নিশা দেশাই কী দিশা দিয়ে গেলেন

আমানুল্লাহ কবীর
Published : 21 Nov 2013, 11:18 AM
Updated : 21 Nov 2013, 11:18 AM

দেশের উত্তাল রাজনীতির মধ্যে গত রোববার থেকে মঙ্গলবার এই তিন দিনে আচমকা একের পর এক কয়েকটি ঘটনা ঘটে গেল। জনগণ গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে এসব ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছে এবং আলোচনা-পর্যালোচনার খোরাক হয়েছে রাজনৈতিক মহলসহ বিভিন্ন মহলে। এসব ঘটনার উদ্ভব শেষ পর্যন্ত দেশকে কোন দিকে নিয়ে যাবে, তাদের প্রত্যাশার অনুকূলে না প্রতিকূলে? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে তারা আশা-হতাশার দোলাচলে। শুভ সম্ভাবনার আলো ঝিলিক দিয়ে জ্বলে উঠে আবার নিভে যাচ্ছে। আলো-আঁধারের এ এক অভিশপ্ত খেলা।

ঘটনাগুলো দৃশ্যমান হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালের ঢাকা সফরের শুরু থেকে। তিনি রোববার বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং রাতে বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন। নিশা দেশাইয়ের সঙ্গে আলোচনার পরই প্রধানমন্ত্রী যান বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। রাষ্ট্রপতির কাছে তিনি তার নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব পেশ করেন এবং রাষ্ট্রপতি তাকে নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনার অনুমতি প্রদান করেন।

সিদ্ধান্ত হয় পরের দিন সোমবার বিকেলে সর্বদলীয় সরকারে অন্তর্ভূক্ত নতুন মন্ত্রীদের শপথ অনুষ্ঠিত হবে। ওই রোববার সকালেই দীর্ঘদিন আলোচিত-সমালোচিত মানি লন্ডারিং বা অর্থপাচার মামলায় আদালত খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানকে বেকসুর খালাস দেয়।

সোমবার বিকেলে সর্বদলীয় সরকারের নতুন মন্ত্রীদের শপথ অনুষ্ঠানের পর শোনা গেল আরেক চমকপ্রদ খবর– খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎ চেয়েছেন। পরের দিন মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক চলে এক ঘণ্টা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বৈঠকের পর দরবার হল থেকে খালেদা জিয়া যখন বের হয়ে আসেন, তার চোখেমুখে ছিল কিছুটা স্বস্তির ভাব।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অপেক্ষমান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে তারা রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ ও উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই বর্তমান সমস্যার সমাধান হবে বলে রাষ্ট্রপতি আশা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, তাদের দাবি ও বক্তব্য সরকারকে দ্রুতই জানাবেন।

তিনদিনের এসব ঘটনার পরম্পরা লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে যে, কোনো ঘটনাই বিচ্ছিন্ন নয়, একটার সঙ্গে আরেকটার যোগসূত্র রয়েছে। নিশা দেশাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কানে কী মন্ত্র পাঠ করেছেন, তা আমরা জানি না, কিন্তু ফলশ্রুতিতে যেসব ঘটনা ঘটেছে তা দেখার সুযোগ আমাদের হয়েছে।

নিশা দেশাই বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটকে তিনি এতটাই গুরুত্ব দিয়েছেন যে দায়িত্ব নেওয়ার পর শপথ গ্রহণ না করেই ঢাকা সফরে এসেছেন। অবশ্য তিনি ঢাকা এসেছিলেন টোকিও হয়ে, যেখানে জাপান, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের ত্রিদেশীয় বৈঠক ছিল। এই তিনটি দেশই বিশেষত ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র নিজ নিজ স্বার্থ বিবেচনায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট নিয়ে উদ্বিগ্ন ও মীমাংসার জন্য তৎপর।

সুতরাং টোকিওতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাংলাদেশ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, এটাই স্বাভাবিক এবং ওয়াকিবহাল মহলও এমন কথাই বলছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট সমাধানের উপায় নিয়ে দিল্লি ও ওয়াশিংটনের মধ্যে যে মতভিন্নতা দেখা দিয়েছিল, অনুমান করা যায়, সে ব্যাপারে সমঝোতা হওয়ার পরই ঢাকায় নিশা দেশাইয়ের মন্ত্র কাজ করতে শুরু করেছে।

দীর্ঘদিন নীরব থাকার পর কয়েকদিন আগে ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণও এমন আভাস দিয়ে বলেছিলেন, তার সরকার বাংলাদেশে একটা অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতেই আগ্রহী। খালেদা জিয়াকেও নিশা মন্ত্র দিয়েছেন, আর সম্ভবত সেজন্যই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে খালেদা জিয়ার বৈঠক।

রাষ্ট্রপতি দেশের অভিভাবক বটে, তবে সংবিধান অনুসারে তিনি কেবল রাষ্ট্রের অলংকার। ১৯৯১-এ নির্বাচিত পার্লামেন্টে সংবিধান সংশোধন করে এ অলংকার তৈরি করেছিলেন খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা। আজকের যে রাজনৈতিক সংকট, তা বস্তুত জাতীয় দুর্যোগ এবং এই দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য অভিভাবক হিসেবে তিনিই শেষ ব্যক্তি।

রাষ্ট্রপতি কোনো দলীয় ব্যক্তি নন, কিন্তু তিনি দলের মনোনীত। সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ বিএনপির প্রাথমিক সদস্যও ছিলেন না, কিন্তু ক্ষমতাসীন বিএনপির মনোনীত ব্যক্তি ছিলেন। যেজন্য তিনি জাতির চরম দুঃসময়েও খালেদা জিয়ার প্রতি ব্যক্তিগত আনুগত্যের কারণে রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

এই দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে তার হাত ধরেই সেনাবাহিনী সমর্থিত এক-এগারোর অবৈধ ফখরুদ্দিন সরকার রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিল। এখন সাংবিধানিকভাবে নির্দলীয় ব্যক্তি হলেও আবদুল হামিদ আওয়ামী লীগের একজন প্রবীণ নেতা। রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ হলে তিনি হয়তো আওয়ামী লীগেই ফিরে যাবেন। তিনি কি দলের নেত্রী শেখ হাসিনার ইচ্ছা-অনিচ্ছার উর্ধ্বে ওঠে জাতির এই দুর্যোগ মোকাবিলায় তার ভূমিকা রাখতে পারবেন? অতীতের অভিজ্ঞতার কারণে জনগণের মনে এ প্রশ্ন রয়েছে।

সব সন্দেহ-সংশয় থাকা সত্ত্বেও এ কথা বলতে হবে যে, রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে বর্তমান সংকট ফয়সালায় উদ্যোগ গ্রহণের জন্য তিনিই একমাত্র উপযুক্ত ব্যক্তি। রাস্তায় সংঘাতের পরিবর্তে দুই বিবদমান রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসার উদ্যোগ গ্রহণ করলে যে সংবিধান তাকে হাতকড়া পরিয়ে রেখেছে, সেই সংবিধানের মালিক জনগণই তাকে অভিনন্দন জানাবে।

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে খালেদা জিয়ার বৈঠক কেন্দ্র করে প্রাসঙ্গিক নানা প্রশ্ন ও আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে। যে লিখিত বক্তব্য রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তর করা হয়, তা সাংবাদিকদের কাছে বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়নি। রাষ্ট্রপতি তাদের কী বলেছেন, মির্জা আলমগীর সাংবাদিকদের সংক্ষেপে কেবল সেটুকুই বলেছেন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট কি কোনো ছাড় দিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকে গিয়েছে, না কি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনড় রয়েছে?

মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি সর্বদলীয় সরকারে যোগ দিলে তাদের এক ডজন মন্ত্রী দেওয়া হবে। কী ধরনের নির্বাচনকালীন সরকার হবে, এই মূল বিরোধের মীমাংসার পরই কেবল মন্ত্রিত্ব ভাগাভাগির বিষয়টি আসে। কিন্তু ওবায়দুল কাদেরের প্রস্তাব শুনে মনে হয়, সর্বদলীয় সরকার গঠনের পর নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়ে গেছে, এ নিয়ে আলোচনার আর কোনো সুযোগ নেই।

নিশা দেশাইয়ের সঙ্গে আলোচনার পরই তাড়াহুড়ো করে শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠন করলেন কেন, এ নিয়ে ইতোমধ্যে নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে। প্রথমেই যে প্রশ্নটি ওঠে তা হল: সর্বদলীয় সরকার গঠনের বিষয়টি কি তিনি নিশা দেশাইকে অবহিত করেছিলেন? যদি তা করা হয়ে থাকে, তবে তাতে কি তিনি সম্মতি দিয়েছিলেন? যদি সম্মতি দিয়ে থাকেন– যা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করেন– তাহলে নির্বাচনকালীন সরকার কী ধরনের হবে, মূল বিরোধের বিষয়টির ফয়সালা তখনই হয়ে গেছে।

পাল্টা প্রশ্ন আসে, তাহলে খালেদা জিয়াকে তিনি এ ব্যাপারে কী বলেছিলেন? তিনি খালেদা জিয়াকে সমঝোতার জন্য যা-ই বলে থাকুন, বিরোধী দলের সঙ্গে বিষয়টি আলোচনা ও ফয়সালার পূর্বেই তড়িঘড়ি করে সর্বদলীয় সরকার গঠনের পেছনে দুটি কৌশল কাজ করেছে। প্রথমত, সর্বদলীয় সরকার গঠন করে বিএনপির ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করা, যাতে তারা নির্বাচনকালীন এই সরকার পদ্ধতি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। দ্বিতীয়ত, গ্রহণ না করে নির্বাচন বর্জন করলে বিএনপিকে বাদ দিয়েই নির্বাচন অনুষ্ঠান করা।

শেখ হাসিনা কথায় কথায় সংবিধানের দোহাই দিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নাকচ করলেও যে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠন করেছেন, সংবিধানের কোথাও তার উল্লেখ নেই। বিএনপি একে সংবিধানপরিপন্থী আখ্যায়িত করেছে। যে মহাজোট সরকার বর্তমানে রয়েছে, কেবল তার নামবদল করে নামকরণ করা হয়েছে সর্বদলীয় সরকার– নতুন কোনো দল তাতে অন্তর্ভূক্ত করা সম্ভব হয়নি। কিংবা বর্তমান সরকার ভেঙে দিয়েও কোনো নতুন সরকার গঠন করা হয়নি।

বর্তমান মন্ত্রিপরিষদের কয়েকজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীকে বাদ দিয়ে তাদের পরিবর্তে নতুন কয়েকটি মুখ যোগ করা হয়েছে, যা যে কোনো সময় করার সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর রয়েছে। এটা যে নতুন বোতলে পুরাতন মদ তাও নয়; বরং পুরাতন বোতলে পুরাতন মদ রেখেই তার লেবেল পরিবর্তন করা হয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা জনগণকে বোকা ঠাওরে এভাবেই ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করেন। আসলে জনগণের তুলনায় তারা নিজেরা যে বোকা ও অনগ্রসর, এটা তারা বুঝেন না।

যাহোক, বিএনপি এখন কী করবে? এটা তর্কাতীত ব্যাপার যে, আওয়ামী লীগকে ছাড়া যেমন কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়, তেমনি বিএনপিকে বাদ দিয়েও কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে না। এই দুই দলের কাউকে বাদ দিয়ে নির্বাচন হলে তা হবে একদলীয় নির্বাচন। আর গণতন্ত্রে একদলীয় নির্বাচন কোনো নির্বাচন নয়।

রাজনৈতিক নেতা ও পর্যবেক্ষকদের অনেকেই প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে বলছেন যে, বিএনপি নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার ব্যবস্থা যদি মেনে নিতে রাজিও হয়, তবে তা শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রিত্ব বহাল রেখে নয়। সর্বদলীয় সরকারের প্রধান কে হবেন– এটাই শেষ পর্যন্ত দরকষাকষির একমাত্র ইস্যু হতে পারে।

কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র দলগুলো কি সর্বদলীয় সরকার ব্যবস্থা মেনে নেবে? কারণ তারা জানে, এর অর্থ হবে তাদের জন্য রাজনৈতিক হারিকিরি। তাহলে নির্বাচনের আগেই বিএনপি বিজয়োল্লাস করবে। নির্বাচনের রাজনীতি এমনই একটা জটিল অবস্থার মধ্যে প্রবেশ করেছে। চ্যালেঞ্জ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি, দুই দলের জন্যই। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ঝুঁকির কথা জেনেও নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু করে সকল প্রস্তুতি নিচ্ছে।

পক্ষান্তরে বিএনপি এখনও দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছে। বিএনপির সামনে এখন দুটি পথ খোলা আছে– এক. নির্বাচন বর্জন করে আন্দোলন করা, যা দেশের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করবে; দুই. সর্বদলীয় সরকারে যোগ না দিয়েই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা। তাহলে নির্বাচনের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে সব দায়দায়িত্ব নিয়েই এককভাবে কাজ করতে হবে শেখ হাসিনার সর্বদলীয় সরকারকে।

এটা কেবল একটা বিকল্প চিন্তা। সর্বদলীয় সরকারে যোগ না দিলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা যাবে না– সংবিধানে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। রাষ্ট্রপতির উদ্যোগে যদি অনুকূল পরিবেশে সংলাপের আয়োজন হয়, তাহলে এক সমস্যার একাধিক সমাধানের খোঁজ পাওয়া কঠিন কিছু নয়। প্রতিবন্ধক সংবিধান নয়, সংবিধানপ্রণেতারা। নিশা দেশাই দুই নেত্রীর কানে যে মন্ত্রই পাঠ করে থাকুন না কেন, নিজেদের সমস্যা দুই নেত্রীকেই সমাধান করতে হবে।

গোড়াতেই মামলায় তারেক রহমানের বেকসুর খালাসের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কারণেই, বিশেষত যে সময় তিনি রেহাই পেলেন, তখন আমাদের রাজনীতিতে চলছে শ্বাসরুদ্ধকর অচলাবস্থা। দেশের রাষ্ট্রক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি রাজনৈতিক পরিবারের একটির সন্তান তারেক রহমান। জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার সন্তান ছাড়াও তিনি বিএনপির বস্তুত দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা ও নীতিনির্ধারক।

আরেক মানি লন্ডারিং বা অর্থপাচার মামলায় তার কনিষ্ঠ ভ্রাতা আরাফাত রহমান কোকোর ছয় বছরের কারাদণ্ড হয়েছে তার অনুপস্থিতিতে। বিশেষত তারেকের বিরুদ্ধে সত্য-মিথ্যা বিষয় অবতারণা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার দলের নেতানেত্রী ও সমর্থকরা যেসব বক্তৃতা-বিবৃতি এ যাবত দিয়েছেন এবং এই ঘরানার পত্রপত্রিকা যেসব খবর ও লেখালেখি প্রকাশ করেছে, সেসব মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হলে দশটনী ট্রাক লাগবে বহন করার জন্য।

আদালতের বিচারের আগেই তারেকের বিচার করেছে রাজনীতিকরা ও মিডিয়া। দেশি-বিদেশি তদন্ত সংস্থা তার বিরুদ্ধে অর্থপাচারের সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করেছে আদালতে, কিন্তু আদালতের সন্তুষ্টি বিধান করতে পারেনি। আদালতের রায় ছিল তার শত্রুপক্ষের ওপর বজ্রপাতের মতো, আর মিত্রপক্ষের ওপর গ্রীষ্মের দাবদাহে বৃষ্টির মতো। উভয় পক্ষই বিস্মিত- কেউ ক্ষোভে, কেউ আনন্দে।

তারেককে গ্রেফতার করা হয়েছিল সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দিনের অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয় বর্তমান সরকারের সময়। চিকিৎসার জন্য জামিনে তারেক এখন লন্ডনবাসী। খালেদা জিয়া শেখ হাসিনা সরকার ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে পাল্টা দুর্নীতির অভিযোগ করলে তিনি তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, 'চোরের মায়ের বড় গলা'।

শেখ হাসিনার বক্তব্য থেকেই বোঝা যায় তারেক ও কোকোর বিরুদ্ধে অভিযোগ যা-ই থাক, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য শতভাগ কাজ করেছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে, জনসমক্ষে জিয়া পরিবারের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন করে এককভাবে মুজিব পরিবারের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। খালেদা জিয়া ও তারেক-কোকোর বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্য-মিথ্যা বিচারের চেয়ে দেশের সাধারণ মানুষ এসব অভিযোগের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেকেই বড় করে দেখেছে। এর কারণ এক-এগারোর পর জিয়া পরিবার ও বিএনপি নেতানেত্রীদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন।

শেখ হাসিনা সরকারের সময় দ্বিতীয় দফায় সে অত্যাচার-নির্যাতন অব্যাহত থাকে। শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণের কিছুদিন পরেই খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্ট বাসা থেকে উচ্ছেদ করা হয় এবং তাকে ও বিএনপি নেতানেত্রীদের জেলজুলুমসহ নানাভাবে হয়রানির পন্থা অবলম্বন করা হয়।

তারেকের বন্ধু মামুনের পাচার করা অর্থ সিঙ্গাপুরের ব্যাংকে গচ্ছিত ছিল। আদালতে প্রমাণিত হয়েছে যে, এই অর্থ থেকে তারেক চেকের মাধ্যমে প্রায় ২০ কোটি টাকা উত্তোলন করেছেন। কিন্তু অর্থপাচারের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন, এটা প্রমাণিত হয়নি।

সমালোচকদের যুক্তি, এর অর্থ তারেক পাচারকৃত অর্থের ভাগ নিয়েছেন। সুতরাং তার সংশ্লিষ্টতা পরোক্ষভাবে হলেও রয়েছে। অর্থপাচারের অভিযোগ থেকে রেহাই পেলেও তিনি নৈতিক দায় থেকে মুক্তি পাননি। তারেকের বিরুদ্ধে আরও কয়েকটি মামলা রয়েছে। এসবের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ শেখ হাসিনার ওপর বোমা হামলার মামলায় তিনি আসামী। এ সরকারের সময়ই এ মামলা রজু করা হয়।

আমাদের দেশে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অনেক মামলা হয়, আবার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই এসব মামলার রায় হয়। তারেকের মামলার রায়ের পেছনে এমন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কাজ করেছে কিনা, সে প্রশ্ন আজ অনেকের মুখেই। লক্ষ্যণীয় যে, তারেকের মামলার রায়ে আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীরা ক্ষুব্ধ হলেও কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি। তারেক-কোকোর বিরুদ্ধে মামলায় খালেদা জিয়া কেবল অস্বস্তিতেই ছিলেন না, ক্ষুব্ধও ছিলেন। অর্থপাচারের মামলায় তারেক খালাস পাওয়ায় নিঃসন্দেহে খালেদা জিয়া অনেক স্বস্তিবোধ করছেন।

এ রায়ের মাধ্যমে কি রাজনৈতিক দরকষাকষির কোনো পূর্বশর্ত পূরণ করা হয়েছে? নাকি আরও কোনো সুদূরপ্রসারী ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে? যেটাই হয়ে থাক, সহিংসতা, রক্তপাত, ভাঙচুর অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তায় নিরাপত্তাহীন ও উদ্বিগ্ন দেশবাসী রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য দিন গুণছে।

ছাড় দিয়েই সমঝোতা করতে হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে গণভবনে না গিয়ে খালেদা জিয়া ভুল করেছিলেন। বঙ্গভবনে গিয়ে তিনি প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। সংকট সমাধানের জন্য এটা তার আন্তরিকতার পরিচায়ক।

নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠনের পরেও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আলোচনার দরজা খোলা আছে। এই খোলা দরজা দিয়েই রাষ্ট্রপতি দুই বিবদমান পক্ষকে সংলাপের টেবিলে বসানোর সার্বিক প্রচেষ্টা গ্রহণ করবেন, এটা আজ কেবল জনগণের আশা নয়, দাবি। কারণ সাংবিধানিক উপায়ে এই চেষ্টাই হবে সম্ভবত শেষ চেষ্টা।

আমানুল্লাহ কবীর: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সিনিয়র এডিটর।