আন্তর্জাতিক কাঠগড়ায় বাংলাদেশ

আবেদ খান
Published : 25 Nov 2013, 04:16 PM
Updated : 25 Nov 2013, 04:16 PM

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছে। বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই এই আগ্রহের পরিমাণ তীব্রতর হয়েছে। অনুমান করা অনুচিত হবে না, বাংলাদেশের সরকার কাঠামো কেমন হবে এবং সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব কতখানি থাকবে– তা নিয়ে তাদের একটি সাজানো ছক আগে থেকেই ছিল।

সেই ছকের একটা হিসেব ছিল এক-এগারো। সেই ছকেরই একটা অংশ ছিল 'মাইনাস টু' ফর্মূলা। রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে ঢালাও প্রচার এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়া দূষিত প্রমাণের মাধ্যমে একটি আবহ সৃষ্টি করার প্রয়াস ছিল ওই ফর্মূলায়। পাশাপাশি দাঁড় করানো হয়েছিল এমন এক বিকল্প শক্তি, যে শক্তিকে বহুযত্নে বহু কৌশলে তিল তিল করে গড়ে তোলা হচ্ছিল দীর্ঘ সময় ধরে।

রাজনৈতিক শক্তিসমূহ বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়ানোর ফলে পরিকল্পনাটি থমকে দাঁড়ায়। পরবর্তীতে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা পুনঃস্থাপিত হলে বিভিন্ন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে আবার ওই ফর্মূলা কার্যকর করার খুব নিভৃত কৌশল প্রয়োগ করা শুরু হয়।

এই প্রয়োগবিধির গতি অত্যন্ত সতর্ক, ধীর এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিভাজনের ফাঁকে পা রেখে পরিকল্পিত এই বিচরণ। এর ফলে আমরা উপহার হিসেবে পেলাম বিডিআর বিদ্রোহ, শ্রমিকনেতা আমিনুল হত্যা ইস্যু, কোটা সিস্টেম, সবচাইতে সম্ভাবনাময় পোশাক শিল্পে লাগাতার অসন্তোষ, ভাঙচুর, নৈরাজ্য, পদ্মা সেতু, বিশ্বব্যাংক, পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোতে সরকারবিরোধী নানাবিধ প্রচারণা এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কূটনীতির সীমারেখা অতিক্রমকারী অবিশ্বাস্য রাজনৈতিক কার্যক্রম– এসবই একসূত্রে গাঁথা।

এত শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সূচকের বিস্ময়কর অগ্রযাত্রা, স্বনির্ভরতা, মানব উন্নয়ন সূচকের অনবদ্য সাফল্য, খাদ্য এবং বৈদেশিক মুদ্রার ক্ষেত্রে রেকর্ড পরিমাণ উদ্বৃত্ত বিরোধীদের শঙ্কিত এবং মাইনাস থিওরির প্রণেতাদের কপালে ভাঁজ গভীরতর করে তোলে।

তারই আপাত সর্বশেষ চেষ্টা হচ্ছে মার্কিন কংগ্রেসের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপ কমিটির 'শুনানি'– যেখানে বাংলাদেশের নির্বাচনকালীন পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। ওয়াশিংটনের ক্যাপিটাল হিলের ল্যাবার্ন অফিস ভবনে অনুষ্ঠিত 'শুনানি'র উদ্যোক্তা হলেন কিছুদিন আগে বাংলাদেশে ভ্রমণ করা স্টিব শ্যাবোট। এই স্টিভ শ্যাবোট কংগ্রেসের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক উপ কমিটির চেয়ারম্যান এবং সুপরিচিত লবিস্ট।

তিনি যখন বাংলাদেশে আসেন তখনই অভিজ্ঞ মহলে প্রশ্ন উঠেছিল তার আগমনের এজেন্ডা নিয়ে। সে সময় এমন কথাও উঠেছিল যে তিনি বিশাল অঙ্কের ফি নিয়ে এই মিশনে বেরিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা, ড. ইউনূস, সুশীল সমাজের সুনির্দিষ্ট প্রতিনিধি এবং যে গোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করার পর সাংবাদিকদের কাছে কিছু তাৎপর্যপূর্ণ কথাও বলেছেন। তারপর নিজের দেশে গিয়ে নেমে পড়েছেন তাঁর ওপরে ন্যস্ত কর্তব্য বাস্তবায়নে!

লক্ষ্য করার বিষয়, যে শিরোনামে তিনি এই 'শুনানি'র আয়োজন করেছেন সেই 'শুনানি'র শিরোনাম– "নৈরাজ্যে বাংলাদেশ: খাদের কিনারে একটি জাতি।" শিরোনাম থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় সিদ্ধান্ত নিয়েই তথাকথিত আলোচনার অবতারণা করা হয়েছে। কোথায় নৈরাজ্য, কীসের নৈরাজ্য এবং নৈরাজ্য কাকে বলে এ ব্যাপারে কোনো কিছু চিন্তার আগেই শিরোনাম স্থির হয়ে গেল? প্রয়োগ করা হয়ে গেল নৈরাজ্য শব্দটি?

আর 'খাদের কিনারে একটি জাতি' কথাটিরই-বা মানে কী? যে জাতি ক্রমান্বয়ে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে– বিদ্যুৎ, যোগাযোগ, খাদ্য, জীবনযাত্রার মান, নারীর সামাজিক অবস্থান, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি করে বিপুল সাফল্য অর্জনের মাধ্যমে সমৃদ্ধির সোপানে পা রাখছে– সেই জাতিকে খাদের কিনারে কীভাবে পৌঁছে দেওয়া হল ওই 'শুনানি'তে?

আর ওটা 'শুনানি' কেন? এটা কি কোনো দায়ের করা মামলা? কে তবে এই মামলার বাদী? এটা কি সেই ধরনের মামলা যে মামলায় 'হিডেন' এজেন্ডাই হচ্ছে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার? মনে হচ্ছে এই মামলার বাদীপক্ষের এমন একজন সাক্ষীকে উপস্থিত করা হয়েছে যিনি সুস্পষ্টভাবে এক বিশেষ মহলের প্রতিনিধিত্বকারী এবং কোনো এক বিপজ্জনক আন্তর্জাতিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে যার নাম প্রায়শই উঠে আসে। এই সাক্ষী সরাসরি ট্রাইব্যুনালের গঠনপ্রক্রিয়া, বিচারকার্য ও সামগ্রিক কার্যক্রম কঠোর ভাষায় চ্যালেঞ্জ করলেন এবং সরকারের প্রতি নানাপ্রকার কটুবাক্য বর্ষণ করলেন।

অবশ্য তাঁর বক্তব্য প্রদানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিলেন ওই উপ কমিটির চেয়ারম্যান এবং 'শুনানি'র মূল উদ্যোক্তা স্টিভ শ্যাবোট। তাঁর সঙ্গে যুক্ত হলেন হিউম্যান রাইটসের পরিচালক জন সিফটন। আলোচনার নতুন স্রোত থেকে পরিষ্কার হয়ে গেল এই 'শুনানি'র আসল উদ্দেশ্য। পুরো 'শুনানি'তে বাংলাদেশের সাফল্য কিংবা কৃতিত্বের ক্ষুদ্রতর চিত্রও তুলে ধরা হল না।

একমাত্র ব্যক্তি ইলিনয় বিশ্ববদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ, যিনি কোনো মতে বলতে পেরেছিলেন যে, বাংলাদেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতেই হবে– এটা একাত্তরের তিরিশ লাখ শহীদের আত্মার প্রতি বাংলার মানুষের অঙ্গীকার এবং বাংলাদেশের গণদাবি। কিন্তু ড. আলী রীয়াজের সংক্ষিপ্ত মন্তব্য সেখানে অরণ্যে রোদন ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক জন সিফটন তো প্রস্তাব করেই বসলেন যেন বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা না দেওয়া হয়। অর্থাৎ তাঁদের ভাষায়– 'যে জাতি খাদের কিনারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তাকে ধাক্কা দিয়ে খাদের মধ্যেই ফেলে দাও।'

বুঝি না, এই বাঙালি জাতির প্রতি কেন তাঁদের এত ক্রোধ, এত বিদ্বেষ! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে মার্কিন সরকারের ভূমিকাই কি এই ক্রোধের মূল সূত্র?

দুই.

পাশ্চাত্য মিডিয়ার প্রচারণার ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবার কোনো কারণ আমি দেখি না। সেখানে ব্যক্তি স্বাধীন হতে পারে, কিন্তু মিডিয়া মোটেই স্বাধীন নয়। সেখানে বিভিন্ন প্রভাবশালী পত্রিকায় অর্থের বিনিময়ে সংবাদ অথবা যে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশের অবকাশ থাকে। পরিবেশনার ধরন এবং আকৃতি অথবা গুরুত্বারোপ নির্ণীত হয় টাকার অঙ্কের ওজনের ওপর। সেখানে লবিস্ট গ্রুপের প্রভাব খুবই প্রবল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্বমিডিয়াকে আকৃষ্ট করার জন্য জামায়াতে ইসলামী কোটি কোটি ডলার ব্যয় করেছে প্রভাবশালী লবিস্ট নিয়োগ করার জন্য।

সম্প্রতি ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনার জন্য প্রচুর অর্থব্যয়ে লবিস্ট নিয়োগ করা হয়েছিল। তাঁদের আয়োজনে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ৬০ সদস্য ছয়টি আবেদন জমাও দিয়েছিলেন। যাঁরা লবিস্ট নিয়োগ করে আশা করেছিলেন যে, পার্লামেন্ট এমন প্রস্তাব পাশ করবে যা বাংলাদেশ সরকারকে বিশ্ববাসীর কাছে একটা নিকৃষ্ট ভিলেন হিসেবে তুলে ধরারই নামান্তর হবে।

কিন্তু ইউরোপীয় পার্লামেন্টে যে প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে তাতে কোনো অবস্থাতেই নির্বাচন বর্জন না করার আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রীর সর্বদলীয় সরকার গঠনের আহ্বানের কথা উল্লেখ করে তাতে বিএনপির সাড়া না দেওয়ার ব্যাপারটি আমলে নেওয়া হয়েছে। গৃহীত প্রস্তাবে তত্ত্বাবধায়ক আমলে হাসিনা এবং খালেদাকে গ্রেফতার করার বিষয়টি উল্লেখ করে পরবর্তীতে বিএনপির অবস্থান পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং শেখ হাসিনার সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাবে খালেদার অস্বীকৃতিতে বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে।

লক্ষ্য করার বিষয়টি হল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্লামেন্টে আনীত প্রস্তাব নিয়ে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করা হলেও, অনুমোদিত প্রস্তাব চেপে যাওয়া হয়েছে কিংবা বিকৃত করা হয়েছে। আর বিদেশি মিডিয়ায় এর কোনো উল্লেখই পাওয়া যাচ্ছে না! অর্থাৎ অর্থের জালে আবদ্ধ লবিস্ট-প্রভাবিত বিদেশি মিডিয়া এখন বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিনষ্টকারী সংবাদ পরিবেশনেই অধিকতর তৎপরতা দেখাচ্ছে।

একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ বাংলাদেশের মিডিয়ায় রীতিমত ব্ল্যাকআউট করা হয়েছে। সেটি হচ্ছে কানাডীয় পার্লামেন্টের দুই গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের বাংলাদেশে আগমন। তাঁরা এসেছিলেন ইউরোপের প্রভাবশালী থিংক-ট্যাংক সাউথ এশিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোরাম বা এসএডিএফ-এর পক্ষ থেকে। এই দুজন এমপি হচ্ছেন রুজ হেইবার্ট ও জো ডোনিয়েল।
তাঁরা তিন দিনের সফরে এসে সাক্ষাৎ করেছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মীয় নেতা, সাংবাদিক, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, সাবেক সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা, সুধীসমাজের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণির নেতাদের সঙ্গে।

সফর শেষে তাঁরা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন– 'বাংলাদেশে নির্বাচনপূর্ব পর্যবেক্ষণ মিশন-২০১৩' শিরোনামে। প্রতিবেদনটিতে তাঁরা বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হিসেবে পাঁচটি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন। এই বিষয় পাঁচটি হচ্ছে–

ক) সরকার ব্যবস্থা;

খ) হরতাল;

গ) যুদ্ধাপরাধের বিচার সংক্রান্ত ট্রাইব্যুনাল;

ঘ) জামায়াতে ইসলামী;

ঙ) দুর্নীতি দমন কমিশন।

এতে ৮টি অনুচ্ছেদে ৭টি বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে–

১. বাংলাদেশের অনেক ঝুঁকি সত্ত্বেও পর্যবেক্ষণ মিশনের সঙ্গে সবাই এদেশের সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আছে বলে জোরালো আশা প্রকাশ করেছেন। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে তরুণ, কর্মঠ ও বিশাল জনগোষ্ঠী নিয়ে বাংলাদেশ অনেক কিছু অর্জন করতে পারে;

২. পর্যবেক্ষণ মিশন মনে করে, বাংলাদেশে মৌলিক সংস্কারের ব্যাপারে সরকারি ও বিরোধী উভয় পক্ষ অঙ্গীকার করলে দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসতে পারে। এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্র পরিপক্ব হওয়ার পথ প্রশস্ত করবে। এ ধরনের সংস্কারে সংসদকে আরও ক্ষমতা দেওয়া উচিত এবং আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় আন্তরিকভাবে অংশ নিতে বিরোধী দলকে সংসদে নিয়মিত উপস্থিত থাকতে হবে;

৩. আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসের মর্মন্তুদ ঘটনা মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন এবং দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। যদিও বিয়াল্লিশ বছর পর ট্রাইব্যুনাল হয়তো প্রতিটি অপরাধের বিচার করতে সক্ষম হবেন না, তবু এটা অন্তত প্রথমবারের মতো ন্যায়বিচার ও জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে;

৪. দুর্নীতিদমন কমিশন আইন অবশ্যই পরিবর্তন করা দরকার, যাতে কমিশন শক্তিশালী হয় ও তদন্তকাজে সরকারের অনুমতি না লাগে;

৫. জামায়াতে ইসলামী নারী, সংখ্যালঘু ও অন্যদের অধিকার সুরক্ষার ব্যাপারে গভীর সংকট সৃষ্টি করছে। তাই জাতীয় রাজনীতিতে এই দলটির ভূমিকা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা উচিত। বিশেষ করে বিএনপিকে অবশ্যই জোটের ভিতরে জামায়াতের ভূমিকাকে অনুধাবন করতে হবে এবং এই উগ্রবাদী সংগঠনের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করতে হবে;

৬. সংকটময় মুহূর্তে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে বিরোধী দল বিএনপির শান্তিপূর্ণ সাধারণ ধর্মঘট ডাকার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য হলেও, বর্তমানে হরতালের সঙ্গে যে ব্যাপক সহিংসতা হয় তা সুস্পষ্টভাবে অগ্রহণযোগ্য। এ ধরনের নৈরাজ্যের সরাসরি শিকার হওয়া কেবলমাত্র জীবন ও সম্পদের জন্যই নয়, সার্বিকভাবে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনীতির জন্যও হুমকি;

৭. সর্বশেষ পর্যবেক্ষণে মিশন মনে করে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাওয়ার জন্য অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সৃষ্টির উপায় হল অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন।

প্রতিবেদনটির সামগ্রিক পর্যবেক্ষণে হরতালকে 'আত্মঘাতী' অভিহিত করে বলা হয়েছে যে, কট্টরপন্থী জামায়াত ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠী দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাস, ব্যক্তিগত যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করছে এবং এ ক্ষেত্রে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করছে। এতে রাজনৈতিকভাবে বিএনপিই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, কানাডীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদের এই পর্যবেক্ষণ মিডিয়ায় কোনো গুরুত্বই পায়নি। এমনকি ইউরোপীয় পার্লামেন্টের অনুমোদিত প্রস্তাবে বাংলাদেশে সুষ্ঠু সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন নিয়ে যে স্বচ্ছতার কথা বলা হয়েছিল তারও কোনো আভাস আমরা মিডিয়ায় পাইনি।

এসব থেকেই সহজে অনুমান করা যায় যে, আমাদের দেশে এবং লবিস্ট-নিয়ন্ত্রিত ও অর্থপ্রভাবিত আন্তর্জাতিক মিডিয়া কীভাবে জাল ফেলেছে। অবাক লাগে, এই সরকার পাঁচটি বছরে মিডিয়ার প্রশ্নে কী ঔদাসীন্য দেখিয়েছে, সে কথা যখন ভাবি। কোন রহস্যজনক কারণে মিডিয়াকে বৈরী করার আত্মহননকারী কাজ একের পর এক করা হয়েছে এবং সরকারের অর্জন প্রচারে ক্রমাগত ভুল পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা আমার বোধগম্য নয়।

শুধু এ কথাই বলি, বিএনপি বর্তমান সরকারের সাফল্যের এক দশমাংশও যদি করতে পারত তাহলে প্রচারণার স্রোতে নির্বাচনী বৈতরণীকে অনায়াসে জয়ে রূপান্তরিত করতে পারত। অথচ এই হতভাগ্য সরকারকে এই শেষ বেলায় কেবল আত্মরক্ষাই করে যেতে হচ্ছে।

তিন.

শেখ হাসিনার এই আমলের সূচনা থেকে এ পর্যন্ত সময়কালের সঙ্গে বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায় স্বাধীনতা-পরবর্তী বঙ্গবন্ধু সরকারের। সে সময়ও গোড়া থেকেই ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল; এখনও তাই হচ্ছে। সে সময়ও ব্যাপক নাশকতা চলছিল; এখনও তাই চলছে। সে সময়ও অসাধারণ সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের জন্য; এখনও অনেক উন্নয়নমূলক কাজ হচ্ছে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তখনও একশ্রেণির আন্তর্জাতিক শক্তি বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপর্যস্ত করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল; এখনও তাদের তৎপরতা দৃশ্যমান।

তফাৎ শুধু এটুকুই যে এটা বাহাত্তর নয়, ২০১৩। তখন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মিত্র ছিল বিভ্রান্ত; আর এখন আন্তর্জাতিক মিত্র যথেষ্ট সতর্ক। তখন সামরিক শক্তি ছিল অবিন্যস্ত ও আত্মদ্বন্দ্বে জর্জরিত; আর এখন সুসংহত ও আত্মশক্তিতে উজ্জীবিত।

কাজেই শেখ হাসিনাকেই এখন পথচলার নির্ভরযোগ্য 'সাথী' বাছতে হবে।


আবেদ খান :
সাংবাদিক, প্রকাশিতব্য দৈনিক জাগরণ-এর সম্পাদক।