অশ্রু-সুখের বাংলাদেশে

শারমিন আহমদ
Published : 4 August 2013, 07:48 AM
Updated : 4 August 2013, 07:48 AM

প্রতিবারই বাংলাদেশে যাই এবং সেখান থেকে প্রবাস আমেরিকায় ফিরে আসি এক সুগভীর মিশ্র অনুভূতি নিয়ে। সুখময় অনুভূতি, যখন প্রিয়জনদের সঙ্গে মিলিত হই। ছেলেবেলার মতো উচ্ছ্বাসে হৃদয় আন্দোলিত হয় যখন ফিরে যাই আব্বুর জন্মভূমি শীতলক্ষ্যার কূলঘেঁষা শাল, গজারি, মহুয়া বনে ঢাকা লাল মাটির প্রিয় দরদরিয়া গ্রামে। স্পর্শ করি আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, নারকেল আর জুঁই-কামিনীর আলিঙ্গনে ঘেরা পিতামহের হাতে গড়া ঐতিহাসিক গৃহটি।

তীব্র দুঃখ বোধ হয় যখন জনঅরণ্যের ঢাকা শহরে খুঁজে পাই না প্রিয় অনেক মানুষকে, শৈশবের রূপসী ঢাকাকে, কৃষ্ণচূড়া-বকুলে ছাওয়া ধানমণ্ডির রাস্তাগুলোকে। শ্বাসরুদ্ধকর ভিড় ও যানজটের মধ্যেও বোধ করি একরকমের নিঃসঙ্গতা।

আশির দশকের প্রথমার্ধে যখন সুদূর প্রবাসে পাড়ি জমাই, তখন আমাকে বিদায় দিতে যে একরাশ প্রিয় মানুষ আমাদের বাড়িতে ভিড় জমিয়েছিলেন তাদের অনেকেই আজ অমর্ত্য লোকের অধিবাসী। যারা রয়ে গেছেন এপারে, তাদের প্রায় সকলেই কোনো না কোনো বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছেন অথবা জীবনযুদ্ধে ক্লিষ্ট হয়ে কেমন নেতিয়ে গিয়েছেন।

যারা দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য এবং এক বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত ও নিরাপদ বাংলাদেশের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে নেমেছিলেন তাদের অনেকের চোখে দেখি স্বপ্নভঙ্গের কেমন এক নিরব আর্তনাদ।

প্রবাসীদের সমস্যা এই যে তারা যখন দেশ থেকে দূরে পাড়ি জমান তখন মনের মণিকোঠায় যে দেশটির স্মৃতি রেখে দেন পরম যত্নের সঙ্গে, তাকেই আবার খুঁজে পেতে চান স্বদেশের মাটিতে। আর এই খুঁজতে গিয়েই হোঁচট খেতে হয় পাহাড়সমান বেদনার দেয়ালে।

আমার আম্মার কথা দিয়েই শুরু করি। আম্মা প্রায় দুবছর অন্তর ম্যারিল্যান্ডে আমাদের কাছে বেড়াতে আসতেন। আমার সঙ্গে আমার ছেলেমেয়েরাও সাগ্রহে পথ চেয়ে থাকত ওদের নানুর জন্য। আম্মাকে নিয়ে বেড়াতে যেতাম ওয়াশিংটন ডিসির স্মিথসনিয়ানে যেখানে রয়েছে সারিবদ্ধ বৈচিত্র্যময় ইতিহাস ও নিদর্শনের আধার মিউজিয়াম-রাশি, বিনোদন পার্কে নানুকে চমক লাগাতে সন্তানদের হরেক রকমের অ্যাডভেঞ্চারাস রাইড, রোজার সময় আম্মাকে সঙ্গে নিয়ে পাড়ার মসজিদে বিভিন্ন জাতি ও ভাষাভাষী মুসলিমদের সঙ্গে ইফতার, আমার বিভিন্ন শান্তি ও উন্নয়ন বিষয়ক কর্মশালায় বিপুল উৎসাহে আম্মার যোগদান, নতুন কিছু দেখলেই জীবন সমন্ধে অশেষ কৌতূহলী উনার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন, মা ও মেয়ের নিবিড় সংলাপ, এক মহৎ রাজনৈতিক পুরুষ আব্বু এবং একটি জাতির জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে হাত ধরে চলা আম্মার স্মৃতি লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে আম্মাকে নতুন করে আবিষ্কারের নিগুঢ় আনন্দের মধ্যে দিয়ে আমাদের কাছে আম্মার বেড়াতে আসা হয়ে উঠত অবিস্মরণীয়, তাৎপর্যময়।

আম্মা এলে প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যেও ব্যাপক সাড়া পড়ে যেত। যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আম্মাকে আমন্ত্রণ জানানো হত। প্রধান অতিথি হিসেবে ভাষণদানরত আম্মার সৌন্দর্যের বুননে গাঁথা সুচিন্তিত, জ্ঞানগর্ভ ও তেজোদীপ্ত ভাষণ দুই শিশুসন্তানকে সঙ্গে নিয়ে বাকি শ্রোতাদের সঙ্গে শুনতাম মন্ত্রমুগ্ধের মতো। মন চলে যেত সেই পঁচাত্তর-পরবর্তী দিনগুলিতে।

বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর আম্মা সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের এক যুগান্তকারী আবির্ভাব বাংলাদেশের রাজনীতিতে। সে সময়, জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনকালে বাইরে সভা করে রাজনীতি ছিল নিষিদ্ধ। আওয়ামী লীগের বহু নেতা-কর্মী কারাগার-প্রকোষ্ঠে। যারা বাইরে রয়েছেন তারা ঘরোয়া মিটিংয়ের মধ্যে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।

আম্মা মাঝে মাঝে তাদের কাছ থেকে আমন্ত্রণ পান। কিন্তু আব্বুর অবর্তমানে স্কুলপড়ুয়া চার নাবালক সন্তান নিয়ে আম্মা তখন আবারও নেমেছেন জীবনযুদ্ধে। মিটিংয়ে যাবার সময়, মন ও মানসিকতা তখন নেই। পাকিস্তান আমলে পুরোদস্তুর রাজনৈতিক কর্মী ও নেতা আব্বু যখন জেলে যেতেন, তখন জীবনসংগ্রামে লিপ্ত আম্মার ভেতরে জ্বলত আশার আলো। আব্বু ঘরে ফিরবেন একদিন।

কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতেই মুক্তিযুদ্ধের কাণ্ডারি আব্বুর জেলপ্রকোষ্ঠে অমানবিক মৃত্যুর পর আম্মার ভেতরটা যে কেমন শূন্য হয়ে পড়েছিল তা ভুক্তভোগী যারা তারাই বুঝবেন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরল, আত্মপ্রচারবিমুখ, সৎ ও নির্লোভ, স্বাধীনতাউত্তরকালের অর্থমন্ত্রী মৃত্যুকালে নিজ উপার্জিত অর্থে কেনা বৈষয়িক সম্পদ বলতে পেছনে রেখে গিয়েছিলেন ১৯৫৭ সালে দশ বছরের কিস্তিতে ক্রয় করা ধানমণ্ডির জমির ওপর হাউস বিল্ডিংয়ের লোনে করা বাড়িটি, যার লোন তখনও শোধ হচ্ছিল বাড়ির অর্ধেক ভাড়া দিয়ে। আব্বুর মৃত্যুর পর বাড়িভাড়া আর হতে চায় না। আম্মারও তখন সংসার চালাতে হিমশিম খাওয়া অবস্থা।

এমন সময় আম্মা একদিন স্বপ্নে দেখলেন যে আব্বু যেন আমাদের ভেতরের বারান্দার ইজি চেয়ারে বসে পা দোলাতে দোলাতে তার স্বভাবজাত স্মিত হাসি দিয়ে আম্মাকে বলছেন, "তুমি একটু মিটিং-টিটিংয়ে যাও না কেন?"

তার কদিন পরেই আম্মা আওয়ামী লীগের তরফ থেকে একটি ঘরোয়া বৈঠকের আমন্ত্রণলিপি পেলেন। এর আগেও এমনি আমন্ত্রণ পেতেন, কিন্তু উল্লেখ্য পরিস্থিতির কারণে যাওয়া আর হত না। কিন্ত এবার মনস্থির করলেন যে যাবেন। আব্বুর স্বপ্নের কথাটা আম্মার মনে গেঁথে ছিল।

আওয়ামী লীগ নেতা জহিরুল কাইউমের বাড়িতে অনুষ্ঠিত মিটিংয়ে সেদিন ভীষণ রকমের বাক-বিতণ্ডা চলছিল। আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক পদে কেউ অন্য কারও নাম মেনে নিতে পারছিলেন না। দীর্ঘ সময় পার হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু আহ্বায়ক কে মনোনীত হবেন সে বিষয়ে নেতা-কর্মীরা কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছিলেন না।

সে সময় জহিরুল কাইউম সাহেব আম্মার নাম প্রস্তাব করেন। আম্মার নাম শুনে সভার নেতাকর্মীদের মতানৈক্য নিমিষেই দূর হয়ে যায়। সর্বসম্মতিক্রমে মহিলা আওয়ামী লীগের সদস্য আম্মা আওয়ামী লীগের আহ্বায়িকা মনোনীত হন এবং বাকশাল-উত্তর আওয়ামী লীগের নবজাগরণে এই নিবেদিত নেত্রী অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখেন।

সেই সময় যারা আম্মার সঙ্গে কাজ করেছেন তারা জানেন তিনি কতখানি আন্তরিকতা ও সততার সঙ্গে দলটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সামরিক জিয়া সরকার আরোপিত প্রচণ্ড বাধা ও হয়রানি উপেক্ষা করে বাংলাদেশের দূর-দূরান্তের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তিনি ভয়লেশহীনভাবে ঘুরে দলকে দিতেন দিকনির্দেশনা। তৃণমূলের থানা-ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। তাদের দিতেন উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোয় দলকে সবল করার জন্য সকলের মেধা ও মননশীলতা কাজে লাগাবার জন্য তিনি ছিলেন সদা সক্রিয়।

তিনি আত্মত্যাগের পরিচ্ছন্ন রাজনীতি বুঝতেন। দলাদলি করে, আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে ক্ষমতা, বিত্ত ও নামের রাজনীতি কী করে করতে হয় তা তিনি জানতেন না। এজন্য উনাকে ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হয়েছে কিন্তু তাতে উনার ভেতর কোনো খেদ ছিল না। আব্বুর মতোই উনার ভেতর 'ভালো কাজই জীবনের আলফা ও ওমেগা' এই মনোবৃত্তি কাজ করত নির্দ্বিধায়, নিঃসংকোচে।

আম্মার সেই দুঃসময়ের নেতৃত্ব কেন্দ্র করে নিউইয়র্কে ডেমোক্রেট দলের সক্রিয় রাজনীতিবিদ মোরশেদ আলম আমাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, আম্মার নেতৃত্বে বিশেষত তরুণ এবং তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিপুল সাড়া পড়ে যায়। তরুণ ছাত্রকর্মীদের প্রতি আম্মার নির্দেশ ছিল যে তারা যেন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে গিয়ে লেখাপড়ায় ব্যাঘাত না ঘটায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সেদিনের অনার্স বর্ষের ছাত্র মোরশেদ আলম বলেন, "খালাম্মা আমাদের লেখাপড়ার ফলাফল সমন্ধে নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখতেন। আমাদেরকে মূল্যায়ন করতেন সততা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে। নিজের স্বার্থ তিনি কখনও-ই দেখেননি।"

আওয়ামী লীগের সেই সময়ের আরেক তরুণ নেতা মুক্তিযোদ্ধা মফিযুল ইসলাম খান কামাল গত বছরে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আমাকে জানান যে, '৭৭-এর ১৫ আগস্টে সভা করে প্রথম শোক দিবস পালন করা হয় আম্মার নেতৃত্বে। সেটা এমন এক সময় ছিল যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম জনসমক্ষে উচ্চারণ করতে মানুষ ভয় পেত।

সে সময় আর্মি-পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে আম্মা তার সহকর্মীদের নিয়ে এগিয়ে যান বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর রোডের বাসভবন অভিমুখে। নিরাপত্তা বাহিনী ৩২ নম্বর রোডের সামনে ব্যারিকেড ফেলে উনাদের যাত্রা বন্ধের চেষ্টা করে। আম্মা তখন উনার সহকর্মীদের নিয়ে ওই ব্যারিকেডের সামনে রাস্তার ওপরেই সভা করে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার হত্যার দিনটিকে শোক দিবস রূপে স্মরণ করেন।

নারী উন্নয়ন সংগঠন মহিলা পরিষদের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন আম্মা এবং সেই সঙ্গে নানা সমাজসেবার সঙ্গেও যুক্ত থেকেছেন আজীবন। কিন্তু পঁচাত্তর-পরবর্তী আওয়ামী লীগের চরম নেতৃত্ব-সংকটের সময় তিনি যে সততা ও সাহসিকতার সঙ্গে নেতৃত্ব দেন ও এই দলের পুনরুত্থানে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন তা ছিল ঐতিহাসিক।

অন্য কোনো সভ্য দেশ হলে দলীয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সেই ইতিহাস শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হত যা নতুন প্রজন্মের জন্য হতে পারত সৎ এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ ও দুর্নীতিমুক্ত রাজনীতির উৎকৃষ্ট উদাহরণ। (একটি জাতির মুক্তিযুদ্ধের হাল ধরে, পাহাড়-সমান বাধা-বিপত্তি উতরে দক্ষ নাবিকের মতোই দেশটাকে বিজয়ের কূলে পৌঁছে দিয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ এবং সুশাসনকে রাজনৈতিক ও জাতীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত করার জন্য যার ছিল বিরল ভিশন, নিজস্ব কাজেকর্মে প্রকৃষ্ট উদাহরণ এবং আজীবন সংগ্রামী সেই মানুষটিরও তো কোনো মূল্যায়ন হয়নি। হাতেগোনা দু একজন বাদে ঐতিহাসিক ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদরা তাঁকে নিয়ে মৌলিক কোনো গবেষণা করেননি। উপরন্তু আটত্রিশ বছর হল বিগত একজন মৃত মানুষের ঐতিহাসিক অবদান স্মরণ করতে ক্ষমতাসীনদের এত শঙ্কা ও দৈন্যতা দেখে মনে হয়, তিনি আসলেই জীবিত। তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর কর্মের আলোকে বাস্তবিক মৃত্যুঞ্জয়ী।)

আম্মা যখন যুক্তরাষ্ট্রে আসতেন, তার প্রাণবন্ত সংলাপ, তেজস্বী বক্তব্য ও ইতিহাসচারণের মধ্যে দিয়ে আমি বর্তমান সময়কে বন্দি করে পৌঁছে যেতাম অন্যন্য এক ইতিহাসের মর্মস্থলে। মনে হত আম্মা চিরকাল এমনি করেই আমার কাছে আসবেন; এমনই তেজী থাকবেন শরীরে ও মনে।

২০০২ সালের অক্টোবরে আম্মা যুক্তরাষ্ট্রে এলেন। বেড়াতে নয়, চোখের চিকিৎসার জন্য। আম্মার বাঁ চোখে স্ট্রোক হল একমাত্র ছোটভাই সোহেলের ২০০১-এর নির্বাচনের ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে।

সোহেল সে বছর গাজীপুর-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হয় এবং জাতীয়ভাবে বিএনপি দল হয় বিজয়ী। নির্বাচনের আগে প্রতিপক্ষ বিএনপির নেতা হান্নান শাহের সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী রাতের অন্ধকারে সোহেল ও তার সমর্থকদের ওপর গুলিবর্ষণ করে এবং তারা অল্পের জন্য বেঁচে যায়। পরের দফায় দা, ছুরি, বল্লম ইত্যাদি নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে সোহেল ও তার নিরস্ত্র সমর্থকদের ট্রাকে।

সোহেলের সাহসিকতা ও উপস্থিত বুদ্ধির কারণে মানুষ সেদিন প্রাণে বেঁচে গেলেও, পরদিন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভরে যায় সোহেলের আহত সমর্থকদের দিয়ে। (সে সময় আমি বাংলাদেশে গিয়েছিলাম সোহেলের নির্বাচনের প্রচারকাজে ওকে সমর্থন যোগাতে এবং আম্মাকে সঙ্গে নিয়ে আহতদের দেখতে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে গিয়েছিলাম। বৃদ্ধ, কিশোর, দিনমজুর এমনি সাধারণ ও অসহায় মানুষদের ওপর হামলা করেছিল সন্ত্রাসীরা। পরে লাইব্রেরিয়ান জালালসহ আমাদের এলাকার নিরীহ অনেক সমর্থককে সন্ত্রাসীরা হত্যা করে।)

নির্বাচনের পরও হামলা চলতে থাকে এবং আমাদের বাড়িতেও ফোনে সোহেলকে হত্যার হুমকি আসতে থাকে। সোহেলের নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত আম্মা এমনি একটি হুমকিপূর্ণ ফোন কল রিসিভ করেন এবং প্রচণ্ড উত্তেজনায় সেই মুহূর্তেই আম্মার বাঁ চোখের আলো নিভে যায়। আমেরিকার চক্ষু বিশারদরা কোনো আশা দিতে পারলেন না। অন্য চোখের ওপরেও বেশি চাপ দিতে ডাক্তাররা নিষেধ করলেন। সব শুনে আম্মার একটি হতাশার অভিব্যক্তি ছিল- "তাহলে আমি লিখব-পড়ব কী করে?"

আমার কাছে এসে তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা আবারও লেখা শুরু করেছিলেন। '৭২ সালে তিনি 'উদয়ের পথে' নামে জনপ্রিয় এই স্মৃতিকথা ধারাবাহিকভাবে 'দৈনিক বাংলা'য় লিখতেন। পরবর্তীতে 'বিচিত্রা' ম্যাগাজিনেও তার সেই সুদীর্ঘ লেখা হতে অংশবিশেষ প্রকাশিত হয়েছিল।

২০০২ সালের পর আম্মার আর আমেরিকায় আসা হয়নি। পরের বছর উনার ব্রেন স্ট্রোক হল এবং তা থেকে সুস্থ হতে না হতেই একের পর এক রোগে উনি আক্রান্ত হলেন। আমেরিকায় আমার কাছে আসার সেই শারীরিক শক্তি আর রইল না।

প্রতিবার তাই বাংলাদেশে এসে আম্মার সাহচর্য ও সান্নিধ্যের মধ্যে খুঁজে নিই অক্সিজেনরূপী জীবনীশক্তি। শারীরিক-মানসিক এত ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও অভাবী, নিপীড়িত এবং অধস্তন কর্মচারিদের প্রতি আম্মার স্নেহশীল দৃষ্টি এখনও সজাগ, প্রখর এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সুন্দর হোক এ তাঁর প্রতিদিনের প্রার্থনা।

এ বছর জুনে ঢাকা যাই তাজউদ্দীন আহমদ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট ফান্ডের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন সম্পন্ন করতে। বাংলাদেশে শান্তি শিক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মশালা ও শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশে সহায়ক কর্মকাণ্ড সংগঠিত করাসহ ২০১১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগে (বাংলাদেশে আব্বুর নামে এই প্রথম) ট্রাস্ট ফান্ডটি প্রতিষ্ঠা করি। প্রতি বছর আব্বুর জন্ম-মাস জুলাইতে (জন্মদিন ২৩ জুলাই) ওই বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে শীর্ষ মার্কসপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীকে 'তাজউদ্দীন আহমদ শান্তি স্বর্ণপদক'-এ ভূষিত করা হয় এবং মাস্টার্স সমাপ্ত করার জন্য তাকে বৃত্তি দেওয়া হয়।

তাছাড়া ওই বিভাগে ফিমেল অ্যামপাওয়ারমেন্ট বৃত্তি প্রদান, তাজউদ্দীন আহমদের জীবন ও কর্মের আলোকে রচনা প্রতিযোগিতা, যাতে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করতে পারে এবং তাজউদ্দীন আহমদ স্মারক বক্তৃতার আয়োজন ট্রাষ্ট ফান্ড করে থাকে।

তরুণরা যখন উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে এ সকল কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে তখন মনে আশা জাগে যে এদের মধ্য থেকেই একদিন বেরিয়ে আসবে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ সৎ ও মেধাবী নেতৃত্ব। এ বছরের রচনার বিষয়বস্তু ছিল "মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে তাজউদ্দীন আহমদের ভূমিকা।"

উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর মুক্ত যশোরের মাটিতে তিনি ধর্মের অপব্যবহারকারী জামায়াতে ইসলামীর ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিল প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেছিলেন যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জার্মান যুদ্ধাপরাধীদের নাগরিকত্ব বাতিল হয়নি। তাদেরকে জার্মান নাগরিক হিসেবেই যুদ্ধাপরাধের জন্য বিচার করা হয়েছে।

আইনের শাসন, স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষ বিচারের প্রতি চিরশ্রদ্ধাশীল তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, "গোলাম আযমকেও দেশে আনতে হবে। এই সমস্ত লোকেরা বিদেশে থাকলে তাদের শাস্তি তো হল না। এই দেশের মানুষ তো জানতেই পারল না যে মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা কী জঘন্য অপরাধ করেছিল। সুতরাং দেশে তাদের আসতে হবে। দেশে ফিরে আসার পর তাদের বিচার করতে হবে এবং বিচারে যে শাস্তি হবে সেই শাস্তি তাদেরকে দেওয়া হবে, যদি কেউ বেকসুর খালাস পায় সেটা সে পাবে।"

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে তাঁর চিন্তাধারা ছিল স্বচ্ছ। তিনি বলেছিলেন, "যুদ্ধাপরাধ যে করেছে সে যদি পাকিস্তান আর্মির হয়ে থাকে তবে তাকে আন্তর্জাতিক আইনে বিচার করা হবে এবং সে যদি বাঙালি হয়ে থাকে তবে তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব থেকে বিচ্যূত না করে দেশের আইন অনুযায়ী বিচার করতে হবে।"

বর্তমানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তাঁর চিন্তার দূরদর্শিতাই প্রমাণ করে।

নৃশংস গণহত্যার মূল ঘাতকের তালিকাভূক্ত জেনারেল নিয়াজী, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পক রাও ফরমান আলীসহ ১৯৫ জন পাকিস্তানি সেনা যাদেরকে বঙ্গবন্ধু ক্ষমা করে দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে যারা বেঁচে আছে তাদেরও হয়তো একদিন বিচার হবে। প্রতিহিংসা নয়, ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যই বিচার হতে হবে সকল মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীর; তারা যে দল ও দেশভূক্তই হোক না কেন।

অনেকে ছোট বোন রিমি (তাজউদ্দীন আহমদ বিষয়ে যার ব্যাপক গবেষণাভিত্তিক প্রকাশিত গ্রন্থাবলী রয়েছে) আমাকে বলেন, ''তাজউদ্দীন আহমদের আদর্শ ঘিরে এ ধরনের কাজ তো জাতীয় পর্যায়ে হওয়া উচিত ছিল। এই ক্ষুদ্র পরিসরে কতখানি সম্ভব তাঁর আদর্শের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের পরিচিতি ঘটানো এবং তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করা?''

আম্মাকে সে কথা বলি। আম্মা উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করেন, "তুই কী বলিস?"

আমি তখন আম্মার সঙ্গে শেয়ার করি সেই পুরাতন নীতিগল্পটি যার রয়েছে বিবিধ ভার্সন, কিন্তু মূল কথা একই। এক ব্যক্তি সাগরপাড়ে হাঁটছেন। সাগরের ঢেউয়ের সঙ্গে বেলাভূমিতে আছড়ে পড়ছে রাশি রাশি স্টার ফিশ। ওই ব্যক্তি বালুতে পড়ে থাকা স্টার ফিশগুলোকে বাঁচানোর জন্য একটি দুটি করে তাদের তুলে নিয়ে সাগরের জলে ছুঁড়ে ফেলছেন।

দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি তার পাশেই হাঁটছিলেন, জিজ্ঞেস করলেন, "তুমি কী করছ?"

উদ্ধারকর্মে লিপ্ত ব্যক্তি বললেন, "এদের বাঁচানোর চেষ্টা করছি।"

প্রশ্নকর্তা অবাক হয়ে বললেন, "এই হাজার হাজার স্টার ফিশকে তো তুমি একা বাঁচাতে পারবে না! দুই একটিকে বাঁচিয়ে তুমি কোনো পরিবর্তনই আনতে পারবে না।"

প্রথম ব্যক্তি আরও একটি স্টার ফিশ হাতে তুলে নিয়ে সাগরের জলে ছুঁড়ে ফেলে উত্তর দিলেন, "ওই একটির তো পরিবর্তন হল।" (ইট মেইড আ ডিফারেন্স টু দ্যাট ওয়ান।)/big>

শারমিন আহমদ : শিক্ষাবিদ ও বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের জ্যেষ্ঠ কন্যা।