ্রি, জ্ঞান, শিক্ষা– যে পথটি কখনওই আমার ছিল না। সেদিক দিয়ে ডা. হাসান আমার চাইতে অনেক এগিয়ে আছেন।

তাছাড়া অন্য সব পেশারই একটা নিয়মকানুন আছে। যেমন একজন ইচ্ছে করলেই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, আমলা, শিক্ষক ইত্যাদি হতে পারবেন না। সেজন্য প্রাথমিকভাবে পড়াশুনা করে শুধু পাশ করলে হবে না, ভালো রেজাল্টও করতে হবে।

সে হিসেবে বলা যায়, বেঁচে গেছি। এমন একটা পেশায় ঢুকে পড়েছি যেখানে ছাদ আছে কিন্তু দেওয়াল নেই। দরজা আছে হয়তো, কিন্তু সেটা হাট করে খোলা, বন্ধ হয় না কখনও। সব চাইতে মজার ব্যাপার হচ্ছে ডিগ্রিধারী ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, ক্যাডার সার্ভিস, শিক্ষক ইত্যাদি অবস্থান থেকে অনেকজন এসে সাংবাদিকতা পেশাকেই প্রধান পেশা হিসেবে বরণ করেছেন। এটা আমাদের পেশার বিশাল অর্জনও বটে।

ধান ভানতে শিবের গীত হল বটে, কিন্তু এই পেশার উদারতা, বিশালতা এবং ধারণ করার অসামান্য ক্ষমতার কথা ভেবে আমি ব্যক্তিগতভাবে সত্যিই গৌরব বোধ করি। কিন্তু ডা. এম এ হাসান এই দলে পড়েন না। তিনি নিছকই একজন নিবিষ্টচিত্ত গবেষক– ব্যক্তিগত পেশার গণ্ডি অতিক্রম করে তাঁর পরিচিতি ভৌগোলিক সীমানা পেরিয়েছে এই নিবিষ্টচিত্ততার কারণেই।

কিছুদিন আগে তাঁর একটি গবেষণাগ্রন্থ হাতে এল। 'বিয়ন্ড ডিনায়াল: দ্য অ্যাভিডেন্স অব আ জেনোসাইড' শিরোনামে। টম ডিগানের সঙ্গে যৌথভাবে সংকলিত হয়েছে গ্রন্থটি। টম ডিগান গ্রন্থটি সাজিয়েছেন পাশ্চত্যের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য। আর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ করে লেখকের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন মি. ওয়াই এস গিল।

গ্রন্থটিতে দেওয়া হয়েছে ইতিহাসের অনেক উপাদান, সংগৃহীত হয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হত্যাকাণ্ডের বিবরণ– কখনও প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে, কখনও নির্যাতিত ভুক্তভোগীর মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা থেকে। দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যা, ধ্বংস, অগ্নিসংযোগ এবং নারী নির্যাতনের অসংখ্য উদাহরণ তুলে ধরে তিনি দাবি করেছেন যে, ১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন নয় মাসে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে সাড়ে চার লক্ষ নারী যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন।

তিনি টাঙ্গাইলের ভানু বেগমের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন, দেখিয়েছেন, কীভাবে ভানু বেগমের ওপর পাশবিক নির্যাতনের আগে তাঁর শিশুসন্তান রাজুকে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। নিপীড়নের পর সংজ্ঞাহীন ভানু বেগমকেও নিক্ষেপ করা হয়েছিল অনলগর্ভে।

ডা. হাসানের সংগৃহীত তথ্যে বলা হয়েছে– প্রায়শই পাকিস্তানি সৈন্যরা যৌন নির্যাতনের শিকারদের উচ্ছিষ্ট হিসেবে দিয়ে দিত রাজাকার-আলবদরদের হাতে, সহযোগিতার পুরস্কার হিসেবে। অনেক সময় নির্যাতিতা মেয়েদের নিয়ে যাওয়া হত সেনা ছাউনিতে, দিনের পর দিন ক্রমাগত যৌনপীড়ন চলত– তাঁদের ব্যবহার করা হত যৌনদাসী হিসেবে। অনেককে পরিণত করা হয়েছিল সম্ভোগ নারীতে।

ডা. হাসান এ ক্ষেত্রে সুসান ব্রাউন মিলারের একটি বই 'অ্যাগেইনস্ট আওয়ার উইল: আ হিস্টরি অব উইমেন অ্যান্ড রেপস'-এর কথাও উল্লেখ করেছেন। তাঁর বই-এর মধ্যে পড়েছি আমার একান্ত সুহৃদ ময়মনসিংহের মুকুল নিকেতনের প্রতিষ্ঠাতা বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা জনাব আমির আহমদ চৌধুরীর ওপর অমানবিক নির্যাতনের মর্মস্পর্শী কাহিনি।

গ্রন্থটি পাঠ করতে করতে মনে হচ্ছিল, নিবেদিতপ্রাণ এই চিকিৎসক কী মমতা এবং ঐকান্তিকতা নিয়েই না এই তথ্যসংগ্রহের কাজটি করে গেছেন। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল, একাত্তরে যে বাংলাদেশে গণহত্যা হয়েছিল সেটা আন্তর্জাতিকভাবে প্রমাণের এবং প্রতিষ্ঠার জন্যই তাঁর এই প্রয়াস।

কাজটি তিনি হাতে নিলেন সম্ভবত আরও একটি কারণে যে, স্বাধীনতার এই বিয়াল্লিশ বছরেরও বেশি হয়ে গেল কিন্তু একাত্তরের নির্মম গণহত্যার– যাকে শতাব্দীর বীভৎসতম গণহত্যার একটি বলে মনে করা হয়– কোনো আনুষ্ঠানিক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া যায়নি। অথচ সেই সময় থেকে, অর্থাৎ বাংলাদেশ শক্রমুক্ত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে অন্তত সহস্রাধিক নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, প্রকাশিত হয়েছে কয়েক সহস্র আলোকচিত্র।

এমনকি একাত্তরের গণহত্যার সঙ্গে জড়িত পাকিস্তানের সামরিক কর্মকর্তাদের অনেকে, যেমন, জেনারেল নিয়াজি, রাও ফরমান আলী, বিগ্রেডিয়ার সিদ্দিক মালিক, বিগ্রেডিয়ার এ আর সিদ্দিকী প্রমুখ এ বিষয়ে বইয়ের পর বই লিখেছেন।

বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ, গবেষক ড. মুনতাসীর মামুন এক অসাধারণ গ্রন্থ রচনা করেছেন 'পাকিস্তানি জেনারেলদের মন– বাংলা, বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ' শিরোনামে। সেখানে তিনি পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের গ্রন্থের একটি তালিকা এবং প্রকাশকালও সন্নিবিষ্ট করেছেন। সেখানে একুশটি পুস্তকের উল্লেখ আছে। এ ছাড়া তিনি যে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন সেইসব কর্মকর্তার তালিকা তো আছেই।

সবচাইতে মজার ব্যাপার, গণহত্যার কথা তারা সবাই প্রকারান্তরে স্বীকারও করেছেন, যদিও দায়টি কখনও অন্যের ওপর, কখনও রাষ্ট্র্রের ওপর, কখনও রাজনীতিকদের ওপর চাপিয়েছেন আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে। পাকিস্তানের সুশীল সমাজের পক্ষ থেকেও অনেক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে যেখানে সুস্পষ্টভাবে গণহত্যা সংঘটনের কথা বলে পাকিস্তানি সরকারকে প্রকাশ্যে এর পরিপূর্ণ দায় স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে বলা হয়েছে।

তারপরেও আন্তর্জাতিকভাবে একাত্তরে বাংলাদেশে যে মানবতাবিরোধী গণহত্যা এবং সব ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তার আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না। ডা. হাসানের তথ্যবহুল গবেষণালব্ধ গ্রন্থটি গত বিয়াল্লিশ বছর ধরে নানাভাবে প্রকাশিত বিশাল কর্মযজ্ঞের নবতর সংযোজন।

যে গণহত্যার এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের কথা সবাই বলছেন এবং ডা. হাসানও এই বইটাতে লিখেছেন, সেই গণহত্যার প্রকৃত সংজ্ঞাটি কী? ১৯৪৪ সালের আগে তো এই শব্দটির কোনো প্রয়োগ ছিল না। ১৯৪৪ সালের র‌্যাফেল লেমিকিন নামে একজন পোলিশ-ইহুদি আইনজীবী ইহুদি-নিধনের নাৎসি পরিকল্পনার কথা বলতে গিয়ে এই 'জেনোসাইড' বা গণহত্যা শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। অর্থাৎ কোনো জাতিগোষ্ঠী, কোনো সম্প্রদায়– তা সে ধর্মীয় বা নির্দিষ্ট ভাষাভাষী যাই হোক না কেন– তাকে নির্মূল অথবা নিশ্চিহ্ন করার জন্য যে মানবতাবিরোধী কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়, র‌্যাফল লেমিকিন তার প্রতি নির্দেশ করে এই শব্দ চয়ন করেছিলেন।

তাঁর এই সংজ্ঞা অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের 'বিল অব রাইটস' অথবা ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘে মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক ঘোষণা এসেছিল। ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘে অনুমোদিত হয়েছিল মানবতাবিরোধী মহান ঘোষণাটি। কী কারণে এসেছিল এই অনুমোদন? তখন বিশ্বরাষ্ট্র সংস্থার চোখের সামনে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন নাৎসি তাণ্ডব এবং ব্যাপক ইহুদি নিধনযজ্ঞ।

অবাক হতে হয় যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে নাৎসি নারকীয়তায় শিহরিত হয়েছিলেন আজ তাদের ভূমিকার কথা ভাবলে। ফেইসবুকে নিঝুম মজুমদার নামে এক বিশিষ্ট ব্লগার যে মন্তব্যটির মাধ্যমে ব্যাপক বিস্ময় প্রকাশ করেছেন তার কিয়দংশ উদ্ধৃত করার আগে এ কথা বলা নিশ্চয়ই অনুচিত হবে না যে, যারা ভিন্ন রাষ্ট্রের একজন রাষ্ট্রপ্রধানকে কিডন্যাপ করে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিচার করেন, যারা রুয়ান্ডা অথবা অন্য যে কোনো আফ্রিকান অথবা ল্যাতিন আমেরিকান দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন– তাদের কাছে হিরোশিমা-নাগাসাকিতে অ্যাটম বোমা বর্ষণ কিংবা ১৯৬৫ সালে ইন্দোনেশিয়ায় এক পক্ষকালের মধ্যে দশ লাখ মানুষ হত্যা মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলে মনে হয় না।

এ প্রসঙ্গেই চলে আসে নিঝুম মজুমদারের মন্তব্যটি :

''দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন অপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয় তখন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনসটন চার্চিল বিচারের পক্ষে ছিলেন না, বিচার ছাড়া গুলি করে মেরে ফেলবার পক্ষপাতী ছিলেন। সেই দেশের নাগরিক হয়ে ব্লগস্পটের ব্লগ লেখক জনাব ডেভিড বার্গম্যান এবং জনাব টবি ক্যাডমেন যখন আমাদের ট্রাইব্যুনালের মতো এমন চমৎকার বিচার ব্যবস্থা যেখানে আন্তর্জাতিক অপরাধগুলোর দেশীয় আইনে বিচার হচ্ছে সেটি নিয়ে দিন-রাত সমালোচনা করেন তখন বিস্মিত হই…

স্টিফেন র‌্যাপ যখন সাদ্দাম হোসেনের বিচার নিয়ে উচ্চমার্গীয় শাস্ত্রীয় প্রশংসা করেন কিংবা আমেরিকা রোম স্ট্যাটিউটের সিগনেটোরি রাষ্ট্র না হবার পরেও বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনালকে বার বার রোম স্ট্যাটিউট দেখাতে থাকেন কিংবা আমেরিকার বিভিন্ন প্রেসিডেন্ট শত শত যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত হবেন নিশ্চিত, এই ব্যাপারগুলো জানার পরেও তা এড়িয়ে বাংলাদেশে এসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বুলি কপচান তখন বিস্মিত হই…

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করবার বিচার যাতে না হয় সে জন্য যখন জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল ৫ম সংশোধনী পাশ করে সংবিধানের ৪র্থ তফসিলে ১৮ নম্বর অনুচ্ছেদ সংযোজিত করে কিংবা জাতীয় বীর কর্ণেল তাহেরসহ হাজার হাজার আর্মি অফিসারকে নির্বিচারে খুন করা হয় এবং সেই বিএনপিই যখন এই সময়ে এসে সুষ্ঠু বিচারের কথা বলে তখন বিস্মিত হই…

১৯৮১ সালের জুলাইয়ের ৪ তারিখে অবৈধ কোর্ট মার্শাল বানিয়ে ১২ জনকে হত্যা কিংবা জেনারেল মঞ্জুরকে যখন গুলি করে হত্যা করা হয় বিচার ছাড়া এবং সেসবের হোতা লে জে হু মু এরশাদ যখন আমাদের ট্রাইবুনালে বিচার সুষ্ঠু হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন তখন বিস্মিত হই…

একসময় দালালদের বিচারের পক্ষের প্রধান আইনজীবী (প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটির) খন্দকার মাহবুব যখন বিয়াল্লিশ বছর পর দেশে রাজাকার নেই এবং বিচার সুষ্ঠু হচ্ছে না বলে লাফান তখন বিস্মিত হই…

মুক্তিযুদ্ধের ঠিক পরপর যখন ওপেন স্টেডিয়ামে কাদের সিদ্দিকী কয়েকজন লোককে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছিলেন (বিচার ছাড়া) এমন তথ্য আমরা জানতে পারি সে সময়ের ওঠানো স্থিরচিত্রের মাধ্যমে এবং সেই কাদের সিদ্দিকীই যখন এই সময়ে বলেন এই বিচার সুষ্ঠু হচ্ছে না বা সাঈদী রাজাকার নন তখন বিস্মিত হই…''

নিঝুম মজুমদারের বিস্ময়ের সঙ্গে আমার কিছু প্রশ্ন যুক্ত করি, যা একান্ত আমার নিজস্ব, যার উত্তর আমি পাই না কোথাও–

১. একাত্তর তো ক্রমাগত মানুষের স্মৃতি থেকে অবলুপ্ত হয়ে শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধাদের দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে অবরুদ্ধ হয়েছিল। ধর্মের রাজনীতি ক্রমাগত রাজনীতির ধর্মকে গ্রাস করছিল। সুবিধাবাদের কবলে পড়ে নৈতিকতার নাভিশ্বাস উঠেছিল, মুক্তিযুদ্ধের এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সেই অভ্রভেদী স্লোগান 'জয় বাংলা' কেবলমাত্র একটি দলীয় প্রাচীরের মধ্যে অন্তরীণাবদ্ধ ছিল।

অকস্মাৎ মুক্তিযুদ্ধকে, 'জয় বাংলা' স্লোগানকে যারা আবার নতুন করে জাগিয়ে দিল বাংলার কোটি কোটি প্রাণে, যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে যে কোটি তরুণ প্রকম্পিত করল রাজপথ-জনপদ-বাংলার প্রতিটি প্রান্ত, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অগ্নিমশালে আলোকিত করল বাংলাদেশ– কোন কূটিল ষড়যন্ত্রে তাদের সেই উজ্জ্বল প্রভা অন্তর্হিত হল? কে করল, কেন করল? কেন জাতির এই অমূল্য প্রজন্মকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়া হল না?

২. শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন, ডা. এম এ হাসান, কর্নেল সাজ্জাদ জাহির, শামসুল আরেফিনদের মতো মানুষ যাঁরা একাগ্রচিত্তে কর্মে ও গবেষণায় মুক্তিযুদ্ধকে রাষ্ট্রীয় চেতনার মূল কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠা করার জন্য জাগতিক সকল প্রত্যাশা প্রত্যাখ্যান করেছেন– কতটুকু সহযোগিতা পেলেন তাঁরা তাঁদের কর্মজগতে?

৩. যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের গ্রহণযোগ্য মান থাকা সত্ত্বেও, এর বিরুদ্ধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত চলছে, বিপুল উৎকোচের বিনিময়ে নিয়োগকৃত লবিস্টদের তৎপরতা উত্তরোত্তর বাড়ানোর পাঁয়তারা চলছে। সে ক্ষেত্রে যখন উচিত দৃঢ়তার সঙ্গে বিচারের রায় কার্যকর করা তখন যে দৃশ্যমান বিলম্ব পরিলক্ষিত হতে থাকল, তার ফলে ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা কতখানি নিরাপত্তা এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনের নিশ্চয়তা পাচ্ছেন?

৪. সন্ত্রাসী সংগঠন এবং মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক নির্দেশিত হওয়া সত্ত্বেও কেন জামায়াতের রাজনৈতিক বিচরণ এখনও অবাধ? বাহাত্তরের সংবিধান অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিরোধীদের রাজনীতির অধিকার নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও কেন রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব এবং বিস্তার চলছে?

নিঝুম মজুমদারের বিস্ময় এবং আমার অন্তরোচ্চারিত প্রশ্নের উত্তর কোথায় এবং কার কাছে পাব জানি না। তাই জানতে চাই।

আবেদ খান: সাংবাদিক, প্রকাশিতব্য দৈনিক জাগরণ-এর সম্পাদক।