হায়রে দেশি সাহেব-মেমসাহেবদের ইংরেজি সাহিত্যচর্চা!

আজফার হোসেনআজফার হোসেন
Published : 19 Nov 2013, 11:55 AM
Updated : 19 Nov 2013, 11:55 AM

আমি ঢালাওভাবে ইংরেজিতে অ-ইংরেজদের সাহিত্যচর্চার বিরুদ্ধে নই। কে কোন্ পরিপ্রেক্ষিতে কী কারণে কী কায়দায় কী লিখছে, সেই সব বিষয় অবশ্যই বিবেচনায় রাখা দরকার বলে আমি মনে করি। আর যারা একটি নয়, দুটি বা এমনকি তিনটি ভাষায় লেখার ক্ষমতা রাখেন, তাদের বরং আমি বাহবাই দিই। যাদের শিখবার সুযোগ আছে (এখানে শ্রেণির প্রশ্নটা থাকে বটে), তাদের জন্য মাতৃভাষার পাশাপাশি অন্যান্য ভাষা শেখার প্রয়োজনীয়তারও আমি গুরুত্ব দিয়ে এসেছি বরাবর।

তবে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করে এবং বাংলাদেশেই জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়ে ওই বাংলাদেশেই বসবাস করে যারা তথাকথিত সাহিত্যচর্চার জন্য কিংবা সৃষ্টিশীল বা অন্যান্য লেখালেখির জন্য ইংরেজি ভাষাকে প্রধান বা এমনকি একমাত্র মাধ্যম হিসেবে— লক্ষ্য করুন আবারও– প্রধান বা এমনকি একমাত্র মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন, তাদের নিয়ে প্রশ্ন থাকে।

আমি এইসব দেশি ইংরেজি সাহিত্যচর্চাকারীর রাজনৈতিক-আদর্শিক অবস্থান নিয়ে একাধিক জায়গায় কথা বলেছি এবং লিখেছিও। সেই কারণে গালিগালাজও শুনেছি। 'কথায় কথায় রাজনীতি মারায়' বলে যারা আমাকে গালিগালাজ করে এসেছে (যেন ওই কথা বলার ভেতর দিয়ে তারাও তাদের রাজনীতি মারায় না!) তাদের কেউ কেউ আবার 'নান্দনিকতার' দোহাইও পেড়ে থাকে।

তো, ঠিক আছে, লেখার নান্দনিকতার প্রশ্নেই আসি; আসি তার মান ও গুণের প্রশ্নে। ধরা যাক বাংলাদেশের ইংরেজি কবিতার কথা, বাংলা কবিতার কথাও। বাংলা কবিতা মানেই ভালো কবিতা সেটা মোটেই বোঝাতে চাচ্ছি না। তবে দুর্দান্ত ভালো সব বাংলা কবিতার কথা বাদ দিয়েও কেবল যদি গড়পড়তা বাংলা কবিতার কথা বলি, সেগুলো পড়ার পর আমি যখন 'ভালো'-বলে-সুপারিশকৃত বাংলাদেশের ইংরেজি কবিতাগুলো পড়ি, তখন ধপাস করে এক ধরনের 'অ্যান্টি ক্লাইমেক্স'-এর অভিজ্ঞতা লাভ করি।

এভাবেই ইংরেজি কবিতাগুলোকে বেখাপ্পা, ম্রিয়মান, খানিকটা অবশ্য চটকদার এবং অবশ্যই সীমিত ও দুর্বল মনে হয়। অবশ্য ইংরেজি ভাষার দেশি কবিদের কেউ কেউ ইংল্যান্ড ও আমেরিকার কিছু পত্রপত্রিকায় এবং এমনকি বেশ পরিচিত সংকলনেও কবিতা ছাপিয়েছেন। সেখানে যে 'টোকেনিজম' কাজ করেনি, তা নয়। আর বিদেশে কবিতা ছাপা হয়েছে বলেই যে তাদের কবিতাগুলা (আমি কিন্তু অনুবাদের কথা বলছি না) বৈশ্বিক পরিসরে দারুণভাবে পাঠ করা হচ্ছে বা আলোচনা করা হচ্ছে, তাও তো নয়।

সত্যি কথা বলতে কি, গড়পড়তা বাংলা কবিতার পাশে বাংলাদেশের ইংরেজি কবিতা দাঁড়াবার কোনো ক্ষমতাই রাখে না। অথচ ইংরেজিতে লিখে বলে তাদের 'আমি-কি-হনুরে' এই ভাবটা হরহামেশাই দেখা যায়। ফিকশনের ক্ষেত্রে প্রায় একই কথা খাটে। বাংলাদেশের শক্তিশালী কথাসাহিত্যিকদের— ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকারদের (আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা তাঁর মতো ব্যতিক্রমের কথা না হয় বাদই দিলাম)— পাশাপাশি দাঁড়াবার মতো কোনো শক্তিশালী দেশি-ইংরেজ কথাসাহিত্যিক তেমন একটা এসেছেন কি? তাহমিমা আনাম? (আর মনিকা আলী তো দেশে থাকেন না)।

এদের কাজের চেয়েও যে শক্তিশালী কাজ বাংলা সাহিত্যে হাজির আছে, তা বোধ করি দীর্ঘ বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে বোঝাবার দরকার নাই। হায়রে দেশি সাহেব-মেমসাহেবদের ইংরেজি সাহিত্যচর্চা!

এবারে 'হে ফেস্টিভ্যাল' নিয়ে দুয়েকটা কথা। হে হে হে। নাম বটে! বাংলা একাডেমীতে পশ্চিমা দুনিয়ার এক অখ্যাত (আর বিখ্যাত হলেই-বা কী?) হে ফেস্টিভ্যাল? এর মধ্যেই অনেকেই সমালোচনা করেছেন এই ফেস্টিভ্যালের। তাদের সঙ্গে সংহতি এবং কথা না বাড়িয়ে এইটুকুই বলি– পয়সাওয়ালা ছেলেমেয়েদের ফুটানি-মারা অথচ নিম্নমানের ইংরেজি সাহিত্যচর্চার সঙ্গে যখন ঔপনিবেশিক হীনমন্যতা মেলে এবং যখন কর্পোরেট আগ্রাসনে টাকা সাহিত্যের কান মলে— তখন তো বাংলা একাডেমী অনেক ধরনের আবর্জনারই ডাম্পিং গ্রাউন্ড হতে বাধ্য।

তাই তো নিদেনপক্ষে দরকার সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন, যেমন দরকার যে কোনো নিপীড়নের বিরুদ্ধেই আন্দোলন।

আজফার হোসেন: সাহিত্যসমালোচক, অনুবাদক এবং অধ্যাপক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে গ্র্যান্ড ভ্যালি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে বর্তমানে অধ্যাপনা করছেন। বাংলা এবং ইংরেজি, উভয় ভাষাতেই শিল্পতত্ত্ব, দর্শন ও সংস্কৃতি বিষয়ে লেখালেখি করেন।