উনিশ বছর আগের সেই পত্রবিনিময়

Published : 11 Nov 2013, 08:35 AM
Updated : 11 Nov 2013, 08:35 AM

আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াকে ফোন করেছিলেন; কিন্ত প্রথম দফায় পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ না হলেও শেষাবধি তাঁদের মধ্যে কথাবার্তা হয়। তাঁদের আলোচনার প্রধান বিষয় ছিল দু'পক্ষের মধ্যে আনুষ্ঠানিক আলোচনা এবং আসন্ন নির্বাচনের সময়কার সরকার।

এই টেলিফোন আলোচনায় কোনো রকমের ঐকমত্য হয়নি। উভয় পক্ষ নিজ নিজ অবস্থান থেকে সামান্যও সরেননি।

এটুকু পড়বার পর আপনার মনেই হতে পারে যে আমি গত ২৬ অক্টোবর, ২০১৩ সালের টেলিফোন আলোচনার কথা বলছি। এ থেকে এই উপসংহারেও পৌঁছুতে পারেন যে এ বিষয়ে ইতোমধ্যে দেশের ও দেশের বাইরের গণমাধ্যমে বিস্তর কথা হয়েছে, এ নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই।

আপনার ধারণা হতেই পারে যে আমি খানিকটা পিছিয়ে আছি। কেননা এরপরেও আরও অনেক ঘটনা ঘটেছে যা নিয়ে সকলে চিন্তিত। কিন্ত আপনাকে আশ্বস্ত করতে পারি যে, আমি ২৬ অক্টোবর, ২০১৩-এর কথা বলছি না। আমি আপনাদের ১৯৯৪ সালের ২৬ নভেম্বরের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের উপর্যুপরি হরতালের কর্মসূচির পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নির্বাচনের প্রস্ততি থেকে এ কথা বলা মোটেই অতিরঞ্জন হবে না রাজনীতির চেহারা ১৯৯৬ সালের মতোই দেখাচ্ছে। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির একদলীয় নির্বাচনের ঘটনার যে পটভূমি ছিল এখনকার অবস্থায় তার সব রকম লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে; সে কারণেই দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সেই পেছনের ইতিহাসের দিকে তাকাতে হচ্ছে।

সম্ভবত সকলেরই মনে আছে যে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের দাবি ছিল তত্বাবধায়ক সরকার। আর ক্ষমতাসীন বিএনপির যুক্তি ছিল যে সংবিধানে তত্বাবধায়ক সরকারের বিধান নেই।

কমনওয়েলথ মহাসচিবের প্রতিনিধি নিনিয়ান স্টিফেনের প্রায় মাসব্যাপী প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবার পর ২৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বিরোধী দলের নেত্রী শেখ হাসিনার কাছে এক চিঠিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান বিষয়ে আলোচনার জন্যে আমন্ত্রণ জানান। দু'দিন পরে শেখ হাসিনা তার জবাবে জানান যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে সরকার নীতিগতভাবে সম্মত হলেই কেবল আলোচনা হতে পারে।

তাঁদের এই পত্রবিনিময় চলে আরও দু দফায়। ২ নভেম্বর খালেদা জিয়ার পাঠানো চিঠির জবাবে ৪ নভেম্বর শেখ হাসিনা একই অবস্থানে থাকেন। ১২ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী তাঁর পাঠানো চিঠিতে জানান যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আলোচনায় তিনি রাজি নন; কিন্ত 'অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের' ব্যাপারে আলোচনায় তিনি প্রস্তত আছেন। দুই নেত্রীর মধ্যে পত্রবিনিময়ের ইতি ঘটে।

সে সময় দেশের সুশীল সমাজের সদস্য, সাংবাদিক ও রাজনীতির বিশ্লেষকরা প্রথমে আশাবাদী এবং পরে হতাশ হয়ে পড়েন। কিন্ত তাঁরা এই বিষয়ে জোর দিয়ে যেতে থাকেন যে, 'দুই নেত্রীর আলোচনা' ছাড়া সংকট সমাধানের আর কোনো বিকল্প নেই।

এই পটভূমিকায় নাটকীয় টেলিফোন সংলাপের ঘটনা ঘটে। সে সময় উদযোগ এসেছিল শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে। ২৬ নভেম্বর বিরোধী দলের নেত্রী প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করলে তিনি ছিলেন না। ঘণ্টা তিনেক পরে খালেদা জিয়া পাল্টা ফোন করলে তাঁদের আলোচনা হয় ১৬ মিনিট। সেই আলোচনায় বিরোধী নেত্রী প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছিলেন যে, রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পরামর্শ দিয়ে ইতিহাস তৈরি করুন।

কিন্ত অনমনীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলতে বিরোধী নেত্রী কী বোঝাচ্ছেন সেটা তাঁর কাছে বোধগম্য নয়। এর পরে আলোচনা এগুবার উপায় ছিল না, আলোচনা এগোয়নি। তার পরে আর সংকট সমাধানে দুই পক্ষের সরাসরি যোগাযোগ হয়েছিল বলে মনে করতে পারি না। তাতে অবশ্য আলোচনার কথা থেকে কোনো পক্ষ সরে আসেননি।

আলোচনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে, কিন্ত আলোচনা হয়নি। দুই পক্ষের মধ্যেকার এই বার্তা বিনিময়ের বিস্তারিত স্মরণ করিয়ে দেওয়ার কারণ একটাই– গত কয়েক দিনে যা ঘটছে তার অভাবনীয় মিল নিশ্চয়ই সহজেই চোখে পড়বে। কতটা মিল তা লক্ষ্য করলে এও দেখতে পাবেন যে এই ধরনের পরিস্থিতিতে আলোচনার জন্যে উদযোগ নেবার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার চেয়ে এগিয়ে থেকেছেন।

১৯৯৪ এবং ২০১৩ সালে দুই নেত্রীর মধ্যেকার আলোচনার অভিজ্ঞতার পরেও যারা আশা করেন যে তাঁরা আলোচনার মাধ্যমে চলমান রাজনৈতিক সংকটের একটা সমাধান বের করবেন, তাদের এই অফুরান আশাবাদের সঙ্গে আমি একমত হতে পারছি না। তাদের আশাবাদের পেছনে কারণ আমার সকলেই জানি-– এই দুই নেত্রীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত কথা।

সংকট সমাধানের যে পথ তাঁরা বেছে নেবেন সংশ্লিষ্ট দল ও সমর্থকরা তাকে শিরোধার্য করবেন। গণতন্ত্রের জন্যে এই পদ্ধতিতে দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণের বাস্তবতাই বাধ্য করে এই আশাবাদ ব্যক্ত করতে। কিন্ত এই ধরনের আশাবাদ যে শেষ বিচারে গণতন্ত্রের জন্যে কতটা ইতিবাচক তা তাঁরাও নিশ্চেই বুঝতে পারেন। যদি দুই নেত্রীর মধ্যে আলোচনার কোনো সম্ভাবনাই না থাকে তবে রাজনৈতিক সংকট সমাধানের আর কী পথ খোলা রয়েছে?

দুই পক্ষের আলোচনার আর দুটি পথ খোলা রয়েছে বলে আমরা ধরে নিতে পারি– মধ্যস্থতার মাধ্যমে অথবা প্রতিনিধি পর্যায়ে। মধ্যস্থতার মাধ্যমে আলোচনার ইতিহাস হল ১৯৯৪ সালে নিনিয়ান মিশনের ব্যর্থতা এবং ১৯৯৫ সালের অক্টোবরে অধ্যাপক রেহমান সোবহান, ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেদ এবং সাবেক প্রধান বিচারপতি কামাল উদ্দিন আহমেদের চেষ্টার অনভিপ্রেত পরিণতি।

গত কয়েক মাসে মধ্যস্থতার জন্যে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে দেশি-বিদেশিরা যে সব চেষ্টা চালিয়েছেন বলে জানা যায় তার পরিণতি কী হয়েছে তা না জানার কোনো কারণ নেই। সামান্য সম্ভাবনা থাকলে সেখানেই আছে। প্রতিনিধি পর্যায়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা এবং যোগাযোগের বিষয়টি বিএনপির মহাসচিব এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন।

কিন্ত যে ক্ষেত্রে দলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের ক্ষমতা দলের প্রধানের হাতে সেখানে মহাসচিব বা সাধারণ সম্পাদকরা কতটুকু করতে পারেন তা ২০০৬ সালে এই দুই দলের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদকদের আলোচনা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল তাতেই বোঝা যায়। সর্বশেষ ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিরা যে উদযোগ নিয়েছিলেন তাঁর পরিণতিও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে।

এ সব ইতিহাস আপনার-আমার মতো দুই নেত্রীও জানেন। তা সত্বেও দুই পক্ষই অব্যাহতভাবে আলোচনার কথা বলছেন কেন সে প্রশ্ন তুলতেই পারেন। তার কারণ কোনো পক্ষই আলোচনা ভেঙে দেওয়ার দায়িত্ব নিতে রাজি নন। তাতে করে এককভাবে যে পদক্ষেপই নেন না কেন তার দায়িত্ব যেন প্রতিপক্ষের ওপরেই বর্তায়।

তাহলে এই সংকট থেকে বেরুবার পথ কী?

গোটা পরিস্থিতি যে অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে তা থেকে বেরুবার পথ হল এক পক্ষকে তাদের অবস্থান থেকে সরে দাঁড়াতে হবে। অর্থাৎ হয় সরকারকে বিরোধীদের দাবির কোনো না কোনো অংশ মেনে নিতে হবে নতুবা বিরোধীদের এই সরকারের অধীনেই নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। এই ধরনের সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট দল কীভাবে তাদের সমর্থকদের কাছে গ্রহণযোগ্য করবেন সেটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তবে দলগুলোর ব্যক্তি-নির্ভরতার যদি কোনো সুবিধা থেকে থাকে তবে এই জায়গায়।

অতীতে নির্বাচন প্রশ্নে নাটকীয় সিদ্ধান্ত নেবার ইতিহাস আওয়ামী লীগের রয়েছে; তাতে দলকে ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে এবং বিএনপি তা থেকে সুবিধা লাভ করেছে। কোনো পক্ষ এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে রাজি আছেন কিনা সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।

কোনো পক্ষই যদি এই সিদ্ধান্ত নিতে রাজি না হন তাহলে কী হবে সেটা ১৯৯৬ সালের ইতিহাস থেকে আমাদের ভালো করেই জানা আছে। ইতোমধ্যে সে পথে দেশ অনেকটাই এগিয়েছে। সে সময়কার বিরোধীরা-– আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী– অভিন্ন কর্মসূচি হিসেবে ৯৬ দিন হরতালসহ বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করেছিল। এর মধ্যে ছিল একটি লাগাতার ৯৬ ঘণ্টা, ২টি ৭২ ঘন্টা, ৫টি ৪৮ ঘণ্টার হরতাল। ২৬ দিনের অসহযোগ কর্মসূচির মধ্যে ২২ দিন ছিল একাধারে কর্মসূচি, যা কার্যত হরতালই বলা যায়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ২০১১ সালে ৫ দিন, ২০১২ সালে ১ দিন হরতাল পালনের পর অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত পালন করেছিল ১০ দিন হরতাল। এ মাসেই তারা দু দফায় ৬০ ঘণ্টা এবং ৮৪ ঘণ্টার হরতাল পালন করেছে।

এই সব হরতালে-– ১৯৯৪ সালে যেমন, এখনও তেমনি-– প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে। এই সব হরতাল আগের চেয়ে আরও বেশি সহিংস হয়ে উঠেছে। তাতে করে আগামীতে আরও বেশি প্রাণসংহার হবে, দেশকে আরও বেশি ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে।

তার নৈতিক দায় কিন্তু বর্তাবে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী নেত্রী দুজনের ওপরেই।

আলী রীয়াজ: পাবলিক পলিসি স্কলার; উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলারস, ওয়াশিংটন, যুক্তরাষ্ট্র।