প্রাণদণ্ডাদেশ প্রত্যাশিত ছিল

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীসিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
Published : 15 July 2013, 09:25 AM
Updated : 15 July 2013, 09:25 AM

একাত্তরের সবচেয়ে আলোচিত ও ঘৃণিত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ গঠন করেছে। দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে কাঙ্খিত রায় ঘোষণা হল ১৫ জুলাই ২০১৩। এদিকে দেশজুড়ে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং আলোচনাও ছিল ব্যাপক। যাহোক, কাঙ্খিত রায় পাওয়া গেল এটা দেশের জন্য বড় একটি খবর।

এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে। যুদ্ধাপরাধের বিচার কিন্তু কোনো ব্যক্তির বিচার নয়, এটা হল একটি অপরাধের বিচার। এ বিচার খুবই প্রয়োজনীয় ছিল। কারণ এটি ছিল মস্ত বড় একটি অপরাধ। এমন নয় যে, কিছু ব্যক্তি একটি অপরাধ সংঘটন করেছে। এটি একটি সংগঠিত অপরাধ। একটি জাতির ওপর দীর্ঘ ন' মাসে গণহত্যা, নারীনির্যাতন, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মতো চরম অপরাধ করা হয়েছে। এসব অপরাধের জন্য যুদ্ধাপরাধীদের অবশ্যই শাস্তি দিতে হবে।

সন্দেহ নেই, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের জন্য মূলত দায়ী ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তাদের আমরা বিচার করতে পারিনি এটি অবশ্যই আমাদের বড় একটি ব্যর্থতা। বিশেষ করে চিহ্নিত ১৯৩ জনের যাদের নামের একটি তালিকা তৈরি হয়েছিল তাদের বিচার করা খুবই জরুরি ছিল।
কিন্তু সেই ব্যর্থতার জন্য তাদের সহযোগীদের বিচার করব না তা হতে পারে না। হানাদার বাহিনীর সহযোগীরা আমাদের দেশেরই লোক। তারপরও তারা তাদের অপরাধগুলো ছিল খুবই জঘন্য। কারণ এ দেশের মানুষ হয়ে তারা ভিনদেশের বাহিনীকে এখানে যুদ্ধাপরাধ সংঘটনে পূর্ণ সহযোগিতা ও সমর্থন দিয়েছে। এ ধরনের অপরাধের কোনো তুলনা হয় না। তাই এদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা ছিল খুব শুভ একটি উদ্যোগ।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি মনে রাখা জরুরি তা হল, এই বিচারপ্রক্রিয়া কোনো প্রতিহিংসামূলক কাজ নয়। বরং এ প্রক্রিয়া শুরু করার মাধ্যমে এই সত্য প্রতিষ্ঠিত করা যাচ্ছে যে, অন্যায় করলে অপরাধীকে শাস্তি পেতে হবে। কোনো অজুহাতেই অপরাধী পার পেয়ে যেতে পারবে না। পাশাপাশি অপরাধকেও চিহ্নিত করা যাবে যে কত বড় অপরাধ তারা করেছে।

আরেকটি বিষয় হল এটাই যে, এতবড় অপরাধের বিচার করতে এতদিন আমরা ব্যর্থ হয়েছি বলেই ছোট ছোট অনেক অপরাধের ন্যায্যতা নষ্ট হয়ে গেছে। এতবড় একটি অপরাধ বিচারের আওতার বাইরে ছিলো বহুদিন।

গোলাম আযমসহ দেশের চিহ্নিত যুদ্ধপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া সব জায়গায় একটি বার্তাও পৌঁছে দেবে। সমষ্টিগতভাবে একটি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। অপরাধীদের শাস্তি দিয়ে আমরা এটা নিশ্চিত করতে পারছি যে, এ ধরনের গুরুতর অপরাধ সংঘটনে ভবিষ্যতে আর কেউ সাহস করতে পারবে না। এভাবে একটি বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে শুরু করেছি। সামগ্রিকভাবে দেশের জন্য এর ফলাফল ইতিবাচক হবে।

চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে গোলাম আযম ছিলেন সংগঠক। তিনি এ কাজে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। অন্যসব যুদ্ধাপরাধীরা তারই অনুসারী। তাই তার অপরাধের মাত্রা অনেক বেশি। গোলাম আযমের ভূমিকা এতটাই ষ্পষ্ট ছিল যে, এটা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। নতুন করে তার অপরাধ প্রমাণের জন্য আর বেশি তথ্যপ্রমাণের দরকার নেই। একাত্তরে এদেশের সাধারণ মানুষও জানতেন তার ভূমিকার কথা।

এ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ইউরোপে নুরেমবার্গ ট্রায়ালের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হয়েছিল। এখানে একটি কথা বলব যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যারা অপরাধ করেছিল, অনেক বছর পরে হলেও তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল। ইউরোপের বসনিয়া-হারজেগোবিনায় যুদ্ধাপরাধ সংঘটনের দায়ে অপরাধীদের বিচার করা হচ্ছে। আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকায় না হলেও বেশ কয়েকটি দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার হচ্ছে।

এসব উদাহরণ আমাদের সামনে আছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার করার এই সংস্কৃতি সারা বিশ্বেই উদাহরণ তৈরি করছে। আমরাও তেমন একটি উদাহরণ তৈরি করছি এটাই হচ্ছে যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়ার সবচেয়ে বড় দিক।

গোলাম আযমের মতো গণহত্যার সংগঠকের শেষ পর্যন্ত ফাঁসির রায় হল না, তাকে নব্বই বছরের কারাদণ্ড দেয়া হল। যদিও তার প্রাণদণ্ডাদেশ প্রত্যাশিত ছিল, কিন্তু এত দীর্ঘ সময়ের কারাদণ্ডও চরম শাস্তিই । তিনি তো আর নব্বই বছর বাঁচবেন না । তবে এ রায়ের ফলে তিনি বেঁচে থাকার একটি সুযোগ পেলেন সেটা্ও সত্য । প্রাণদণ্ডাদেশ হলে সেটি কার্যকর করে তাকে অপরাধের জন্য প্রাপ্য শাস্তি দেয়া সহজ ছিল । তবে আপিলের সুযোগ আছে ।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক, কলামিস্ট ও লেখক।