ক্লাইমেট-গরম যেভাবে চারপাশ সরগরম করে দিল

মানস চৌধুরী
Published : 25 August 2010, 02:47 PM
Updated : 25 August 2010, 02:47 PM

খবরের কাগজ না-পড়ার অভ্যাস অনেকদিনের। খুব ভেবেচিন্তে, কারো প্রায় জোর-করে-দেয়া কোনো খবরের প্রত্যক্ষ পঠনের জন্য কাগজ উল্টানো হয়। নেটেও নিউজ এজেন্সির সঙ্গে এর থেকে নিবিড় সম্পর্ক নয় আমার। যতক্ষণ ধরে বৈশ্বিক খবরাখবরে চোখ বুলাই, তার থেকে ঢের বেশি সময় ধরে নিজের পুরান রচনাসম্ভার খুলে, কম্প্যুটারের পর্দায়, মুগ্ধভাবে চোখ সেঁটে বসে থাকি। নিজের লেখার তারিফ করতে প্রায় পুত্রস্নেহে নিজের দিকে তাকাই। তারপরও, সম্ভবত ২০০৬ সালে, মার্কিন কংগ্রেসের একটা বিতর্ক, কিংবা বলা যায়, আলাপের খবর নেটেই আমার চোখে পড়ে। আলাপটার ধরন ছিল যাকে এনজিও পরিভাষায় মেইনস্ট্রীমিং বলা হয়ে থাকে আরকি।

'ক্লাইমেট' যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আর 'গ্লোব্যাল ওয়ার্মিং' যে এর মধ্যে সর্বাপেক্ষা দুশ্চিন্তাকর উপাদান এবং মার্কিন রাষ্ট্রের, বিশ্বাধিপতি হিসেবে, একে যে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে এই ছিল মোদ্দা খবর। বিতর্ক বলতেও ওটুকুই যে কীভাবে ও কতখানি গুরুত্ব দিতে হবে, সেই গুরুত্বের আঙ্কিক মূল্য কত ইত্যাদি। আর আমরা সকলেই জানি যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মারাত্মক এক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। রাষ্ট্রীয় ও [নিজ] জনগণের জানমালের হেফাজত বিষয়ে কংগ্রেসে ও সিনেটে বিতর্ক করা তাঁদের নৈমিত্তিক অভ্যাস। ওটা না থাকলেই বরং আপনারা ভুল করে বসতেন ইউএস আসলে একটা মিলিটারি এন্টারপ্রাইজ বুঝি।

ছোটবেলার তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণী থেকেই জেনে আসছি জলবায়ু কত জরুরি বিষয়। ছয়টা ঋতু মুখস্ত করে পরীক্ষা দেয়া এক কথা, আর সেগুলো আলাদা করে গায়েগতরে টের পাওয়া আরেক জিনিস। যত বয়স হয়েছে গ্রীষ্ম, বর্ষা আর শীত ছাড়া ঋতু বলতে আর কিছু তেমন টের পাইনি। লোকজনের সঙ্গে আলাপে বুঝেছি সেটা কেবল আমার সমস্যা না। তাঁদেরও একই রকম হয়। ফলে, আমি মহৎভাবে ভেবেছি যে এ যুগের প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের অন্তত তিনটা বাড়তি নাম মুখস্ত করার দায় থেকে কর্তৃপক্ষ মুক্তি দেবেন। বাস্তবে তা হয়নি। ওঁরাও ছয়ঋতুই মুখস্ত করে থাকেন, মানে বাংলা মাধ্যমে আরকি। তবে ষড়ঋতু কথাটার মানে আর তেমন কেউ করতে পারেন না ওঁদের প্রজন্মে। দরকারও নেই বোধ হয়।

তুলনায়, গরম-লাগা বা শীত-লাগা বা বৃষ্টি-পড়া নিয়ে বিশেষ বিশেষজ্ঞ আলাপের প্রয়োজন পড়ে না। আলাপ-প্রসঙ্গ খুঁজে না-পেলে, এমনকি আলাপ প্রসঙ্গের সচেতন প্রারম্ভিকা হিসেবেও এগুলো নিয়ে কথা বলার চল দেখা যায়। পেশাজীবী সহকর্মীরাও দেখি একত্র বসে 'এবার কত গরম পড়েছে' এই নিয়ে ফোঁস ফোঁস আফসোস করতে থাকেন। এর সঙ্গে প্রাসঙ্গিকভাবেই বৈজ্ঞানিক (আসলে যন্ত্রপাতি) আলাপ চলে আসে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র কিংবা আইপিএস ইত্যাদি। চলে আসে বিদ্যুৎ থাকা না-থাকার মধ্যবিত্ত আহাজারি। প্রতিবছর যেভাবে লোকজন দাবি করতে থাকেন 'এবারের মতো গরম আর পড়েনি' তাতে এই দাবির প্রতি বিশ্বাস রাখলে, আমার স্মৃতিশক্তিকাল যদি অন্তত ৩৫ বছর হয়, এদ্দিনে গায়ে ফোস্কা পড়ার উপক্রম হতো। আমার এই কথার মানে এটা নয় যে আমি দাবি করছি গরম বাড়ছে না কিংবা মানুষজন বানিয়ে-বানিয়ে বলছেন। এই মুহূর্তে আমার বলবার বিষয়টুকু হলো, পাবলিক-জবান নিরন্তর প্রসঙ্গ হাতড়ে বেড়ায় এবং আবহাওয়া-জলবায়ু সেখানে অনায়াস সহজ বাছাই। অধিকন্তু, আজকের টীকাখানি আমি এমনকি পাবলিক-জবান নিয়েও লিখতে বসিনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ধরা যাক ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাথা ব্যথাকে কি আমি আম-মানুষের জবান বলে চালিয়ে দিতে পারি? ফলে প্রসঙ্গটা গুরুতর।

কথা হচ্ছিল মার্কিন কংগ্রেসের একটা আলাপ বা বিতর্ক নিয়ে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন কিংবা উষ্ণতা বৃদ্ধি ইত্যাদি। ইন্টারনেটের সুবিশাল তথ্যখামার মাথা গুলিয়ে দিতে যেমন সমর্থ, মাথায় তেমনি জবরদস্ত মালসামান চালানও করতে পারে। চলতি ভাষায় যাকে বলে 'ডেটা' তা আমার বরাবর বিশেষ না-পছন্দ। কিন্তু এযাত্রা আমি সামান্য কিছু খোঁচাখুঁচি শুরু করি ওই 'ডেটা' হাতাতেই। জাপানের গতিশীল ইন্টারনেট, সম্ভবত, আমাকে 'ডেটা'-বিদ্বেষ থেকে খানিক বিচ্যুত করে। অথবা হতে পারে মার্কিন কংগ্রেস।

বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি কী ঘটছে শীতাতপওয়ালা ওই ঘরে বসে, মায় তুষারপাতের কালে, আমার পক্ষে ঠাহর করা মুস্কিল ছিল। সে চেষ্টাও আমি, অন্তত ঘর থেকে বেরিয়ে, করিনি। কিন্তু হাতানো 'ডেটা' মাথায় ঢুকতে-না-ঢুকতে আমার মাথা মহা উষ্ণ হয়ে উঠল। ২০০৬-এর বিতর্ক বা আলাপটা ছিল 'সংকট'টিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কত গুরুত্ব দেবে; এই খাতে কী পরিমাণ টাকা বরাদ্দ হবে যাতে করে একটি সুশীতল ও সুষম-জলবায়ু-সম্পন্ন দুনিয়া তাঁরা আমাদেরকে উপহার দিতে পারেন, ইত্যাদি। যতটা মনে পড়ে ২০০৬-এ একটি বড় অঙ্কের টাকা কংগ্রেস অনুমোদন করে। এবং খোঁজ-খবর যা মনে পড়ে তাতে খুব বেশিদিন আগে এই 'কুমিরছানা'টি আবিষ্কৃত হয়নি। এর বড়জোর ৩ কি ৪ বছর আগে থেকে এটি একটি মার্কিন 'এজেন্ডা'।

এমনিতেই ডলার, পাউন্ড বা ইউরোর যে কোনো অঙ্ক বাংলায় অনুবাদ করলে গা শিরশির করে। তার মধ্যে রাষ্ট্রীয় বাজেটের অঙ্কগুলো ছাপোষা মাস্টারদের চোখে এক ধরনের হ্যালুসিনেশনের জন্ম দেয়। শূন্য প্রায়শই দু'চারটে কম বা বেশি হয়ে যায়। তার মধ্যে [মার্কিন] রাষ্ট্রীয় বাজেটের ডলারিয় অঙ্ক যখন বাংলাকরণের জন্য মাথা উসখুশ করতে থাকল, তখন একই সঙ্গে গা ছমছম করাটা বেড়ে গেল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (কিংবা অন্য যে কোনো 'উন্নত' রাষ্ট্র) তার অর্থবরাদ্দে কী করবে না-করবে তা আমাদের ভাবিয়ে-তোলা সমসাময়িক বিশ্বে খুব সাধারণ ব্যাপার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়াচ্ছে আর আপনি আরও দু'চারটা দেশে বোমাবর্ষণ আশঙ্কা করবেন না তা তো হয় না! কিন্তু পৃথিবীর উষ্ণতা হ্রাস করবার এই মহতী অর্থযজ্ঞে আমার মাথাগরম করবার কারণ কী? কারণ হলো, বরাদ্দের একটা বড় অংশই 'গবেষণা' কাজে খরচ করা হবে।

'গবেষণা' নিয়ে, পেশাগত কারণেই, আমার ভীত হবার বদলে উল্লসিত হওয়া দরকার। এবং নিজের পুনঃ পুনঃ সম্ভাবনায় আন্দোলিত হবার কথা। বিশেষ করে, 'উন্নয়নে'র কালে। কিন্তু, আসলে পেশাবাজারের ঊর্ধ্বেও একটা সামাজিক অস্তিত্ব কখনো কখনো পেরেশান করে ফেলে। সেটারও ইতিহাস আছে। বিশ্বব্যাঙ্ক বন্যা নিয়ন্ত্রণে 'মনোযোগ' দেবার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশে বন্যা-বিশেষজ্ঞ উৎপাদিত থাকল অভাবনীয় গতিতে। বন্যাও দশকে একবার আবির্ভূত হবার বদলে ফি বছরে দেখা-দিতে শুরু করল। মুস্কিল হলো, মুঘল যুগেরও বুজুর্গ লোকজন যেটা বুঝতেন, সেটা নয়া-বিশেষজ্ঞরা কিছুতেই বুঝলেন না। নাব্যতা না বাড়িয়ে বাঁধ দেয়া এঁরা প্রধান কর্তব্য ঠাওরালেন। বন্যা তাতে বিশেষ কমল না, বাড়ল। কিন্তু পানি কমল বাংলাদেশে। 'দারিদ্র্য দূরীকরণের' বিষয়েও কাছাকাছি অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ-উপদ্রুত প্রসঙ্গ হয়ে এর 'জন' বৈশিষ্ট্যটিই হারাতে বসেছে। বিশেষজ্ঞতার এই সমস্যাটি ভয় না ধরানোর তো কারণ দেখি না! ফলে জলবায়ুতে মার্কিন কংগ্রেসের মনোযোগের খবরটি জলবায়ু নিয়ে আক্রান্ত না করে আমাকে করল বাংলাদেশে গবেষণা-এজেন্ডার ভবিষ্যৎ নিয়ে।

এরপর বছর তিনেক কেটে গেছে। 'ক্লাইমেট চেঞ্জ' ও 'গ্লোব্যাল ওয়ার্মিং' নিয়ে ব্যস্ত পেশাজীবীদের দেখা এখন আমার হকিকত। নানান প্রজেক্ট, প্রপোজাল, ফান্ড আর কনফারেন্স-এর একটা মোচ্ছব শুরু হয়েছে। মোচ্ছবটাতে অংশগ্রহণের ধুম বাংলাদেশেও কম নয় নেহায়েৎ। একটু অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু চলতি প্রবণতা দেখলে মনে হয় গবেষকগণ প্রায় যেকোনো প্রকল্পের সঙ্গেই এই ধারণাযুগল জুড়ে দিতে প্রস্তুত। তাঁদের উন্মুখতার ধরনকে পাঠ করতে হবে গবেষণার বৈশ্বিক অর্থযোগানকারদের আগ্রহের সঙ্গে মিলিয়ে। এই ব্যতিব্যস্ততা বিশ্ব নিয়ে দুর্ভাবনার বদলে স্পষ্ট করে পেশাজীবীদের এজেন্ডা নির্ধারণের উস্কানিগুলোর সামর্থ্যকে। যখন বিশ্বব্যাঙ্কের মতো প্রতিষ্ঠানসমূহ বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর 'উচ্চশিক্ষা' নিয়ে গভীর মনোযোগ দিতে শুরু করেছে তখন প্রবণতাটি বিশেষভাবে স্বতন্ত্র।

একদিকে 'ক্লাইমেট চেঞ্জ' নিয়ে স্বাস্থ্যবান অর্থযোগান হচ্ছে যখন, বেশ শক্তপোক্ত একটা প্রচারণাও কিন্তু শুরু হয়েছে। সেটাও পাশ্চাত্য থেকেই। বারাক ওবামা'র আহ্বানকে কংগ্রেস যেন অগ্রাহ্য করে সেই পরামর্শ দিচ্ছেন কেউ কেউ। তাঁদের মূল যুক্তি বা প্রচারণা হলো জলবায়ু বদলের বিষয়টাই একটা অতিকল্প/মিথ। এর পিছনে গুচ্ছের টাকা খরচ করার দরকার নেই। এই প্রচারণাটা কিছু হলেও জনপ্রিয়তা পাবে পাশ্চাত্যে। পাবার কথা। এর একটা কারণ হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইয়োরোপবাসী বহু আম-মানুষই 'গুচ্ছের' টাকা খরচের বৈশ্বিক রাজনীতি নিয়ে অনেক ভাবনাচিন্তায় অভ্যস্ত নন। তাঁদের দুশ্চিন্তা হবে বেহুদা 'তাঁদের' টাকা খরচ হয়ে যাবে বলে। বিশ্বকে বাঁচাতে 'তাঁরা' কেন বাড়তি খরচ করবেন? বটেই তো! সম্পদ আহরণ করে আর বর্জ্য নিষ্কাশন করে প্রকৃতিকে নষ্ট করবার কীর্তিটা যে 'তাঁদের'ই এই ইতিহাস-জ্ঞানটা আম-মানুষের যাতে না জন্মে সেজন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইয়োরোপীয় বহু রাষ্ট্র সাধ্য-সাধনা করে, খেটেখুটে, শিক্ষাকর্মসূচি নিয়ে থাকে। সেসব মানুষ যদি ঐতিহাসিক দায়টা বুঝেই ফেলেন তাহলে অন্তত অপরাধবোধের একটা সংস্কৃতিও তৈরি হয়ে যেতে পারে, প্রতিবাদের না হলেও।

দুনিয়া গরম হোক বা না-হোক আমার জানা নেই, মাথাব্যথাও নেই। কিন্তু আলাপ-জগতটা নতুন শব্দাবলি এসে গরম করে দিয়েছে। 'ক্লাইমেট চেঞ্জ' শব্দমালা এসে প্রকৃতি ধ্বংসের যে আলাপটা অনেক বছর ধরে গড়ে উঠেছে একটু একটু, সেটার গুরুত্ব লাঘব করতে পেরেছে। বৈশ্বিক শব্দমালার এই রাজনৈতিক তাৎপর্য গুরুত্বপূর্ণ। নতুন নতুন প্রপোজাল নিয়ে দৌড়ে-বেড়ানো আমাদের পেশাজীবীরা কি এসকল পরিস্থিতির মধ্যে আছেন?!

টাকা নিজগুণেই গরম। বৈশ্বিক উষ্ণতার থেকে বেশিও হতে পারে।

[জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, ২২শে আগস্ট ২০১০]