প্রতিবন্ধী নই, মানুষ

মুহম্মদ জাফর ইকবালমুহম্মদ জাফর ইকবাল
Published : 21 Nov 2013, 07:13 PM
Updated : 21 Nov 2013, 07:13 PM


আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের নিয়ে অনেক কাজ করি। সে কারণে তাদের অনেকের সঙ্গে আমার পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। একবার কোনো এক কারণে আমি তাদের অফিসে গিয়েছি, সেখানে যারা ছিলেন তাদের প্রায় সবাই শুধু দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নন, বেশিরভাগই পুরোপুরি দৃষ্টিহীন। সে জন্যে তারা যে কোনো কাজকর্ম করছেন না তা নয়, সবাই কিছু না কিছু করছেন।

কথা বলতে বলতে সন্ধ্যে হয়ে গেছে। তখন হঠাৎ কারেন্ট চলে গিয়ে অন্ধকার হয়ে গেল। কারেন্ট চলে গিয়ে অন্ধকার হলে আমাদের কাজকর্ম থেমে যায়, কারেন্ট এলে আবার কাজ শুরু হয়। আমি নিজের অজান্তেই সে রকম কিছু একটা ভেবেছিলাম।

কিন্তু হঠাৎ করে আবিষ্কার করলাম সেই প্রতিষ্ঠানের কোনো কাজ বন্ধ হল না, সবাই নিজের মতো কাজ করতে লাগলেন। বিষয়টা আমার আগেই অনুমান করার কথা ছিল। কিন্তু কখনও মাথায় আসেনি। আমরা যারা চোখ ব্যবহার করে কাজকর্ম করি তারা অন্ধকারে কাজ করতে পারি না। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা পারেন। আলো না থাকলে আমরা খানিকক্ষণের জন্যে প্রতিবন্ধী হয়ে যাই, তারা হন না।

আমার অবশ্যি তখন আরও কিছু জানা বাকি ছিল। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের লেখাপড়ার জন্যে ব্রেইল পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয়। কাগজে যখন ব্রেইলে কিছু লেখা হয় তখন সেটা খানিকটা উঁচু হয়ে যায় এবং দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা হাত দিয়ে স্পর্শ করে সেটা পড়তে পারেন। এই ব্রেইল প্রিন্টার খুব দামি একটা প্রিন্টার। তাই অনেকদিন থেকেই আমি সাধারণ ডট মেট্রিক্স প্রিন্টার দিয়ে ব্রেইলে লেখার একটা পদ্ধতি বের করার চেষ্টা করেছিলাম।

শেষ পর্যন্ত সেই প্রিন্টার তৈরি হয়েছে এবং সেই প্রিন্টারে লেখা পড়ে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা খুব খুশি। এ রকম সময়ে তাদের কমবয়সী একজন ছেলে বলল, "স্যার, আমাদের এখানে সত্যিকারের ব্রেইল প্রিন্টার আছে, আপনাকে দেখাই।" আমি আগে ব্রেইল প্রিন্টার দেখিনি। তাই তার সঙ্গে পাশের ঘরে গেলাম।

সেখানে সব কম্পিউটার টেপাটেপি করে ব্রেইল প্রিন্টারে কিছু একটি প্রিন্ট করতে দিল। সারা পৃথিবীর সকল প্রিন্টারে যা হয় এই মহামূল্যবান প্রিন্টারেও তাই হল। হঠাৎ করে ভিতরে কাগজটা আটকে গেল। আমি ধরেই নিলাম ব্রেইল প্রিন্টার দেখানোটা আজকের মতো এখানেই শেষ।

কিন্তু মজার ব্যাপার হল ব্রেইল প্রিন্টার দেখানো এখানেই শেষ হল না। কারণ আমি দেখলাম পুরোপুরি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছেলেটা একটা স্ক্রু ড্রাইভার নিয়ে প্রিন্টারটা খুলতে শুরু করল। কিছুক্ষণেই সে প্রিন্টারটা খুলে ফেলল এবং ভেতরের যন্ত্রপাতি আলাদা হয়ে গেল এবং ভেতরে কোনো এক জায়গায় আটকে থাকা কাগজটা টেনে বের করে ফেলল। তারপর যে দক্ষতার সে প্রিন্টারটি খুলেছিল সেই একই দক্ষতায় পুরো প্রিন্টারটা জুড়ে ফেলল।

(আমি যখন যন্ত্র খুলে সেটা আবার লাগানোর চেষ্টা করি তখন সব সময়েই কিছু স্ক্রু বাড়তি থেকে যায়, এবারে কিন্তু কোনো বাড়তি স্ক্রু থাকল না এবং সব স্ক্রু ঠিক ঠিক জায়গায় লাগানো হয়ে গেল।)

প্রিন্টার রেডি হবার পর সে আবার কম্পিউটার টেপাটেপি করে কাগজে ব্রেইল প্রিন্ট করে দেখাল। ব্রেইল প্রিন্টার দেখে আমি যতটুকু মুগ্ধ হয়েছিলাম তার থেকে একশ গুণ বেশি মুগ্ধ হলাম এই ছেলেটিকে দেখে। একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষ নিশ্চয়ই কিছু কিছু কাজ কখনওই করতে পারবে না, আমার মনে সে করম একটা ধারণা ছিল। আমি ধরেই নিয়েছিলাম কিছু কিছু কাজ নিশ্চয়ই শুধুমাত্র যারা দেখতে পায় তারা করবে।

আমার ভুল ভাঙল, কে কী কাজ করতে পারবে আর কী কাজ করতে পারবে না সেই সীমারেখাটি কেউ কোনোদিন টানতে পারবে না। আমি যাকে দৃষ্টিপ্রতিবদ্ধী ভেবে এসেছি, আসলে নিজের চোখে দেখলাম দৃষ্টি না থাকাটা এখন আর তার জন্যে কোনো প্রতিবদ্ধকতা নয়। আমরা যে কাজটা আমাদের দৃষ্টি ব্যবহার করি এই ছেলেটি সেই একই কাজ দৃষ্টি ব্যবহার না করেই করতে শিখেছে।

সবাই হয়তো তার মতো পারবে না, কিন্তু এই ছেলেটি যেহেতু পারে তার অর্থ চেষ্টা করলে পারা সম্ভব। ঠিকভাবে সুযোগ দেওয়া হলে আরও অনেকে নিশ্চয়ই আরও অনেক কিছু করতে পারবে যেটা আমরা এখন চিন্তাও করতে পারি না। আমার মনে হল হয়তো প্রতিবন্ধী শব্দটাই নতুন করে ব্যাখ্যা করা দরকার। তার কারণ একজন একদিকে প্রতিবন্ধী হলেও অন্যদিকে তারা সেটি পূরণ করে নিতে পারে, আমাদের শুধুমাত্র সেই সুযোগটি করে দিতে হবে।

এটি যে আমার দেখা একটিমাত্র ঘটনা তা কিন্তু মোটেও নয়। বেশ কয়েক বছর আগে একটি মেয়ে আমাকে কোনো একটি কাজে ফোন করেছিল। ফোনে কথা বলে বুঝতে পারলাম সে শারীরিকভাবে একজন প্রতিবন্ধী মানুষ, তাকে চলাফেরার জন্যে হুইলচেয়ারের উপর নির্ভর করতে হয়।

আমাকে কেন ফোন করেছিল এতদিন পরে আর মনে নেই, আমি তাকে সম্ভবত ছোটখাট সাহায্যও করেছিলাম। মেয়েটি ব্লগে লেখালেখি করে, প্রতিবন্ধী মানুষদের অধিকার নিয়ে সে রীতিমতো একটা আন্দোলন শুরু করেছে। তার তৈরি করা একটা সংগঠনও আছে এবং সেখানে আরও অনেকে যোগ দিয়েছে।

মেয়েটির বা তার প্রতিষ্ঠানের নাম বললে অনেকেই হয়তো তাকে চিনে যাবে, ইচ্ছে করেই তার নামটা এখানে উচ্চারণ করছি না। আমি যে কারণে এই লেখাটি লিখছি সেখানে তার পরিচয়টি হবে একজন প্রতিবন্ধী মানুষ, আমি সেটা চাই না। (তার সত্যিকারের পরিচয় সে ঠিক আমাদের মতো একজন মানুষ, যখন সে রকমভাবে পরিচয় দিই তখন তার নাম লিখতে আমার কোনো দ্বিধা হবে না।)

যাই হোক, একসময় মেয়েটির সঙ্গে আমার দেখা হল, তখন আমি সবিস্ময়ে আবিষ্কার করলাম তার যে এত লেখালেখি, এত বড় সংগঠন, এত চমৎকার একটি আন্দোলন, সমাজের জন্যে তার যে এত বড় অবদান– তার সবকিছু সে করেছে শুধুমাত্র একটি আঙুল দিয়ে। সারা শরীরের মধ্যে শুধু এই আঙুলটি দিয়ে সে কোনো কিছু স্পর্শ করতে পারে।

সত্যি কথা বলতে কী, এই মেয়েটিকে দেখে আমার নিজেকে পুরোপুরি অকিঞ্চিতকর একজন মানুষ বলে মনে হয়েছে। শুধুমাত্র একটা সচল আঙুল দিয়ে একজন মানুষ যদি এত কিছু করতে পারে তাহলে আমরা আমাদের সারা শরীর, হাত-পা-মাথা-ঘাড়-বুক-পেট সবকিছু নিয়ে কেন কিছু করতে পারি না? এই মেয়েটি যদি কোনো অভিযোগ না করে তার সব কাজ করে যেতে পারে, তাহলে আমরা কেন সারাক্ষণ জগৎ-সংসার দেশ নিয়ে ঘ্যান ঘ্যান করে অভিযোগ করি? আমাদের সমস্যাটা কোথায়?

বেশ কিছুদিন আগে আমি আরও একটি টেলিফোন পেয়েছিলাম, যে আমাকে ফোন করেছিল সেও ছিল একটি মেয়ে। গলার স্বর শুনে বুঝতে পারলাম বয়স বেশি নয়, কিন্তু তার কথা বুঝতে আমার একটু সমস্যা হচ্ছিল। আমার কাছে মনে হচ্ছিল তার গলার স্বরটা কেমন যেন একটু যান্ত্রিক। মেয়েটি তখন আমাকে এসএমএস পাঠাল এবং সেখান থেকে জানতে পারলাম সে শুধু হুইলচেয়ারে নয়, পাকাপাকিভাবে একটা বিছানায় আবদ্ধ একজন মানুষ।

কিছুদিন আগেও সে পুরোপুরি সুস্থ-সবল ছটফটে দুরন্ত একটি মেয়ে ছিল, কোনো একটি গণিত অলিম্পিয়াডে তার সঙ্গে নাকি আমার একবার দেখাও হয়েছিল। কোনো একভাবে সে তার স্কুলের চারতলা থেকে নিচে পড়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে পড়ে কারও বেঁচে থাকার কথা নয়, সে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল। কিন্তু সে চিরদিনের জন্যে একটা বিছানায় আবদ্ধ হয়ে পড়ল, নিঃশ্বাসটুকুও নিতে হয় যন্ত্র দিয়ে।

সেই মেয়েটিও তার একটিমাত্র আঙুল ব্যবহার করে কবিতা লিখত, সেই কবিতা সে আমার কাছে পাঠিয়েছিল। আমাকে বলেছিল এই শারীরিক অবস্থা নিয়ে সে নাকি ছবিও আকঁত। বিছানার মাঝে আটকে থাকা একটা কিশোরীর সামনে বাইরের পৃথিবীর জানালা কীভাবে খুলে দেওয়া যায় আমি যখন সেটা ভাবছি, তখন তার একজন বান্ধবী আমাকে জানাল সেই মেয়েটি আর বেঁচে নেই। যে মানুষটিকে কখনও সামনাসামনি দেখিনি তার জন্যে দুঃখে আমার বুকটা একেবারে ভেঙে গিয়েছিল।

আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা কত? আমি জানি সংখ্যাটি শুনলে সবাই চমকে উঠবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আর বিশ্ব ব্যাংকের ২০১১ সালের জরিপ অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে প্রতিবন্ধী মানুষ হচ্ছে শতকরা ১৫ জন। (সত্তরের দশকেও সংখ্যাটি ছিল শতকরা ১০ জন) সারা পৃথিবীতে যে হিসেবে বাংলাদেশ তার বাইরে থাকবে সেটা হতে পারে না।

সত্যি কথা বলতে কী, যে দেশ একটু দরিদ্র সেই দেশে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা বেশি। কাজেই আমরা যদি বাংলাদেশের জন্যেও এই ১৫ শতাংশ সংখ্যাটি ধরে নিই তাহলে এখানে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি চল্লিশ লক্ষ। সংখ্যাটি কত বড় অনুমান করার জন্যে বলা যায় অস্ট্রেলিয়ায় যদি এই সংখ্যক মানুষকে প্রতিবন্ধী হতে হয় তাহলে সেই দেশের প্রত্যেকটি মানুষকে প্রতিবন্ধী মানুষ হতে হবে।

আমি যখন প্রথমবার এই সংখ্যাটি নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি তখন আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। আমাদের দেশে আদিবাসীদের সংখ্যা ২০ লক্ষ্যের কাছাকাছি, আমরা এই মানুষগুলোর অধিকারের জন্যে সবসময় সোচ্চার থাকি। সরকার যখন ঘোষণা দিল এই দেশে আদিবাসী নেই আমরা তখন তীব্র ভাষায় সরকারের সমালোচনা করেছিলাম।

এই দেশের প্রায় নব্বই ভাগই এখন মুসলমান, বাকি অল্প যে কজন ভিন্নধর্মের মানুষ আছে তাদেরকে নিয়ে যেন এদেশে একটা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি থাকে আমরা সবসময়েই সেটা লক্ষ্য রাখার চেষ্টা করি।

অথচ সংখ্যায় তাদের থেকে অনেক বেশি হচ্ছে প্রতিবন্ধী মানুষ। কিন্তু তারা কী পূর্ণাঙ্গ মানুষের মর্যাদা নিয়ে এদেশে আছে, নাকি একটা ঘরের ভেতর সবার চোখের আড়ালে এক ধরনের গভীর হতাশায় ডুবে আছে, সেটা নিয়ে আমরা কখনও মুখ ফুটে কথা বলি না! এর চাইতে বড় পরিহাস আর কী হতে পারে?

প্রতিবন্ধী মানুষ নিয়ে আমাদের ভেতরে এখনও কোনো সচেতনতা নেই। বরং উল্টোটা আছে, তাদের সম্পর্কে আমাদের নানা রকম নেতিবাচক ধারণা আছে। আমার স্পষ্ট মনে আছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন আমরা প্রথম একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছাত্র ভর্তি করেছিলাম তখন বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব বুড়ো বুড়ো প্রফেসর আমাদের নতুন বিশ্ববিদ্যালয়েকে নানা ধরনের হাইকোর্ট দেখাতেন তারা রীতিমতো আঁতকে উঠেছিলেন। 'কানা', 'খোঁড়া' মানুষ ভর্তি করে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ঝামেলা তৈরি না করি সেজন্যে আমাদের উপদেশ দিয়েছিলেন।

প্রথমবারের মতো একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছাত্র ভর্তি হচ্ছে, সেটি কোনো কোটায় নয়, নিজের যোগ্যতায়– সেটি নিয়ে আমার ভেতরে এক ধরনের আনন্দ ছিল এবং আমার মনে আছে একাডেমিক কাউন্সিলে বুড়ো বুড়ো প্রফেসরদের সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রতিবন্ধী ছাত্রটিকে ভর্তি করা হয়েছিল। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের দৃষ্টিভঙ্গি যদি এ রকম ভয়াবহ হয় তাহলে সাধারণ মানুষের কী হবে সেটা অনুমান করা কঠিন নয়।

এখন সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। একজন প্রতিবন্ধী ছাত্র যেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠিকভাবে পড়তে পারে সে জন্যে নীতিমালা আছে, আমরা তাদের প্রয়োজনটুকু দেখার চেষ্টা করি।

কিন্তু এই কথাটি কি পুরোপুরি সত্যি? আমাদের দেশে আইন করা হয়েছে প্রত্যেকটা নতুন বিল্ডিংয়ে হুইলচেয়ারে করে ভেতরে ঢোকার ব্যবস্থা থাকতে হবে। বাথরুমগুলোতে যেন হুইলচেয়ার নিয়ে একজন প্রতিবন্ধী মানুষ ঢুকতে পারে তার ব্যবস্থা রাখতে হবে। কিন্তু আমাদের এত আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিল্ডিংয়ে সেটি করা হয়নি।

আমার মনে আছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় আয়োজন করা হয়েছে। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি টিম এসেছে যার একজন হুইলচেয়ারে চলাফেরা করে। অত্যন্ত দক্ষ প্রোগ্রামার হিসেবে সেই টিম একটা পুরস্কার পেয়ে গেল, এখন তাদের মঞ্চে গিয়ে পুরস্কার নিতে হবে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করা আমাদের অডিটরিয়ামের রাজসিক মঞ্চ, কিন্তু হুইলচেয়ারে করে আসা সেই ছেলেটির মঞ্চে ওঠার কোনো জায়গা নেই। লজ্জায় মনে হল মাটির সঙ্গে মিশে যাই।

তার বন্ধুরা তাকে হুইলচেয়ারসহ মঞ্চে তুলে নিয়ে এল। সেখানে বন্ধুদের ভালোবাসা আছে, কিন্তু পুরস্কার পাওয়া তরুণের সম্মানটুকু নেই। আমি তখন তাকে কথা দিয়েছিলাম পরের বছর সে যদি আসে আমরা তাহলে তার জন্যে একটা র‌্যাম্পের ব্যবস্থা করে রাখব।

(সত্যি কথা বলতে কী, পরের বছরও আমি বিষয়টা ভুলে গিয়েছিলাম। একেবারে শেষ মুহূর্তে যখন মনে পড়েছে তখন তাড়াতাড়ি করে একজন কাঠমিস্ত্রিকে ডেকে খুব দায়সারা একটা র‌্যাম্প তৈরি করে রেখেছিলাম যেন সেটা দিয়ে তার বন্ধুরা হুইলচেয়ারটাকে খানিকটা হলেও সম্মান নিয়ে উপরে নিয়ে যেতে পারে!)

নতুন একটা বিল্ডিং তৈরি করতে যত টাকা দরকার হয় তার তুলনায় সেই বিল্ডিংয়ে হুইলচেয়ারে ওঠার ব্যবস্থা করে দেওয়া বা বাথরুমে হুইলচেয়ার নিয়ে ঢোকার ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্যে বলতে গেলে কিছুই খরচ নেই, তারপরেও সেটা করা হয় না। দেশে এটা নিয়ে একটা আইন তৈরি করা হয়েছে। আমরা বেশিরভাগ সেই আইনটার কথা জানিই না!

বিল্ডিংয়ে ঢোকা শুধু একটা অংশ, যে মানুষটি হুইলচেয়ারে চলাফেরা করে তার কোনো একটা বিল্ডিংয়ে ঢোকার আগে অনেক রাস্তা পাড়ি দিয়ে আসতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে রাস্তাঘাট, যানবাহন কোনো কিছুতেই কিন্তু হুইলচেয়ারে করে যাওয়ার ব্যবস্থা নেই।

যেসব দেশ প্রতিবন্ধী মানুষবান্ধব সেখানে গেলে এক ধরনের মুগ্ধতা নিয়ে দেখতে হয় তারা কত গভীর মমতা নিয়ে এই মানুষগুলোর চলাফেরার ব্যবস্থা করে রেখেছে। সেখানে সাধারণ মানুষের চলাফেরা করার যেটুকু অধিকার, হুইলচেয়ারে করে একজন মানুষের তার সমান অধিকার। রাস্তাঘাট, ফুটপাথ সব জায়গায় হুইলচেয়ার নিয়ে যাওয়া যায়। হুইলচেয়ারের সুবিধেটুকু বড় বড় স্পষ্ট সাইন দিয়ে বলে দেওয়া থাকে।

পার্কিং লটে হুইলচেয়ারের যাত্রীদের গাড়ি পার্কিংয়ের আলাদা জায়গা থাকে। বাসে-ট্রেনে তাদের ওঠার ব্যবস্থা থাকে, ওঠার পর হুইলচেয়ারে বসে যাওয়ার আলাদা জায়গা থাকে। একজন মানুষ তার বাসা থেকে হুইলচেয়ারে রওনা দিয়ে সারাদিন পুরো শহর চষে বেরিয়ে আবার নিজের ঘরে ফিরে আসতে পারবে, তাকে একটিবারও অন্য কারও সাহায্য নিতে হবে না। আমাদের পাশের দেশ ভারতবর্ষ যদি এর মাঝেই প্রতিবন্ধী মানুষদের যাতায়াতের জন্যে অনেক কিছু করে ফেলতে পারে, তাহলে আমরা কেন পারব না?

একটি প্রতিষ্ঠানকে কিংবা একটা শহরকে এমনকি একটা দেশকেও যদি হুইলচেয়ারে যাতায়াতের ব্যবস্থা করে দিতে হয় তার জন্যে এমন কিছু বাড়তি টাকা-পয়সার দরকার হয় না। যেটুকু দরকার হয় সেটি হচ্ছে একটুখানি ইচ্ছে বা একটুখানি সিদ্ধান্ত। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে যে ক্ষুদ্র টাকা-পয়সা খরচ করে সবার জন্যে প্রবশেগম্যতা নিশ্চিত করা হবে তার প্রতিদানে যেটুকু পাওয়া যাবে তার মূল্য সেই টাকা-পয়সার সহস্রগুণ বেশি।

প্রতিবন্ধী মানুষ বলে আমরা যাদের চোখের আড়াল করে রেখেছি, সমাজের বোঝা বলে আমরা যাদের অবহেলা করে এসেছি, তাদের কিন্তু আসলেই সবার চোখের আড়ালে সমাজের বোঝা হিসেবে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। যদি এই দেশের পথেঘাটে, বাসে, ট্রেনে, গাড়িতে একজন হুইলচেয়ারে করে নিজে নিজে যেতে পারে তাহলে আমরা অবাক হয়ে দেখব তাদের আর পরিবারের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হবে না, তারা নিজেরাই অনেক সময় নিজেদের দায়িত্ব নিয়ে নিতে পারবে।

এই দেশের দুই কোটি চল্লিশ লক্ষ মানুষ যদি কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধী হয় তাহলে তাদেরকে ঘরের মাঝে আটকে রেখে চোখের আড়াল করে ফেলার চেষ্টা করার কোনো মানে হয় না। আমাদের তাদের মুক্ত করে দিতে হবে। এই বিশাল সংখ্যক মানুষের যতজনকে সম্ভব পরিপূর্ণ জীবন যাপনের অধিকার দিতে হবে।

কিছুদিন আগে একজন ব্রিটিশ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের কাজগুলো দেখতে এসেছিল। কথা বলতে বলতে হঠাৎ করে জানতে পারলাম সে গণিতে লেখাপড়া করে এসেছে। যে মানুষটি চোখে দেখতে পায় না সে কেমন করে গণিত নিয়ে পড়াশোনা করতে পারে সেটি নিয়ে আমার কৌতূহল ছিল।

তাকে জিজ্ঞেস করায় সে বলল চোখে দেখতে পায় না বলে ভুল করে সে অন্য একটি ক্লাসরুমে ঢুকে গিয়েছিল, সেখানে সে শুনতে পেল গণিত পড়ানো হচ্ছে, তার কাছে মনে হল বিষয়টা খুব চমৎকার। তখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের গিয়ে জানাল সে গণিতে স্নাতক পড়তে চায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় অধ্যাপকেরা বলল, যে মানুষ চোখে দেখতে পায় না সে কখনও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের গণিতে স্নাতক ডিগ্রি নিতে পারবে না।

মেয়েটি বলল, "এটা তোমাদের একটা থিওরি, আমাকে দিয়ে এই থিওরির একটা এক্সপেরিমেন্ট করে দ্যাখো তোমাদের থিওরিটা সঠিক কী না!'' কাজেই প্রফেসররা তাকে গণিত পড়তে দিতে বাধ্য হল এবং সে সকল থিওরিকে ভুল প্রমাণিত করে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে বের হয়ে এল!

আমি তখন তাকে জিজ্ঞেস করলাম, লন্ডন শহরে তুমি কেমন করে যাতায়াত কর? সে বলল, সে সম্পূর্ণ একা একা পুরো লন্ডন শহর চষে বেড়ায়, সে জন্যে তার দরকার ছোট একটা কম্পিউটার ট্যাবলেট, আর কিছু নয়!

এই বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তি, বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তির এমন কিছু নূতন আবিষ্কার এখন সবার হাতে হাতে চলে এসেছে যেগুলো প্রতিবন্ধী মানুষের সামনে একেবারে নূতন একটি দিগন্ত খুলে দিচ্ছে। একটি উন্নত দেশের তুলনায় আমাদের দেশের মানুষের প্রয়োজন ভিন্ন, কাজেই এর সমাধানও হতে হবে ভিন্ন আর সেই কাজটুকু করতেও হবে আমাদের নিজেদের। এর মাঝে সেটি শুরু হয়েছে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা সেটা করার চেষ্টা করি। অন্যরাও যদি করে আমার মনে হয় অনেক কিছু হতে পারে।

প্রতিবন্ধী মানুষের জীবন নিয়ে আমাদের কোনো আগ্রহ নেই। তাই তাদের লেখাপড়া নিয়ে আমাদের আগ্রেহ থাকবে সেটি নিশ্চয়ই আমরা আশা করতে পারি না। প্রতিবন্ধী বাচ্চারা যতটুকু সম্ভব সাধারণ বাচ্চাদের সঙ্গে লেখাপড়া করে বড় হবে সেটা সবার স্বপ্ন। এই মুহূর্তে তার ব্যবস্থা নেই, কিন্তু আইন করে সেই ব্যবস্থা করা হবে আমরা তার অপেক্ষা করে আছি।

যেটি করা কঠিন সেটি করতে সময় লাগতে পারে। কিন্তু যেটি করা সোজা সেটি যদি করা না হয় তাহলে আমরা হতাশা অনুভব করতে থাকি। যেমন ধরা যাক, ব্রেইল বইয়ের ব্যাপারটি। কথা ছিল দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বাচ্চাদের জন্যে ব্রেইল বই দেওয়া হবে, কিন্তু সেটি দেওয়া হল না। তখন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সংগঠনগুলোর সঙ্গে সঙ্গে আমরা অন্ততপক্ষে পাঠ্যবইগুলোর সফটকপির জন্যে এনটিসিবির সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করলাম যেন নিজেদের উদ্যোগে সেগুলোকে ব্রেইল করে নেওয়া যায়।

বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে প্রত্যেকটা পাঠ্যবই পিডিএফ করে তাদের ওয়েবসাইটে রাখা আছে, যে কেউ সেটা ডাউনলোড করে নিতে পারবে। কিন্তু ব্রেইলে ছাপানোর জন্যে যে রকমভাবেই ট্রেক্সট ফাইল দরকার সেটি কিছুতেই পাওয়া গেল না।

বিষয়টি যখন জানাজানি হল তখন এই দেশের তরুণেরা নিজেদেরা সেই বইগুলো নূতন করে টাইপ করে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। প্রতি বছর এই দেশের বাচ্চারা নূতন বই হাতে মুখে বিশাল একটা হাসি নিয়ে বাড়ি যায়– এর চাইতে সুন্দর দৃশ্য পৃথিবীতে আর কিছু হতে পারে বলে আমার জানা নেই।

ঠিক একই সময় সবরকম চেষ্টা করেও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বাচ্চাদের লেখাপড়ার জন্যে, পুরো ক্লাসের জন্যে একটা করে ব্রেইল বই আমরা তুলে দিতে পারি না! শুধু তাই নয়, যখন প্রক্রিয়াটা আমরা নিজেরাই করতে চাই তখনও এনসিটিবি থেকে আমরা সহযোগিতা পাই না।

আগামী ৩ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। আমাদের দেশের মিডিয়াগুলো দিনটিকে গুরুত্ব দিয়ে নিয়ে সবার ভেতরে এক ধরনের সচেতনতা তৈরি করবেন বলে খুব আশা করে আছি। প্রতিবন্ধী মানুষদের আমাদের পাশাপাশি নিয়ে এসে একসঙ্গে কাজ করার গন্তব্যটুকুতে আমরা এখনও পৌঁছাইনি। যাত্রা শুরু করলে একসময় পৌঁছানো যায়, আমরা এখনও যাত্রা শুরু করিনি।

সবাই মিলে যাত্রাটুকু শুরু করি। কাজটুকু খুবই সহজ, শুধু মনে রাখতে হবে প্রতিবন্ধী মানুষেরা আসলে প্রতিবন্ধী নয়, আসলে তারা মানুষ।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল : লেখক ও অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।