পদত্যাগ বিতর্ক ও চিলে কান নেবার কাহিনি

মুজতবা হাকিম প্লেটো
Published : 12 Nov 2013, 11:36 AM
Updated : 12 Nov 2013, 11:36 AM

প্রধানমন্ত্রীর কাছে মন্ত্রীরা 'পদত্যাগপত্র' জমা দিয়েছেন। শেখ হাসিনার হাতে এসব পত্র তুলে দেওয়ার দৃশ্য টেলিভিশনে দেখিয়েছে। এ নিয়ে শুরু হয়ে যায় বিতর্ক। তার্কিকরা বলছেন, পদত্যাগপত্র দিলেই সংবিধান অনুযায়ী তা তথন থেকেই কার্যকর। তাই এ ক্ষেত্রে বিধান অমান্য হচ্ছে। কিন্তু এ দাবি কি নির্বোধের নাকি পণ্ডিতের?

মন্ত্রিপরিষদের সভার পর এ পদত্যাগের ব্যাপারে সরকারি তরফ থেকে জানাল, এদের কারও কারও পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হবে, কারও কারওটি নয়। প্রধানমন্ত্রী যার যার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করবেন তারা বাদ পড়বেন। অন্যরা স্বপদে বহাল থাকবেন, নতুন করে শপথ নেবার দরকার পড়বে না।

সংবিধানের ৫৮ ধারা পেড়ে বলা হচ্ছে, এ ধারার (১) ক ধারায় আছে- 'তিনি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করিবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট পদত্যাগপত্র প্রদান করেন;' যেহেতু মন্ত্রীরা একতরফা পদত্যাগ করতে পারেন, তাই প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছের এখানে কোনো দাম নেই। এমনকি সাংবিধানিক এসব প্রশ্নে অতীত ঘটনাসহ বিদেশের নানা প্রসঙ্গ পাড়া হয়েছে।

ফলে তাদের দাবি সোমবারই মন্ত্রীদের পদত্যাগ হয়েছে গেছে, তারা আইনত আর মন্ত্রী নেই। আসলেই বিধি যদি ভঙ্গ হয় তবে এখন পতাকাবাহী গাড়িতে মন্ত্রীদের ঘোরাফেরা অথবা মন্ত্রীর মতো নির্দেশ দেওয়া অবৈধ হয়ে যায়। ইচ্ছে করলে কেউ এ নিয়ে আদালতে গেলেও প্রতিকার পেতে পারেন। কিন্তু এ ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও কাউকে আদালতের দরজায় দাঁড়াতে দেখা যায়নি।

পাঠকরা লক্ষ্য করেছেন, মন্ত্রিপরিষদ সচিব প্রেস ব্রিফিং-এর সময় কোনো এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ওতে কী লেখা আছে তা তো জানা নেই। আবার সংবাদে এসেছে মন্ত্রীরা তারিখবিহীন পত্র জমা দিয়েছেন।

প্রকৃতপক্ষে সবাই মন্ত্রীসহ সরকারি ব্যক্তিদের মৌখিক কথার উপর ভর করে কথার মালা গেঁখে চলেছেন। কিন্তু মৌখিকভাবে তিন কবুল বলার মতো তিনশ' বার বললেও পদত্যাগ কার্যকর হবে না। সংবিধানের ওই ধারায় বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিতে হবে। ফলে খতিয়ে দেখা দরকার টেলিভিশনে মন্ত্রীরা যে কাগজখানা প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দিলেন সেটি আসলে কী।

প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকালে সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দিলে, পাল্টা জবাবে বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া নির্দলীয় সরকারের প্রস্তাব দেন। তবে কারা এই নিদর্লীয় ব্যক্তি তাও তিনিই ঠিক করে দেন। মানে দাঁড়াল, আওয়ামী লীগই-বা কাকে কাকে পছন্দ করবে তাও তার পছন্দমতো হতে হবে। তার প্রস্তাবটিতে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারে যারা উপদেষ্টা ছিলেন তাদের মধ্য থেকে এবারের উপদেষ্টা বেছে নিতে হবে বলা হয়েছে।

অনেকই হয়তো বলবেন ওদের মধ্যে তো আওয়ামী লীগের লোকজনও আছে। বিএনপির অমুক অমুক নেতাদের মধ্য থেকে বেগম জিয়া তার মন্ত্রী বাছাই করুন এমন আবদার শেখ হাসিনা করলে যা হয় তেমনই দাবি এটি। এছাড়া সে সময়ের উপদেষ্টাদের মধ্যে কতজন মারা গেছেন, কতজন অসুস্থ আর কতজনই অনিচ্ছুক এসব প্রসঙ্গ উঠে আসায় বিরোধী দলীয় নেত্রীর প্রস্তাবটি এরই মধ্যে গাম্ভীর্য হারিয়েছে।

কিন্তু প্রস্তাবটির অসারতা অনুভব করে নতুন করে কোনো প্রস্তাব তিনি দেননি। এমন ধোঁয়াশার মধ্যেই তিনি সাঁড়াশি হরতাল দিয়ে চলেছেন। আর তাতে বোমাবাজি ও আগুনে পুড়ছে দেশ।

অন্যদিকে, নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী অনড় রয়েছেন। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, দুই নেত্রীর প্রস্তাবের মধ্যে দূরত্ব খুব কমই। বেগম জিয়া চান দুদলের পছন্দের সমান সংখ্যক ব্যক্তি নিয়ে সরকার গঠন; যারা দলে আস্থাভাজন আবার গায়ে নির্দলীয় লেবাস আছে। আর শেখ হাসিনা চান দুই দলের মার্কামারা সাংসদ নিয়ে সরকার গঠন।

এ বিতর্ক হয়তো মিটবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আসলে দুদলের লড়াপেটা সরকারপ্রধান কে হবেন তা নিয়ে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে হরতালে মানুষ পুড়িয়ে মারার প্রসঙ্গ টেনে মন ভার করে শেখ হাসিনা বলেই ফেললেন, এসব দেখে তার প্রধানমন্ত্রী হতে ইচ্ছে করে না। এরপরই মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র নামক কাগজটি তার হাতে তুলে দেবার ঘটনা ঘটতে দেখি আমরা।

সংবিধানে উল্লিখিত পদত্যাগপত্র বলতে কী বোঝায় তার মীমাংসা না করে গণমাধ্যমে মন্ত্রী ও তাদের সঙ্গীদের মুখের কথা নিয়ে হৈচৈ চলছে। আদতে চিলে কান নিয়েছে কিনা তা কেউ খতিয়েই দেখছে না। বিষয়টি পরিষ্কার করে বলি, যদি কোনো পত্রে স্বাক্ষর না থাকে সেটি কি পদত্যাগপত্র বলে গণ্য হবে?

গত রাতে এক বন্ধুকে এমন প্রশ্ন করলাম। কালবিলম্ব না করে তার উত্তর– 'না।' এর অর্থ হচ্ছে কোনো পত্র যথাযথভাবে লেখা হলে তবেই না সেটি পদত্যাগপত্র। সংবাদে লেখা হয়েছে মন্ত্রীরা যে পত্র জমা দিয়েছেন তাতে কোনো তারিখ নেই। তারিখ না থাকলে কি পত্রটি যথাযথ হয়? সংবিধানবেত্তারা নানা ধারা এবং নানা দেশের নানা উদাহরণ নিয়ে হাজির হয়েছেন, কিন্তু তলায় হাত দেননি। এড়িয়ে গেছেন পদত্যাগপত্র বলতে ঠিক বোঝায় সে প্রসঙ্গটি।

অসম্পূর্ণ পদত্যাগপত্র আইনের চোখে পদত্যাগপত্র কিনা তা আগে বিচার না করে দুনিয়া কাঁপানোর কিছু নেই। ফলে এখনও এটিকে শুধুই একটি রাজনৈতিক বার্তা হিসেবে দেখতে হবে।

হরতালের আগুনে পুড়ে মানুষ মরতে দেখে মর্মাহত শেখ হাসিনাও যেমন বলেছেন তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে চান না সে কথাটিও যেমন।