তরুণ তোমার আসল জিহাদ জেনে নিও…

অমি রহমান পিয়ালঅমি রহমান পিয়াল
Published : 28 Nov 2013, 07:13 AM
Updated : 28 Nov 2013, 07:13 AM

''যে ব্যক্তি কোনো মুসলমান ভাইয়ের দোষত্রুটিগুলো গোপন রাখবে আল্লাহপাক দুনিয়াতে তার বিচ্যুতিগুলো ঢেকে রাখবেন।'' মুসলিম শরীফে বর্ণিত একটি হাদিসের অংশবিশেষ এটা। আর বিশেষ এই বাক্যটা বাংলাদেশের ধর্মব্যবসায়ী জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির সবচেয়ে ধূর্ততার সঙ্গে ব্যবহার করে যা শুধু ইসলামের অবমাননাই নয়, মহান নবীজীকেও (দ:) অবমাননার সামিল। বিষয়টি আমার চোখে পড়েছে দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর যুদ্ধাপরাধ নিয়ে লেখালেখির সময়। মন্তব্যে ঠিক এই হাদিসের লাইনটা পেস্ট করে আমাকে হেদায়েত করা হয়েছে।

মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর নির্দেশনা আল কোর্‌আনের কোথাও কিন্তু বলেননি যে, মুসলমান হলেই কারও সাতখুন মাফ। তিনি সেখানে মানুষকে মানুষ হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং ন্যায়-অন্যায় সত্য-মিথ্যা নীতি-দুর্নীতি পূণ্য-পাপের মধ্যে স্পষ্ট সীমারেখা টেনে দিয়েছেন। একজন লোক ধর্মপরিচয়ে মুসলমান হয়ে হত্যা-ধর্ষণ-অগ্নিকাণ্ড-লুটপাটসহ মানুষকে বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ করবে, আর আমি সেগুলো চেপে যাব, তার পক্ষে সাফাই গাইব যাতে আমি ভবিষ্যতে এমন কাজ করলে আল্লাহ সেটা চেপে যাবেন– এমন মুনাফেকি চিন্তাভাবনা তো রীতিমতো অপরাধের পর্যায়ে পড়ে!

অথচ জামাত-শিবির তাই করছে। ধর্মভীরু সাধারণ মানুষের আবেগ ব্যবহার করে দেশজুড়ে তাণ্ডবের সৃষ্টি করছে একদল ঘোর অপরাধীকে রক্ষা করতে। সেজন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ভুলভাবে ব্যবহার করছে কোরআনের আয়াত, হাদিসের বাণী এবং নিশ্চিতভাবেই তা মুনাফেকি।

আল্লাহ তার পাক কালামে বলেছেন: ''যারা আল্লাহর সঙ্গে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে এবং যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখার জন্য আল্লাহ নির্দেশ করেছেন তা ছিন্ন করে আর পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায় তাদেরই জন্য রয়েছে অভিশাপ এবং তাদের জন্য নিকৃষ্ট বাসস্থান।'' (সুরা রা'দ, ২৫)

আরও নির্দিষ্ট করে পুনরুচ্চারণ করেছেন এই ভণ্ডদের জন্য নির্ধারিত শাস্তির: ''আল্লাহ মুনাফেক নর-নারী ও অবিশ্বাসীদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জাহান্নামের আগুনের যেখানে ওরা থাকবে চিরকাল, এই ওদের জন্য হিসেব। ওদের ওপর রয়েছে আল্লাহর অভিশাপ, ওদের জন্য রয়েছে স্থায়ী শাস্তি।'' (সুরা তওবা ৬৮)

কমন সেন্স ব্যবহার করেই বোঝা যায় উল্লিখিত হাদিসে কোনো মুসলমানের বিরুদ্ধে গসিপ বা অপবাদ ছড়াতে নিষেধ করা হয়েছে, অনুৎসাহিত করা হয়েছে। আল্লাহপাক বলেছেন: ''মুনাফিকরাও যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে আর যারা শহরে গুজব রটিয়ে বেড়ায় তারা বিরত না হলে আমি নিশ্চয়ই তাদের বিরুদ্ধে তোমাকে প্রবল করব। এ ব্যাপারে তারা এ শহরে অল্পসংখ্যকই থাকবে প্রতিবেশিরূপে, অভিশপ্ত হয়ে।'' (সুরা আহজাব-৬০-৬১)

অথচ এই মিথ্যাচারই তাদের বর্ম, তাদের ঢাল। হত্যাকারী-ধর্ষকদের তারা আল্লাহর আলেম বলে পরিচয় দেয়, তাদের অপরাধ গোপন করার জন্য হাদিস শোনায় এবং রাজনৈতিক সন্ত্রাসে ব্যবহার করে। তারা দিনরাত অপবাদ দেয় মানুষকে। ধর্মের অপব্যবহার করে নিজেরা কিন্তু মানুষকে আখ্যা দেয় 'নাস্তিক' বলে।

এই চর্চা শরীয়তের সবচেয়ে ঘৃণিত ও নিষিদ্ধ, যা কিনা শিরক। একমাত্র আল্লাহই জানেন কে সত্যিকারের বিশ্বাসী আর কে কাফির, কে নাস্তিক। মানুষকে এই ক্ষমতা তিনি দেননি। বরং পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে লক্ষণ চিনিয়েছেন ইসলামের শত্রু মুনাফিকদের।

এই জ্ঞানপাপীদের জানার কথা শরীয়তের বিধান, যেখানে বিদআত আর শিরক থেকে নিবৃত্ থাকতে বলা হয়েছে। এই পাপ কাজগুলো না ছাড়া পর্যন্ত কোনো নেক আমল এবং তওবা কবুল হয় না। রাসুল (সা:) বলেছেন: ''আল্লাহ বান্দার পাপ মাপ করতে থাকেন যতক্ষণ না আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে পর্দা সৃষ্টি হয়। সাহাবাগণ জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, পর্দা কী? তিনি বললেন, পর্দা হল মানুষ শিরক করা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা।'' (মুসনাদে আহমাদ)

রাসুল (সা:) আরও বলেছেন: ''আল্লাহ বিদ'আতীর তওবা কবুল করেন না যতক্ষণ না সে বিদ'আত ছেড়ে দেয়।'' (তাবারানি)

কিন্তু ছাড়লে এই মুনাফিকরা যে বিপন্ন হয়ে পড়বে, ফাঁস হয়ে যাবে তাদের স্বরূপ, তখন শুধু পরকালই নয়, ইহকালও তাদের জন্য জাহান্নাম হয়ে যাবে। সেই পাপ ঢাকতেই তারা সর্বক্ষণ ব্যতিব্যস্ত রাখতে চায় ধর্মপ্রাণ মানুষকে মিথ্যা বলে ধোঁকা দিয়ে, ইসলাম রক্ষা করবে বলে, ধর্মরক্ষা করবে বলে।

অথচ হাদিসেই রয়েছে স্পষ্ট নির্দেশনা তাদের চিনে নেওয়ার: ''শেষ জমানায় কিছু প্রতারক সৃষ্টি হবে। তারা ধর্মের নামে দুনিয়া শিকার করবে। তারা মানুষের নিকট নিজেদের সাধুতা প্রকাশ ও মানুষকে প্রভাবিত করার জন্য ভেড়ার চামড়ার পোশাক পরবে (মানুষের কল্যাণকারী সাজবে)। তাদের রসনা হবে চিনির চেয়ে মিষ্টি। কিন্তু তাদের হৃদয় হবে নেকড়ের হৃদয়ের মতো হিংস্র।'' (তিরমিজী)

আজ সেই ধর্মরক্ষার নামেই তারা রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছে অল্পবয়সী কিশোর, তরুণদের। আজ যে তরুণ যে কিশোর যে যুবক রাস্তায় নেমে হত্যার উৎসবে মেতেছে, সে জানে সে জিহাদ করছে। মহান আল্লাহর রাস্তায় দ্বিনের কায়েমে সে নিজেকে উৎসর্গ করেছে। এমনটাই তাকে জানানো হয়েছে, তাকে জানিয়েছে জামাত-শিবির। কিন্তু সে জানে না বাস্তবে সে তার আত্মা বন্ধক রেখেছে শয়তানের কাছে, আর মানুষের কাছে সে জালিম হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। তার ইহকালের সঙ্গে পরকালও সমস্যাগ্রস্ত ও আল্লাহর লানতের শিকার।

তোমরা আজ রাস্তায় নেমেছ সেইসব মানুষদের পক্ষে, তাদের রক্ষা করতে যাদের হাতে রয়েছে রক্তের দাগ, নারীর আব্রু, লুটপাট ও বাস্তভিটা থেকে এতিমদের উৎখাতের পাপ। যে পোস্টার নিয়ে তোমরা রাস্তায় নাম তাতে নুরানী চেহারা নিয়ে, হাতে তসবিহ আর পরনে আলখাল্লা নিয়ে দাঁড়িয়ে এসব মুনাফিকেরা।

আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা:) বর্ণিত একটি হাদিস উল্লেখ করি। রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, ''যে ব্যক্তি খ্যাতি ও প্রদর্শনীর পোশাক পরিধান করল, কিয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা তাকে অপমান ও লাঞ্ছনার পোশাক পরাবেন।'' (আবু দাউদ)

এর ব্যাখ্যায় শাসক, নেতা ও সম্পদশালীদের পাশাপাশি ধর্মব্যবসায়ীদের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। ধর্মীয় নেতা, দুনিয়াত্যাগী দরবেশ, ইসলামি আলেম ইত্যাদি ধরনের লোকেরা দ্বীনী ও পবিত্রতার সাইনবোর্ড লাগিয়ে যেসব পোশাক পরিধান করে তাও ইসলামে নিষিদ্ধ, কুফরি।

কারণ এই চর্চা অন্য ধর্মাবলম্বীদের মাঝে দেখা যায় এবং এর মাধ্যমে ঈশ্বরকে ব্যবহার করে মানুষকে শোষণ করার প্রবণতা থাকে। ইসলামি সমাজে ধনী ও নেতাদের কোনো বিশেষ পোশাক পরার নির্দেশনা নেই। নেই ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক নেতাদের জন্য বিশেষ পরিচ্ছদে সজ্জিত হওয়ার বিধান।

দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী বা মওলানা শফীর অশ্লীল বাক্যসম্বলিত ভাষণকে আল্লাহর নবীজীর সুন্নাহবিরোধী বলে মানতে শেখ। হযরত আনাস (রা:) বর্ণিত: ''রাসুলুল্লাহ (সা:)-এর জবান অশ্লীল কথা, অভিশাপ দেওয়া ও গালাগালি করা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র ছিল। রাগ ও অসন্তুষ্টির সময়ও তিনি বলতেন, 'তার যে কী হয়ে গেল' বা 'তার কপালের ধুলি মলিন হোক'।'' (বুখারী)

অন্য একটি হাদিসের শুরুতেও স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে: ''যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন ভালো ও ন্যায় কথা বলে অথবা চুপ থাকে।''

এটা ঈমানের দাবি। সেখানে স্পষ্টতই গীবত, মিথ্যা, অসৎ ও বাজে কথা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে এবং নিজের ভাষাকে ভালো ও কল্যাণকর কাজে ব্যবহার করতে বলা হয়েছে।

একটু ভেবে দেখ, সাঈদী বা শফীদের ওয়াজে সমাগত হয় কারা? এরা কিন্তু মুসলমান, কোনো অমুসলিম সেখানে গিয়ে মুগ্ধতায় আত্মসমর্পণ করে না (কিছু নাটক বাদে)। নিজেদের ঈমান আরও শাণিত করার জন্য সেখানে তারা গিয়েছে। কিন্তু তারা প্রতারিত হয়। আল্লাহ ও নবীজীর (দ:) নাম ব্যবহার করে তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক ঘৃণা এবং রাজনৈতিক সন্ত্রাসের বীজ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।

চিন্তা করে দেখ তো, তুমি যা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ ভাবছ সেটা কি কোরআন বা শরীয়াসম্মত হচ্ছে কিনা, নাকি শয়তান ধর্মের লেবাস পরে তোমাকে কলহে নামিয়ে স্বার্থ উদ্ধার করছে! তুমি কি জান না মহানবীর সেই দৃঢ় উচ্চারণ: ''যে ধোঁকা দেয় তার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।'' (মুসলিম শরীফ)

নিজের বিবেক, প্রজ্ঞা, বিবেচনা বন্ধক দেওয়ার প্রয়োজন নেই। হাসরের ময়দানে আল্লাহ দলীয় বিচার করবেন না, সেই বিচার হবে একক। তোমার আমলের জবাবদিহিতা তোমাকেই করতে হবে। যদি বল আমাকে প্রতারিত করা হয়েছিল তখন তোমাকে শুনতে হবে, ''কিন্তু আমি তো তোমাকে নিজের বিবেচনাবোধ প্রয়োগের জন্য জ্ঞানবুদ্ধি দিয়েছিলাম, যাতে তুমি সত্য-মিথ্যা ন্যায়-অন্যায়ের প্রভেদ করতে পার।''

ভাব। শরণ নাও মহান আল্লাহর। তওবা কর। জিহাদ যদি করতেই হও, মুনাফিকদের বিরুদ্ধে নাম। ইসলামকে আজ বিশ্বজুড়ে বিপন্ন করার ষড়যন্ত্রে নেমেছে তারা। এদের হাত থেকে ধর্মরক্ষাই তোমার আসল জিহাদ, তোমার ঈমানি দায়িত্ব।

অমি রহমান পিয়াল: ব্লগার, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট।