বর্তমান রাজনৈতিক সংকট ও জনপ্রত্যাশা

এম এম আকাশ
Published : 29 Oct 2013, 06:44 PM
Updated : 29 Oct 2013, 06:44 PM

১.

ইদানিং দৈনিক কাগজের শিরোনামগুলি নিম্নরূপ:

ক.

হরতালের পরদিন জনকণ্ঠের শিরোনাম হচ্ছে: "হরতালের প্রথম দিন: নিহত ৫, দুই যুবলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা, মন্দিরে হামলা, সংখ্যালঘু নারীর শ্লীলতাহানি, বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষে মারা গেছে একজন, পুলিশ ও বিএনপির মধ্যে সংঘর্ষে বিএনপি কর্মী নিহত, পাবনায় জামাত কর্মী নিহত, রাজধানীতে ঢিলেঢালা হরতাল।"

খ.

হরতালের পরদিন দিনকালের শিরোনাম হচ্ছে: "হরতালে অচল দেশ: নিহত ৬, ফরিদপুরে ১, ঈশ্বরদীতে ১, বগুড়ায় ১, অভয়নগরে ১, পিরোজপুরে ১, সীতাকুণ্ডে ১ জন নিহত, আহত আড়াই হাজার, গ্রেফতার দেড় সহস্রাধিক, মামলা ৫ হাজারের বিরুদ্ধে, সারাদেশে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, বিক্ষোভ মিছিল সর্বত্র।"

২.

এদের মধ্যে সাধারণ খবরটি হচ্ছে মৃত্যুর খবর। এক পক্ষের কাগজ দাবি করেছে হরতাল সফল হয়েছে। দেশ অচল হয়ে গেছে। মৃত্যু, হামলা, মামলা উপেক্ষা করে মানুষ বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দিয়েছে। অপর পক্ষের কাগজের দাবি রাজধানীতে ঢিলেঢালা হরতাল হয়েছে। এসব মৃত্যুর কথা স্বীকার করলেও কারণ ব্যাখ্যা করেছেন তারা ভিন্নভাবে। তাদের তথ্যানুসারে, এক কিশোর মারা গেছেন বোমা বহন করতে গিয়ে। দুই পক্ষেরই লোকের মৃত্যু হয়েছে পারস্পরিক সংঘর্ষে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে মারা গেছেন কেউ কেউ। এমনকি এক জায়গায় বিএনপির কর্মীরা নিজেরা্ই পরস্পর সংঘর্ষে প্রাণহানি ঘটিয়েছেন।

৩.

ব্যাখ্যা বা বিবরণ যাই হোক না কেন, মানুষ আজ সবিশেষ চিন্তিত, বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ। তারা এতদিনে এটুকু বুঝেছেন যে "রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়"। তাই তাদের ব্যাপক অংশের মধ্যে কোনো 'জোট' বা 'মহাজোটের' প্রতি সক্রিয় পক্ষপাতিত্ব দেখা যাচ্ছে না।

কিন্তু তাই বলে এটা ভাবা ঠিক হবে না যে তারা দুই দল থেকেই মুখ ফিরিয়ে নিয়ে এখনই তৃতীয় শক্তিকে ক্ষমতাসীন করবেন বা তারা Army-কে চাইছেন। তারা তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক শক্তিকে বিকল্প হিসেবেও সামনে দেখছেন না। তাই উপায়ন্তরবিহীন হয়ে তারা চাইছেন দুই দলই যেন পরস্পরকে কিছু ছাড় দিয়ে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে দেয়। দেশে যাতে শান্তি ফিরে আসে। তখন তারা ভোট দিয়ে ঠিক করে দিবেন– কে হবেন তাদের শাসক।

৪.

প্রশ্ন হচ্ছে তাদের এই প্রত্যাশা পূরণ হবে কি? হলে, তার পক্ষের সম্ভাব্য শক্তিগুলি কারা? বলাবাহুল্য, গণবিরোধী অরাজনৈতিক শক্তিগুলিও এই জনপ্রত্যাশা ভণ্ডুল করে দিতে চাইবে। তারাই-বা কারা এবং তাদের শক্তিও আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। এভাবে অংক কষে দেখতে হবে শক্তি-ভারসাম্য কাদের অনুকূলে এবং কী হতে যাচ্ছে আগামীতে। জনপ্রত্যাশা ভণ্ডুল হবে, নাকি পূরণ?

৫.

সাধারণভাবে আমরা বলতে পারি যে, বর্তমানে জামায়াতে ইসলামী হচ্ছে সর্বপ্রকার আপোসের বিরোধী। তারাই সর্বপ্রথম দ্বিধাহীনভাবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর আলোচনা প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছেন। এই নির্বাচনে নিজের নামে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও তারা করতে পারছেন না। কারণ তাদের ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্রে তারা প্রয়োজনীয় সংশোধনও করতে সম্মত হননি।

যদিও আমার আগের এক লেখায় আমি উল্লেখ করেছিলাম যে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে ব্যারিস্টার রাজ্জাক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টিকে বলেছিলেন যে, তারা বেআইনি হলে অন্য নামে তারা সংগঠন গড়ে তুলবেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে তারা সেই নমনীয় কৌশলে এগোচ্ছেন না। তারা সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের সঙ্গে নেটওয়ার্ক আরও শক্ত করেছেন। ভালোভাবেই ১৮ দলের মধ্যে বিএনপির ছত্রচ্ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছেন। শোনা যায় অন্যান্য দলের মধ্যেও তাদের বিশেষ গুপ্তচররা রয়েছে। হেফাজতসহ সকল ইসলামি শক্তিকেও তারা ব্যবহারে সচেষ্ট হয়েছেন।

এ মুহূর্তে তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার ও শাস্তিদান প্রক্রিয়া বানচাল করা। না পারলে অন্তত শ্লথ করে দেওয়া। বিএনপির ঘাড়ে ভর করে তারা পুনরায় ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের স্বপ্ন দেখছেন।

সুতরাং একটি কথা এখান থেকে বোঝা যায় যে বিএনপি-জামাত আনুষ্ঠানিক ঐক্য অটুট রেখে জনপ্রত্যাশা পূরণ তথা শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না।

৬.

বর্তমান রাজনীতিতে আরেকটি উল্লেখযোগ্য শক্তি হচ্ছে জাতীয় পার্টি। ২৯ অক্টোবর দৈনিক 'প্রথম আলো'য় প্রকাশিত জেনারেল এরশাদ সম্পর্কিত বিশ্লেষণটি জটিল হলেও সেটি আমাদের হিসেবে নিতে হবে। এই বিশ্লেষণের মোদ্দা কথা হচ্ছে, তিনটি বিষয়ে এখন পর্যন্ত জাপার সঙ্গে আওয়ামী লীগের বোঝাপড়া সম্পন্ন হয়নি।

এগুলি হচ্ছে:

(১) মহাজোটের মিত্র দল হিসেবে জাপাকে কয়টি আসন দেওয়া হবে;

(২) বিএনপি ছাড়া নির্বাচন হলে তাতে জাপা অংশগ্রহণ করবে কিনা;

(৩) নির্বাচন সর্বদলীয় সরকারের অধীনে হলে সেই সরকারে তাদের প্রতিনিধি থাকবে কিনা।

জাপার এসব মতভেদ মূলত কৌশলগত। সুতরাং মনে হয় দরকষাকষি করে সর্বোচ্চ সুবিধা আদায়ের পর জাপা নির্বাচনের দিকেই ঝুঁকবে।

৭.

সরকারি ও বিরোধী এই দুই বিপরীত জোটের বাইরে যেসব ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ দল রয়েছে তারা কী ভাবছেন? তাদের মধ্যে 'খাঁটি' বামেরা আশু রাজনীতির জটিলতাগুলিকে "দুই কুকুরের মারামারি" বা "একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ" নামে অভিহিত করেছেন। এরই যান্ত্রিক প্রয়োগ কৌশল হচ্ছে দুই মেরু থেকে সমদূরত্ব বা সমনৈকট্য বজায় রাখার কৌশল। এর ফলে দুই বৃহৎ দলের এই তীব্র দৃশ্যমান আশু দ্বন্দ্বে তাদের ভূমিকা হচ্ছে উদাসীন দর্শকের ভূমিকা।

অবশ্য অপেক্ষাকৃত পরিণত বামেরা শেষ পর্যায়ে দুটি প্রধান দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছেন এবং উভয মেরুর মূল নেতৃদ্বয়ের সংগে সংলাপ চালানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। তারা প্রধানমন্ত্রীকে বলছেন 'গ্রহণযোগ্য নির্বাচন' করার জন্য। আর বিরোধী দলীয় নেতৃত্বকে বলছেন জামাতমুক্ত হতে। দুজনের কেউই তাদের কথা শুনবেন বলে মনে হচ্ছে না।

৮.

আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয়ের কয়েকটি "Bottom Line'' রয়েছে। বিদ্যমান প্রতিহিংসার চক্রানুক্রমিক রাজনীতির আবর্তে ২০০১ এর পুনরাবৃত্তি আওয়ামী লীগ কিছুতেই চাইবেন না। একাধিক নতুন আশংকা যুক্ত হওয়ায় (যেমন, তারেক জিয়ার প্রত্যাবর্তন ও যুদ্ধাপরাধীদের জেল থেকে মুক্তি) তারা আগামী নির্বাচনে তাই পরাজয়ের বিন্দুমাত্র ঝুঁকিও গ্রহণ করতে চাইবেন না, সেটাই স্বাভাবিক।

অন্যদিক থেকে বিএনপিকেও এবার যে করেই হোক জিততে হবে। কারণ এবার হারলে তারেক জিয়ার প্রত্যাবর্তন ও দলটির পুনর্গঠন প্রক্রিয়া অনিশ্চিত হয়ে যাবে। তদুপরি জেল-জুলুম-হামলা-মামলায় তারা গত ৫ বছরে এতটাই বিপর্যস্ত হয়েছেন যে আরেক টার্মের জন্য তারা একই বিপদ আরেকবার ঘাড়ে নিতে একদমই নারাজ।

সুতরাং ইংরেজিতে যেমনটি বলা হয়, Nobody can afford to lose, এ রকম একটি অবস্থার মুখোমুখি হয়েছে উভয় দল। কিন্তু উভয় দলই ভুলে গেছেন যে গণতন্ত্রে দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, আর জনগণ ভোট দিয়ে ঠিক করে কোন দলটি উত্তম। আর জনগণের সেই রায় যে সব দল হারে তাদেরকেও মেনে নিতে হয়।

৯.

যদি গণতন্ত্র রক্ষা করতে হয় তাহলে উভয় দলকে জনগণের প্রতি আস্থাশীল হতে হবে এবং ভোটে অংশগ্রহণ করতে হবে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের দৃষ্টান্তটি আমাদের সামনে আছে। ওই নির্বাচনে সম্পূর্ণ বৈরী এক সামরিক শাসকের অধীনে নির্বাচন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন। পরবর্তীতে ইয়াইয়াহ্ খাঁন ওই রায় মানেননি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাতে তার কোনো লাভ যে হয়নি তা আমরা সবাই জানি।

যদিও মুজিবকে তখন উগ্র শক্তিগুলি নির্বাচন বর্জন করে এক লাফে সশস্ত্র সংগ্রামের উস্কানি দিয়েছিল, কিন্তু তিনি তখন সে কথা সঠিকভাবেই শুনেননি। বেগম খালেদা জিয়াকে আমি বিনয়ের সঙ্গে সেই দৃষ্টান্তটি মনে করিয়ে দিচ্ছি।

আবার আমাদের সামনে অন্য রকম দৃষ্টান্তও আছে। বেগম খালেদা জিয়া একবার একতরফা জনসমর্থনহীন নির্বাচন করে সংসদ গঠন করেছিলেন। কিন্তু সেটিও শেষ পর্যন্ত টেঁকসই হয়নি। তিনিও শেষপর্যন্ত এভাবে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেননি।

তাই শেখ হাসিনাকেও একতরফা নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অনেকবার ভাবতে অনুরোধ করব।

এম এম আকাশ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।