আত্মহত্যা

আলিমুল হক
Published : 6 Sept 2010, 11:25 AM
Updated : 6 Sept 2010, 11:25 AM

আন্তন পাভলোভিচ চেখভ রুশ নাট্যকার ও ছোটগল্প-লেখক হিসেবে বিশ্ব সাহিত্যাঙ্গনে সুপরিচিত হলেও, তাঁর জন্ম (১৮৬০ সালে) কিন্তু ইউক্রেনে। চেখভ রম্য-রচনায়ও সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তাঁর রয়স যখন মাত্র ২৬ বছর, তখন প্রকাশিত হয়েছিল 'ÔMotley Stories''। এটি চেখভের অনেকগুলো রম্য-রচনার একটি সংকলন। তো, এই সুসাহিত্যিক ও নাট্যকারের এক তরুণ নায়ককে জানি, যে চরম দারিদ্র্য আর প্রেমে ব্যর্থতায় কাতর হয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত তো নেয়া হলো, এখন আত্মহত্যা করা কীভাবে? গলায় ফাঁস লাগানো থেকে শুরু করে বিষ খাওয়া পর্যন্ত, আত্মহত্যার নানান উপায় আছে। সেগুলোর একটাও নায়কের পছন্দ হলো না। ওসব উপায় অবলম্বন করলে, মৃত্যুর পর তাঁর সুন্দর দেহটি অবধারিতভাবে মাতাল ডোমের হাতে ছিন্নভিন্ন হবে; খুবই জঘন্য একটা ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত নায়ক ঠিক করলো, সে পানিতে ডুবে মরবে। সে-ক্ষেত্রে মৃত্যুর পর তাঁর লাশটা পুলিশের হাতে এবং আরো পরে মাতাল ডোমের হাতে পড়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু একটা ব্রিজ থেকে নদীর পানিতে লাফিয়ে পড়ার ঠিক আগমুহূর্তে তাঁর মনে হলো: 'শহরের সমস্ত নর্দমা থেকে নোংরা-ময়লা নেমে আসে এ-নদীতে। ময়লার সঙ্গে থাকে অসংখ্য কীট। নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ার অর্থ, ওসব ময়লা ও কীট আমার নাক-মুখ দিয়ে ভেতরে ঢুকবে! বিভৎস!!'

চেখভের সে-নায়ক শেষমেষ আত্মহত্যার চিন্তা বাদ দিয়ে, নতুন করে বাঁচার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, যারা আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন, তাদের খুব কমই ওই নায়কের মতো করে ভাবেন। তাই বিশ্বে প্রতিনিয়ত ঘটছে আত্মহত্যার ঘটনা। দিন দিন আত্মহত্যাকারীর সংখ্যা বাড়ছে বৈ কমছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) হিসেবে, বিগত প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছরে বিশ্বে আত্মহত্যার হার বেড়েছে শতকরা ষাট ভাগ। একটা সময় ছিল যখন তরুণদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা ছিল অপেক্ষাকৃত কম। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে।

এখন তো আত্মহত্যাকারীদের বেশীরাভাগই ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সী তরুণ-তরুণী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আরেকটি হিসেব মতে, সারা বিশ্বে বর্তমানে প্রতি বছর গড়ে দশ লাখ লোক আত্মহত্যা করছে। আর যারা আত্মহত্যা করবার চেষ্টা করে কোনো-না-কোনো কারণে ব্যর্থ হয়, তাদের সংখ্যা আত্মহত্যাকারীদের বিশ গুণ। আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশী পূর্ব-ইউরোপের দেশগুলোতে এবং সবচেয়ে কম ল্যাটিন আমেরিকায়।

রবীন্দ্রনাথ আকুল হয়ে বলেছিলেন: "মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে।" অথচ এই সুন্দর ভুবন ছেড়ে চলে যেতে অনেকেই করেন না-হক তাড়াহুড়া, করেন আত্মহত্যা। কেন করেন? ইটালির কবি ও ঔপন্যাসিক সেসার পাভিস এ-প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এভাবে: "আত্মহত্যা করবার জন্য কারুর কারণের অভাব হয় না।" তাত্ত্বিকরা এই কারণগুলোকে ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করেছেন নানানভাবে। তাই গড়ে উঠেছে একাধিক তত্ত্ব। মনোবৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলো এক্ষেত্রে জোর দিয়েছে মানুষের ব্যক্তিত্ব ও আবেগগত ফ্যাক্টরগুলোর ওপর এবং সমাজবৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলো বলেছে ব্যক্তির ওপর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চাপের কথা। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে যে, যারা আত্মহত্যা করেন তাদের নব্বই শতাংশই কোনো-না-কোনো মাত্রার মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। ধারণা করা চলে যে, এই নব্বই শতাংশের একটা বড় অংশই ব্যক্তিগত ও সামাজিক চাপে পড়ে মানসিক ভারসাম্য হারায়।

কারণ যা-ই থাকুক, আত্মহত্যা কি গ্রহণযোগ্য? এ-প্রশ্নের জবাব দেবার চেষ্টা করেছেন বহু পন্ডিত ব্যক্তি। প্রাচীন যুগের প্লেটো ও এরিস্টটল এবং মধ্যযুগের অগাস্টিন ও থমাস অ্যাকিনাস থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের লক, হিউম ও কান্টের মতো পন্ডিতরা আছেন ওই দলে। হিউম সাধারণভাবে আত্মহত্যার বিরুদ্ধে থাকলেও, বিশেষ পরিস্থিতিতে একে গ্রহণযোগ্য বলেছেন। জন লক ও ইমানুয়েল কান্ট-এর মতো দার্শনিকরা বরাবর আত্মহত্যাকে অগ্রহণযোগ্যই গণ্য করেছেন। আর প্লেটো আত্মহত্যাকে 'কাপুরুষের কাজ' মনে করলেও বিশ্বাস করতেন যে, বিশেষ ক্ষেত্রে একে মেনে নেয়াই উচিত। প্লেটো তাঁর Republic নামক গ্রন্থের তিন নম্বর অনুচ্ছেদে বরং প্রকারান্তরে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের আত্মহত্যায় সাহায্য করতে সকলকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ হয়েই কি না জানি না, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে আজকাল ডাক্তাররা পর্যন্ত দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত (যাদের বাঁচার কোনো সম্ভাবনা নেই, অথচ তীব্র যন্ত্রণায় কাতর ) রোগীদের আত্মহত্যায় সাহায্য করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন রাজ্যে ২০০২ সালে ঐরকম ৩৮ জন রোগীকে সংশিষ্ট চিকিৎসকরা প্রকারান্তরে আত্মহত্যা করতে সাহায্য করেছিলেন। ওরেগন রাজ্যে কাজটা অবশ্য বৈধ।

আধুনিক বিশ্বের বহু দেশেই আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়ে ধরা পড়লে শাস্তি পেতে হয়। তবে অতীতে কোনো কোনো দেশ ও সংস্কৃতিতে আত্মহত্যা ছিল রীতিমতো গৌরবের কাজ। ভারতে এক সময় মৃত স্বামীর চিতায় সদ্য-বিধবা স্ত্রীর আত্মাহূতি দেয়া ছিল বাধ্যতামূলক এবং পূণ্যের কাজ হিসেবে বিবেচিত। প্রাচীন গ্রীসে অপরাধীদের আত্মহত্যা করার সুযোগ দেয়া হতো। জাপানে 'হারিকিরি' (এক ধরনের আত্মহত্যা) ছিল সৈনিকদের জন্য অত্যন্ত মর্যাদাকর। প্রাচীন ভাইকিংরা বিশ্বাস করতো যে, যুদ্ধের ময়দানে বা আত্মহত্যার মাধ্যমে মৃত্যু না-হলে স্বর্গে যাওয়া যাবে না। বৃদ্ধ হয়ে গেলে আত্মহত্যা করা ছিল প্রাচীন শিথিয়ানদের কাছে গৌরবের বিষয়। এক সময় বুদ্ধ পুরোহিত ও নানরা কোনো সামাজিক অনাচারের প্রতিবাদ জানাতে নিজেদের শরীরে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করতেন। সেসবই এখন অতীত। তবে প্রতিবাদ জানানোর ভাষা হিসেবে আত্মহত্যা এখনো ব্যবহৃত হয়। ধর্মীয় বিশ্বাস থেকেও অনেক সময় মানুষ আত্মহত্যা করে। ১৯৯৪ সালে জেনেভায় Order of the solar T নামক একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর ৪৮ জন সদস্য একযোগে আত্মহত্যা করেছিল। আত্মহত্যার পূর্বে তাঁরা একটি কাগজে স্বাক্ষর করে। কাগজটিতে লেখা ছিল: 'দুঃখ নয়, বরং সুগভীর প্রেম ও আনন্দ নিয়ে আমরা পৃথিবী থেকে চলে গেলাম। তোমরা আমাদের ভাগ্যের কথা ভেবে কেঁদো না; নিজেদের জন্য কাঁদো।'

ইসলাম কিন্তু কোনো অবস্থাতেই আত্মহত্যাকে সমর্থন করে না। ইহুদী ও খ্রীষ্টান ধর্মেও আত্মহত্যা মহাপাপ। ইসলামের শেষ আসমানী গ্রন্থ আল-কুরআনের সুরা নিসায় একটি আয়াত আছে। আয়াতটি হলো: "তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ওপর দয়ালু। আর যে বাড়াবাড়ি ও জুলুমের কাজ করবে, তাকে আমি আগুণে পোড়াবো। একাজ আল্লাহর পক্ষে সহজ।" কোনো কোনো ইসলামী পন্ডিত মনে করেন যে, আয়াতটি আত্মহত্যার বিরুদ্ধেই নাজেল হয়েছে। আর ইসলামের শেষ নবী তো আত্মহত্যাকে সরাসরিই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন:"কোনো মানুষকে অভিশাপ দেয়া তাকে হত্যা করার শামিল। কোনো মুমিনকে মিথ্যামিথ্যি কাফের বলা তাকে হত্যা করার শামিল। আর যে-ব্যক্তি কোনো জিনিষ দ্বারা নিজেকে হত্যা করবে (অর্থাৎ আত্মহত্যা করবে), কিয়ামতের দিনও তাকে সেই জিনিস দ্বারা শাস্তি দেয়া হবে।"(বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফ)।

আত্মহত্যা কোনো অবস্থাতেই কাম্য হতে পারে না। আত্মহত্যার মাধ্যমে একটি জীবনই শুধু নষ্ট হয় না, প্রতিটি আত্মহত্যার বিরূপ প্রভাব পড়ে পরিবারের ওপর, আত্মহত্যাকারীর বন্ধু-বান্ধবদের ওপর। আমি দেখেছি, একটি মাত্র আত্মহত্যার ঘটনা কীভাবে একটি পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সুখ-শান্তি কেড়ে নেয়। প্রশ্ন হচ্ছে: আত্মহত্যার হার কমিয়ে আনার উপায় কী? আমাদের দেশে দারিদ্র্য দূর করা গেলে এবং নারী নির্যাতন বন্ধ করা গেলে যে আত্মহত্যার হার নাটকীয়ভাবে কমে যাবে, তা বলা-ই বাহুল্য। আজকাল, সংখ্যায় কম হলেও, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যা করবার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শিশু সন্তানকে বিষপানে বা আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করার পর মা নিজে আত্মহত্যা করেছেন–এমন ঘটনা সম্প্রতি রাজধানীতে ঘটেছে পরপর দুটি। পরিবারের সদস্যরা সতর্ক থাকলে এ-ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, আত্মহত্যাকারীদের দুই-তৃতীয়াংশই নিজেদের ইচ্ছা সম্পর্কে পূর্বেই অন্যের কাছে (যেমন: বন্ধু-বান্ধবদের কাছে) কম-বেশী তথ্য দেয়। ওসব তথ্যকে গুরুত্ব দিয়ে, যথাযথ কাউন্সেলিং-এর মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। উন্নত বিশ্বে সম্ভাব্য আত্মহত্যাকারীকে কাউন্সেলিং-এর মাধ্যমে আত্মহত্যা করা থেকে বিরত রাখতে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান কাজ করে (ইন্টারনেটে এমন বহু ওয়েভ-পেজ পাওয়া যায় যেগুলোতে সম্ভাব্য আত্মহত্যাকারীদের আত্মহত্যা না-করতে উদ্বুদ্ধ করে বিভিন্ন মেসেজ বা বার্তা পরিবেশন করা হয় নিয়মিত)। বাংলাদেশে তেমন কোনো প্রতিষ্ঠান কাজ করছে কি না আমার জানা নেই।

মার্কিন লেখক এডওয়ার্ড ডালবার্গ বলেছেন: "যখন কেউ উপলব্ধি করে যে, তাঁর জীবনের কোনো মূল্য নেই, তখন সে আত্মহত্যা করে নতুবা ভ্রমণে বেড়িয়ে পড়ে।" প্রথম কথা হচ্ছে, কোনো মানুষের জীবনই মূল্যহীন বা অর্থহীন হতে পারে না। তথাপি কেউ যদি তা মনে করেন-ই, আমি চাইব, আত্মহত্যার পরিবর্তে তিনি ভ্রমণকেই বেছে নেবেন। কে জানে, হয়তো ঘুরতে ঘুরতেই তিনি খুঁজে পাবেন জীবনের অর্থ! আত্মহত্যা করার সুযোগ তখন আর থাকে না।