মোরা একই হালের দুইটি বলদ গো হিন্দু-মুসলমান

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 17 Nov 2013, 07:40 AM
Updated : 17 Nov 2013, 07:40 AM

কবি নজরুল একসময় এদেশের হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি দেখে অনেক তৃপ্তি নিয়ে লিখেছিলেন, 'মোরা একই বৃন্তের দুইটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান।' নজরুল মরে গিয়ে বেঁচেছেন। এখন যদি তিনি বেঁচে থাকতেন তবে তাকে হয়তো লিখতে হত, 'মোরা একই হালের দুইটি বলদ গো, হিন্দু-মুসলমান।'

হ্যাঁ, এদেশে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি এখন অনেকটাই ষাঁড় কিংবা বলদের গুঁতোগুঁতিতে পর্যবসিত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় জোয়াল যতক্ষণ ঘাড়ের উপর শক্ত করে বাঁধা থাকে ততক্ষণ আমরা একসঙ্গে 'হালচাষ' করি, পাশাপাশি হাঁটি, কিন্তু যখনই রাষ্ট্রীয় 'জোয়াল'টা একটু আলগা হয়ে যায়, তখনই শুরু হয় 'গুঁতোগুঁতি'।

গুঁতোগুঁতি না বলে 'গুঁতানো' বলাটাই সঙ্গত। কারণ এখন একপক্ষই গুঁতিয়ে চলে। যে যখন যেখানে যতটুকু হিন্দু-গুঁতানোর সুযোগ পায় তার পুরোটাই সদ্ব্যবহার করে। অবস্থা এতটাই বেগতিক যে, ফুটবল খেলা দেখা নিয়ে সংঘাতের জের ধরে হিন্দুবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ কাজটি করেছে হাজার হাজার মানুষ সংগঠিত হয়ে।

মাত্র কিছুদিন আগেই পাবনার সাঁথিয়ায় একটি গুজব কেন্দ্র করে হিন্দুদের বাড়িঘরে আক্রমণ করা হয়। যখনই হিন্দুবাড়িতে আক্রমণের দরকার হয়, তখনই একশ্রেণির মানুষ সংগঠিত ও সংঘবদ্ধ হয়ে যায়। থানা-পুলিশ-আইন কোনো কিছুই এই আক্রমণ ঠেকাতে পারে না। এ ব্যাপারে সামাজিক প্রতিরোধও এখন একেবারেই আলগা।

সম্প্রতি ফেসবুকে আমার এক বন্ধু গভীর হতাশা ব্যক্ত করে লিখেছেন,

''জ্বর এসেছে? ধরছে মাথা? ভাঙতে কিছু ইচ্ছে করে?/গাল দিয়েছে? জমেছে রাগ? পেটের ভেতর কেমন করে?/আরে বোকা! বলবে কে কী? দাও না আগুন হিন্দুর ঘরে!''

বর্তমানে পরিস্থিতি যেন এমনটাই দাঁড়িয়েছে। আমরা যখন বলি বাংলাদেশ ধর্মীয় সম্প্রীতির দেশ– তখন কি এসব সাম্প্রদায়িক ঘটনার কথা বিস্মৃত হয়ে বলি? যারা বলি এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা– তারা কি নিজেদের প্রবোধ দিই মাত্র? এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে, তাদের বাড়িঘরে আগুন দিচ্ছে, এই দৃশ্য দেখার পরও কীভাবে বলি যে বাংলাদেশের মানুষ সত্যিই সাম্প্রদায়িক নয়?

এদেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একগাদা 'অপযুক্তি' শোনা যায়। এমনকি 'শিক্ষিত-সচেতন'রা পর্যন্ত মনে করেন– এ দেশে হিন্দুরা 'খুব ভালো' আছে, সংখ্যালঘু ইস্যুটা বিশেষ উদ্দেশ্যে সামনে আনা হয়, এদেশের হিন্দুদের মধ্যে দেশপ্রেম নেই, এদের দেহ থাকে বাংলাদেশে, কিন্তু মন ভারতে, এরা বাংলাদেশের সম্পদ ভারতে পাচার করে!

পাশাপাশি এটাও ভাবেন এবং বলেন যে– ভারতে মুসলমানরা যতটা খারাপ অবস্থায় আছে, সে তুলনায় বাংলাদেশে হিন্দুরা 'রাজার হালে' আছে, এরা আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়, বাড়াবাড়ি করে, এদের পিটিয়ে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত!

বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে, এই কথাগুলো যারা বলেন এবং বিশ্বাস করেন তারা অন্য কোনো যুক্তি-প্রমাণ-তথ্যের ধার ধারেন না।

এই দেশে জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আপাতত একটা বিরাট যাঁতাকলের মধ্যে আছে। নিয়মিত পিষ্ট হলেও করার কিছু তো নেই-ই, বলারও কিছু নেই। কারণ বললে তা কেউ কানে তোলে না। উল্টো এমন সব কথা বলে যে, তাতে বোবা-কালা হয়ে বেঁচে থাকাটাই শ্রেয় মনে হয়।

১৯৭৫ সালের পর বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িকতা, হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির পরিবর্তে এক ধরনের সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণ রাজনীতিচর্চা প্রাধান্য পেয়েছে। ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও চর্চার জায়গা থেকে ক্রমশ রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে থাবা প্রসারিত করেছে। এখন ধর্মকে রাজনীতির বাহন বানিয়ে রাষ্ট্রীয় আচারে পরিণত করার দাবি পর্যন্ত উচ্চারিত হচ্ছে। আমরা এখন আর 'মানুষ' পরিচয় দিতে তেমন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না। কে 'কতটা' হিন্দু বা মুসলমান– সেটাই আমরা মূখ্য করে তুলছি।

এজন্যই নিজের ধর্ম আর ধর্মপরিচয়কে বড় করে দেখতে গিয়ে অন্যের ধর্ম ও ধর্মপরিচয়কে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছি। ফলে পারস্পরিক ঘৃণা, অশ্রদ্ধা আর অসম্মান বাড়ছে। আমরা মানুষ না হয়ে হচ্ছি ধর্মের 'বলদ'। আর বলদের মতো গুঁতানোর স্বভাব ঊর্ধ্বে তুলে ধরছি। আমাদের মধ্যে এমন একটা সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা ও দুষ্টবুদ্ধি সারাক্ষণ তাড়া করে ফিরছে যে, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানদের আমরা স্থায়ী প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলছি।

বিশেষত হিন্দুদের কোনো কিছুই মেনে নিতে পারছি না। এমনকি তাদের উপস্থিতিও আমাদের অনেকের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই তো আমরা দেখছি প্রায়ই সংঘবদ্ধ মানুষের তীব্র ক্ষোভ হিন্দুদের বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে দিতে উৎসাহ জোগাচ্ছে।

আমরা মুখে যতই প্রেম, মানবিকতা, ঔদার্য, মহত্ব, ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি কপচাই না কেন, বাস্তবে কিন্তু ততটা মহৎ, উদার, মানবিক হতে পারি না। সংকীর্ণতা, বিদ্বেষ, ঘৃণা আমাদের চেতনা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আচ্ছন্ন করে রাখে। আমাদের মধ্যে প্রেম-মানবিকতা অবশ্যই আছে; কিন্তু ঘৃণা-বিদ্বেষ-হিংস্রতাও একেবারে কম নেই। আমাদের মধ্যে জাতিগত, সম্প্রদায়গত সম্প্রীতি যেমন আছে পাশাপাশি ভিন্ন জাতি, অন্য ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি বিদ্বেষও আছে।

মোটা দাগে বলতে গেলে আমাদের সমাজের মানুষগুলোকে স্বার্থপর, সংকীর্ণমনা, হিংসুটে, সাম্প্রদায়িকই বলতে হবে। আমাদের সমাজে এক পরিবারের কোনো সন্তানের সাফল্যে অন্য পরিবারের লোকজন সত্যিকার অর্থেই খুশি হয়েছেন, গর্বিত ও আনন্দিত হয়েছেন এমন দৃষ্টান্ত খুব একটা দেখা যায় না। বরং এতে তারা মনে মনে ভীষণ আহত হন। যে সাফল্য নিজের ঘরে, নিজের পরিবারে আসতে পারত, সেই সাফল্যের মুকুট অন্যের মাথায় শোভাবর্ধন করলে আমরা খুশি হতে পারি না, মেনে নিতেও পারি না।

নিজের বাইরে আমরা কাউকেই কোনো কিছু দিতে প্রস্তুত নই। নিজের দোষ বা অযোগ্যতা আমরা কখনও বিবেচনায় নিই না। নিজেকে দক্ষ ও যোগ্য করার জন্য চেষ্টাও করি না। কিন্তু অন্য কেউ যদি নিজের প্রতিভা, অধ্যবসায় ও যোগ্যতা দিয়ে কোনো কিছু অর্জন করে সেটাও আমরা মেনে নিতে পারি না। সংকীর্ণতা ও স্বার্থপরতার ভূত আমাদের সারাক্ষণ আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে।

আবার এক দলের সাফল্য অন্য দল মেনে নিতে পারে না। অন্য দলের কথা আর কী বলব, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিজের দলের লোকেরাই তা মেনে নিতে পারে না! তাই তো দলে দলে দলাদলি, নিজ দলে কোন্দল আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে।

নিজেদের সাফল্যের জন্য আমাদের দেশের নেতানেত্রীরা যে পরিমাণ শ্রম-মেধা ব্যয় করেন, তার চেয়ে বেশি শ্রম-মেধা খাটান অন্যের সাফল্য ঠেকানোর কাজে। অন্যের সর্বনাশ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা স্বস্তি পাই না। তাই তো আমাদের জাতীয় জীবনের দুর্গতিও কিছুতেই কমে না। দিন দিন তা চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েই চলে।

তাই দেখা যায়, বাংলাদেশে মৌলবাদী তৎপরতা বৃদ্ধি পেলে এদেশের হিন্দুরা যতটা উদ্বিগ্ন হন, ভারতে হিন্দু জঙ্গিদের উত্থানে ততটা বিচলিত হন বলে মনে হয় না। বরং অনেকের মনের মধ্যে এক ধরনের আনন্দের বুদবুদ লক্ষ্য করা যায়। তাদের ভাবখানা এমন, এপারে তো আমরা পিটুনি খাচ্ছি, ওপারে এখন তোমরা একটু ঠ্যালা বোঝ!

আবার আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, আমাদের অনেক প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ মুসলমান হামাস, লস্কর-ই-তৈয়বা, মুসলিম ব্রাদারহুড কিংবা আল-কায়েদার মতো জঙ্গি সংগঠনকে নিয়ে এক ধরনের গর্ব বা পুলক অনুভব করেন। টুইন টাওয়ারে হামলার পর হাজার হাজার নিরীহ আমেরিকান মারা গেলেও তাদের প্রতি শোক কিংবা সহানুভূতির চেয়ে আমাদের দেশের একশ্রেণির মানুষের মধ্যে আত্মতৃপ্তির ভাবই বেশি প্রকাশ পেয়েছে। অসংখ্য নিরীহ মানুষের মৃত্যু, এই হামলার ভবিষ্যৎ পরিণতি এসব বিষয় তলিয়ে না দেখে অনেক প্রগতিশীল পর্যন্ত 'আমেরিকার গর্ব খর্ব' হওয়ার আনন্দে বগল বাজিয়েছেন!

মৌলবাদ বা জঙ্গি তা সে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান যে দেশেরই হোক না কেন, সেটা যে কোনো সভ্য মানুষের জন্যই বিপদের– সে হুঁশ আমাদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থাকে না।

এখনও আমাদের দেশের মানুষদের মধ্যে আওয়ামী-চেতনা, বিএনপি-চেতনা, মুসলিম-চেতনা, হিন্দু-চেতনা যেভাবে কাজ করে সেভাবে মানবিক-চেতনা কাজ করে না। চলমান হরতালে যখন বোমায় কিংবা আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারা হয়, তখনও আমরা আক্রান্তের প্রতি সহানুভূতিশীল হই না, আক্রমণকারী নরপশুদের প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করি না। বরং আওয়ামী লীগের আমলে কতজন মরেছিল, সেই তথ্য সামনে এনে চলমান পাশবিকতা ও হত্যার বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করি!

আমরা এখনও ইরাকে আমেরিকান সৈন্য মারা গেলে খুশি হই, ইসরায়েলে ইহুদিরা নাস্তানাবুদ হলে প্রশান্তি লাভ করি, ভারত যদি পাকিস্তানের দ্বারা নাজেহাল হয় তাহলে আনন্দ পাই। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের কোনো ধনকুবের যদি জঙ্গি তৎপরতায় পৃষ্ঠপোষকতার দায়ে আটক হয় তাহলে ভীষণ হতাশ হই। বেপরোয়া ও উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করতে গিয়ে কোনো সৌদি শেখের যদি মৃত্যু হয় তাহলে আমরা স্বজন হারানোর বেদনা অনুভব করি।

আসলে নীতি-নৈতিকতা আদর্শ-মূল্যবোধহীন স্বার্থপর জীবনযাপন, সুবিধাবাদিতাকে তালিম দেওয়া, দীর্ঘদিনের বঞ্চনা-অভাব-শোষণ আমাদের মনমানসিকতাকে ভীষণ রকম সংকীর্ণ বানিয়ে ফেলেছে। আমরা এখন নিজেদের ব্যর্থতার জন্য কেবলই অন্যকে দায়ী করি। অনেক ক্ষেত্রে হয়তো এই দায়ী করাটা সঠিক; কিন্তু সব ক্ষেত্রে তা ঠিক নয়। তারপরও আমরা সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা ও বিদ্বেষের কারণে অন্য ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দল, সম্প্রদায় ও জাতির প্রতি আমাদের যাবতীয় ঘৃণা ও অভিসম্পাত ঠিকই জমা রাখি। সময়-সুযোগমতো তার বহিঃপ্রকাশও ঘটাই। এটা আমাদের সামগ্রিক অধঃপতন ও ব্যর্থতা।

আজকে শিক্ষিত ও সচেতনদের এ জন্য অবশ্যই নিজেদের ভূমিকা যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে দেখতে হবে। নিজেদের ব্যর্থতা আমাদের স্বীকার করতে হবে। রাজনৈতিক ব্যর্থতা আছে, আছে সামাজিক ব্যর্থতাও। যাঁরা ধর্মপ্রাণ, তাঁরা সকলকে বোঝাতে পারেননি যে, অন্য ধর্মাবলম্বীকে আঘাত করা ধর্মীয় নির্দেশের পরিপন্থী। যাঁরা ইহজাগতিক, যাঁরা নিত্য মানবতা, শুভাশুভ, ন্যায়-অন্যায়ের কথা বলেন, তাঁরাও সমাজে যথোচিত প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হননি।

ধর্ম নিয়ে যারা রাজনীতি করেন, তারা বরং ভেদবুদ্ধির মন্ত্র দিয়ে যাচ্ছেন মানুষের কানে। একাত্তরের ঐক্য কোথায় গেল? দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে অতি অল্পসময়ে রাজনৈতিক নেতারা মানুষকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, তেমন নেতৃত্ব আজ কোথায়!

আমরাই-বা আর কতকাল ঘুমিয়ে থাকব? সাম্প্রদায়িক পশুত্বকে আর কতকাল লালন করব? কত আর …