বঙ্গবন্ধুর নব মূল্যায়ন

Published : 16 August 2010, 01:08 PM
Updated : 16 August 2010, 01:08 PM

বিবিসি'র শ্রোতাদের জরিপে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি হলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৭/৩/১৯২০  – ১৫/৮/১৯৭৫)। বিষয়টি নিয়ে কেউ কেউ বিতর্ক তুললেন, বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নয় কেনো? তাঁকে দ্বিতীয় শীর্ষ শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে অনেকেই মেনে নিতে পারেন নি। কিন্ত জরিপের ব্যাপারটি সাধারণ মানুষের মতামত ও মূল্যায়নের প্রতিফলন। এখানে কোনো ‌দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। এমন কী কাউকে বড় করা, কাউকে খাটো করার দৃষ্টিভঙ্গিও এখানে অবান্তর!

একজন বাংলা ভাষাকে, আরেক জন বাংলাদেশকে বিশ্বায়নে সুপ্রতিষ্ঠিত করে বাঙালি জাতিকে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় ‌জীবন্ত করেছেন। এক অ-বাঙালি ড. কাজুও আজুমা, যিনি জাপানি, তিনি এই মহান ব্যক্তিদ্বয়ের ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে–আমার এক কানে বাজে রবীন্দ্র সঙ্গীত অন্য কানে শুনি ৭ মার্চের বজ্রভাষণ!

সার্বিকভাবে রবী ঠাকুর এবং বঙ্গবন্ধুকে একই বৃত্তে ফেলে সমান্তরাল তুলনা করা যথার্থ নয়। কারণ, দুজনের ক্ষেত্র ও ভুবন ভিন্ন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তার জীবনকে তিনটি পযার্য়ে মূল্যায়ন করা যায়। প্রথমতঃ স্বাধীনতার আগে তার নেতৃত্বে রাজনৈতিক আন্দোলন, দ্বিতীয়ত: স্বাধীনতা উত্তর রাষ্ট্রনায়ক এবং তৃতীয় পযার্য়ে মৃত্যুর পর তার কর্ম-জীবনের অবদান এবং আদর্শ। কিন্ত এভাবে মূল্যায়ণ না করে তাকে দুইভাবে মূল্যায়ন করা হয়। দলীয়ভাবে আওয়ামী মূল্যায়ন অথবা প্রতিপক্ষের অব-মূল্যায়ন। কোনটাই ইতিহাসের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

একপক্ষ বঙ্গবন্ধুকে অতি মূল্যায়ন করতে মহামানব থেকেও উচ্চাসনে পূজনীয় করে তোলেন। আর সেখানে থেকে নামানোর জন্য অন্যপক্ষ ইতিহাসের খলনায়ককে মহানায়কে পরিণত করতে চান। পক্ষান্তরে বঙ্গবন্ধুর সমান্তরাল সাজানোর অপপ্রয়াস করেন।

দুটো প্রক্রিয়াই প্রকৃত শেখ মুজিবের জন্য ক্ষতিকর। ‌'জীবিত মুজিব' আর "মৃত মুজিবে'র উভয়ের ব্যবধানটা বোঝেন না।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব্ যখন বাংলাদেশের স্থপতি অর্থাৎ প্রতিষ্ঠাতা, তখন তার নামে একটি হাসপাতাল বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামকরণে মধ্য দিয়ে তাকে সীমাবদ্ধ করে তার অসীমত্বকে ক্ষুণ্ন করা হয় বলে আমার বিশ্বাস।

এক শ্রেণীর রাজনৈতিক লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মীরা বঙ্গবন্ধুকে সংকীর্ণ ও সংকুচিত করছেন। তাদের মাত্রাতিরিক্ত ভক্তামি সবর্জনীন বঙ্গবন্ধুকে সীমাবদ্ধ করে দিচ্ছে। তাদের দালালী বা চামচা-গিরি একটি ছোট দৃষ্টান্ত (সংবাদ শিরোনাম) উল্লেখ করছি:

বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মদিন পালিত (দ্র: দৈনিক আমাদের সময়, আগস্ট ০৯, ২০১০)।

এখন তথাকথিত সুবিধাবাদী মুজিবভক্তরা বঙ্গবন্ধুর স্ত্রীকে বঙ্গমাতা ভূষিত করেছেন। এ খেতাবের কী কোনো প্রয়োজন্ ছিল?

এভাবেই বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তিকে তারা নষ্ট করছে। যারা গণতন্ত্রকে হত্যা করে, যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটে দেশ ও জাতির সর্বনাশ করেছে, তাদের মতোই এক শ্রেনীর ‌মুজিববাদী'রা ভিন্নভাবে শেখ মুজিবের চেতনা ও আদর্শকে কবর দিচ্ছে।

একজন শেখ মুজিব যখন একটি দেশ ও একটি জাতির জননেতা (এমন-কী আন্তর্জাতিকভাবে পৃথিবীর সকল নির্যাতিত মানুষের নেতাও বটে), তখন তাকে সীমাবদ্ধ করে রাখা হয় দলীয় গণ্ডির ভেতর'!

শেখ মুজিব দোষগুণ ভালোমন্দ মিলিয়ে একজন মহামানব। কিন্তূ তোষামদকারীরা তাকে ফেরেস্তা তূল্য করতে চান। তার প্রতিপক্ষরা পারলে তাকে কাঠগড়া থেকে শুলে চড়াতে চান! মুছে দিতে চান ইতিহাসের পাতা থেকে।

দীর্ঘদিন পাঠ্যপুস্তকে বিকৃতভাবে ম্লান করে উপস্থাপন করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। তুলে ধরা হয়েছিল তাদের স্বরচিত ইতিহাস। ক'বছর আগে সংবাদপত্রের এক জরিপে দেখা গেছে, স্কুল কলেজের সিংহভাগ শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের স্থপতির নাম বলতে পারছে না।

স্বাধীনতার শত্রু আল বদর, রাজাকার এবং বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীন তাদের দোসররা এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বুট জুতার নিচে পিষ্ঠ করতে চেয়েছেন।

কিন্ত পারেনি। প্রকৃত সত্য এবং সুন্দর কখনোই ম্লান হয় না, পরাজিত হয়না। হয়না বলেই বাংলার জনগণ আবারো চেতনাগতভাবে জেগে উঠেছে। জেগে উঠেছে ইতিহাসের আসল সূর্য।

আজ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি সরকার গঠন করেছে জন সমথর্ন নিয়ে সোজা হয়ে দাড়িয়ে। দীর্ঘকাল অতিক্রম করে প্রচুর প্রতিকূল প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচারকার্য সম্পন্ন হয়েছে, দেশ ও জাতি কলঙ্ক মুক্ত হয়েছে। কারণ, খুন, সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ ও কু-কর্মের স্থান বাংলাদেশে নেই। বিশ্বের কাছে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে।

আরো উজ্জ্বল হবে, যদি ৭১-এর মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়। এসব রাজনৈতিক অর্জন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন এবং তার মূল্যায়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এতোদিন কুশাসনের গণতান্তিক স্বৈরতন্ত্রে দেশ ও জাতি যে অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে ছিল, তা একটু একটু করে কাটিয়ে উঠছে। যেমন, যেসব তরুণেরা মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে বিমুখ ছিলো, তাদের কাছে বঙ্গবন্ধু এখন আদর্শের প্রতীক। সম্প্রতি ঢাকাস্থ বৃটিশ কাউন্সিল তৃনমূল পর্যায়ে বছরব্যাপী এক সরাসরি ২১৬৭ সাধারণ তরুণ এবং শিক্ষার্থীদের (১৫ থেকে ৩০ বছর বয়স) মধ্যে জরিপ করে গত ১২ জুলাই জানিয়েছে, ৩৮% তরুণ রাজনৈতিক বিমুখ হওয়া সত্ত্বেও ৭৪% মনে করে জাতীয় পযায়ে আর্দশ হচ্ছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। (বিবিসি এবং বৃটিশ কাউন্সিলের দুটি জরিপেই রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল যুক্ত হয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে।)

শুধুমাত্র দেশের নতুন প্রজন্মই নয়, প্রবাসী নতুন প্রজন্মের বাঙালিদের জন্য বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস জানা এবং প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরার জন্য শেখ মুজিব অনিবার্য। তাই, সকল রাজনৈতিক মিথ্যাচার থেকে প্রকৃত সত্যকে প্রকাশের জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জীবন ও আদর্শকে মূল্যায়ন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্ব একাকার। বঙ্গবন্ধুই বাঙালি জাতির হাতে মুক্ত আকাশে মুক্তির পতাকা তুলে দিয়েছেন।