গাড়ির চতুর্থ চাকা

মুহম্মদ জাফর ইকবালমুহম্মদ জাফর ইকবাল
Published : 1 August 2013, 07:49 PM
Updated : 1 August 2013, 07:49 PM

মে মাসের ১০ তারিখে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে আমাকে সমাবর্তন বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আমি তখন অনেক চিন্তাভাবনা করে একটা বক্তব্য দাঁড় করিয়েছিলাম। বক্তব্যটি যদিও একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা নির্দিষ্ট বয়সের তরুণ-তরুণীদের উদ্দেশে তৈরি করা হয়েছিল কিন্তু সেখানে আমি যে কথাগুলো বলেছিলাম, আমার খুব ইচ্ছে সেই কথাগুলো অন্যদেরও বলি। আমার মনে হয় এই লেখায় সে কাজটি করার জন্যে খুব বড় একটা সুযোগ। আমি সুযোগটি গ্রহণ করছি, পাঠকেরা নিশ্চয়ই আমাকে ক্ষমা করে দেবেন।

আমার প্রিয় ছাত্রছাত্রীরা

আজকের দিনটি তোমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোর একটি– একই সঙ্গে এটি সবচেয়ে আনন্দেরও একটি দিন। আমার অনেক বড় সৌভাগ্য যে তোমাদের এই আনন্দের দিনটিতে আমি তোমাদের সঙ্গে কিছু সময় কাটাতে পারছি। আমাকে এই সুযোগটি দেওয়ার জন্যে তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা আমার জানা নেই।

তোমরা যে রকম তোমাদের জীবনের প্রথম সমাবর্তনে এসেছ আমিও ঠিক সে রকম আমার জীবনের প্রথম সমাবর্তন বক্তা হিসেবে এসেছি। সমাবর্তন নিয়ে তোমাদের মনের ভেতর যে রকম আগ্রহ এবং উদ্দীপনা– তোমাদের সামনে কয়েকটি কথা বলার জন্যে আমার ভেতরেও ঠিক একই আগ্রহ এবং উদ্দীপনা।

তোমাদের আমি কোনো উপদেশ দেব না, কোনো নীতিকথাও শোনাব না, আমি তোমাদের হয়তো কয়েকটি কথা স্মরণ করিয়ে দেব। তার পাশাপাশি আমি আমার এই দীর্ঘ জীবনে যে কয়টি সত্য উপলব্ধি করেছি তোমাদেরকে সেই কথাগুলো বলার চেষ্টা করব। কয়েক যুগ পর তোমরা হয়তো নিজেরাই এই সত্যগুলো উপলব্ধি করবে। আমি মাঝখানের সেই দীর্ঘ সময়টুকু শর্টসার্কিট করে দিচ্ছি মাত্র– তার বেশি কিছু নয়।

তোমরা একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করে জীবনের পরের ধাপে পা দিতে যাচ্ছ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় চলে আসার কারণে দেশের সবাই এখন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে লেখাপড়ায় কত খরচ হয় তার একটা ধারণা পেয়ে গেছে। সেই তুলনাটি থেকে তোমাদের ধারণা হতে পারে তোমরা বুঝি খুব অল্পখরচে একটা ডিগ্রি পেয়েছ– সেটি কিন্তু সত্যি নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বাজেটকে তোমাদের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে তোমাদের লেখাপড়ার খরচটুকু বের হয়ে আসবে এবং আমি বাজি ধরে বলতে পারি সেই পরিমাণটুকু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ থেকে কোনো অংশে কম নয়– বরং বেশি হলে আমি অবাক হব না।

তোমাদের পেছনে এই খরচটুকু করেছে সরকার। সরকার এই অর্থটুকু কার কাছ থেকে পেয়েছে? পেয়েছে এই দেশের চাষীদের কাছ থেকে, শ্রমিকদের কাছ থেকে, খেটে খাওয়া মানুষদের কাছ থেকে। আমি তোমাদের শুধু মনে করিয়ে দিতে চাই এই দেশের অনেক দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষ হয়তো তার নিজের সন্তানকে স্কুল-কলেজ শেষ করিয়ে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত পাঠাতে পারেনি, কিন্তু তার হাড়ভাঙ্গা খাটুনির অর্থ দিয়ে তোমাদের লেখাপড়া করিয়েছে। এখন তোমরাই ঠিক কর এই শিক্ষাটুকু দিয়ে কার জন্যে কী করবে!

কিছুদিন আগে খবরের কাগজের একটি প্রতিবেদন চোখে আঙুল দিয়ে আমাকে একটি সত্য নতুন করে জানিয়ে দিয়েছে। সত্যটি হল আমাদের দেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে এসেছে, আর এই এগিয়ে যাওয়ার পিছনে রয়েছে দেশের তিন ধরনের মানুষ। গার্মেন্টেসের শ্রমিকরা– যার বেশিরভাগই হচ্ছে মেয়ে– অর্ধসহস্রাধিক (তখনও আমি জানতাম না সংখ্যাটি আসলে সহস্রাধিক হয়ে যাবে) সেই গার্মেন্টস শ্রমিকদের আমরা সাভারে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছি। প্রবাসী শ্রমিক– যারা আপনজনকে দেশে ফেলে নির্বান্ধব পরিবেশে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এবং এই দেশের কৃষক যাদেরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার জন্যে আমরা আমাদের ভাষায় 'চাষা' নামক একটা শব্দ তৈরি করে রেখেছি।

আমি রীতিমত ধাক্কা খেয়েছি যখন আবিষ্কার করেছি– যারা এই দেশের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে আমি তাদের কেউ নই, তাদের কারও সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই– আমি তাদের জন্যে কখনও কিছু করিনি। আমার মনে হয়েছে আমি বুঝি এই দেশের বোঝা, এই দেশের গার্মেন্টেসের মেয়েরা, প্রবাসী শ্রমিকেরা আর মাঠেঘাটের চাষীরা আমাকে সুন্দর একটা জীবন উপহার দিয়েছে– প্রতিদানে আমি তাদের কিছু দিইনি।

আমি তখন নিজেকে বুঝিয়েছি, দেশের অর্থনীতিকে এখন গার্মেন্টেসের মেয়েরা, প্রবাসী শ্রমিক এবং চাষীরা সচল রেখেছে, তারা একটি গাড়ির তিনটি চাকার মতো– গাড়িটি সত্যিকারভাবে ছুটতে পারবে যখন তার সঙ্গে চতুর্থ চাকাটি জুড়ে দেওয়া হবে। সেই চতুর্থ চাকা কোনটি?

তোমরা হচ্ছ সেই চতুর্থ চাকা, জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে বলীয়ান আমাদের নতুন প্রজন্ম। আমি বুভুক্ষের মতো অপেক্ষা করে আছি তোমাদের মেধা, মনন এবং সৃজনশীলতা নিয়ে কখন তোমরা এই দেশের শ্রমজীবী মানুষের পাশে এসে দাঁড়াবে। কখন মানুষের শরীরের ঘাম অপসারিত হবে মস্তিষ্কের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে।

তোমরা কি জান, এটি তোমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়? তোমরা কি জান তোমাদের চোখে রয়েছে রঙিন চশমা, আমাদের চোখে যেটি একেবারেই সাদামাটা তোমাদের চোখে সেটিই বিচিত্র বর্ণে উজ্জ্বল? তোমরা কি জান এখন তোমাদের জীবন উপভোগ করার সময়?

তোমরা কি জান জীবন কীভাবে সবচেয়ে বেশি উপভোগ করা যায়? তোমাদের সবারই নিশ্চয়ই এই বিষয়ে নিজের একটা ভাবনা আছে– আমি তোমাদের সঙ্গে আমার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া আমার ভাবনাটুকু বিনিময় করি। নিজের জন্যে যখন কিছু একটা করি তখন অবশ্যই আমাদের এক ধরনের আনন্দ হয়। কিন্তু তার থেকে শতগুণ বেশি আনন্দ হয় যখন আমরা অন্যের জন্যে কিছু করি!

তোমাদের ভেতর যারা বন্যাপীড়িত মানুষের কাছে গিয়ে তাদের হাতে একটুখানি ত্রাণ তুলে দিয়েছ তখন তাদের মুখে যে হাসিটুকু দেখেছ আমি জানি সেটি তুমি কখনও ভুলবে না। তুমি যখন রক্ত দিয়েছ সেই রক্তের ব্যাগ থেকে ফোঁটাফোঁটা রক্ত গিয়ে যখন একজন মূমূর্ষ বিবর্ণ রোগীর মুখে জীবনের স্পন্দন দিয়ে এসেছে, আমি জানি তুমি সেই আনন্দের কথা কখনও ভুলতে পারবে না। তুমি যখন তোমার ক্যাম্পাসের পথেঘাটে পাতাকুড়ানো হতদরিদ্র শিশুটিকে বারান্দায় বসিয়ে বর্ণপরিচয় করিয়েছ, তুমি নিশ্চয়ই সেই আনন্দটির কথাও কখনও ভুলতে পারনি। যখন গণিত অলিম্পিয়াডে গিয়ে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের সাহায্য করেছ তখন তাদের উজ্জল চোখের দৃষ্টি নিশ্চয়ই তুমি ভুলতে পারনি।

যারা এখনও সেই তীব্র আনন্দের স্বাদ উপভোগ করনি তাদের আমি মনে করিয়ে দিতে চাই– জীবনটিকে একেবারে কানায় কানায় উপভোগ করার এখনই সময়। অন্যের জন্যে কিছু করে জীবন উপভোগ করার এই পথটুকুর সন্ধান পেতে পেতে আমার অনেক সময় পার হয়ে গিয়েছিল– আমি কিন্তু তোমাদের অনেক আগেই বলে দিয়েছি!

আমার এই দীর্ঘ জীবনে আমি অনেক মানুষকে দেখেছি, অনেকের সঙ্গে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে, সবাইকে নিয়ে আমি অনেক কিছু করেছি। আমার এই দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে আমি খুব সোজাসাপ্টা একটা বিষয় আবিষ্কার করেছি; সেটি হচ্ছে পৃথিবীর মানুষ দুই রকম! এক ধরনের মানুষের সবকিছুতে উৎসাহ, সবসময়ই তারা নতুন কিছু করার জন্যে ব্যস্ত। সবসময়ই তারা কিছু না কিছু করছে, একশ'টা জিনিস করতে গিয়ে তারা অনেক সময়েই ঘোট পাকিয়ে ফেলছে, সমস্যায় পড়ে যাচ্ছে– তারপরও তাদের উৎসাহের কোনো অভাব নেই। অন্য ধরনের মানুষের কোনো কিছুতে উৎসাহ নেই, তারা নিস্পৃহ, তাদের তাপ-উত্তাপ নেই। তারা নতুন কিছু করে না, তাই তাদের জীবনে ভুলও হয় না। তাদের নিস্তরঙ্গ জীবনে উত্তেজনা নেই, উচ্ছ্বাস নেই।

আমি তোমাদের আরও একটি সত্যের সন্ধান দিয়ে যাই– এই পৃথিবী, দেশ কিংবা সমাজটাকে চালায় প্রথম গোষ্ঠী যাদের সবকিছুতে উৎসাহ! পৃথিবীর যত বড় কাজ সব করেছে এই উৎসাহী প্রজন্ম। তোমাদের ভেতর যারা এই উৎসাহীদের দলে আমি জানি তোমাদের অতিউৎসাহের কারণে অনেক সময় তোমাদের ক্ষতি হয়েছে, অনেক গুরুজন তোমাদের নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে নিষেধ করেছেন, ভূল সিদ্ধান্ত নিয়ে তোমরা অনেকবার বিপদে পড়েছ।

আমি তোমাদের আশ্বস্ত করতে চাই, দেখবে তোমরাই কিন্তু সবকিছুতে নেতৃত্ব দেবে, তোমার অঙ্গুলিহেলনে সবাই তোমাদের পিছনে এসে দাঁড়াবে। তোমাদের ভিতর যারা উৎসাহকে রাশ টেনে নামিয়ে সতর্কভাবে পা ফেলেছে, উৎসাহী বন্ধুদের একশ রকম কাজ দেখে বিরক্ত হচ্ছে, সমালোচনা করেছে তাদেরকে বলে রাখি– এই উৎসাহটুকুই কিন্তু সফল আর অসফল মানুষের মাঝখানে বিভাজন। তোমরা ঠিক কর মাপা উৎসাহ নিয়ে বিভাজনের নিচে দাঁড়াবে নাকি তীব্র উৎসাহের বান ডাকিয়ে বিভাজনের উপরে গিয়ে দাঁড়াবে।

আজ তোমাদের একটি ছাত্রজীবনের সমাপ্তি হয়েছে। মেধার মূল্যায়ন করতে গিয়ে তোমাদেরকে অসংখ্যবার পরীক্ষা দিতে হয়েছে, সেই পরীক্ষায় তুমি তোমার সহপাঠীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছ, সেই প্রতিযোগিতায় তোমরা কেউ কেউ তোমাদের সহপাঠীদের পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছ।

আমি তোমাদের মনে করিয়ে দিতে চাই সত্যিকারের জীবন কিন্তু প্রতিযোগিতার জীবন নয়। যেখানে কিন্তু কাউকে ঠেলে পেছনে ফেলে তোমায় এগিয়ে যেতে হবে না। সত্যিকারের জীবন হচ্ছে সহযোগিতার। সত্যিকার জীবনে তুমি যখন সত্যিকারের কাজ করবে তখন একে অন্যের সঙ্গে পাশাপাশি থেকে সাহায্য করবে। সেখানে কোনো প্রতিযোগিতা নেই।

প্রতিযোগিতা শুধু একটি জায়গায় থাকে– সেটি হচ্ছে নিজের সঙ্গে প্রতিযোগিতা। তুমি এখন যা, দেখি তুমি এক বছর পর সেখান থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে পার কিনা।

তোমরা এই দেশের নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে যাচ্ছ, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মশালটি এখন তোমাদের হাতে। তোমরা কর্মজীবনে কী কর তার উপর নির্ভর করবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম। তাই তোমাদের আকাশছোঁয়া স্বপ্ন দেখতে হবে। বড় স্বপ্ন না দেখলে বড় কিছু অর্জন করা যায় না!

এই দেশটি তরুণদের দেশ। বায়ান্ন সালে তরুণেরা এই দেশে মাতৃভাষার জন্যে আন্দোলন করেছে, রক্ত দিয়েছে, একাত্তরে সেই তরুণেরাই মাতৃভূমির জন্যে যুদ্ধ করেছে, অকাতরে রক্ত দিয়েছে। আমাদের দেশটি এখন যখন পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে যাচ্ছে আবার সেই তরুণেরাই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে। তোমরা সেই তরুণদের প্রতিনিধি– তোমাদের দেখে আমি অনুপ্রাণিত হই, আমি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি।

তোমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা– ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখার জন্যে আমাকে নতুন একটা সুযোগ করে দেওয়ার জন্যে!

মুহম্মদ জাফর ইকবাল: অধ্যাপক, শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।