যুক্তরাষ্ট্র-তালেবান আলোচনা : কী ঘটেছে কী ঘটবে

Published : 20 June 2013, 07:45 PM
Updated : 20 June 2013, 07:45 PM

যুক্তরাষ্ট্র এবং আফগানিস্তানের তালেবানরা সরাসরি আলোচনায় বসতে সম্মত হয়েছে। ঘটনাটি আফগানিস্তানে বারো বছর ধরে চলা যুদ্ধের অবসানের পথে বড় ধরনের একটি পদক্ষেপ। এতে আফগান সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা তৈরি হল। তবে মনে রাখতে হবে এখন পর্যন্ত কেবল সম্ভাবনাই তৈরি হয়েছে– এর বেশি কিছু নয়।

তালেবানের পক্ষ থেকে এ ঘোষণা এবং তার পরপরই হোয়াইট হাউসের এ বিষয়ে বক্তব্য যতটা নাটকীয় ততটাই প্রত্যাশিত; প্রত্যাশিত এ অর্থে যে এটি হঠাৎ ঘটেনি। গত কয়েক বছর ধরে- অন্ততপক্ষে দেড় বছর হবে- এ ধরনের একটি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্যে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো কাজ করে যাচ্ছিল। ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটোর সৈন্যরা আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহার হওয়ার পর সেখানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য রাজনৈতিক সমাধানের বিকল্প নেই– এ বিবেচনার আলোকেই যুক্তরাষ্ট্র তালেবানের সঙ্গে আলোচনায় রাজি হয়েছে।

অন্যদিকে তালেবানের একটা বড় অংশই এখন মনে করে যে যুদ্ধের পরিবর্তে আলোচনার মাধ্যমেই তারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশীদার হতে পারে। 'তালেবান আলোচনার মাধ্যমে সমাধান চায়'- কাতারে তালেবান প্রতিনিধি মোহামদ নাঈমের এ ঘোষণা ছিল প্রত্যাশিত; কিন্ত দেড় বছর ধরে চলা চেষ্টাটি যে শেষ পর্যন্ত বাস্তবের মুখ দেখবে এ নিয়ে অনেকে সন্দিগ্ধও ছিলেন।

লক্ষ্য করে থাকবেন যে এ বিষয়ে সংবাদে বলা হয়েছে আলোচনার উদ্দেশ্যে কাতারে তালেবানের অফিস খোলা হয়েছে। এ থেকে কারও কারও মনে এ ধারণা হতে পারে যে এইমাত্র কাতারে তালেবানের অফিস খোলা হল। কিন্ত যারা আফগানিস্তানের খবরাখবর রাখেন তারা জানেন যে দু বছর আগেই কাতারে তালেবানের একটি অফিস খোলা হয়েছে। তালেবানের সঙ্গে ভবিষ্যতে আনুষ্ঠানিক আলোচনার ঘোষণা দেওয়া হলেও তাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অঘোষিত যোগাযোগ ও আলোচনা চলছে ২০১১ সাল থেকেই। সে বছর কাতারে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও তালেবানদের মধ্যে যে গোপন আলোচনা হয় তাতেই এ বিষয়ে আশার সঞ্চার হয় যে তালেবানের অন্ততপক্ষে একাংশ আলোচনার মাধ্যমেই সংকটের সমাধান করতে চায়।

এ প্রেক্ষাপটে কাতারে তালেবানের অফিস স্থাপন বিষয়ে ২০১১ সালের শেষদিকে যুক্তরাষ্ট্র নীতিগতভাবে সম্মতি দেয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতি থাকলেও ২০১২ সালের গোড়া থেকে কয়েকটি সমস্যার সমাধান করতে করতেই প্রায় এক বছর লেগে যায়।

অনানুষ্ঠানিকভাবে গত বছরের শুরুতে কাতারে অফিস খোলার কাজটি সম্পাদিত হয়। কিন্ত তালেবানরা এ বিষয়ে সরাসরি কোনো ঘোষণা দিতে পারেনি; এর অন্যতম কারণ ছিল আফগান সরকারের আপত্তি। তালেবানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি আলোচনার বিষয়ে আপত্তি ছিল স্বয়ং আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের।

অন্যদিকে তালেবান আফগান সরকারের সঙ্গে আলোচনায় মোটেই উৎসাহী ছিল না এ যুক্তিতে যে, আফগান সরকার একটি পুতুল সরকার আর আফগানিস্তান বিদেশি বাহিনী দিয়ে অধিকৃত; অতএব আলোচনা হতে হবে বিদেশিদের সঙ্গেই। একই ধরনের আপত্তি পাকিস্তানের প্রশাসনের একাংশেরও ছিল। যে কারণে বছরের গোড়াতে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই শতাধিক তালেবান নেতাকে আটক করেছিল। এ নেতারা পাকিস্তানিদের অনুমতি ছাড়াই আফগান সরকার, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি ও জাতিসংঘের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়েছিল এবং যোগাযোগ রাখছিল।

সংশ্লিষ্ট তিন পক্ষেরই কঠোর অবস্থান আলোচনার পথে বাধা হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় সমস্যা দেখা দেয় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাতারের ভূমিকা নিয়ে। কাতারের মধ্যস্থতার ভূমিকা কারজাই পছন্দ করেননি। তিনি চাচ্ছিলেন সৌদি আরব ও তার সরকারের নিয়োগকৃত 'আফগানিস্তান শান্তি কাউন্সিল' এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা নিক এবং আলোচনা কাতারের বদলে সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত হোক।

শেষাবধি কারজাই এ প্রক্রিয়ার ব্যাপারে রাজি হলেও ততদিনে আরেকটা বড় বাধা মাথাছাড়া দিয়ে উঠেছে। কাতারে তালেবানের অফিসের কাজের চরিত্র ও প্রকৃতি কী হবে সেটি নিয়ে অস্পষ্টতা ছিল। যুক্তরাষ্ট্র কোনো অবস্থাতেই চায়নি যে আলোচনা উপলক্ষ করে তালেবানের খোলা এ অফিস কার্যত তালেবানের দূতাবাসে পরিণত হোক। তালেবান প্রতিনিধিরা কাতারে উপস্থিত হয়ে গোটা পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের কাজের বৈধতা তৈরি ও সামরিক অভিযানের জন্য অর্থসংগ্রহ করবে- যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সেটি ছিল সবচেয়ে অগ্রহণযোগ্য বিষয়।

ফলে তালেবানের কাছ থেকে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাই নিশ্চয়তা আদায়ের চেষ্টা করছিল যে এ অফিস শান্তি আলোচনার বাইরে আর কোনো কাজে ব্যবহৃত হবে না। এ পটভূমিকায় তালেবান নেতারা অন্যান্য বিষয়ের নিস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কাতারে তাদের অফিস স্থাপনের কাজটির জন্য অপেক্ষা করে।

এসবের মধ্যেই নতুন সমস্যা তৈরি হয়। ২০১২ সালের মার্চে তালেবানরা সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় যাবে না। এর প্রেক্ষিত ছিল ফেব্রুয়ারি মাসে ন্যাটোর একটি ঘাঁটিতে কোরান শরীফ পোড়ানো এবং যুক্তরাষ্ট্রের একজন সৈন্য কর্তৃক ৭ বেসামরিক আফগান নাগরিক হত্যার ঘটনা। এরপর তালেবানরা জানিয়ে দেয় যে তারা আলোচনা থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। সাধারণভাবে গণমাধ্যমে তালেবানরা এ ঘটনাগুলো কারণ হিসেবে বললেও সেগুলোই আসল কারণ ছিল বলে মনে হয় না। যে বিবৃতিতে তালেবান ঘোষণা করেছিল যে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তি আলোচনা স্থগিত করছে সেখানে তারা এও দাবি করেছিল যে আলোচনায় স্বচ্ছতার অভাব এবং অঙ্গীকার পূর্ণ করায় মার্কিনীদের ব্যর্থতাই এ সিদ্ধান্তের কারণ।

অঙ্গীকার পূরণের বিষয়টি কী সেটা তালেবানের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করা না হলেও বিশ্লেষকদের ধারণা ছিল যে আলোচনার পূর্বশর্ত হিসেবে পাঁচ তালেবান নেতাকে গুয়ানতানামোর বন্দিশিবির থেকে কাতারের জেলে পাঠাতে যুক্তরাষ্ট্র আগে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সম্ভবত সেখান থেকে সরে আসাই আলোচনা ভেঙে যাওয়ার অন্যতম কারণ। কথা ছিল যে এ পাঁচজনের হস্তান্তরের বিপরীতে তালেবানের হাতে আটক অপহৃত মার্কিন সেনা বোয়ি বার্গদালকে ছেড়ে দেওয়া হবে। আলোচনা ভেঙে যাওয়ায় কোনো পক্ষই আর এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়নি।

এসব ঘটনার পাশাপাশি আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে তালেবানের শক্তিবৃদ্ধি ঘটে এবং আন্তর্জাতিক বাহিনীর ওপর হামলা বেড়ে যায়। অন্যদিকে ওবামা প্রশাসন এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে ২০১৪ সালের শেষ নাগাদ সৈন্যপ্রত্যাহারের পরিকল্পনা থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে আসবে না। আলোচনা ভেঙে যাওয়ার বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যে কূটনৈতিক মহলে অনেকেই জাতিসংঘের মহাসচিবকে আহবান জানান যেন জাতিসংঘ, বিশেষ করে মহাসচিব ব্যক্তিগতভাবে আলোচনার উদ্যোগ নেন যাতে ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক সেনাউপস্থিতির অবসান হলে সেখানে আর রক্তপাতের ঘটনা না ঘটে।

এ ধরনের হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতির মধ্যেও বিবদমান দলগুলোর মধ্যে একধরনের যোগাযোগ অব্যাহত ছিল ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত দুটি বেসরকারি উদ্যোগের কারণে; এর একটি হল জুন মাসে জাপানের কিয়োটোতে এবং অপরটি একই বছরের ডিসেম্বরে প্যারিসে অনুষ্ঠিত আরেকটি বৈঠকের কারণে। দ্বিতীয় বৈঠকের আয়োজন করে একটি গবেষণা সংস্থা- ফাউন্ডেশন ফর স্ট্র্যাটেজিক রিসার্চ, যেখানে তালেবান এবং তার প্রতিপক্ষ নর্দার্ন অ্যালায়েন্স যোগ দেয়; যুক্ত্ররাষ্ট্র, আফগান সরকারের প্রতিনিধি ও অন্যান্যরা তো সেখানে ছিলই। এ যোগাযোগগুলো ভবিষ্যত আলোচনার দরজা সামান্য হলেও উন্মুক্ত রাখে।

আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পথে যেমন বিভিন্ন বাধা তৈরি হয় তেমনই কয়েকটি ঘটনা সব পক্ষকেই আলোচনার পথে ঠেলে দেয়। ওবামা প্রশাসন দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিবেচনায় এ যুদ্ধের অবসানের জন্য সচেষ্ট শুধু নয়, বলা যায় মরিয়া হয়ে ওঠে। বারাক ওবামা চান তার দ্বিতীয় মেয়াদের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে প্রক্রিয়াটি শেষ করে সব সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে যাতে ইতিহাসে তার নাম এ বলে উল্লিখিত হয় যে তার আমলেই দুটো দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ শেষ হয়েছে।

অন্যদিকে তালেবানরা দেশের ভেতরে সংঘাতে সাফল্য লাভ করলেও তাদের অভ্যন্তরীন বিবাদ বাড়তে থাকে। ২০১২ সালের মার্চ মাসে তালেবানের এ বিভক্তির জের ধরে তাদের বেশ কজন নেতা নিহত হন; বাকিরা পাকিস্তান ত্যাগ করতে বাধ্য হন। তালেবানের একপক্ষ মনে করে তারা যুদ্ধের মধ্য দিয়েই বিজয়ী হবে; কিন্ত অন্যপক্ষ মনে করে তাদের উচিত হবে আলোচনার মাধ্যমে আফগানিস্তানে প্রভাব বৃদ্ধি করা। তাদের মধ্যে এ আশংকাও তৈরি হয় যে ন্যাটো সৈন্যদের প্রত্যাহারের পর রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণের বিষয়ে পরিস্কার ধারণা না থাকলে একসময় সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহারের পর মুজাহিদরা যেমন পারস্পরিক বিরোধে জড়িয়ে পড়েছিল তারাও একই সমস্যায় পড়তে পারে।

পাকিস্তানের প্রশাসনের মধ্যেও তালেবান প্রশ্নে দৃষ্টিভঙ্গির বদল ঘটে। ২০১২ সালের গোড়ায় তালেবানের পক্ষে যারা বাইরের শক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল তাদের আটক করা হয়; আইএসআই-য়ের কোপানলে পড়েছিল ওরা। কিন্ত ২০১২ সালের শেষ নাগাদ অনেক তালেবান নেতাকে আবার পাকিস্তানের জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়, আলোচনায় উৎসাহী করে তোলার জন্যই মূলত। পাকিস্তানের দৃষ্টিভঙ্গি বদলের কারণ ছিল তাদের দেশের ভেতরে তালেবানের প্রভাব বৃদ্ধি এবং তালেবানকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতি।

আফগানিস্তানের শান্তিপ্রক্রিয়ায় পাকিস্তানের ভূমিকা বিষয়ে আফগান সরকারের অবস্থান বদলের ফলেও আলোচনার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। অতীতে আফগান সরকার তালেবানের সঙ্গে আলোচনায় পাকিস্তানের কোনো ভূমিকা দেখতে চাইত না। কিন্ত ২০১২ সালের শেষ নাগাদ তারা স্বীকার করে নেয় যে পাকিস্তানের ভূমিকা ছাড়া তালেবানের সঙ্গে আলোচনায় সাফল্যলাভের সম্ভাবনা খুব কম, সম্ভবত নেই-ই। ২০১২ সালের নভেম্বরে কারজাইয়ের নিয়োগ করা 'হাই পিস কাউন্সিল' ২০১৫ সালের মধ্যে শান্তির যে রোডম্যাপ তৈরি করেছে তাতেও পাকিস্তানের এ ভূমিকার কথা রয়েছে।

পাঁচটি পর্বে বিভক্ত এ পরিকল্পনায় তালেবানের ক্ষমতায় অংশগ্রহণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে; তারা যেখানে শক্তিশালী সেখানে গভর্নর নিয়োগের ব্যবস্থাও রয়েছে। তবে প্রধান শর্তসমূহ যা ওই দলিলে মূলনীতি বলে বর্ণনা করা হয়েছে, তা হল সব পক্ষকে আফগানিস্তানের বর্তমান সংবিধান মানতে হবে, সংবিধানে নারী ও পুরুষের যেসব অধিকার দেওয়া হয়েছে তা রক্ষা করতে হবে, আল-কায়েদা ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে এবং যাচাইযোগ্যভাবে সন্ত্রাসের পথ পরিত্যাগ করতে হবে।

তালেবানের সঙ্গে আলোচনার জায়গা হিসেবে এ পরিকল্পনায় সৌদি আরবের কথাই উল্লেখ করা হয়। তাতে বলা হয় যে আলোচনায় অংশগ্রহণেচ্ছু তালেবান নেতাদের চলাচলের সুবিধার্থে জাতিসংঘ সন্ত্রাসী তালিকা থেকে তাদের বাদ দেবে। এ পরিকল্পনার প্রতি তালেবানের একাংশের ইতিবাচক মনোভাবের কারণেই ডিসেম্বর মাসে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ তালেবান ও কাবুলের মধ্যে শান্তি আলোচনায় অংশ নিতে তালেবান নেতাদের সফর সহজ করার ব্যবস্থা নেয়।

এর দ্বিতীয় পর্যায়, যার মেয়াদকাল ধরা হয়েছে ২০১৩ সালের প্রথমার্ধ্ব, তাতে রয়েছে যে এ পর্যায়ে তালেবান ও অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর নেতাদের সঙ্গে আফগানিস্তান শান্তি কমিশন বা আফগান সরকারের প্রতিনিধিদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগে পাকিস্তান সহযোগিতা দেবে। এ রোডম্যাপের দ্বিতীয় পর্বে যতটুকু অগ্রসর হওয়ার কথা ছিল আমরা এখন পর্যন্ত ততটাই অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করেছি।

কিন্ত এ সব ঘোষণা এবং এ বিষয়ে সারা পৃথিবীর গণমাধ্যমে আপাতত একধরনের উচ্ছাসের সুর শোনা গেলেও বলা দরকার যে এখনও অনেক প্রশ্নই অমীমাংসিত রয়ে গেছে এবং সামনের দিনগুলোতে আলোচনায় বসার পর এসব বিষয়ে আরও অনেক বাধা-বিঘ্ন তৈরি হবে।

প্রথমেই প্রশ্ন হল যাদের সঙ্গে আলোচনা হবে তার বাইরেও তালেবানের কোনো অংশ থাকবে কিনা। এখন পর্যন্ত যতদূর জানা গেছে তাতে বলা যায় যে তালেবান এবং হাক্কানি নেটওয়ার্ক দুই-ই আলোচনার পক্ষে এবং যারা ঘোষণা দিয়েছে তারা তালেবান নেতা মোল্লা ওমরের সম্মতি নিয়েই আলোচনায় অংশ নিচ্ছে। গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের নেতৃত্বাধীন হেজব-ই-ইসলামি আলোচনায় আসবে কিনা সেটা খুব স্পষ্ট নয়। তবে তারা যে আলোচনা এবং তার সূত্রে ক্ষমতাবণ্টনের বাইরে থাকতে চাইবে এমন মনে হয় না। যে তালেবান নেতাদের কাতারে হস্তান্তরের প্রশ্ন নিয়ে ২০১২ সালের মার্চ মাসে আলোচনা ভেঙে গিয়েছিল, বিনিময়ে যে মার্কিন সৈন্যকে ছাড়ার কথা ছিল- সেগুলো এখনও ঝুলে আছে।

তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র যে সব শর্তকে আলোচনার পূর্বশর্ত বলে জোর দিচ্ছিল তার অন্যতম ছিল আল-কায়েদার সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা। তালেবানের পক্ষ থেকে যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে তাতে এ বিষয়ে নাম ধরে আল-কায়েদার কথা নেই। বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে অন্যান্য দেশের নিরাপত্তায় হুমকি সৃষ্টির জন্য আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। এটি যে যুক্তরাষ্ট্রের কাঙ্ক্ষিত বিবৃতি নয় সেটা বোঝাই যায়। কিন্ত এখন যুক্তরাষ্ট্র বলছে যে আলোচনা শুরুর জন্য এটাই যথেষ্ট– বিষয়টি আলোচনার টেবিলে নিষ্পত্তি হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে দক্ষিণপন্থীরা সমালোচনা করছে এভাবে যে তালেবানের বিবৃতিতে যেহেতু সারা পৃথিবীতেই নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কথা বলেছে তার অর্থ হল তারা তাদের আন্তর্জাতিক আকাঙ্ক্ষার অবসান ঘটায়নি। বিবৃতির যে অংশটি সবচেয়ে বড় সমস্যার সৃষ্টি করেছে তা হল, তালেবানরা আফগানিস্তানকে 'ইসলামি আমিরাত' বলে বর্ণনা করেছে যেভাবে তাদের শাসনামলে আফগানিস্তান রাষ্ট্রের পরিচয় ছিল।

এ নিয়ে ইতোমধ্যেই একটা ঝড় উঠেছে। আফগান সরকার এতে ঘোরতর আপত্তি করেছে এবং শান্তি কাউন্সিলের একজন সদস্য গণমাধ্যমকে বলেছেন যে এভাবে তালেবানরা ইতোমধ্যেই তাদের সঙ্গে করা অলিখিত চুক্তি ভঙ্গ করেছে। তিনি বলেন, ''কথা ছিল অফিস খোলা হবে কেবল আলোচনার জন্য, মোটেই রাজনৈতিক অস্তিত্বের জানান দেওয়ার জন্য নয়। দেশের বাইরে আফগানিস্তানকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য দেশের দূতাবাস রয়েছে।''

কাতার সরকারও এ বিষয়ে তাদের আপত্তির বিষয়টি প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে যে এ অফিসের নাম হওয়ার কথা ছিল– 'পলিটিক্যাল ব্যুরো অব দ্য তালেবান আফগান ইন দোহা'।

যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের সমঝোতা এবং সরাসরি আলোচনার ঘোষণা দেওয়ার পর আফগান সরকার তার প্রথম প্রতিক্রিয়ায় কাতারে তাদের প্রতিনিধি পাঠানোর কথা বললেও ২৪ ঘণ্টা না পেরুতেই তাদের সুর বদলাতে শুরু করেছে। যেভাবে এ ঘোষণা দেওয়া হয়েছে তাতে হামিদ কারজাই অখুশি। আফগানিস্তানকে 'ইসলামি আমিরাত' বলে বর্ণনা করাকে আফগান সরকার যুক্তিগ্রাহ্য কারণেই আপত্তিকর মনে করছে। তদুপরি কারজাই বলেছেন যে যুক্তরাষ্ট্র আলোচনা থেকে সরে না গেলে তিনি তার প্রতিনিধি পাঠাবেন না এবং এখন তালেবানের আক্রমণ বন্ধ করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণার এ সময় এবং পরে জোর দিয়ে বলেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র আলোচনায় সাহায্যকারী মাত্র, প্রক্রিয়াটিকে অবশ্যই হতে হবে আফগান-নেতৃত্বাধীন।

কিন্ত আমরা জানি যে যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে এ আলোচনা হবে না, তালেবান নেতৃবৃন্দ তাতে অংশও নেবেন না। এসব থেকে যে কোনো ব্যক্তিই বুঝতে পারেন যে যুক্তরাষ্ট্র এবং আফগানিস্তানের তালেবানদের মধ্যে সরাসরি আলোচনার যে প্রক্রিয়া শুরু হতে যাচ্ছে তা মোটেই শঙ্কামুক্ত নয়, তাতে সাফল্যও নিশ্চিত নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল হাতে সময় খুব কম– ২০১৪ সালের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র তার সৈন্য তুলে নেবে আর সে বছরেই অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর ক্ষমতায় নতুন মুখের আগমন হবে।

ফলে যুক্তরাষ্ট্রকে আগামী দিনগুলোতে দ্রুততার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।

ইলিনয়, ১৯ জুন ২০১৩

আলী রীয়াজ : যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক।