একজন বেলাল মোহাম্মদ এবং তাঁর মরণোত্তর দেহদান

অভিজিৎ রায়
Published : 19 August 2013, 05:01 AM
Updated : 19 August 2013, 05:01 AM

"Helping Hands are Better than Praying Lips" – ইংরেজি প্রবাদ।

বেলাল মোহাম্মদ চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে কিছুদিন আগে। তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সংগঠকদের একজন। চরমপত্র সহ যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানগুলো একসময় বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা এবং আপামর জনসাধারণের জন্য 'আশার প্রদীপ' হয়ে বিরাজ করেছিল একাত্তরে , তার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, মেজর জিয়ার যে ঐতিহাসিক ঘোষণাটি একাত্তরের ২৭ শে মার্চ সন্ধ্যায় কালুরঘাট থেকে প্রচারিত হয়েছিল, সেটারও অন্যতম আয়োজক ছিলেন এই বেলাল মোহাম্মদ। পরে এই ভাষণটি নিয়ে নানা রকমের জল ঘোলা করা হয়েছে, ব্যবহার করা হয়েছে নানা দলীয় স্বার্থে। সেগুলো আমরা জানি। কিন্তু বেলাল মোহম্মদ বরাবরই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রতি নির্মোহ থেকে তাঁর বিশ্লেষণ হাজির করেছেন, স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন জিয়ার ভাষণের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটি। সেগুলোর প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর লেখা 'স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র' নামের অসাধারণ বইটিতে।

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের জন্য লালায়িত ছিলেন না তিনি কখনোই। স্বাধীনতা পদকও অনেক দেরী করে পেয়েছিলেন তিনি। ২০১০ সালে এসে। ততদিন বহু শর্ষীনার পীর সহ বহু বিতর্কিত ব্যক্তিরাই এই পুরস্কার বগলদাবা করে ফেলেছেন। বাংলা একাডেমী পুরস্কার আরো পরে। আর একুশে পদক তো পানই নি। তাতে অবশ্য বেলাল মোহাম্মদের কোন কিছু আসে যায়নি। পুরষ্কার নিয়ে ভাবিত ছিলেন না তিনি। মানুষের জন্য কাজ করতেন। সব সময়ই সাদা পাঞ্জাবি পরে ঘুরতেন। আমার সাথে যতবার দেখা হয়েছে এই নিরাভরণ সাদা পোষাকেই দেখেছি সহজ সরল মানুষটিকে। শেষবার দেখা হয়েছিল আজিজ সুপার মার্কেটে। মুক্তান্বেষায় প্রকাশিত একটি কবিতা নিয়ে অনেক কথা হয়েছিল সেদিন। জানলাম, কেবল মুক্তিযুদ্ধ নয়, পাশাপাশি বিজ্ঞান, মানবতাবাদ আর যুক্তিবাদও ছিল তাঁর মানস গঠনের অনুপ্রেরণা। ভরসা রাখতেন সেই সব তরুণদের উপর যারা এই আন্দোলনের সাথে জড়িত।

ইহাকালে যেমন তিনি রাষ্ট্রীয় পদপর্যাদাকে তোয়াক্কা করেছেন, তেমনি সেটা করলেন মরণের পরেও। কবির শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর মরদেহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করা হয়। কেন করলেন তিনি এই কাজ? বেলাল মোহম্মাদ হয়তো জানতেন মানুষকে কবর দিলেই কি আর ঘটা করে শ্মশান ঘাটে নিয়ে পুড়ালেই বা কি, এতে তো জগৎ জীবন কিংবা মানুষের কোন উপকারই হচ্ছে না। তার চেয়ে আরো ভাল সিদ্ধান্ত কী এরকম হতে পারে না যদি আমাদের মৃতদেহটিকে মানব কল্যাণে আমরা উৎসর্গ করতে পারি? আমাদের কৃষক-দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর (১৯০০–১৯৮৫) কিন্তু চেষ্টা করেছিলেন। আরজ আলী মাতুব্বর লোকটাকে আমার বরাবরই দুঃসাহসী, দুর্দান্ত, দুরন্ত, দুর্বিনীত বলে মনে হয়েছে। অশিক্ষিত সামান্য একজন চাষা নিজ উদ্যোগে স্বশিক্ষিত হয়েছেন। কিন্তু এই শিক্ষা কেবল 'শমশের আলীদের মত কোরানে বিজ্ঞান খোঁজার শিক্ষায়' শিক্ষিত হওয়া নয়, বরং মনের বাতায়ন খুলে দিয়ে 'আলোকিত মানুষ' হবার ঐকান্তিক বাসনা। আরজ আলী বিনা প্রমাণে কিছু মেনে নেননি, প্রশ্ন করেছেন, জানতে চেয়েছেন। সে প্রশ্নগুলো সন্নিবেশিত করেছেন 'সত্যের সন্ধান' বইয়ে। যে প্রশ্নগুলো একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারীরাও করতে ভয় পেতেন, সে সব প্রশ্নগুলো তিনি করে গেছেন অবলীলায়, ভাবলেশবিহীন মুখে। আমাদের মত শিক্ষিত বলে কথিত সুশীলদের গালে সজোরে চড় বসিয়ে দিয়েছেন আরজ আলী মাতুব্বর। শুধু জীবিত অবস্থায় নিজেকে আর অন্যদের জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেননি, তিনি তাঁর মৃত্যুর সময়েও এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, যে সাহস এর আগে কওন শিক্ষিত সুশীলেরা করে দেখাতে পারেনি। তিনি তাঁর মৃতদেহ কবরে দাফন না করে মানব কল্যাণে দান করার সিদ্ধান্ত নিলেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে লেখা 'কেন আমার মৃতদেহ মেডিকেলে দান করেছি' শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি বলেন –
'…আমি আমার মৃতদেহটিকে বিশ্বাসীদের অবহেলার বস্তু ও কবরে গলিত পদার্থে পরিণত না করে, তা মানব কল্যাণে সোপর্দ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। আমার মরদেহটির সাহায্যে মেডিক্যাল কলেজের শল্যবিদ্যা শিক্ষার্থীগন শল্যবিদ্যা আয়ত্ত করবে, আবার তাদের সাহায্যে রুগ্ন মানুষ রোগমুক্ত হয়ে শান্তিলাভ করবে। আর এসব প্রত্যক্ষ অনুভূতিই আমাকে দিয়েছে মেডিকেলে শবদেহ দানের মাধ্যমে মানব-কল্যাণের আনন্দ লাভের প্রেরণা।'

আরজ আলী মাতুব্বরের মতো বাংলার বিবেক, অধ্যাপক আহমদ শরীফও তাঁর মৃতদেহকে মেডিকেল মানব কল্যাণে দান করে গেছেন। আরজ আলী মাতুব্বরের মৃতদেহ দানপত্রের মতো আহমদ শরীফের সম্পাদিত ( মৃত্যুর চার-পাঁচ বছর আগে) তাঁর 'অছিয়তনামা' আর 'মরদেহ হস্তান্তরের দলিল' দুটিও বাংলা আর বাঙালির মুক্তবুদ্ধির ইতিহাসে অনন্য কীর্তি। সেখানে তিনি লিখেছিলেন –
"আমি সুস্থ শারীরিক এবং সুস্থ মানসিক অবস্থায় আমার দৃঢ় সঙ্কল্প বা অঙ্গীকার স্থির সিদ্ধান্ত-রূপে এখানে পরিব্যক্ত করছি।
আমার মৃত্যুর পরে আমার মৃতদেহ চিকিৎসাবিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের অ্যানাটমি এবং ফিজিওলজি সংক্রান্ত কাজে ব্যবহারের জন্য ঢাকার ধানমন্ডিস্থ বেসরকারী মেডিকেল কলেজে অর্পণ করতে চাই। … চক্ষুদান এবং রক্তদান তো চালুই হয়েছে। চোখ শ্রেষ্ঠ প্রত্যঙ্গ, আর রক্ত হচ্ছে প্রাণ-প্রতীক। কাজেই গোটা অঙ্গ কবরের কীটের খাদ্য হওয়ার চেয়ে মানুষের কাজে লাগাই তো বাঞ্ছনীয়।"
অধ্যাপক ইরতিশাদ আহমদ লিখেছিলেন তাঁর 'আহমদ শরীফ: এক দুর্বিনীত সক্রেটিসের প্রতিকৃতি' নামের ব্যতিক্রমী একটি প্রবন্ধ। সে প্রবন্ধে খুব সঠিকভাবেই তিনি উল্লেখ করেছেন –
'আর কিছু না হলেও শুধুমাত্র এই দু'টি দলিলের কারণে আহমদ শরীফ বাংলার মুক্তমনাদের পথিকৃৎ হয়ে থাকবেন যুগ যুগ ধরে।
আরজ আলী কিংবা আহমদ শরীফের মত ব্যক্তিত্বরা শুধু ইহজীবনে নয়, এমনকি পরকালকে সামনে রেখেও ঋজু চিত্তে বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিতে পারলেও আমরা জানি আমাদের চেনা জানা অধিকাংশ মানুষই এভাবে চিন্তা করতে সক্ষম নন। এই অক্ষমতার মূল কারণ হল আত্মা সংক্রান্ত প্রাচীন কুসংস্কারের কাছে নতি স্বীকার। আমার অন্তত: তাই মনে হয়। আমি বছর কয়েক আগে 'আত্মা নিয়ে ইতং বিতং' নামে একটি সিরিজ লিখেছিলাম। সে লেখাটাতে আমি দেখিয়েছিলাম – আত্মা ব্যাপারটি যে মানুষের আদিমতম কল্পনা যেটা সুসংবদ্ধ রূপ পেয়েছিল গ্রীসে প্লেটোর দর্শনে এসে। প্লেটোর বক্তব্য ছিল যে, প্রাণী বা উদ্ভিদ কেউ জীবিত নয়, কেবলমাত্র যখন আত্মা প্রাণী বা উদ্ভিদদেহে প্রবেশ করে তখনই তাতে জীবনের লক্ষণ পরিস্ফুট হয়। প্লেটোর এ সমস্ত তত্ত্বকথাই পরবর্তীতে খ্রিস্টধর্মের বুদ্ধিবৃত্তিক সমর্থনের যোগান দেয়। প্লেটোর এই ভাববাদী তত্ত্ব অ্যারিস্টটলের দর্শনের রূপ নিয়ে পরবর্তীতে হাজার-খানেক বছর রাজত্ব করে। এখন প্রায় সব ধর্মমতই দার্শনিক-যুগলের ভাববাদী ধারণার সাথে সঙ্গতি বিধান করে। আত্মা সংক্রান্ত কুসংস্কার শেষপর্যন্ত মানব সমাজে ধীরে ধীরে জাঁকিয়ে বসে। আমি আমার প্রবন্ধে দেখিয়েছিলাম যে, আধুনিক বিজ্ঞানের চোখে অপার্থিব আত্মার কল্পনা ভ্রান্ত বিশ্বাস ছাড়া কিছু নয়। বলা বাহুল্য, আত্মার অস্তিত্ব ছাড়াই বিজ্ঞানীরা আজ মানুষ সহ অন্যান্য প্রাণীর আচরণ, আচার-ব্যবহার এবং নিজের 'আমিত্ব' (self) এবং সচেতনতাকে (consciousness) ব্যাখ্যা করতে পারছে। এমনকি খুঁজে পেয়েছে ধর্মীয় অপার্থিব অভিজ্ঞতার বিভিন্ন শরীরবৃত্তীয় নানা উৎসও। যা হোক, লেখাটি পরে আমার আর রায়হানের লেখা 'অবিশ্বাসের দর্শন' বইয়েও অন্তর্ভুক্ত হয়। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আত্মার ধারণার খণ্ডনের পাশাপাশি লেখাটির একদম শেষে এসে বলেছিলাম এই প্রবন্ধের সাথে সম্পর্কযুক্ত প্রয়োজনীয় কিছু কথা –
'…এমন একদিন নিশ্চয় আসবে যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ জীবন-মৃত্যুকে ব্যাখ্যা করার জন্য আত্মার দ্বারস্থ হবে না; আত্মার 'পারলৌকিক' শান্তির জন্য শ্রাদ্ধ-শান্তিতে কিংবা মিলাদ-মাহফিল বা চল্লিশায় অর্থ ব্যয় করবে না, মৃতদেহকে শ্মশান ঘাটে পুড়িয়ে বা মাটিচাপা দিয়ে মৃত দেহকে নষ্ট করবে না, বরং কর্নিয়া, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, যকৃত, অগ্ন্যাশয় প্রভৃতি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো যেগুলো মানুষের কাজে লাগে, সেগুলো মানবসেবায় দান করে দেবে (গবেষণা থেকে জানা গেছে, মানুষের একটিমাত্র মৃতদেহের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে ২২ জন অসুস্থ মানুষ উপকৃত হতে পারে)। এ ছাড়াও মেডিকেলের ছাত্রদের জন্য মৃতদেহ উন্মুক্ত করবে ব্যবহারিকভাবে শরীরবিদ্যাশিক্ষার দুয়ার। আরজ আলী মাতুব্বর তাঁর মৃতদেহ মেডিকেল কলজে দান করার সিদ্ধান্ত নিয়ে এক সময় অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। এ অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে পরবর্তীতে মেডিকেলে নিজ মৃতদেহ দান করেছেন ড. আহমেদ শরীফ, ড. নরেন বিশ্বাস, ওয়াহিদুল হক, গায়ক সঞ্জীব চৌধুরী প্রমুখ। সমাজ সচেতন ইহজাগতিক এ মানুষগুলোকে জানাই আমার প্রাণের প্রণতি'।

আমাদের বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১১ সালে। তখনো 'মধ্যরাতের অশ্বারোহী' খ্যাত সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ জীবিত। উনি মারা যান ২০১২ সালের ২০ শে ফেব্রুয়ারি। তাই আমাদের বইয়ে ড. আহমেদ শরীফ, ড. নরেন বিশ্বাস, ওয়াহিদুল হক, গায়ক সঞ্জীব চৌধুরীদের কথা থাকলেও ফয়েজ আহমদের কথা ছিল না। জীবিত অবস্থায় তিনি জনকল্যাণে মরণোত্তর দেহ ও চক্ষু দানের ঘোষণা দিয়ে গিয়েছিলেন। ফয়েজ আহমদ মারা যাওয়ার পর প্রদীপ দেব তাঁর 'ফয়েজ আহমদ: একজন মুক্তমনার প্রতিকৃতি' শিরোনামের লেখাটিতে লিখেছিলেন –
চিরকুমার ফয়েজ আহমদ ব্যক্তিগত সুখের কথা ভাবেন নি কখনো। সারাজীবন মানুষের জন্য গঠনমূলক কাজে ব্যস্ত থেকেছেন। … সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করার জন্য চিরদিন সংগ্রাম করে গেছেন যিনি – মৃত্যুর পরেও মানুষেরই কাজে লাগিয়েছেন নিজের শরীর। চোখ দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছেন দু'জন মানুষের দৃষ্টি। তাঁর চেয়ে মুক্তমনা মানুষ আমরা আর কোথায় পাবো?

আরজ আলী মাতুব্বর থেকে শুরু করে ড. আহমেদ শরীফ, ড. নরেন বিশ্বাস, ওয়াহিদুল হক, গায়ক সঞ্জীব চৌধুরী, ফয়েজ আহমদ কিংবা বেলাল মোহাম্মদের উদাহরণ দেখলে বোঝা যায় মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে মরণোত্তর দেহ দানের আগ্রহ বাড়ছে, প্রতি বছরই দৃষ্টান্ত হিসেবে তালিকায় উঠে আসছে বিদগ্ধজনদের নাম। কিন্তু তারপরেও – দুঃখজনক হলেও দেশে সাধারণ মানুষদের মধ্যে প্রক্রিয়াটি এখনো জনপ্রিয় করা যায়নি। বেহেস্তের হুর-পরীর লোভ, দোজখের ভয়, কুসংস্কার আর অপবিশ্বাসের পাশাপাশি অশিক্ষিত এবং অর্ধশিক্ষিত মোল্লা আর লালসালুর মজিদদের ছড়ি ঘোরানো যে সমাজে প্রবল সে সমাজে এই ধরণের ব্রাত্য ধারণাকে জনপ্রিয় করাটা কষ্টকরই বটে। কিন্তু উদ্যোগ তো নিতে হবে কাউকে না কাউকে একটা সময়।

কেন মরণোত্তর দেহ দানকে আমি এভাবে সামনে আনতে চাইছি এ নিয়ে কিছু বলা যাক। মৃতদেহ নিয়ে আমাদের অফুরন্ত আবেগ থাকতে পারে, স্মৃতি থাকতে পারে, কিন্তু বাস্তবতা হল মানুষ মরে গেলে মৃতদেহ কারো কোন কাজে আসে না। কিন্তু একটি মানুষ মারা যাওয়ার সাথে সাথে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গুলোরও সাথে সাথে মৃত্যু ঘটে না। দেখা গেছে মানুষ মারা যাবার পরেও হৃৎপিণ্ড ১৫ মিনিট, কিডনি ৩০ মিনিট, কঙ্কাল পেশী – ৬ ঘণ্টার মত 'বেঁচে থাকে'। অঙ্গ 'বেঁচে থাকা'র অর্থ হল তার কোষগুলো বেঁচে থাকা। কোষ বেঁচে থাকে ততক্ষণই যতক্ষণ এর মধ্যে শক্তির যোগান থাকে। শক্তি উৎপন্ন হয় কোষের অভ্যন্তরস্থ মাইটোকন্ড্রিয়া থেকে। মাইটোকন্ড্রিয়ার কার্যকারিতা ক্ষুণ্ণ হলে কোষেরও মৃত্যু হয়। যাই হোক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মৃত্যু নিয়ে দার্শনিক আলোচনায় গিয়ে লাভ নেই, মূল কথা হল – মৃতদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে মানুষের কাজে লাগানো যায় ইচ্ছে থাকলেই, মানে কারো সদিচ্ছা থাকলে। স্থানান্তরযোগ্য অঙ্গের মধ্যে আছে চোখ (কর্নিয়া), হৃৎপিণ্ড, যকৃত, কিডনি, চামড়া, স্টেমসেল সহ বহু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। আমেরিকান ডিপার্টমেন্ট অব হেলথ এন্ড হিউম্যান সার্ভিসের দেওয়া তথ্য থেকে আমি সম্প্রতি জানলাম একটি মৃতদেহের অন্তত: পঞ্চাশটি অঙ্গকে নাকি নানাভাবে অন্য মানুষের কাজে লাগানো যায়।

কিন্তু এই হতচ্ছাড়া অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোকে কাজে লাগানোর দরকারটা কি? কারণ হচ্ছে চাহিদা। খোদ আমেরিকাতেই এই মুহূর্তে ১১০, ০০০ আমেরিকাবাসী কোন না কোন অঙ্গের জন্য প্রতীক্ষা করে রয়েছে। সুখবর হচ্ছে প্রতিদিন অন্ততঃ ৭৭ জনের দেহে অন্যের দান করা অঙ্গ স্থানান্তর করে বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে। অন্যদিকে দুঃসংবাদ হল – প্রতিদিন অন্ততঃ ১৯ জন রোগী এই 'ওয়েটিং লিস্টে' থাকা অবস্থাতেই মারা যাচ্ছে, স্থানান্তরযোগ্য অঙ্গের অভাবে।

ইউরোপে প্রতিবছর প্রায় সাতাশ হাজার রোগীর দেহে অন্য কোন কোন সহৃদয় ব্যক্তির কাছ থেকে পাওয়া অঙ্গ সংস্থাপন করা সম্ভব হয়, ষাট হাজার রোগী অঙ্গের অভাবে কেবল প্রতীক্ষাই করে যায়, আর অন্ততঃ তিন হাজার রোগী সঠিক সময়ে অঙ্গ-প্রাপ্তির অভাবে মৃত্যুবরণ করে।

এগুলো তো গেল কেবল আমেরিকা আর ইউরোপের হিসেব। বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে অঙ্গের চাহিদা কত বেশি তা বোধ হয় না বলে দিলেও চলবে। বাংলাদেশে কিডনি এবং যকৃতের রোগে আক্রান্তদের হার আশঙ্কাজনকই বলা যায়। হয়তো এর পেছনে অনবরত ভেজাল খাদ্য, ময়লা পানি, দূষিত পরিবেশে লাগাতার বসবাসের প্রভাব থাকতে পারে। প্রভাব যাই থাকুক কিডনি আক্রান্ত হলে তাকে কৃত্রিমভাবে ডায়ালাইসিস করতে হয়। ডায়ালাইসিসের প্রভাব অনেক সময়ই দেহে হয় নেতিবাচক। কিডনি ট্র্যান্সপ্ল্যান্টই হয় তখন একমাত্র ভরসা। কিন্তু স্থানান্তরযোগ্য কিডনি না পাওয়া গেলে সেটা হয়ে দাঁড়ায় মূর্তিমান সমস্যাই। মৃতদেহের প্রতি অন্ধ আসক্তি পরিহার করে সামান্য বদান্যতাই দিতে পারে বহু রোগীকে নতুন জীবনের সন্ধান। দরকার কেবল উদ্যোগের।

যকৃতের ক্ষেত্রেও তাই। আমি আমার 'মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে' বইয়ে জীবন এবং মৃত্যুকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জেমি ফিস্কের 'জীবন প্রাপ্তি'র উদাহরণ হাজির করেছিলাম। আশির দশকের ঘটনা এটি। এগারো মাসের শিশু জেমি আর হয়ত বড়জোর একটা ঘন্টা বেঁচে থাকতে পারত-তার জন্মগত ত্রুটিপূর্ণ যকৃৎ নিয়ে। তার বাঁচবার একটিমাত্র ক্ষীণ সম্ভাবনা নির্ভর করছিল যদি কোন সুস্থ শিশুর যকৃৎ কোথাও পাওয়া যায় আর ওটি ঠিকমত জেমির দেহে সংস্থাপন করা সম্ভব হয়ে ওঠে। কিন্তু এতো ছোট বাচ্চার জন্য কোথাওই কোন যকৃত পাওয়া যাচ্ছিলো না। যে সময়টাতে জেমি ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ছিলো আর মৃত্যুর থাবা হলুদ থেকে হলুদাভ হয়ে ছড়িয়ে পড়ছিলো সারা দেহে, ঠিক সে সময়টাতেই হাজার মাইল দূরে একটি ছোট্ট শহরে এক বিচ্ছিরি ধরণের সড়ক দুর্ঘটনায় পড়া দশ মাসের শিশু জেসি বেল্লোনকে হুড়াহুড়ি করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। যদিও মাথায় তীব্র আঘাতের ফলে জেসির মস্তিষ্ক আর কাজ করছিলো না, কিন্তু দেহের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোকে কিন্তু রেস্পিরেটরের সাহায্যে ঠিকই কর্মক্ষম করে রাখা হয়েছিলো। জেসির বাবা রেডিওতে দিন কয়েক আগেই একটি যকৃতের জন্য জেমির অভিভাবকদের আর্তির কথা শুনেছিলেন। শোকগ্রস্ত পিতা এতো দুঃখের মাঝেও মানবিক কর্তব্য-বোধকে অস্বীকার করেননি। তিনি ভেজিটেশনে চলে যাওয়া নিজের মেয়ের অক্ষত যকৃৎটি জেমিকে দান করে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। জেসির রেস্পিরেটর বন্ধ করে দিয়ে তার যকৃৎ সংরক্ষিত করে মিনেসোটায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হল। জেমির বহু প্রতীক্ষিত অস্ত্রোপচার সফল হলো। এভাবেই জেসির আকস্মিক মৃত্যু সেদিন জেমি ফিস্ককে দান করল যেন এক নতুন জীবন। সেই ধার করা যকৃৎ নিয়ে পুনর্জীবিত জেমি আজো বেঁচে আছে- পড়াশুনা করছে,দিব্যি হেসে খেলে বেড়িয়ে পার করে দিয়েছে জীবনের চব্বিশটি বছর!

পরকালের নানা লোভ তোয়াক্কা করে যে মানবিকতার জন্য উদ্বুদ্ধ হওয়া যায়, জেসির বাবাই ছিলেন তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তার নিজের মেয়ে মারা গেলেও ঠিক সেই মুহূর্তের সিদ্ধান্তই দিতে পেরেছিল অজানা অচেনা আরেকটি মেয়েকে নবজীবন। এর চেয়ে বড় অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত আর কী হতে পারে!

আমি নিজে মরণোত্তর দেহদানের নিয়ম কানুনের কথা ভেবেছি, সম্প্রতি কিছু খোঁজ খবরও নিয়েছি । ব্যাপারটা কঠিন কিছু নয়। আপনি যদি আমেরিকানিবাসী কেউ হন, তবে আপনার জন্য ব্যাপারটা সোজা। সায়েন্স কেয়ার, বায়োগিফট, মায়ো-ক্লিনিক, এনাটমিক গিফট রেজিস্ট্রি সহ বহু জায়গায় আপনি আপনার মরণোত্তর দেহ দান করতে পারবেন। আপনার দেহ দান করতে পারবেন যে কোন অ্যাকাডেমিক কলেজেও। আপনি যদি প্রাপ্তবয়স্ক যুবক বা যুবতী হন, সরাসরি আপনার পছন্দমতো জায়গায় ফোন করতে পারেন, তাদের সাথে কথা বলতে পারেন। যদি কারো সাথে কথা বলে ভাল লাগে, সম্মত হন, তাদের দেয়া ফর্ম আপনাকে পূরণ করতে হবে। তারা আপনাকে ডাকযোগে একটি কার্ড পাঠাবে। সেটা আপনার মানিব্যাগে রেখে দিতে হবে। ব্যাস কাজ শেষ। আপনার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কেউ আপনাকে ঘাঁটাবে না। কাকে মরণোত্তর দেহ প্রাপ্তির জন্য মনোনীত করবেন, সেটা সম্পূর্ণ আপনার উপরেই নির্ভর করছে। মৃত্যুর আগে আপনার দেহে যদি ক্যান্সার এইডসের মত বদ খদ রোগ কিংবা কোন ছোঁয়াচে রোগ বাসা না বেধে থাকে, তবে আপনার শরীর মরণোত্তর দেহদানের জন্য মনোনীত হবে। আপনার পরিবার পরিজনদের সাথে কথা বলে তারা দেহটি স্থানান্তরের ভার নেবে। পরবর্তীতে মৃতদেহ থেকে সংস্থাপনযোগ্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নিয়ে বিভিন্ন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করা হবে।

মৃত্যুর সময় আপনার কোন বড় সড় কিংবা ছোঁয়াচে রোগ ছিল কিনা সেটা জানা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মৃতদেহ থেকে পাওয়া অঙ্গ অন্য সুস্থ রোগীর দেহে সংস্থাপন করা হলে কেউ নিশ্চয় এইডস বা ক্যান্সারে মারা যাওয়া মানুষের অঙ্গ গ্রহণ করে নিজের মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করতে চাইবে না; তাই না? তাই যে এজেন্সির সাথে আপনি চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন তারা মৃতদেহ গ্রহণ করার আছে রক্ত পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে নেবে।

তবে একটি বিষয় উল্লেখ করে রাখি- ক্যান্সার, এইডস এ ধরনের রোগে মারা গেলে মরণোত্তর দেহদানের সুযোগ বন্ধ হয়ে যায় তা কিন্তু নয়। এ ধরণের বড় সড় রোগে কেউ মারা গেলে তার মৃতদেহও দান হিসেবে গ্রহণ করা হয়, ক্যান্সার কিংবা এইডসের রিসার্চে সেই শবদেহ কাজ লাগান গবেষকেরা। দেহ কাটাছেঁড়া করে গবেষণার ক্ষেত্র প্রসারিত করেন গবেষকেরা, শবদেহ বিশ্লেষণ করে চিকিৎসকেরা পেতে চেষ্টা করেন রোগ নিরাময়ে নতুন আশার ঠিকানা। উদাহরণ দেয়া যাক। সবারই নন্দিত লেখক ক্রিস্টোফার হিচেন্সকে মনে আছে। এসোফেগাল ক্যান্সারাক্রান্ত হিচেন্স মারা যান ২০১১ সালের ১৫ই ডিসেম্বর তারিখে। মৃত্যুর আগে তিনি তার মৃতদেহ মেডিকেল রিসার্চের জন্য দান করে যাওয়ার জন্য বলে দেন। হিচেন্সের মৃত্যুর পর তার সাহিত্য-প্রতিনিধি স্টিভ ওয়াসারম্যান খুব ছোট্ট একটা বার্তায় সারকথা বলে দেন, যা হয়তো তখন অনেকেরই দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে –
"In accordance with Christopher's wishes, his body was donated to medical research. Memorial gatherings will occur next year."

ক্রিস্টোফার হিচেন্সের মত ক্যান্সারাক্রান্ত হয়ে কিছুদিন আগে মারা গেছেন বাংলাদেশের জননন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদও। কিন্তু তিনি নীরবে নিভৃতে চলে যেতে পারেননি। তার শবদেহ কোথায় কবরস্থ করা হবে তা নিয়ে রীতিমত দুই পরিবারে মল্লযুদ্ধ হয়েছে। পুরো দেশ যেন হাসিনা-খালেদা পরিবারের মত দুইভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল – শাওন পরিবার বনাম গুলতেকিন পরিবার। এক পরিবার চাচ্ছিল নুহাশ পল্লীতে যেন লেখকের দাফন হয়, অন্য পরিবার চাচ্ছিল ঢাকায়। দুই পরিবারই তাদের সিদ্ধান্তে ছিলেন এক্কেবারে অনড় (শেষ পর্যন্ত অবশ্য হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী দাবী মেনে নিয়ে নুহাশ পল্লীতেই দাফনের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। সেখানেই সমাধিস্থ করা হয় এই জনপ্রিয় কথা শিল্পীকে)। দুর্ভাগ্যক্রমে এই অস্বস্তিকর মল্লযুদ্ধ থেকে একটি মানুষও উপকৃত হয়নি, একটি রোগাক্রান্ত মানুষকে সুস্থ করা যায়নি, গবেষণার ক্ষেত্রে কানা-কঞ্চিও অগ্রগতি হয়নি, কোন মেডিকেলের ছাত্র শবদেহ কেটে তার জ্ঞান এক রত্তি বাড়াতে পারেননি। কেবল পারলৌকিক প্রশান্তি আর হুর পরীর মিথ্যে আশায় গা ভাসিয়ে দেয়া ছাড়া। আমি পার্থক্যটা এখানেই দেখি।

ক্রিস্টোফার হিচেন্সের ব্যতিক্রমী দান অনুপ্রাণিত করেছে বহু মুক্তমনা মানুষদের। এমনি একজন মানুষ হচ্ছেন এডওয়ার্ড টার্ট। একসময় ক্যাথলিক প্রিস্ট ছিলেন। কিন্তু বাইবেলের ভুজুং ভাজুং বুঝতে তার সময় লাগেনি। একসময় নীরবেই খ্রিস্টধর্ম ত্যাগ করেন তিনি, হয়ে উঠেন মুক্তমনা। ক্রিস্টোফার হিচেন্স মারা যাওয়ার পরে তার শবদেহ মেডিকেল রিসার্চের জন্য দান করার কথা শুনে এডওয়ার্ডও অনুপ্রাণিত হন। তিনি তার মৃতদেহ আমেরিকার বেলর কলেজ অব মেডিসিনে দান করে যেতে মনস্থ করেন। উজ্জীবিত এই বয়োবৃদ্ধ তরুণের উজ্জয়নী ভিডিও রাখা আছে ইউটিউবে, অবশ্যই একবার হলেও সবার দেখে নেয়া দরকার ।

দেশে মরণোত্তর চক্ষুদান নিয়ে ছুৎমার্গ কেটেছে বহুদিন হল। দেশের মানুষ এখন মৃত্যুর পরে কর্নিয়া দান করে যেতে ভয় পায় না। কিন্তু একটা সময় এটাও সহজ ছিলো না। সন্ধানীর উদ্যোগে মরণোত্তর কর্মসূচী এতোই ব্যাপকতা পেয়েছে যে, যে কোন মেলা বা উৎসবেও তাদের স্টল দেখা যায়, দেখা যায় তরুণ তরুণীদের অনুপ্রাণিত করতে। সেটা তো দরকারিই। বাংলাদেশে বর্তমানে কর্নিয়া-জনিত কারণে অন্ধত্বের সংখ্যা পাঁচ লক্ষাধিক বলে মনে করা হয়, সে-তুলনায় প্রতি বছর কর্নিয়ার যোগান অপ্রতুল হলেও সংখ্যা কিন্তু ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।

দরকার আরেকটু এগুনোর। মরণোত্তর দেহদান নিয়েও ছুৎমার্গ আর কুসংস্কারের দেওয়াল ডিঙাতে হবে। এবং সেটার পদক্ষেপ নিতে হবে এখনই। তাত্ত্বিকভাবে মরণোত্তর দেহদানের বিষয়টি কঠিন হবার কথা ছিল না। যে কোন নিকটস্থ সরকারি মেডিকেল কলেজের এনাটমি বিভাগে যোগাযোগ করলেই ব্যাপারটা হয়ে যাবার কথা। কেবল প্রয়োজন পড়ার কথা মরণোত্তর দেহদানে সম্মত ব্যক্তিটির পরিবারের দুজন সদস্যের সম্মতি, সেই সম্মতি নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে এফিডেভিটকৃত হতে পারে।

হতে পারে পারত অনেককিছুই, যদি না দেশটার নাম বাংলাদেশ না হয়ে অন্যকিছু হত। যদি না দেশের অধিকাংশ মানুষ গোর আজাব আর পারলৌকিক হুর-পরিতে অবসেসড না থাকত। এই আফটার -লাইফ-অবসেসড মানুষেরা কীভাবে সৎ-কর্মে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, আরজ আলী মাতুব্বরের জীবনই তার প্রমাণ। আরজ আলীর মায়ের মৃত্যুর পরে মৃতদেহের ছবি তোলা নিয়ে নরক-গুলজার করেছিল মোল্লারা। জানাজা পড়তে দেয়নি। তাও তো আরজ আলী মাতুব্বর লিখে রেখে গেছেন বলে সেই সকরুণ ঘটনা আমরা জানতে পেরেছি। এ ধরণের বহু ঘটনাই রয়ে যায় বিস্মৃতির অন্তরালে।

যেমনটি ঘটেছিল রায়হান রশীদের ক্ষেত্রে। রায়হানকে অনেকেই জানেন মুক্তাঙ্গন-নির্মাণ ব্লগের সম্পাদক হিসেবে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে ডক্টরেট করে বর্তমানে যুক্তরাজ্যেরই আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন শিক্ষকতা করছেন। নেতৃত্ব দিচ্ছেন ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়াকে সহায়তা প্রদানে সক্রিয় নাগরিক পর্যায়ের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক 'ইনটারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম' (ICSF) এর। সেই রায়হানের বাবা ডাক্তার ছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন মৃতদেহ মাটিতে কবর দিয়ে গলিয়ে পঁচিয়ে নষ্ট করার চেয়ে মেডিকেলে দান করে দেয়াটাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত, যাতে ছাত্ররা অন্ততঃ একটি দেহ পায় শরীরবিদ্যা সঠিকভাবে আয়ত্ত করার জন্য। তার বাবা চেয়েছিলেন বাংলাদেশের ডাক্তারেরা যেন ছাত্রদের জ্ঞানার্জনের কথা ভেবে সামনে এগিয়ে আসেন মরণোত্তর দেহদানের প্রক্রিয়াটির নেতৃত্ব দিতে। যখন রায়হানের বাবা ১৯৯৭ সালে সত্য সত্যই মারা গেলেন, পরিবারের পক্ষ থেকে মৃতদেহকে মেডিকেলে দান করাতে কারো কোন আপত্তিই ছিল না, বরং সর্বসম্মতিক্রমে তারা মেডিকেলে দেহ দান করাতেই মনস্থ করেছিলেন। কিন্তু মেডিকেল থেকে ভয়ে এই মৃতদেহ গ্রহণ করা হল না। এলাকার কাওমি মাদ্রাসার মোল্লারা মরণোত্তর দেহদানের মত 'বে-শরীয়তী' কাজের জন্য রায়হানদের বাড়ী ঘিরে ফেলেন। অবশেষে মোল্লা-তন্ত্রের হাতে রায়হানদের পরিবারকে নতিস্বীকার করতে হয়েছিল। বলা বাহুল্য, রায়হানের পিতার শেষ ইচ্ছা অপূর্ণই থেকে গিয়েছিল সেদিন। আজও রায়হান সেদিনের কথা মনে করতে গিয়ে বেদনার্ত হয়ে পড়েন।

অথচ দেশের বাইরে কিন্তু ব্যাপারটা সেরকম নয়। মরণোত্তর দেহদানের ব্যাপারটাকে একটা মহৎ কাজ হিসেবেই দেখা হয়। যেমন মায়ো ক্লিনিকে যারা মরণোত্তর দেহদান করেন, তাদের সম্মানে মোমবাতি জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয় ছাত্র শিক্ষক এবং কর্মচারীদের পক্ষ থেকে, কনভোকেশনে অনুষ্ঠান করে পরিবারের কাছে এই মহতী কাজের জন্য সম্মাননা জানানো হয়, অনেকে আবার দান করে যাওয়া অঙ্গের জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে পরিবারকে চিঠি লেখেন। আমাদের সংস্কৃতিতে এগুলো অনুপস্থিত তো বটেই, যারা এটা শুরু করতে চায়, তাদের জীবনই বরং বিপন্ন করে তোলা হয়, করে ফেলা হয় একঘরে। কারণ দেশটার নাম যে বাংলাদেশ। অথচ বাইরে ফাঁসির আসামীরা পর্যন্ত মরণোত্তর দেহদানের কথা সিরিয়াসলি ভাবে।

এত হতাশার মাঝেও একটি আনন্দের সংবাদ পেয়েছিলাম কিছুদিন আগে। বাংলাদেশের কিছু যুক্তিবাদী সংগঠন এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছে, সাহস করে এগিয়ে এসেছে অচলায়তন ভাঙার। তেমনি একটি সংগঠন হল জনবিজ্ঞান ফাউন্ডেশন। আইয়ুব হোসেন এবং বেলাল বেগ এ প্রতিষ্ঠানটির সাথে জড়িত বলে জানি। বেনুবর্নার কল্যাণে আমার ওয়ালে শেয়ারকৃত তাদের একটি পোস্টের ব্যাপারে দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছিল আমার। আমার সাথে জনবিজ্ঞান ফাউন্ডেশনের কোন কথা হয়নি এ ব্যাপারে, কিন্তু তাদের নোট থেকে দেখলাম, কেউ মরণোত্তর দেহদানে আগ্রহী হলে জনবিজ্ঞান ফাউন্ডেশন আইনগত-ভাবে ব্যাপারটা পরিচালনা করবে এবং উকিলের মাধ্যমে লিখিত ভাবে ফরম পূরণ করে দেহের ১৪টি অঙ্গ প্রতিস্থাপন করার অঙ্গীকার প্রদান করবে। বেলাল মোহম্মদ দীর্ঘদিন ধরে এই সংগঠনটির সাথে জড়িত ছিলেন বলে জেনেছি। তাই তিনি মরণোত্তরদেহ দান করে যাওয়ায় অবাক হইনি মোটেই। বরং মৃত্যুর পরেও যে তিনি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন সেটা জেনে গর্বিতই হয়েছি।

হ্যা, বেলাল মোহম্মদ যে অনুকরণীয় কাজটি করে গেছেন, সেটা নিয়ে গুরুত্ব দিয়ে ভাবার প্রয়োজন আছে, সবারই। আর আমি জানি এই আন্দোলনে আমি এক নই। জন লেননের মতই গাইতে ইচ্ছে করে মাঝে সাঝে –

তুমি হয়তো বলবে
আমি স্বপ্নদর্শী, কিন্তু জেনো আমি একা নই
একদিন তুমিও মোর সঙ্গী হবে,
আর পৃথিবীটা হবে এক …

ড. অভিজিৎ রায়: মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক।