হিগসের নোবেলপ্রাপ্তি : পেছনের কিছু কথা

আরশাদ মোমেন
Published : 13 Oct 2013, 01:13 PM
Updated : 13 Oct 2013, 01:13 PM

প্রায় দুই বছরব্যাপী জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে পিটার হিগস পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল প্রাইজ জিতলেন। সংবাদমাধ্যমের কারণে হিগসের নোবেল জেতা নিয়ে খুব বেশি সন্দেহ না থাকলেও কে তার সঙ্গে এই প্রাইজের অংশীদার হতে যাচ্ছেন তা নিয়ে যথেষ্ট টানাপড়েন ছিল। কারণ, হিগসের নামেই আবিষ্কৃত কণার নামকরণ হলেও হিগস একাই বা সর্বপ্রথম এই ধারণার অবতারণা করেননি।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে যে, এই হিগস-প্রক্রিয়া আবিষ্কারের পেছনে আরও অনেক বিজ্ঞানীর অবদান রয়েছে এবং তাদের অবদান কোনোভাবে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। বিজ্ঞানচর্চা কোনো আইভরি–টাওয়ার বা সমাজবিচ্ছিন্ন অবস্থায় করা যায় না। এই আবিষ্কারের ইতিহাস এটাই প্রমাণ করে যে, অন্য দশটি কর্মকাণ্ডের মতো বিজ্ঞানচর্চাও একটি সামাজিক কর্মকাণ্ড।

এটা বুঝতে গেলে আমাদের একটু পেছনে তাকাতে হবে। হিগস-প্রক্রিয়া কণা পদার্থবিজ্ঞানের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ, যার মূল উপাদান হচ্ছে প্রতিসাম্য। প্রতিসাম্য দিয়েই বেশিরভাগ মৌলিক কণার উপস্থিতি সম্পর্কে আমরা পরীক্ষণের আগেই জানতে পেরেছি।

প্রতিসাম্যের একটা সহজ উদাহরণ দেওয়া যাক– একটি বর্গক্ষেত্রের অনেকগুলো প্রতিসাম্য রয়েছে। আমরা যদি আয়নায় বর্গক্ষেত্রের চিত্রের প্রতিফলন দেখি বা বর্গক্ষেত্রটিকে নব্বই (৯০) ডিগ্রি কোণে ঘুরাই, তাহলে যে চিত্র দেখব তাকে আমরা মূল বর্গক্ষেত্র থেকে পার্থক্য করতে পারব না। কণা পদার্থবিজ্ঞানের প্রতিসাম্য– এই উদাহরণ অনেক জটিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন গণিতবিদ এমি নুথার প্রমাণ করেছিলেন যে, চলমান প্রতিসাম্যের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সিস্টেমে সংরক্ষিত রাশি থাকবে। আবারও একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। সাইকেলের চাকা ঘুরতে থাকলে তা যদি সবসময়ই এক রকম দেখায় তবে তার একটি রাশি সংরক্ষিত থাকবে যা হল কৌণিক ভরবেগ (অতি সরলীকরণ করতে চাইলে কৌণিক বেগের কথা চিন্তা করা যেতে পারে, যদিও তা শতভাগ সঠিক নয়)।

সাইকেলের চাকার ঘূর্ণন কোণটির যে কোনো মান আমরা নিতে পারি। এ জন্য এটিকে আমরা চলমান প্রতিসাম্য বলি। বর্গক্ষেত্রের জন্য এই ঘূর্ণন কোণের মানকে অবশ্যই নব্বই (৯০) ডিগ্রি বা তার গুণিতক হতে হবে।

নুথারের উপপাদ্যের ফলশ্রুতিতে আমরা বিশ্বে যদি কোনো সংরক্ষিত রাশি দেখি তবে তার পেছনে কোনোপ্রকার প্রতিসাম্য খুঁজে পাব, এ চিন্তা করাটাই স্বাভাবিক।

যদি এই প্রতিসাম্যটি আমাদের জগতের প্রতিটি বিন্দুতে স্বাধীনভাবে ক্রিয়া করে তাহলে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার নিয়মে প্রতিসাম্যের প্রক্রিয়াটিকে আলোর বেগে কাজ করতে হবে বা আলো যেভাবে ছড়ায় সেই একইভাবে ছড়াতে হবে। এই ধরনের প্রতিসাম্যকে আমরা এখন থেকে স্থানীয় প্রতিসাম্য নামে অভিহিত করব।

পুনরায় একটি তুলনামূলক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। টেলিভিশনে আমরা সংবাদ পাঠকের সংবাদ শুনতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। কারণ ক্যামেরার সামনের ধারণকৃত শব্দ ও দৃশ্য (অর্থাৎ সকল প্রকার ইনফরমেশন বা তথ্য) একই গতিতে সম্প্রচারিত হয়। শব্দকে তার নিজস্ব গতিতে সম্প্রচারিত হতে দিলে উৎস হতে দূরত্ব অনুসারে সংবাদপাঠ বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রতীয়মান হবে। তাহলে ভিন্ন স্থানে যে একইভাবে টেলিভিশনে সংবাদ দেখি ও শুনি, এই প্রতিসাম্য আমরা বুঝতে পারতাম না।

অতএব, প্রতিসাম্য বোঝার জন্য প্রয়োজনীয় ক্রিয়াকে (সাইকেলের চাকার ক্ষেত্রে যেমন ঘূর্ণন) আলোক অর্থাৎ তড়িৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গের বেগেই বিস্তৃত হতে হয়। আইনস্টাইনের তরুণকালের কাজের মাধ্যমে আমরা জানি যে আলোক ও অন্যান্য সকল তড়িৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ ফোটন নামের ভরহীন কণার সমাহারে তৈরি হয়।

প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, ফোটন বা তার সমগোত্রীয় সকল কণাকে কী নিয়মে গণনা করতে হবে ১৯২৪ সালে সেটাই আবিষ্কার করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন রিডার সত্যেন্দ্রনাথ বসু। উল্লেখ্য, সে সময়ে তড়িৎ-চৌম্বক ও মহাকর্ষণ বল ব্যতীত অন্য কোনো বল সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের স্বচ্ছ ধারণা ছিল না। হিগস-প্রক্রিয়া মূলত নিউক্লীয় বল ক্ষেত্রের জন্য প্রয়োগ করা হয় যার ধারণা সত্যেন বসুর কাজের অনেক পরে অবতাড়িত হয়।

মৌলিক কণার আদান-প্রদানের ফলে সৃষ্ট ক্ষেত্র উৎস হতে দূরত্বের সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস পেতে থাকে। তড়িৎ-চৌম্বক ক্ষেত্রের জন্য এই দূরত্ব অসীম। যার ফলাফলে আমরা রেডিও, টেলিভিশন ব্যবহার করে দূর দূরান্তরে যোগাযোগ করতে পারছি। আরও পারছি অনেক দূরত্বের তারা থেকে আলো দেখতে।

এসবই সম্ভব হয় আলোর কণা ফোটনের ভর শূন্য হওয়ার কারণে। কিন্তু নিউক্লীয় বলের প্রভাব শুধুমাত্র নিউক্লিয়াসের ভেতরেই অনুভূত হওয়ায় বোঝা যায়, নিউক্লীয় বলের জন্য দায়ী কণাগুলোকে অবশ্যই ভরযুক্ত হতে হবে।

এ রকম কণার অস্তিত্ব ১৯৩৫ সালেই জাপানি বিজ্ঞানী হিদেকি ইউকায়া করেছিলেন। কিন্তু তার প্রস্তাবিত মেসন কণাগুলোর সঙ্গে স্থানীয় প্রতিসাম্যের কোনো যোগসূত্র ছিল না।

নিউক্লীয় বলের জন্য স্থানীয় প্রতিসাম্যের ধারণাটি প্রস্তাব করেন ১৯৫৪ সালে শেন নিং ইয়াং এবং রবার্ট মিলস। কিন্তু এই চিত্রে দেখা যায় নিউক্লীয় বলের জন্য বিনিময়কৃত কণাগুলোর ভর ঠিক ফোটনের মতোই শূন্য, যা আমরা ভিন্ন রকম যুক্তিতে পূর্বেই দেখেছি।

তাহলে যে বিশাল সমস্যা রইল তা হল, স্থানীয় প্রতিসাম্যকে অবিকৃত রেখে কীভাবে কণার ভর দেওয়া যেতে পারে। এটা অনেকদিন ধরেই তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, কারণ তারা প্রকৃতিতে স্থানীয় প্রতিসাম্যের কারণে যেমন সংরক্ষিত রাশিমালার দেখা পাচ্ছিলেন, তেমনি তারা দেখছিলেন যে নিউক্লীয় বলের প্রভাবণের দূরত্ব অত্যন্ত স্বল্প।

নিউক্লীয় বলের এই ভিন্নমুখী দুটো ধর্মকে একই চিত্রের মধ্যে সফলভাবে সন্নিবেশ করার কৃতিত্ব পিটার হিগস, ফ্রাসোয়া অংলে, রবার্ট ব্রু, জেরাল্ড গুরালনিক, টম কিবল এবং কার্ল রিচার্ড হেগেনের প্রাপ্য। তারা দেখান যে স্থানীয় প্রতিসাম্য যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে লঙ্ঘিত হয়, তবে বিনিময়কৃত কণা ভরপ্রাপ্ত হয়।

তবে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিসাম্য লঙ্ঘনের যে ধারণা নিয়ে উপরোক্ত বিজ্ঞানী কাজ করেছেন তার উৎপত্তি আরও পেছনে।

১৯২৮ সালেই হাইসেনবার্গ ফেরো-চুম্বকের জন্য এই ধারণার অবতারণা করেন। চলমান প্রতিসাম্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে লঙ্ঘিত হয় এ রকম মডেল দেখান লেভ লান্ডাউ ও ভিটালি গিনসবুর্গ। ১৯৬১ সালে জেফ গোল্ডস্টোন দেখান যে চলমান সর্বজনীন প্রতিসাম্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে লঙ্ঘিত হলে সেখানে শূন্য ভরের কিছু কণার জন্ম হয়, যাকে আমরা সাধারণত গোল্ডস্টোন কণা (এটিও সত্যেন বসুর সম্মানে একটি বোসন) বলি। ফলে এখানে সমস্যাটি সমাধান হওয়ার পরিবর্তে আরও প্রকট আকার ধারণ করে।

১৯৬২ সালের নভেম্বরে ফিলিপ অ্যান্ডারসন অতিপরিবাহিতার জন্য একটি মডেল প্রস্তাব করেন যেখানে তিনি দেখান যে যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে লঙ্ঘিত স্থানীয় প্রতিসাম্যের ক্ষেত্রে "ভরহীন ফোটনটি ভরশূন্য গোল্ডস্টোন কণাকে ভক্ষণ করে ভরপ্রাপ্ত হয়"– প্রয়াত বিজ্ঞানী সিডনী কোলম্যানের ভাষ্যমতে।

অ্যান্ডারসনের আর্টিকেলটি ১৯৬৩ সালের এপ্রিলে Physical Review-তে ছাপা হয় কিন্তু তার মডেলটিতে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা সংযুক্ত না থাকায় কণা পদার্থবিজ্ঞানীদের নজর কাড়তে সক্ষম হয়নি। আইনস্টাইনীয় আপেক্ষিকতার রীতি মেনে চলে, এমন মডেল ব্রু এবং অংলে ১৯৬৪ সালের আগস্টে Physical Review Letters প্রকাশ করেন।

উপরের সব মডেলেরই বিশেষত্ব হচ্ছে যে এখানে একটি নতুন ক্ষেত্রের অবতারণা করা হয়। এই ক্ষেত্রকেই আমরা এখন হিগস-ক্ষেত্র বলি। যদিও এটির প্রয়োগ লান্ডাউ-পরবর্তী সব বিজ্ঞানী স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিসাম্য লঙ্ঘনের জন্য ব্যবহার করেছেন। ব্রু এবং অংলের আর্টিকেলে হিগসের প্রক্রিয়াটির ব্যাখ্যা থাকলেও নতুন ক্ষেত্রের জন্য উদ্ভূত কণার কোনো উল্লেখ নেই।

Physical Review Letters অক্টোবরের সংখ্যায় পিটার হিগস সঠিকভাবে ও স্বকীয়ভাবে ভর উৎপত্তি প্রক্রিয়া এবং নতুন কণার উপস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। এ জন্য পিটার হিগসকেই হিগস-কণার জনক বললে অত্যুক্তি করা হবে না।

অংলে, ব্রু ও হিগস– সকলেই একটি বিশেষ মডেল ব্যবহার করছিলেন। কিন্তু হিগস-প্রক্রিয়ার যে সাধারণ মডেল প্রয়োজন তা প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালেরই নভেম্বরে জেরাল্ড গুরালনিক, টম কিবল এবং কার্ল রিচার্ড হেগেনের লেখা প্রবন্ধে।

সামান্য সময়ের হেরফের বাদ দিলে এই তিনটি প্রবন্ধকেই যে সমান গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন তা এদের ছয়জনকে ২০১০ সালের সাকুরাই প্রাইজ একসঙ্গে প্রদানের মাধ্যমে বোঝা যায়। এ ছয়জনের মধ্যে রবার্ট ব্রু ২০১১ সালে পরলোকগমন করেন। গ্লাশাও-সালাম-ভাইনবার্গের একীভূত স্ট্যান্ডার্ড তত্ত্বের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে এই অ্যান্ডারসন-হিগস প্রক্রিয়া। যদিও স্ট্যান্ডার্ড তত্ত্বের বিভিন্ন উপাদান পরীক্ষণের মাধ্যমে স্বীকৃত হয়েছে।

হিগস-কণাটি এতদিন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের জন্য অধরাই ছিল। ATLAS ও CMS গ্রুপের বিজ্ঞানীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যে হিগস-কণা আবিষ্কৃত হয়েছে তার ফলাফলে একভাবে গ্লাশাও-সালাম-ভাইনবার্গের একীভূত স্ট্যান্ডার্ড তত্ত্বের পরিপূর্ণ স্বীকৃতি মিলল।

যে কাজের জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে তার জন্য অনেকেরই মৌলিক অবদান রয়েছে। কিন্তু পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন শুধু হিগস এবং অংলে। রবার্ট ব্রু জীবিত থাকলে তার নামও যে এই পুরস্কারের অংশীদারিত্বে থাকত তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

অ্যান্ডারসনের কাজ পুরো ধারণাটির মূলে থাকলেও বোধহয় তার ১৯৭৮ সালে অন্য কাজের জন্য নোবেল জেতা এবং কণা পদার্থবিজ্ঞানীদের মাঝে আপাত অপরিচিতির কারণে নোবেল কমিটি তাকে তালিকায় রাখেনি। কিন্তু যে পরীক্ষণের কারণে হিগস-কণার অস্তিত্ব প্রমাণিত হল তাদের বাদ দেওয়া সমীচীন কি না তা ভেবে দেখা দরকার।

ভবিষ্যৎ বছরগুলোতে নোবেল কমিটি তাদের অবদান যথাযথভাবে পুরস্কৃত করেন কি না এখন তাই দেখার বিষয়।

আরশাদ মোমেন : তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।