অন্যের রাজনীতি ধার করে চলবে না

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 4 Nov 2013, 04:16 PM
Updated : 4 Nov 2013, 04:16 PM

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যার দায়ে আল-বদল কমান্ডার আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল ৩ নভেম্বর, ২০১৩ 'আমৃত্যু ফাঁসিতে ঝুলিয়ে' তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ''আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের সর্বোচ্চ শাস্তির আদেশ না দিলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে না।''

১৯৭১ সালের ১১ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের কেন্দ্রীয় নেতা আশরাফুজ্জামান ও মুঈনুদ্দীন কীভাবে আল-বদর সদস্যদের নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ ও হত্যার পর বধ্যভূমিতে লাশ গুম করেছিলেন তা আদালতের রায়ে উঠে এসেছে। আশরাফুজ্জামান খান ছিলেন সেই হত্যাকাণ্ডের চিফ এক্সিকিউটর, আর চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ছিলেন সেই পরিকল্পনার অপারেশন ইনচার্জ।

উল্লেখ্য যে, এই দুই অপরাধীর অনুপস্থিতিতেই আদালত রায় দিয়েছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আশরাফুজ্জামান খান পালিয়ে পাকিস্তানে চলে যান। তারপর সেখান থেকে যান যুক্তরাষ্ট্রে। বর্তমানে তিনি নিউ ইয়র্কের জ্যামাইকায় বসবাস করছেন।

চৌধুরী মুঈনুদ্দীনও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানে পালিয়ে যান এবং সেখান থেকে যান যুক্তরাজ্যে। বর্তমানে তিনি লন্ডনে অবস্থান করছেন।

দুজনের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ শিক্ষক, ৬ সাংবাদিক এবং ৩ চিকিৎসকসহ ১৮ বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যা করার অভিযোগ রয়েছে। আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের ১১টি অভিযোগের সবগুলোতেই দুই আসামীর সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়েছে।

বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার নীলনকশা বাস্তবায়নের জন্য বুদ্ধিজীবী হত্যায় নেতৃত্বদানকারী বিদেশে অবস্থানরত ঘৃণ্য দুই আল-বদর নেতার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়ায় দেশের মানুষ নিঃসন্দেহে স্বস্তিবোধ করছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতিবিরোধী ভূমিকা পালন করার জন্য এই বর্বরদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রাপ্য ছিল। বিলম্ব হলেও আদালত তাদের এই শাস্তি দিয়ে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেছেন।

তবে এই দুই অপরাধীকে দেশে ফিরিয়ে এনে তাদের বিরুদ্ধে দেওয়া দণ্ড কার্যকর করা আদৌ সম্ভব হবে কিনা সে প্রশ্নও দেশাবাসীর মনে দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ পর্যন্ত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মোট ৯ জনের বিচার সম্পন্ন করে শাস্তি ঘোষণা করেছেন। এর মধ্যে ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলে তার প্রতিবাদে রাজধানীর শাহবাগে তরুণ প্রজন্মসহ লাখ লাখ প্রতিবাদী মানুষ শান্তিপূর্ণ আন্দোলন গড়ে তোলেন।

যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে দেশব্যাপী প্রবল আন্দোলন গড়ে ওঠার প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবব্যুনাল আইনে সংশোধন এনে দুপক্ষেরই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া হয়। আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ে কাদের মোল্লাকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর জামায়াত-শিবির দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সহিংসতা চালায়। এছাড়া অন্যান্য অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা কেন্দ্র করেও জামায়াত-শিবির ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া ব্যাহত করার জন্য জামায়াত-শিবির দেশে-বিদেশে নানা ধরনের অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে।

বর্তমান সরকারের মেয়াদকাল শেষ হয়ে আসছে। এখন পর্যন্ত একজন যুদ্ধাপরাধীরও শাস্তি কার্যকর না হওয়ায় মানুষের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। আগামী নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন হলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ অব্যাহত থাকবে কিনা এবং ইতোমধ্যে যাদের বিরুদ্ধে রায় ঘোষিত হয়েছে সে রায়ও বাস্তবায়ন হবে কিনা সে প্রশ্ন উঠেছে।

কারণ প্রধান বিরোধী দল বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে। বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া বলছেন, বর্তমান সরকার বিদায় নিলে কারাগারে আটক সকল রাজনৈতিক নেতা মুক্তি পাবেন। এই নেতাদের মধ্যে যে যুদ্ধাপরাধের দায়ে গ্রেফতারকৃত জামায়াত-বিএনপির নেতারাও রয়েছেন, সেটা বেগম জিয়া পরিষ্কার করে না বললেও দেশের মানুষের বুঝতে সমস্যা হচ্ছে না। প্রশ্ন হচ্ছে, আগামী নির্বাচনে দেশের মানুষ কি এমন শক্তিকে নির্বাচিত করবে যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ বন্ধ করে দিবে?

যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, যারা একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করে দেশকে কলঙ্কমুক্ত করতে চান এখন আর তাদের নিষ্ক্রিয় থাকার সময় নেই। ক্ষমতার পালাবদল ঘটলে রাজাকার, আল-বদররা যাতে আবারও রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ না পায় তার জন্য নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে বিজয়ী করতে সর্বশক্তি নিয়ে প্রচারণায় নামার কোনো বিকল্প নেই।

আওয়ামী লীগের দুর্বলতা-সীমাবদ্ধতা নিয়ে বিতর্ক করে শত্রুপক্ষকে উৎসাহ না দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব পালনে আন্তরিক হলেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি কার্যকর করা সম্ভব হবে। আবার আওয়ামী লীগকেও সব ধরনের অহমিকা পরিহার করে নিজেদের ভুল-ত্রুটি শুধরে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে একাত্তরের পরাজিত শক্তিকে মোকাবেলায় দৃঢ়তার সঙ্গে সামনে অগ্রসর হতে হবে।

শত্রুদের দুর্বল ভাবার চেয়ে বড় বোকামি আর কিছু নেই। শত্রুশিবির ঐক্যবদ্ধ। মিত্রশিবিরের বিভেদ পরাজিত শক্তিকেই উৎসাহ যোগাবে।

২.

গত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট বিপুল ভোটে বিজয়ী হওয়ার পর থেকেই এটা বলা হচ্ছে যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকার করাতেই তরুণ প্রজন্ম আওয়ামী লীগকে ব্যাপকভাবে ভোট দিয়েছে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা প্রত্যক্ষভাবে বিরোধিতা করেছে, যারা বাঙালি হয়েও পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হিসেবে হত্যা, গণহত্যা, নারীধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, ধর্মান্তরকরণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, তাদের বিচার করে শান্তি নিশ্চিত করার দাবিটি কার্যত জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে।

২০১০ সালের ২৫ মার্চ সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করলে অনেকের মধ্যেই প্রচণ্ড আশাবাদ তৈরি হয়। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের চার দশকের বেশি সময় পর মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্তদের বিচার করাটা খুব সহজ কাজ নয়। এই জটিল ও কঠিন কাজটি বিতর্কমুক্ত ও সুচারুভাবে সম্পন্ন করার জন্য যতটা সতর্কতার সঙ্গে সরকারের অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন ছিল, সরকার সেভাবে অগ্রসর হয়নি।

তাই বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হলে দেশে এবং বিদেশে তার কী প্রতিক্রিয়া হবে এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী গোষ্ঠী তা ভণ্ডুল করার জন্য কী কী পদক্ষেপ নিতে পারে, সে ব্যাপারেও সরকারের খুব ভাবনাচিন্তা না থাকার বিষয়টিই ক্রমান্বয়ে স্পষ্ট হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর শক্তি-সামর্থ্য নিয়েও সরকারের হিসেবে ভুল ছিল বলে মনে হয়।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি, সেক্টর কমান্ডারস ফোরামসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে নানা ধরনের পরামর্শ দেওয়া হলেও, সরকার সেসব পরামর্শ খুব আমলে নিয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। জামায়াতের অর্থনৈতিক শক্তি এবং বিদেশি কানেকশন সম্পর্কেও সম্ভবত সরকারের সঠিক ধারণা ছিল না।

অথচ এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাতের গবেষণামূলক অনেক প্রকাশনা রয়েছে। এগুলো সরকারের নীতিনির্ধারকরা বিবেচনায় নিলে ভালো হত। বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর দেশের ভেতর রাজনীতিতে কী ধরনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হতে পারে, সেটা যেমন গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হয়নি, তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কাদের কাছ থেকে সমর্থন পাওয়া যাবে এবং কাদের বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হবে এবং সে ক্ষেত্রে সরকারের কৌশল কী হবে– তার কিছুই ভাবনার মধ্যে ছিল বলে মনে হয় না।

সরকার ধরে নিয়েছিল, তারা এতদিন পর বিচারকাজ শুরু করেছে, কাজেই সবাই সরকারকে কেবল বাহবা দেবে, এটা নিয়ে দেশে-বিদেশে কোনো ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে না। পুরো বিষয়টি যে অত সহজ-সরল ছিল না– এটা যখন সরকার বুঝতে পারছে তখন অনেক বিলম্ব ঘটে গেছে।

বিচারকাজ শুরু হওয়ার পর পরই এটা বোঝা যাচ্ছিল যে, জামায়াত একাই কেবল যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে নয়, দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও বিচার প্রশ্নে অত্যন্ত কৌশলে জামায়াতের অবস্থানই সমর্থন করছে। জামায়াত ও বিএনপির রাজনীতি যে অভিন্ন ধারায় অগ্রসর হচ্ছে সেটা আওয়ামী লীগ নেতারা অনেকবারই প্রকাশ্যে বলেছেন।

কিন্তু বিচারপ্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে এই যৌথ শক্তি অবস্থান নিলে তার সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভাব কী এবং কতটা হতে পারে, সেটা হিসেব করে দেখা হয়নি। একাত্তরের পরাজিত রাজনৈতিক শক্তির অবস্থা যে এখন আর একাত্তরের জায়গায় নেই, সেটাও ভেবে দেখা হয়নি। একাত্তরে তাদের পরাজিত করা সম্ভব হয়েছিল, কাজেই ২০১৩-তে এসে কেন তাদের পরাজিত করা যাবে না– এই সরল হিসেব থেকেই সরকার তার পরিকল্পনা তৈরি করে এখন কিছুটা বিপাকে পড়েছে।

একাত্তরের বিজয়ী শক্তির ত্রুটি-দুর্বলতা-বিভেদ-অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে পরাজিত শক্তি বছরের পর বছর নানা কৌশল অবলম্বন করে যে তাদের চেয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে অধিক শক্তিধর হয়ে উঠেছে, এই বাস্তবতা অনুধাবনে ব্যর্থ হওয়ার জন্যই সরকারকে এখন পদে পদে হোঁচট খেতে হচ্ছে। রাষ্ট্রশক্তিকে চ্যালেঞ্জ করার স্পর্ধা জামায়াত-শিবির অর্জন করেছে এবং এখন তারা আর একা নয়, বিএনপি-হেফাজতসহ অনেক মিত্র তাদের আছে।

বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপটও আর একাত্তরের মতো নেই। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার পতনের ফলে বিশ্বের রাজনৈতিক শক্তির ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। সর্বত্র সাম্রাজ্যবাদের একচ্ছত্র আধিপত্য। সেই সঙ্গে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির যে উত্থান দেশে দেশে ঘটেছে, তার প্রভাব থেকে বাংলাদেশও কোনোভাবেই মুক্ত নয়।

বাংলাদেশের বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী-জঙ্গিবাদী সংগঠনের যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। আল-কায়দা নেটওয়ার্কের সঙ্গে বাংলাদেশের কেউ কেউ সম্পর্কিত হয়েছে এবং আফগানিস্তানে গিয়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিয়েও অনেকে দেশে ফিরে জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত হয়েছে।

দেশের মধ্যে এই ভয়াবহ জঙ্গিবাদী শক্তির উত্থান নিয়ে বিভিন্ন সময় পত্রপত্রিকায় অনেক খবর বের হয়েছে। গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তারা একযোগে প্রায় সব জেলায় বোমা হামলা চালিয়ে এবং কয়েকটি আদালতে আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে প্রকাশ্যে তাদের শক্তির জানানও দিয়েছে।

এই সন্ত্রাসী-জঙ্গিবাদীদের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর নিবিড় সম্পর্ক ও যোগাযোগ নিয়ে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হলেও দেশের গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল শক্তি এদের সম্পর্কে সাবধান হওয়ার গরজ বোধ করেনি। একাত্তরের ঘাতক-দালাল চক্র এবং এখনকার জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ যে এক উৎস এবং আদর্শে পরিচালিত তা নিয়ে বিভ্রান্তির কোনো সুযোগ নেই। এরা বিভিন্ন নামে পরিচালিত হলেও এদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অভিন্ন– অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক চেতনার বিরুদ্ধাচারণ এবং ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পক্ষে কাজ করা।

মানবতাবিরোধী অপরাধে একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচার হলে, দেশে অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা যে শক্তিশালী ও বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাবে– এটা সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের লালনপালনকারীরা জানে না বা বোঝে না, তা তো নয়। তাই তারা সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছে বিচারপ্রক্রিয়া বানচাল বা বিলম্বিত করার জন্য।

ওরা জানে বর্তমান সরকার যদি তার মেয়াদকালের মধ্যে অভিযুক্ত শীর্ষ কয়েকজনের দণ্ডও কার্যকর করতে পারে, তাহলে দেশের মানুষের মধ্যে একাত্তরের চেতনা ও আবেগ যেভাবে জেগে উঠবে, তার ফলে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় ঠেকানো সহজ হবে না। সরকারের অন্য সব ব্যর্থতা-অসফলতা চাপা পড়ে যাবে এই বিজয়-গৌরবে।

অথচ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দোদুল্যমানতার কারণে সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যা তাদের জন্য সুফল বয়ে আনার পরিবর্তে বড় রকম হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করছে।

একদিকে জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সরকারকে বিচলিত করেছে, অন্যদিকে হেফাজতে ইসলামের উত্থানও সরকারের জন্য শিরঃপীড়ার কারণ হয়েছে। সর্বশেষ গাজীপুরসহ পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থীদের পরাজয়ে সরকার হতবিহ্বল হয়ে পড়েছে।

সরকার হয়তো ভাবছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া অব্যাহত রাখলে কিংবা সামনে এগিয়ে নিলে দেশের মধ্যে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, যা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরেও চলে যেতে পারে। তবে সরকারের এ ধরনের ভাবনাকে আত্মঘাতী বলে মনে করেন অনেকেই।

জামায়াত-শিবিরকে কনসেশন দিয়ে আওয়ামী লীগের ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ নেই। কোনো বিবেচনাতেই এই শক্তি আওয়ামী লীগের জন্য বাড়তি সুবিধার কারণ হবে না। ধর্মভিত্তিক কোনো সংগঠন যে ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের জন্য সহায়ক হতে পারে না সেটা স্পষ্ট হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফলেও।

হেফাজতের কাছ থেকে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা করেছেন কিন্তু তার ফল ভালো হয়নি। বরং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে গড়িমসি না দেখালে সিটি নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ভোটাররা উৎসাহ নিয়ে ভোট দিতে যাওয়ার গরজ বোধ করত, বাস্তবে যেটা তারা করেনি।

আওয়ামী লীগের কেউ কেউ মনে করেন, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি অনুসরণের কারণেই তারা ভোটের রাজনীতিতে পিছিয়ে পড়ছেন। অথচ বাস্তবতা সম্পূর্ণ এর বিপরীত। তারা এ ক্ষেত্রে ছাড় দিতে গিয়েই বরং নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরেছেন।

অন্যের রাজনীতি ধার করে আওয়ামী লীগ কখনওই ভালো করতে পারবে না– বিষয়টি আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব তথা দলের নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে। সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে আপস করে আওয়ামী লীগ তাদের সমর্থন পাওয়ার আশা করলে সেটা হবে ভুল। তাছাড়া তারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করলে তারা হবে ওই রাজনীতির বি-টিম।

আওয়ামী লীগকে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়েই দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে। নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে সুবিধাবাদিতার পথে চললে আওয়ামী লীগের মিত্ররা মুখ ঘুরিয়ে নেবে। গত প্রায় পাঁচ বছরের শাসনামলে আওয়ামী লীগ তার মিত্রসংখ্যা বাড়াতে না পারলেও শত্রু বাড়িয়েছে। আদর্শচ্যুত হলে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল ও বিতর্কিত হয়, আর তার বেনিফিট যায় আওয়ামী লীগবিরোধীদের ঘরে।

সে জন্যই সব ধরনের পিছুটান বা দ্বিধাদ্বন্দ্ব পরিহার করে আওয়ামী লীগকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অর্থাৎ গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারাকেই এগিয়ে নিতে হবে। দলের নেতৃত্বে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত আনতে হবে বিরাট পরিবর্তন। কর্মী-সমর্থকদের 'মোটিভেট' করতে হবে অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক রাজনীতির পক্ষে। সুবিধাবাদী, সুযোগসন্ধানী ও নিষ্কর্মাদের দল থেকে বিদায় করতে হবে।

গোটা দলকে একটি বড় ঝাঁকুনি না দিলে মানুষের মনে আস্থা-বিশ্বাস তৈরি হবে না। আর তা ফিরে না এলে একাত্তরে যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছে তাদের বিচার সম্পন্ন করে দণ্ড কার্যকর করাও কঠিন হয়ে পড়বে।

বিভুরঞ্জন সরকার : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।